দারিদ্র্য বা গরীবি আমাদের দেশে মাপা হয় ব্যয়ক্ষমতা দিয়ে। কত টাকা খরচ করলে ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো মেটানো যায় প্রথমে তার একটা হিসেব করা হয়। তারপর সমীক্ষা করে দেখা হয় ক’জন সেই পরিমাণের বা তার বেশি টাকা খরচ করতে সক্ষম। যারা পারেন না তারা দরিদ্র। দরিদ্রেরা দেশের জনসংখ্যার কত শতাংশ তার হিসেব করলে গোটা দেশের গরীবির ধারণা পাওয়া যায়। এই সংখ্যাকে বলে হেড কাউন্ট রেশিও (HCR)।
গত দু’দশকে ভারতের HCR দ্রুত কমে এসেছে। আর্থিক সংস্কার (মানে ১৯৯১-এর পর থেকে নয়াউদারনীতির প্রয়োগ) যে সফল হয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে প্রায়শ এই HCR কমে আসার কথা বলা হয়। কী রকম কমেছে একটা ধারণা করে নেওয়া যাক। শহর অঞ্চলগুলোতে HCR কমেছে ৩২% (১৯৯৩-৯৪) থেকে ২১%-এ (২০০৯-১০)। গ্রামীণ এলাকায় কমেছে আরো দ্রুত হারেঃ ৫০% থেকে ৩৪%, একই সময়সীমায়। প্ল্যানিং কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯-১০-এর পরের দু’বছরে সারা দেশের HCR আরো ৮% কমেছে। ফলে ২০১১-১২-তে দারিদ্র্যের হার ২২%-এ নেমে এসেছে। সরকারি নীতি যারা ঠিক করেন তাঁরা, এবং তাঁদের সেনাপতি কাগজ-টিভিওয়ালারা, গরীবির ওপর জোরদার ধাক্কা নিয়ে প্রভূত আপ্লুত। অর্থাৎ, খুব তো শাইনিং ইন্ডিয়া শাইনিং ইন্ডিয়া করে গালমন্দ দিলে। এই দেখ প্রমাণ, আর্থিক সংস্কার সত্যি সত্যি ভাল কাজ করছে। না না, জনপ্রতি আয়-ফায় বাড়ার কথা বলছি না। সে তো মুকেশদা, রতনকাকুরা বেশি কামালে দেশের জনপ্রতি আয় বেড়ে যাবে, তাতে রামা কৈবর্তের কী এল গেল। ওসব ছেঁদো তর্ক থাক। সংস্কারের সুফল এক্কেবার নিচুতলায় পৌঁছোচ্ছে, বুঝেছ?
গরীবি কমা নিয়ে এই তক্কো কিন্তু আরেক প্রস্থ তথ্যের সামনে পড়ে কিঞ্চিৎ সমস্যায় পড়ে। এই তথ্য হ’ল ভারতের অপুষ্টি ও খিদে সংক্রান্ত (আমরা এই প্রবন্ধে ক্যালরির অপ্রতুলতা = অপুষ্টি ধরে এগোচ্ছি)। সচরাচর আমাদের দেশে শহর ও গ্রামে ন্যূনতম ক্যালরির প্রয়োজন ধরা হয় জনপ্রতি ২১০০ ও ২৪০০, যথাক্রমে। সংখ্যাগুলোকে পুষ্টি ও অপুষ্টির বিভাজিকা রেখা ধরে নিলে নিচের উদ্বেগজনক ছবি ফুটে ওঠে। ১৯৯৩-৯৪ সালে শহরাঞ্চলে ৫৮% লোক অপুষ্টিতে ভুগতেন। ২০০৯-১০ সালে সংখ্যাটা ৭০%-এ গিয়ে পৌঁছোয়। গ্রামের অবস্থা আরো আশঙ্কাজনক। ১৯৯৩-৯৪ সালেই ৭১% লোক অপুষ্টিতে ভুগতেন। ২০০৯-১০ সালে বেড়ে হয় ৯০%।
তথ্যগুলো নিঃসন্দেহে ধাঁধার মত। এক আর দুই নম্বর ছবিতে সময়ের সাথে সাথে গরীবি আর অপুষ্টির হার কীভাবে বদলেছে তার গ্রাফ দেওয়া হয়েছে। সময়সীমা ১৯৮৩ থেকে ২০০৯-১০। প্রথমেই যা অবাক করে তা হল গরীবি আর অপুষ্টি একেবারে উল্টোদিকে দৌড় দিয়েছে। প্রথমটা কমেছে, কিন্তু দ্বিতীয়টা বেড়েছে। এই বিপরীতগতি বা ডাইভার্জেন্স বেশি দেখা গেছে আর্থিক সংস্কারের সময়ে। মজার ব্যাপার হল বিষয়টি নিয়ে মিডিয়াতে বিশেষ উচ্চবাচ্য শোনা যায় নি। অথচ এই বিপরীতগতি কোনো নতুন আবিষ্কার নয়। যে অর্থনীতিবিদরা এর ওপর লেখালিখি করেছেন তার মধ্যে জয়া মেহতা (২০০৪), রঞ্জন রায় (২০০৫), উৎসা পট্টনায়েক (২০০৭), সুব্রামানিয়ান (২০১৩) অন্যতম। কেন বিপরীতগতি প্রশ্নে ঢোকার আগে কী পাওয়া গেল একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাকঃ তথ্য বলছে ভারতে ব্যয়ভিত্তিক গরীবি কমেছে, অথচ ক্যালরির নিরিখে মাপা অপুষ্টি বেড়েছে।
ছবি একঃ ভারতের গ্রামাঞ্চলে গরীবি ও অপুষ্টি, ১৯৮৩ থেকে ২০০৯-১০। (সূত্রঃ Deaton and Drèze, 2009; GOI, 2009, এবং প্ল্যানিং কমিশনের ওয়েবসাইটঃ http://planningcommission.nic.in/news/press_pov1903.pdf)
ছবি দুইঃ ভারতের শহরাঞ্চলে গরীবি ও অপুষ্টি, ১৯৮৩ থেকে ২০০৯-১০। (সূত্রঃ Deaton and Drèze, 2009; GOI, 2009, এবং প্ল্যানিং কমিশনের ওয়েবসাইটঃ http://planningcommission.nic.in/news/press_pov1903.pdf)
স্বেচ্ছা না শোষণ?
গরীবি ও অপুষ্টির বিপরীতগতি প্ল্যানিং কমিশনের গরীবি মাপার পদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমরা এই প্রবন্ধে সে আলোচনাতে যাচ্ছি না। বরং গরীবি ও অপুষ্টির উল্টোদিকে যাত্রার রহস্য নিয়ে কয়েকটা কথা বলা যাক। ব্যয়ভিত্তিক গরীবি কমেছে। এর মানে লোকের হাতে বেশি ক্রয়ক্ষমতা এসেছে। গড়পরতা খরচ বেশি হচ্ছে। এটা ঠিক যে সময়ের সাথে সাথে জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। তবে দাম বাড়া ধরে নিয়েই হিসেবগুলো করা হয়েছে। অর্থাৎ তথ্য বলছে লোকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য বেশি টাকা খরচ করছে তো বটেই, কিন্তু তার ওপরও বেশি খরচ করছে।
কিন্তু, গড়পরতা খরচ বাড়লেও ক্যালরি গ্রহণ কমেছে। লোকে বেশি খরচ করছে তবে পুষ্টিকর খাবারে খরচ করছে না। তাই খিদে হয়তো বেড়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ নরেনভাইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী মেয়েরা নাকি দেহসৌষ্ঠবের জন্য ডায়েটিং করে ভুখা থাকছে। সেসব থাক। আপাতত, আমরা এই রহস্যের নাম দিচ্ছি ক্যালরি হেঁয়ালি। এর একটা পোষাকি ইংরিজি নাম আছে, ক্যালরি কনসাম্পসন পাজ়ল।
ক্যালরি হেঁয়ালিকে বোঝার জন্য দুটো আলাদা বিষয়কে শনাক্ত করে নেওয়া যাক। এক, লোকে কি কম খাবার খাচ্ছে যদিও তারা বেশি খেতে আর্থিকভাবে সক্ষম? দুই, লোকে কি কম পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে যদিও তারা বেশি পুষ্টিকর খাবার খেতে সক্ষম? লক্ষ্য করুন প্রশ্নদুটো একধরনের মনে হলেও আসলে আলাদা। এরকম হতে পারে একজন লোক বেশি খাবার খাচ্ছে, কিন্তু পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নের উত্তর না হবে, কিন্তু দ্বিতীয়টার উত্তর হ্যাঁ হবে।
এ্যাঙ্গাস ডিটন ও জঁ দ্রেজ়ের মত গবেষকরা প্রথম প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। ওনাদের মতে, লোকে কম ক্যালরি খাচ্ছে কেননা ক্যালরির প্রয়োজন কমে আসছে (Deaton and Drèze, 2009)। ক্যালরির প্রয়োজন কেন কমেছে? এক, পেশার বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কৃষির মত খাটাখাটনির পেশার থেকে অন্য পেশায় লোকে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কৃষিতে কায়িক শ্রমের বদলে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তিন, এপিডেমোলজিকাল এনভায়রনমের্ন্ট, মানে রোগভোগের বাতাবরণে উন্নতি ঘটেছে। লোকে কম ভুগছে, ফলে কম ক্যালরি দরকার হচ্ছে। চার, ফার্টিলিটি কমছে, মহিলাদের কম বাচ্চা মানুষ করতে হচ্ছে। ঘরোয়া কাজকম্মে যন্ত্র চলে আসছে (ধরুন ওয়াশিং মেশিন)। এগুলোও ক্যালরির প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছে। মোটমাট, লোকে স্বেচ্ছায় কম খাবার খাচ্ছে তাই জনপ্রতি কম ক্যালরি খাওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্থার ডুফলোর মত অর্থনীতিবিদরা বলছেন লোকে দামি ও মুখরোচক খাবার কিনছে। বিস্বাদ কিন্তু পুষ্টিকর খাদ্য কিনছে না। পুওর ইকনমিকস নামে বইয়ে ওনারা লিখছেন, “অত্যন্ত গরীব মানুষ যখন খাবারের পেছনে একটু বেশি খরচ করার সুযোগ পায়, সে আরো বেশি ক্যালরি পাওয়ার জন্য পুরো টাকাটা খরচ করে না। বরং আরেকটু ভাল খাবার জন্য, বেশি দামি ক্যালরির পেছনে খরচ করে” (Banerjee and Duflo, 2011, pp. 23)। ৪ জানুয়ারি ২০১২-এর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে অভিজিৎবাবু একই ধরনের কথা বলেছেন (Banerjee, 2012)।
আমরা এই দুই ধরনের জবাব নিয়ে ঈষৎ সন্দিহান। সচরাচর কোনো দেশে বেশি আয় আসার সাথে পেশার বিন্যাসে পরিবর্তন আসে। কৃষি থেকে বড় পরিমাণ লোক শিল্প বা পরিষেবাতে চলে যায়। সাথে সাথে রোগভোগের বাতাবরণের উন্নতি ঘটে, ফলে কলেরাজাতীয় আন্ত্রিক রোগের প্রকোপ কমে আসে। মহিলাপিছু সন্তানের সংখ্যা কমে, ঘরকন্নার কাজের যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ে। কিন্তু এইসবের সাথে সাথে ক্যালরিগ্রহণের হার কমে না। বরঞ্চ বাড়ে। ভারতে যদি উলটো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, এখানে ব্যতিক্রমী কিছু একটা ঘটছে। স্বেচ্ছায় কম ক্যালরি খাওয়ার দ্রেজ়দের ব্যাখ্যাকে আরো যত্নের সাথে পরীক্ষা করা উচিত এইটুকু অন্তত বলা যায়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দীপঙ্কর তার সহগবেষক অমিত বাসোলের সাথে এই পরীক্ষাটা করেছে (Basu and Basole, 2012)। এই গবেষণা ক্যালরি হেঁয়ালির বিকল্প ব্যাখ্যা দিচ্ছে। বলছে, কম ক্যালরি গ্রহণের মূলে রয়েছে অর্থনীতির কাঠামোগত কারণ। স্বেচ্ছায় না, গরীব কম ক্যালরির খাবার খাচ্ছে কারণ সে খেতে বাধ্য হচ্ছে। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় অ-খাদ্যের (মানে যা খাদ্য নয় ) ওপর খরচ করতে হচ্ছে। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, জ্বালানী, বিদ্যুৎ। ফলে খাদ্যের পেছনে খরচ করার টাকা থাকছে না। গত তিন দশকের তথ্য থেকে দেখতে পাচ্ছি লোকে ওপরে উল্লেখিত জিনিসপত্রের পেছনে আয়ের ক্রমবর্ধমান অংশ খরচ করছে। খরচ এতটাই বেড়েছে যে, আয়ের যা বৃদ্ধি হয়েছিল গোটাটা এদের পেছনে চলে গেছে। এই ঘটনার নাম দেওয়া যায় ‘খাওয়া খরচে চাপ’ (‘food budget squeeze’), যার ফলে খাদ্যের পেছনে খরচ গত দু’দশকে মোটামুটি স্থির, অনড় হয়ে গেছে। খাওয়া খরচে চাপের পেছনের কারণগুলো কী? নিচে কয়েকটার আলোচনা করে নেব। লক্ষ্য করবেন কিছু কারণ শুধু চাপের পেছনে নেই, চাপ বাড়িয়েওছে।
প্রথমত, মার্ক্সকথিত পুঁজির প্রাথমিক সঞ্চয়ের (primitive accumulation of capital) প্রক্রিয়া এই দেশে চলছে। চাষির হাত থেকে জমি কিনে নেওয়া হচ্ছে বা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। উচ্ছিন্ন করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বন, পুকুর, চারণভূমি, নদীর মত সবার জন্য ব্যবহারের প্রাকৃতিক সম্পদকে (common property resources) ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিবর্তিত করে ফেলা হচ্ছে। লোকের ভূমিহীনতা যত বাড়ছে খাদ্যের ওপর অধিকার কমছে। আবার সাধারণ সম্পদের ব্যক্তিগতকরণের ফলেও কিন্তু গরীবের পক্ষে খাদ্য আহরণ করা কঠিণ হয়ে উঠছে। এমন খাদ্য যা বাজারের পরিধির বাইরে থেকেই পাওয়া যেত, মুদ্রামূল্যে কিনতে হত না, হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
দুই, পেশার বিন্যাসে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। গ্রামের থেকে শহরে বা অন্য গ্রামের দিকে শ্রমিকের স্রোত বেড়েছে। কাজের খোঁজে এই প্রব্রজন প্রায়শই হয় কয়েক মাসের জন্য, সাময়িক। লম্বা লম্বা দূরত্ব শ্রমিকদের পার হতে হচ্ছে। দেশজুড়ে দিনমজুরদের ঘূর্ণিপাক তাদের খরচের ওপর প্রভাব ফেলে। যত বেশি দিনমজুর এই মিছিলে যোগ দিচ্ছে, পরিবহণের পেছনে খরচ বেশি হচ্ছে। ঠিক কখন যেতে হবে ক’জন লাগবে এরকম গুরুত্বপূর্ণ খবর জানার জন্য মোবাইল ফোনে কাজের জায়গার সাথে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। আবার, যখন কাজের জন্য ঘুরে বেরাচ্ছে, নিজের গ্রামের অ-বাজারীয় খাদ্যের উৎস পাচ্ছে না।
তিন, সামাজিক খাতে সরকারি খরচ কমে আসছে। ফলে গ্রামে বা শহরের গরীবদের বহু অতি-প্রয়োজনীয় পরিষেবার জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বাজারে দাম সাধারণত বেশি। আশির দশকের মাঝ থেকে আর্থিক সংস্কার শুরু হয়েছিল, নব্বুই দশকের প্রথম থেকে তার জোর বাড়ে। সংস্কারের সমর্থকেরা অনেক সময় স্বীকার করেন না যে সংস্কারের পর অতি-প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর তুলনামূলক দাম কমে নি। উদাহরণ হিসেবে চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহণ নিতে পারি। ১৯৮৩ থেকে ২০১০-এর তথ্য বলছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম এই পরিষেবাগুলোর তুলনায় খানিকটা কমেছে – পরিষেবাগুলো বেশি দামি হয়ে পড়ছে (কৃষিশ্রমিকের ক্রেতামূল্য সূচক বা CPIAL, consumer price index of agricultural labourers ব্যবহার করা হচ্ছে)। গরীবকে অতি-প্রয়োজনীয় বস্তু বা পরিষেবা বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, যার ফলে খাবার খরচে চাপ পড়ছে।
চার, টিভি, রেডিও, খবরের কাগজে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের প্রভাবকে খাটো করে দেখা উচিত নয়। বিত্তবানের বিলাসবহুল জীবনযাপনের ছবি মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। আগে সহজলভ্য ছিল না এরকম খাদ্যসামগ্রী বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ফলত, গরীবের খাদ্যে বৈচিত্র্য এসেছে। শস্তা ক্যালরির (শস্য) তুলনায় দামি ক্যালরি কেনা হচ্ছে (মাংস, ডিম, দুধ, মাছ)।
সংক্ষেপে, কম ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণ বহুবিধ। খাবার খরচের ওপর চাপ পড়েছে, বাজার-বহির্ভূত খাদ্যের উৎস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, খাবারে বৈচিত্র্য আসছে। এই কারণগুলোর মধ্যে প্রথমটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, অভিজিৎ ব্যানার্জী ও এস্থার ডুফলো যা বলেছেন তা সত্যি, দামি কিন্তু কম ক্যালরির খাবারে খরচ বাড়ছে। কিন্তু ক্যালরি হেঁয়ালি সমাধানে ওনাদের ব্যাখ্যা ‘খাবার খরচে চাপ’ (food budget squeeze) ব্যাখ্যার তুলনায় কমজোরি। দীপঙ্কর ও অমিতের প্রবন্ধ (Basole and Basu, 2012) বলছে খাবারে বৈচিত্র্যের প্রভাব কখনোই সংখ্যাতাত্বিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ (statistically significant) নয়। অন্যদিকে খাবার খরচ কমে যাওয়ার প্রভাব যে গুরুত্বপূর্ণ এটা সব ধরনের মডেল স্পেসিফিশনেই পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ গত দুই দশকে আয় ও ব্যয় বেড়েছে সত্যি; কিন্তু সেই বৃদ্ধি একসাথে পুষ্টিকর খাবারের খরচ এবং অন্যান্য অতি-প্রয়োজনীয় পরিষেবা কেনার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
শেষ করার আগে খাদ্য বৈচিত্র্য নিয়ে দু’খান কথা হয়ে যাক। ধরে নিলাম, অভিজিৎবাবুরা যা বলছেন সত্যি। গরীব মানুষ পুষ্টিকর স্বাদহীন খাবার বাদ দিয়ে মুখরোচক কম পুষ্টির খাবার কিনছে। যদি তাই হয়, ঠিকঠাক সরকারি নীতি কী হওয়া উচিত? বিভিন্ন দেশের উন্নয়নের অভিজ্ঞতা বলে লোকে প্রায়শ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। হয়তো তাদের কাছে ঠিক খবর নেই, তারা জানে না কোন খাবারে কী গুণ। বা, অনেক সময় দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা করার ক্ষমতাও থাকে না। এসব ক্ষেত্রে সঠিক দিকে খানিকটা ঠেলে দিলে কিন্তু সুফল পাওয়া যেতে পারে। পুষ্টিকর খাদ্য মুখরোচক খাবারের থেকে কম দামে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা যায়। এই দুই খাবারের মধ্যে দামের পার্থক্য রাখা দরকার। ফারাক থাকলে গরীব লোক কমদামি পুষ্টিকর খাবারের দিকে ঝুঁকবে। অর্থাৎ দাম কম রেখে সরকার লোককে ইনসেন্টিভ দিচ্ছে, একটু ঠেলে দিচ্ছে, যাতে তারা পুষ্টিকর খাবার খায়। এই ব্যবস্থাকে কাজ করাতে গেলে সবল ও সার্বজনীন (universal) গণবন্টন ব্যবস্থা চাই। হালে কেন্দ্র সরকার খাদ্য সুরক্ষা আইন পাস করল, খুব হইচই শোনা গেল। আইনে গণবন্টনকে কিন্তু সার্বজনীন করা হয় নি। ভোটের চোঙা ফুঁকতে কাজে লাগতে পারে, নতুন আইনে অপুষ্টির সমস্যার সুরাহা হবে না।
প্রবন্ধ, বইয়ের সূত্রঃ
Banerjee, A (2012): "দু'টাকায় চাল দিলেই অপুষ্টি কমবে না, গরীব মানুষের জন্য আর একটু যত্ন নিয়ে ভাবতে হবে' আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ জানুয়ারী।
Banerjee, A., and Duflo, E (2011): Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty. Public Affairs: New York.
Basu, D., and Basole, A (2012): “The Calorie Consumption Puzzle in India: An Empirical Investigation”, Working Paper 285, Political Economy Research Institute, University of Massachusetts, Amherst. ডাউনলোড করুন:
http://www.peri.umass.edu/fileadmin/pdf/working_papers/working_papers_251-300/WP285.pdf
Deaton, A., and Drèze, J (2009): “Food and Nutrition in India: Facts and Interpretations”, Economic and Political Weekly, Feb 14.
Government of India (GOI) (2009): Nutritional Intake in India. NSS 66th Round. July 2009 – June 2010. Government of India . Ministry of Statistics and Programme Implementation. National Sample Survey Office.
Mehta, J (2004): “Poverty in India”, in Alternative Economic Survey 2003-04. ডাউনলোড করুনঃ http://www.saunalahti.fi/otammile/povindia.htm
Patnaik, U (2007): “Neoliberalism and Rural Poverty in India”, Economic and Political Weekly, July 28 – August 3.
Ray, R (2005): “Changes in Food Consumption and the Implication for Food Security and Undernourishment: India in the 1990s”, Development and Change, 38(2): 321-343.
Subramanian, S (2013): The Poverty Line. Oxford India Short Introductions. Oxford University Press: New Delhi.
(লেখাটি EPW তে প্রকাশিত প্রবন্ধের অনূদিত ও পরিবর্তিত রূপ )