ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুদন্ড নিয়ে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল চার পর্বে। লেখার মতামতে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। সেগুলির সরাসরি উত্তর দিচ্ছেন দেবাশিস সেনগুপ্ত ও প্রবাল চৌধুরী।
অনেক প্রশ্নের উত্তর ইতিমধ্যেই সৈকতের মূল লেখায় অথবা প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া হয়েছে; বাকিগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। যাঁদের আগ্রহ আছে, অনেক সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন হাইকোর্টের পেপারবুকে। সেটা পাওয়া যাচ্ছে একটি নির্মীয়মান ওয়েবসাইট-এ (
www.india-hanged-innocent.org)। সেখানে আছে এফ আই আর, ময়না তদন্তের রিপোর্ট, ফরেনসিক রিপোর্ট, বিভিন্ন সাক্ষীদের বয়ান, ধনঞ্জয়ের প্রশ্নোত্তর, বিভিন্ন সিজার লিস্ট, দায়রা আদালতের রায় ইত্যাদি।
প্রসঙ্গ - পুলিশকে খবর দিতে কত দেরি হয়েছিল।
মৃতদেহ আবিষ্কার হয় ৬টা ৫ মিনিটে, পুলিশকে জানানো হয় ৯টা ১৫ মিনিটে।
প্রসঙ্গ - পুলিশের কাছে রামধনির বয়ান ও কোর্টে সাক্ষ্যের মধ্যে সময়ের পার্থক্য।
পুলিশ রামধনিকে খুনের রাত্রেই জিজ্ঞাসাবাদ করে; থানায় নিয়ে যায় খুনের পরদিন (৬ই মার্চ, ১৯৯০); কোর্টে সে সাক্ষ্য দেয় ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১।
প্রসঙ্গ - আদালতে রামধনির সাক্ষ্যের আগে তাকে আগের বয়ান মনে করানো হয়েছিল কি না।
কোনো তথ্য নেই, তবে প্রসিকিউশন তাদের সব সাক্ষীদের সাক্ষ্যের আগে প্রস্তুত করে নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।
প্রসঙ্গ - রামধনি সত্যি বলছে ভেবে দুই সময়ে দু'রকম বলেছে এমন হতে পারে কি না।
রামধনির কোর্টে দেওয়া বয়ানে সে স্পষ্ট ভাষায় পুলিশের খাতায় থাকা জবানবান্দির বহু অংশ অস্বীকার করেছে এই বলে যে সে স্বল্পশিক্ষিত, পুলিশ তার বয়ান বলে ইংরিজিতে যা লিখেছে তা সে আদৌ জানে না।
প্রসঙ্গ - ধনঞ্জয়ের অন্তর্ধানের কারণ।
ধনঞ্জয়ের ডিউটি ছিল দুপুর দু'টো পর্যন্ত; পরবর্তী ডিউটির আগে পর্যন্ত সে তল্লাটে না থাকলেও সেটাকে অন্তর্ধান বলা যায় না। ঘটনা হচ্ছে, চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছ'টা পর্যন্ত তাকে বিল্ডিং-এর আশেপাশে দেখা গেছে, তার পর দেখা যায় নি। দু'তিন ঘণ্টা তাকে দেখা যায় নি বলে সে সন্দেহভাজন হয়ে ওঠে, আর সম্ভবত ফিরে আসার পর সবাই সন্দেহ করছে দেখে সে চম্পট দেয়। তার পর তো কাগজে কাগজে সম্ভাব্য খুনী বলে তার নাম বেরোয়, পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় তার খোঁজ করে। লিফটম্যান ও দুই নিরাপত্তারক্ষীকে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে গেছিল। তাদের মারধোর করা হয়েছিল বলে শোনা যায়। পিটুনির ভয়ে ধনঞ্জয়ের মতো লোকেদের পালানো মোটেই অস্বাভাবিক নয়। ধনঞ্জয়ের নিজের বয়ান অনুযায়ী সে ভাইয়ের পৈতের আর তার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছিল, শ্বশুরবাড়িতেও গেছিল; এসব কথার সত্যাসত্য যাচাই করা হয় নি।
প্রসঙ্গ - ধনঞ্জয় সঙ্গে সঙ্গে পালাল কেন।
আনন্দ অ্যাপার্টমেন্ট ধনঞ্জয়ের বাসস্থান ছিল না, সন্ধ্যা ছ'টা থেকে ন'টা তার ডিউটিও ছিল না সেখানে। আমার অফিস সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা পর্যন্ত চলে; সেখানে সন্ধ্যা সাতটা থেকে দশটা আমাকে দেখা না গেলে কেউ বলবে না আমি পালিয়েছি। অফিসে বিকেলবেলা একটা খুন হয়ে গেলেও এই প্রশ্ন ওঠে না। ধনঞ্জয়ের ক্ষেত্রেও আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টে ওই সময় তার দর্শন না মেলাটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। ধনঞ্জয় বলেছে সে সিনেমা দেখতে গেছিল। (সিনেমা দেখে ফিরতে ফিরতেই যদি সে পলাতক খুনী বনে গিয়ে থাকে, তাহলে সত্যিই পালানো ছাড়া তার করার খুব একটা কিছু ছিল না।) এটা অ্যালিবাই হিসেবে না হোক, সন্ধ্যাবেলা সে সেখানে না থাকার কারণ হিসাবে যথেষ্ট। পদ্মপুকুরের কাছাকাছি সিনেমা হল তখন কী কী ছিল আমাদের মনে নেই, তবে তিনটে-ছ'টা-ন'টায় শো শুরু হওয়াটা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। অবশ্য সন্ধ্যাবেলা ধনঞ্জয় পদ্মপুকুরে থাকলে হয়তো তার ঘাড়ে দোষ চাপানোর সুযোগ কেউ পেত না। ধনঞ্জয়ের দিক থেকে দেখলে তাই সিনেমায় যাওয়াটা বড় ব্যাপার ছিল। ওই কথাই সে বার বার বলেছে।
প্রসঙ্গ - ধনঞ্জয় ৩০-৪০ মিনিট ধরে বিল্ডিংয়ের ভিতরে কী করছিল।
৩০-৪০ মিনিটের প্রশ্নই ওঠে না। সরকারি আখ্যান অনুয়ায়ী তাকে দশরথ মুর্মু ঢুকতে দেখেছে ৫টা ২৫ থেকে ৫টা ৩০এর মধ্যে। লিফটম্যান তাকে নামতে দেখেছে ৫টা ৩০ থেকে ৫টা ৪৫এর মধ্যে। সরকারি কাহিনীতে ওর উপস্থিতির সময়টা টেনে লম্বা করার চেষ্টা হয়েছে যতদূর পারা যায়, তাই ঢোকার সময়টা পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। কাজেই ধনঞ্জয় বিল্ডিংয়ের মধ্যে মাত্র পাঁচ মিনিটও থেকে থাকতে পারে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ছোট কাজ সেরে বা সারতে না পেরে আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে থাকতে পারে। যদি ২০ মিনিটও ধনঞ্জয় সেখানে থেকে থাকে, তাতে সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক কিছু নেই। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা নানা খুচরো কাজে লিফটম্যান ও সিকিউরিটি গার্ডদের লাগাত, সেই সূত্রে তাদের নানা ফ্ল্যাটে যাতায়াত ছিল।
প্রসঙ্গ - পোস্ট মর্টেম ও ফরেনসিক পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ কী মিলেছে।
যোনিতে বীর্য পাওয়া যায় নি, পাওয়া গেছে মৃতের চাপ-ধরা যৌনকেশে, প্যান্টিতে আর আন্ডারস্কার্টে। এর মধ্যে প্যান্টিতে বীর্য পাওয়ার স্বাভাবিক ব্যাখ্যা - সঙ্গমের পর প্যান্টি পরা হয়েছিল, অর্থাৎ সঙ্গম ঐচ্ছিক ছিল। স্তনে বা নিম্নাঙ্গে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নি; যত আঘাত সবই মুখে-গলায়-ঘাড়ে-হাতে (কোমরের পাশে একটু ছড়ে যাওয়া ছাড়া)। হেতালের মায়ের পুলিশকে দেওয়া বয়ানে বলা হয়েছিল, দেহ আবিষ্কারের সময় স্তন ও নিম্নাঙ্গ দৃশ্যমান ছিল (আদালতের বয়ানে শুধু নিম্নাঙ্গের কথা বলা হয়)। অথচ ময়না তদন্তের সময় মৃতদেহে ব্রেসিয়ার অক্ষত দেখা গেছিল, ফরেনসিক পরীক্ষাতেও তাতে টানাহ্যাঁচড়ার চিহ্ন মেলেনি। পুলিশকে এবং আদালতে বলা হয়েছে প্যান্টি পাওয়া গেছিল দরজার কাছে, অথচ তাতে বীর্য মিলল কেমন করে তার ব্যাখ্যা নেই। প্যান্টি ও অন্যান্য জিনিস সিজ করার আগে নাকি ছবি তোলা হয়েছিল, কিন্তু সেই ছবি আদালতে ব্যবহার করাই হয় নি। এই-সব দেখে মনে হয় মৃতদেহ আদতে যতটা অনাবৃত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি বানানো হয়েছে আদালতে দেওয়া বর্ণনায়, হয়তো ধর্ষণের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। দেহ খুব বেশি অনাবৃত থাকলে সেই অবস্থায় তাকে নিয়ে মা তৎক্ষণাৎ লিফটে নেমে আসতেন না।
প্রসঙ্গ - ডাক্তার ধর্ষণ সম্বন্ধে কী বলেছেন আর তার গুরুত্ব।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে এপ্রসঙ্গে কিছুই লেখেন নি; ধর্ষণ হয়েছে কি না পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে শুধু লিখেছেন যৌনসংসর্গ হয়েছে। আদালতে প্রথমে বলেছেন, "From the finding as noted by me the girl had been raped before she was murdered"। জেরার উত্তরে বলেছেন, "I had an impression while looking into ext. 17 that the deceased had been raped and killed", যেখানে ext. 17 হল ওই পরীক্ষার রিকুইজিশন, যেখানে পুলিশ লিখেছে - "this case appears to be a case of rape and murder"। আরো জেরার উত্তরে তিনি বলেন, "I did not write anything in the post mortem examination report about the rape. . . I mentioned about the rape in reply to the queries made by police"। তিনটি আদালতে ধর্ষণের প্রমাণ বলতে উল্লেখ করা হয়েছে ডাক্তারের এই সাক্ষ্যের, আর ধনঞ্জয়ের উকিলরা ধর্ষণের অভিযোগকে বিশেষ চ্যালেঞ্জ করেন নি। ব্যাপারটা দাঁড়াল, পুলিশ ধর্ষণ সন্দেহ করেছে দেখে ডাক্তারের ধারণা হয়েছে এটা ধর্ষণ, আর ডাক্তার একথা বলেছেন বলে আদালত স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ধর্ষণ হয়েছে।
প্রসঙ্গ - মৃত্যুর পরে সঙ্গম।
সঙ্গম যে মৃত্যুর আগে ঘটেছিল, তা ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার।
প্রসঙ্গ - রক্ত আর বীর্য স্যাম্পল ম্যাচিং, ডি এন এ টেস্ট।
সেরোলজিকাল পরীক্ষা হয়েছিল। হেতালের জামায় বি গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায়। ধনঞ্জয়ের রক্ত ও গ্রুপের। আর কোনো ম্যাচিং সম্ভব হয় নি। স্যাম্পল হয় পরিমাণে যথেষ্ট ছিল না, নয়তো কালক্ষেপে জীর্ণ হয়ে গেছিল। ডি এন এ টেস্টিং হয় নি। সেই সময় ডি এন এ পরীক্ষা সম্ভব ছিল, কিন্তু কলকাতায় নয়। মূল মামলা চলাকালীন কেউ এই টেস্টের কথা বলে নি। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাণভিক্ষার মামলার সময় ডি এন এ টেস্ট চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু আদালত অনুমতি দেয় নি। এই রিপোর্টে (
http://archive.sltrib.com/article.php?id=2393225&itype=NGPSID) অবশ্য ভুল করে লিখেছে, ভারতে তখন ডি এন এ টেস্টিং হত না।
প্রসঙ্গ - এইসব ম্যাচিং ছাড়া ধর্ষক প্রমাণ হয় কিনা।
স্বাভাবিক যুক্তিতে হয় না। কিন্তু হাইকোর্ট খুব স্পষ্ট করে বলেছে, এই মামলায় ধর্ষণ আর খুন একই transaction। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী নির্ধারণ করা যেতেই পারে।
প্রসঙ্গ - শার্টে রক্তের অস্তিত্ব।
পুলিশ এবিষয়ে জানতেও চায়নি। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিজে থেকেই জানিয়েছেন, শার্টে রক্তের দাগ তিনি দেখেন নি।
প্রসঙ্গ - টাকার খেলা কে কে খেলেছে।
আমাদের জানা নেই। তবে টাকার খেলা ছাড়াও অনেক ঘটনাই ঘটা সম্ভব। মামলায় অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হলে পুলিশের ক্রেডিট মেলে, সরকারি আইনজীবীরও। এই পরিস্থিতিতে সহজে যাকে দোষী প্রমাণ করা যায়, পুলিশের তাকেই পছন্দ হবে। ফ্ল্যাটবাড়িতে খুন হয়ে সিকিউরিটি এজেন্সি যদি চাপে পড়ে থাকে, তারা পুলিশকে সাহায্য করবে নিজের স্বার্থেই। আর আদালত এই মামলার রায়ে নিজেই বলেছে - মেয়েদের উপর আক্রমণ বেড়ে চলেছে, বহু দোষী ছাড়া পেয়ে যায়, সমাজ সুবিচার চায়, তার আকুতিতে সাড়া দেওয়ার দায় আছে আদালতের, ধনঞ্জয়ের শাস্তিবিধান হয়েছে এইসব বিবেচনা করে। অর্থাৎ যে-খেলা এই মামলায় চলেছে, তা এই সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লজিকের দৈনন্দিন খেলা। ধনঞ্জয়ের জন্য বিশেষ করে এবং অর্থব্যয় করে এর আয়োজন হয়েছিল এমন নাও হতে পারে।
প্রসঙ্গ - এসমস্ত গবেষণা আগে করা হয় নি কেন।
অধিকাংশ বাঙালির মত আমরাও এই কেসের কথা জানতে পারি ২০০৪ সালে ফাঁসির আগে আগে। তার পর কাগজপত্র জোগাড় ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে অনেক দিন লেগে যায়। অবশ্য আমাদের পুরো সময়ও আমরা এই কাজে দিতে পারি নি।
প্রসঙ্গ - আমাদের এই কাজের সঙ্গে গণিত বা পরিসংখ্যা বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।
সাদা চোখে দেখলে নেই, একটু তলিয়ে ভাবলে আছে। গণিতের উপস্থিতি যুক্তিবিন্যাসে, সৈকতের লেখাতেও তার ছাপ রয়েছে। আর পরিসংখ্যা বিজ্ঞানের মূল কথা হল তথ্য (data) থেকে সিদ্ধান্তে (inference) পৌঁছনো। তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন হাইপোথিসিসের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাব্যটিকে বেছে নেওয়া পরিসংখ্যাবিজ্ঞানীদের অন্যতম কাজ; এই কাজের অভিজ্ঞতা অবশ্যই আমাদের সহায়ক হয়েছে।
প্রসঙ্গ - আসল খুনী, বিকল্প তত্ত্ব, অনার কিলিং...
সৈকতের লেখার বিষয় হল ধনঞ্জয়ের বিচারপ্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অসঙ্গতি। পাঠকের এই কৌতূহল স্বাভাবিক হলেও তা মূল বিষয় থেকে দূরে। আপাতত এই প্রসঙ্গ থাক, অদূর ভবিষ্যতে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।