ভয়
কেমন করে অন্যরকম হওয়া যায়?
কেমন করে অন্যরকম হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানো যায়?
যৌনতা আবার অন্যরকম কিসের? আমি বুঝতে পারিনি কোনদিন-ই। আর পাঁচজন মেয়ের মতই বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়েছি, ঘর বাঁধতে চেয়েছি প্রত্যেকের সাথেই, কারোর সঙ্গে পেরেছি, বাকিদের সঙ্গে পারিনি। যৌনতা আবিষ্কার হয়ে যখন এসেছে আমার কাছে, পুরুষের সঙ্গে আর নারীর সঙ্গে এরকম ভাগ নিয়ে আসেনি কখনো। প্রত্যেকের সঙ্গেই এক নতুন আবিষ্কার হয়ে এসেছে।
তাই যখন লোকে যৌন অবস্থানকে লড়াই করে তোলে প্রথমে এক পা পিছিয়ে যাই আমি।
আবার এক পা এগিয়ে আসি।
আমি বিবাহিত। কিন্তু সে বিয়ের ওপর আইনের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ আজও পড়েনি। আমার সমস্ত জরুরি ডকুমেন্ট, আমার ফেসবুক প্রোফাইল, সব জায়গায় বড় বড় শাণিত অক্ষরে লেখা "সিঙ্গল" । আমার গয়নার বাক্সে নেই রুপোর সিঁদুর কৌটো কিংবা শাঁখা বাঁধানো। আত্মীয় পরিজনের বিয়েতে যখন এয়োরা ডালা তোলেন, বরণ করেন, তখন আমি দুরে দাঁড়িয়ে দেখি। এমন নয় যে এই সংস্কারগুলির ওপরে আমার খুব বিশ্বাস, কিন্তু খুব লোভ হয় ওই দলে ভিড়ে যেতে, একটিবার ওই আনন্দের স্বাদ নিয়ে দেখতে। কিন্তু না, ভরসা পাইনা। আমার জীবনসঙ্গীকে সর্বসমক্ষে স্বীকারের ভরসা আমার নেই। সে আর আমি, আমরা দুজনেই যে একইরকম শরীর নিয়ে জন্মেছি। সেই সহজন্মের তাপ সারাক্ষণ আমাদের গায়ে লেগে থাকে। ভালবাসার ওমের মধ্যে হঠাত হঠাত সেই আগুনের ছ্যাঁকা খেয়ে শিউরে উঠি আমরা। আইনের বই ঘেঁটে জানতে হয় ঠিক কি কি করণীয় আমাদের, আর কি নয়, কখনো কোর্ট চোখ পাকিয়ে বলে দেয় কি ভাবে শোব, আর ঠিক কতটা ছোঁব, তো কখনো আমাদের আহত দৃষ্টির সামনে রাজনৈতিক কর্মী জানান, এ তো কোনো ইস্যু নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় চিন্তাশীল মাথারা বলেন; খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান নিয়ে যে দেশে এত টানাটানি, সেখানে যৌনতার অধিকার নিয়ে এত উত্তেজনা বাড়াবাড়ি। কখন আমার গায়ে অপরাধীর ছাপ লেগে যায়, এই ভেবে ভয় পাই আমি। চতুর্দিকে ঘিরে থাকে ভয়ের কুয়াশা, না যায় তার মধ্যে লুকোনো, না যায় বেরিয়ে আসা।
জিজ্ঞাসা
লোকে বলে, প্রকৃতির পরিপন্থী আমার ব্যবহার। আমি ভেবে ভেবে কূল পাইনা। আচ্ছা,, কি আলাদা আমার মধ্যে? আমি পুরুষকে ভালোবেসেছি, ভালোবেসেছি নারীকেও। কই, তেমন কোনো তফাত তো পাই নি আমার অনুভবে, শরীরের গঠন ছাড়া, দু পায়ের মধ্যে স্পর্শের বিভিন্নতা ছাড়া! সে কি এমন নির্ণায়ক ব্যাপার? দুজনকেই এক-ই ভাবে জড়িয়ে ধরেছি, দুজনের আদরে এক-ই ভাবে পরিতৃপ্ত হয়েছি। শরীর ছাপিয়ে যে আদর উথলে পড়েছে, মনে, সংসারে, রোজকার জীবনযাপনের খুঁটিনাটিতে, তাকে দু হাত ভরে নিতে কোথাও কোনো তফাত খুঁজে পাইনি কখনো। কিভাবে তা অন্যায় হয়?
আমি থাকি বাংলায় কর্মসূত্রে, আমার জীবনসঙ্গী থাকেন অন্য দেশে। যে কোনো দিন সেখানে যাওয়ার জন্য আমিও পা বাড়িয়েই আছি। দূরবর্তী এই সম্পর্কের মধ্যে সহস্র আইনি জটিলতা, হৃদয়ের জটিলতা না থাকলেও। দুজনেই জানি, বিদেশ আমাদের শেষ গন্তব্য আপন সংসারটি পাততে গেলে। তবু মন কেন এখানেই নোঙ্গর ফেলতে চায়, এই কলকাতায়? কেন এখানে নয়? এই শহর, যা একদা আমাদের দুজনেরই ছিল, আমাদের "প্রথম সবকিছু" যার ফাইল ক্যাবিনেটে সযত্নে রাখা আছে, সে কেবলি ফিরে আসার লোভ দেখায় যে। গত কয়েক বছরে শহরের গায়ে লাগা রামধনু রং আমাদের-ও চোখে লেগেছিল বৈকি। তারপর ঝাপটা আসে। স্বভূমে পরবাসী আমি সেদিন কাজে যাবার পথে স্মার্টফোনের পাতায় খবর দেখতে গিয়ে সেই ঝাপটা খাই। ৩৭৭ ফিরে আসার খবর। মোবাইলে মেসেজ ভেসে আসে। আর ওলট পালট হতে থাকে আমার ভিতর। বাসভূমি থেকেও কি চিরকাল তবে স্বদেশহারা থেকে যাব আমরা? কখনো এ দেশে, শৈশবের মাঠে, কৈশোরের শুঁড়িপথে হাত ধরে হাঁটা হবে না আমাদের, ঠোঁটে ঠোঁট রাখা হবে না বৃষ্টির বোলপুরে, অকারণে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে? সন্তান, স্বাগতম, শুভেচ্ছা কিছুই পাব না?
আমরা একটিভিস্ট নই, রাজনীতিক নই, নিতান্ত সাধারণ মানুষ। মুখচোরা, পড়ুয়া, হাসিখুশি, চোখে চশমা, ঠিক আর পাঁচজনের মত মানুষ। আমরা ভয় পাই। ক্লান্ত, অন্তহীন লড়াইএর ভয়, অহেতুক আক্রমণের ভয়, ঘৃণার ভয়, কৌতুহলের ভয়, জীবিকা হারানোর ভয়। আর অপমানিত হই। যখন সর্বশক্তিমান ধর্মগুরু বলেন আমাদের সারিয়ে দেবেন যে কোনো দিন। যখন কাগজের পাতা থেকে টিভির পর্দায় আমাদের যৌনজীবনের ঠিক কতটা "এগেইনস্ট দ্য নেচার" এই নিয়ে ডিবেট চলে। যখন ধরেই নেওয়া হয়, আমাদের প্রেম প্রেম নয়, দুটি যৌনাঙ্গের বিকৃত সহাবস্থান মাত্র। একে অন্যকে আঁকড়ে এই ভয় বুকে নিয়ে আমরা ঘুমোই, আর সারাদিন আমার চোখ জ্বালা করে। সারাদিন।
চ্যালেঞ্জ
চারপাশের মানুষজনের দিকে হাত বাড়াই আমি, কঠিন শব্দ ছুঁড়ে দিই। তাদের মাপি। এই মাপটা খুব দরকার হয় আমার। বুঝতে, কোথায় নিরাপদ আমি, আর কোথায় নই। বুঝতে পারা যায়, কতটা কম জানেন মানুষ, শুধু দাগ কাটা অন্য বর্গের সম্পর্কেই নয়, নিজের সম্পর্কেও। যে কোনো মানুষ, যাঁরা নিজেদের স্ট্রেট বলে দাবি করেন তাঁদের বলতে ইচ্ছে করে এই স্পেকট্রাম আসলে একটা দোলনার মত, একটা আর্ক-এর মত। কেউ কেউ হয়ত সেই আর্কের দুপ্রান্তে রয়েছেন এখন, কিন্তু হঠাত দোলনা দোল খেয়ে নেমে আসতে পারে কোথাও, আর সারা জীবন ধরে নিজেকে স্ট্রেট মনে করা মানুষটি হয়ত আছড়ে পড়তে পারেন সেই কঠিন, শক্ত মেঝেতে, যখন তাঁর আইডেন্টিটি দোলাচলে।যদি বলো আমার যৌনতার আবিষ্কার, তা এমনি করেই হয়েছিল তো। কিন্তু যৌনতা ধীরে ধীরে ভালোবাসাকে ছাপিয়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। নিজের কথা বলবার জোর। আমার খিদে পেলে চুরি না করে পাওয়া অন্নের অধিকার আমার আছে, এমন-ই সহজ হওয়া উচিত ছিল না কি এই হিসেব? শুধু ভারতকে কি করে দোষ দেব? সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে যেখানে উপছে পড়ছে বিবাহের ছবি, চুম্বনের ছবি, সেখানে ২০১৩র ২৯শে ডিসেম্বর দুই পুরুষের চুম্বনের ছবি পোস্ট করার জন্য একটি গে রাইটস গ্রুপের ১০৬ জন এডমিনকে ফেসবুক বের করে দিয়েছে তাদের ভার্চুয়াল অস্তিত্ব থেকে। তাদের মোবাইল থেকে, কম্পিউটার থেকে ফেসবুক লুপ্ত। সিঙ্গাপুরে আজ-ও পুরুষ সমযৌনতা আলাদা আইন করে অপরাধ বলে ঘোষিত। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলির কথা তো ছেড়েই দিলাম। রাশিয়া, যেখান থেকে সন্তান, পরিবার নিয়ে সুখী দম্পতিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
আমাদের নিরাপত্তা-ও যদি এইরকম একটা আর্ক হয়, তাহলে কতক্ষণ আর তার উচ্চতম বিন্দুতে আটকে থাকা যায়? আগুনে পা ফেলতেই হয়।
দীর্ঘদিন ছুঁই না আমরা একে অন্যকে। দীর্ঘদিন খেতে বসি না একসাথে, সকলের পাওনা মিটিয়ে হয়ত বছরে একবার একে অন্যকে দেখতে পাই, সারাক্ষণ পায়ের নিচে জমি খোঁজার লড়াই ঘিরে থাকে আমাদের। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতে হয়, এভাবেই আমরা নিই তা । হয়ত আমাদের সন্তানেরা আর পিছন দিকে হাঁটবে না। তারা ভয়ও পাবে না আলোর দিকে হেঁটে যেতে।কিংবা রামধনুর দিকে। ইকোয়ালিটির দিকে।
আইন, শরীর, ছুরি কাঁচি
এক ছাতার তলায় অনেক মানুষের সমাহার। কেউ নিজের শরীর নিয়ে সন্তুষ্ট, কেউ নন। কেউ বদলে যেতে চান, কেউ নিজের চামড়ায় স্বচ্ছন্দ। এল জি বি টি লড়াই মানেই কি শুধু যৌনতার অধিকারের লড়াই ? না। নিজের মত করে বাঁচবার লড়াই । আমার শরীর, আমার চিন্তা, আমার বেঁচে থাকার ধরন যে আমারই, তার ওপর আর কারোর হাত নেই, না ধর্মের, না রাষ্ট্রের , না রাজনীতির, কারণ শেষ অবধি মানুষের জন্যই এই সব কিছু। আমার চাওয়ার উপরে কি করে তার স্থান হতে পারে?
আমাদের দুজনের লড়াই শুধু ভালবাসার অধিকারের, আইনের। আরো হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন যাদের লড়াই আরো জটিল, যাদের লড়াই আইনের সাথেই শুধু নয় নিজের শরীরের সাথে। লিঙ্গবোধ আর যৌনতা এক সূত্রে না-ও গাঁথা থাকতে পারে। যেমন জুলিয়া। জুলিয়া আমাদের বান্ধবী, যার চাওয়ার গল্প এমন সোজা নয়। সে জন্মেছে নারীদেহ নিয়ে, যে শরীর নিয়ে সে খুশি নয়, সে চায় পুরুষ শরীর। এর পরেও, পুরুষ শরীর নিয়েও সে কিন্তু পুরুষের সঙ্গেই জোড় বাঁধতে চায়। সহজেই বোঝা যায়, কতটা স্পর্শকাতর সে নিজের অবস্থান নিয়ে। কিন্তু আমার কি অধিকার আছে তাকে প্রশ্ন করার, কেন নারী শরীর নিয়ে পুরুষের সঙ্গে জোড় বাঁধার সোজা রাস্তাটি সে বেছে নেবে না?
না, নেই। কারোরই অধিকার নেই বলে দেওয়ার কোন রাস্তায় আমরা হাঁটবো। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব মানুষের হাঁটার পথ সুরক্ষিত করে দেওয়া। এমন অনেক জুলিয়া, অনেক সুনন্দার গল্প ছড়িয়ে আছে ইতিউতি, যা শুধু গল্প, আত্মজিজ্ঞাসা, এখনও। সেই ভালনারেবিলিটিকে ছাতার আড়াল দেওয়ার জন্যই না আইন!
সেফ পারসন, সেফ প্লেস
লড়াই কি শুধু আমাদের? যাঁরা সরাসরি দাঁড়িয়ে আগুনের আঁচ নিচ্ছেন, যাঁদের যৌনতা প্রশ্নচিহ্নের নিচে, যাদের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে স্ক্রুটিনি করতে পারে যে কেউ ? না। লড়াই তো সকলের হওয়া উচিত, তাই না? কিছু বিশেষ কর্মস্থানে দেখেছি অনেকেই বেছে নিতেন দরজায় লাগানোর জন্য একটি কার্ড , যার মধ্যে আঁকা প্রতীকগুলি জানিয়ে দিত "আই এম আ সেফ পার্সন টু টক।" কাদের জন্য? রাজনৈতিকভাবে আক্রান্ত মানুষদের জন্য, দুর্বল যৌন পরিচয়ের মানুষদের জন্য, ভিক্ষুক থেকে শুরু করে নেশাগ্রস্তদের জন্য। সে দেখে মনে হয়, কি হয়, যদি গোটা পৃথিবীটা এরকম হয়? অন্তত এক একটা দেশ? আঙ্গুল তোলার বদলে যেখানে নোটিশ ঝোলানো থাকবে, আমরা তোমাদের সঙ্গে। আর তার কারণ যেন এই না হয়, যে আমরা সংখ্যালঘু মানুষ। তার কারণ হোক পরিষ্কার করে বোঝা, যে আজ কারোর শোয়ার অধিকার কেড়ে নিলে কাল হাত পড়তে পারে অন্যের কোনো অধিকারে। লড়াই শুধু যৌনতার নয়, সাম্যের, মুঠির মধ্যে নিজের জীবনের রাশ আঁকড়ে রাখার। রাস্তা শুধু আমাদের দুজনের , আমাদের মত মানুষদের নয়, আমাদের সকলের। সারা পৃথিবীটাই সেফ প্লেস হলে ক্ষতি কি? যেখানে কার্ড ঝোলানোর দরকার আর থাকবে না? খুব কি ক্ষতি হবে কারো?
(অংশত পূর্বপ্রকাশিত )
লেখাটি গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশিত 'আমার যৌনতা' সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত।