পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষের সাড়ে তিনি কোটির বেশী মানুষ, মূলত মহিলারা গৃহ-পরিচারিকার পেশায় যুক্ত আছেন। অথচ এই মহিলাদের শ্রমটি সামাজিক ভাবেই শ্রম বলে স্বীকৃত নয় তাই রাষ্ট্রের কাছে তাদের শ্রমিক বলে কোন পরিচয় নেই। সংবিধানের পরিভাষায় একটি শ্রমিকের সংজ্ঞা অনুসারে অন্তত প্রত্যহ চার ঘন্টা যে মানুষ কোন রকম সামাজিক উৎপাদনমূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকবে সেইই শ্রমিক বলে গণ্য হওয়ার কথা। তা হিসেব করে ধরলে এই পরিচারিকা পেশার সাথে যুক্ত মেয়েরা তাদের দৈনিক জীবনে অন্তত ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত শ্রম দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে নিজের পরিবারের জন্য ব্যয় করা সময়ও ধরা আছে। কিন্তু তবুও শ্রমিক পরিচয়ে বাধলো কোথায়? আসলে শ্রমিক বললেই মাথার মধ্যে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তার সাথে এই মেয়েদের যেন কোন মিলই নেই। কারণ গৃহ সামাজিক শ্রমের ক্ষেত্র এবং বাড়ির কাজ সামাজিক শ্রম এই মূল্যবোধটিই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি আজ পর্যন্ত। মধ্যবিত্ত বাড়ির মধ্যবিত্ততা টিকিয়ে রাখে একটি মেয়ের গৃহশ্রম। অর্থাৎ খুব সহজ করে বললে যা দাঁড়ায় তা হল, একটি পরিবার সুস্থ ভাবে টিকে থাকতে পারে না যদি না দিনের মধ্যে যৌথতার প্রয়োজনের কাজগুলি যেমন ঘর পরিষ্কার, খাবার বানানো, বাসন মাজা, জামাকাপড় পরিষ্কার, বাচ্চা দেখা, অসুস্থ রুগীর সেবা করা, বয়স্কদের দেখাশুনা করা ইত্যাদি আরও নানাবিধ কাজ সম্পাদন হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এই পরিচারিকাদের অধিকাররক্ষার লড়াইটা যেমন একদিকে সামাজিক সুরক্ষা, কাজের সুরক্ষা ইত্যাদি দাবীতে তেমনই আবার অনেক গভীরে লুক্কায়িত পিতৃতান্ত্রিক শ্রম বিভাজন ও তাকে ব্যবহার করা পুঁজি ব্যবস্থারও উল্টোদিকে।
পরিচারিকাদের রোজনামচা
শহর বা আধাশহরের পরিবারগুলোতে কাজ করতে আসা গৃহ পরিচারিকাদের একটা বড় অংশই আসে শহরের থেকে দূরে কোন গ্রাম মফঃস্বল থেকে। শহরতলির বস্তি থেকেও আসে কিন্তু তার সংখ্যা গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের তুলনায় বেশ কম। যারা দূর থেকে রোজ ট্রেনে করে আসেন শহরে কাজ করতে তাদের দিন শুরু হয় মধ্য রাত্রি থেকেই। বাড়ির কাজ রান্না ইত্যাদি করে রেখে তারা ভোরের ফার্স্ট সেকেন্ড ট্রেনগুলো ধরেন, যেগুলোর নামই হয়ে গেছে ‘ঝি-লোকাল’। তারপর সকালের আলো ফোটার সাথে সাথেই তাদের কাজের জায়গায় পৌঁছে কাজ শুরু। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়েই জোটে না সকালের চা জলখাবারও। এনেকেই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসেন। সেটাই দস্তুর। খাবার দেওয়া দূর কি বাত, বাড়ির বাথরুম ব্যবহার করতে দেয় না এদের। লুকিয়ে যেতে হয় অথবা স্টেশন চত্ত্বরেই সেরে রাখতে হয় সব শৌচ কর্ম। তাতেও সমস্যা বাড়িতে লুকিয়ে বাথরুম ব্যবহার করলে যদি বুঝতে পারে তাহলে অপমান। এভাবেই নিত্যদিন অভ্যস্ত এরা। এভাবেই একের পর এক বাড়ির কাজ সেরে আবার বিকেলের দিকে ট্রেন ধরে ফেরা নিজেদের বাড়ি। অনেক সময়েই এই মেয়েদের ট্রেনে বাসে আমাদের সহযাত্রী হিসেবে পেতে হয় যারা ট্রেনের সীটে না বসে দরজার কাছে পা মেলে ‘আরাম করে’ (!) মুড়ি খেতে খেতে বা গল্প করতে করতে যান। অনেক অফিসযাত্রী মহিলাদের সাথেই ট্রেনে দাঁড়ানোর জায়গার অভাবের জন্য এই নিয়ে অনেক ক্ষোভও দেখতে পাওয়া যায়। আসলে পরিচারিকাদের সাথে কথা বললেই বোঝা যায় ওই ট্রেনের যাতায়াতের পথটুকু বাদ দিলে প্রায় বসার বা ঝিমোবার সময় তারা না বাড়িতে পান, না কাজের ক্ষেত্রে। এ তো গেল যারা দূর থেকে আসেন তাদের কথা। আর যারা শহরের আশেপাশে বস্তিতে থাকেন? তারা কেমন আছে জানতে চাইলে ঢুঁ মারতে হবে ঢাকুরিয়া বস্তিতে কিংবা, বিধাননগর বস্তিগুলোতে। শহরতলিতে বাস করে বাজারের আগুন দামে পাল্লা দিয়ে জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখতে অবস্থা জেরবার। মাথা ওপর একটুকরো আশ্রয়ের ভরসা নেই অথচ তাকে উদয়াস্ত শ্রম দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয় অন্যের সাজানো সংসার।
পারিশ্রমিক কেমন?
পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট নেই, না কাজ হিসেবে না জনপ্রতি কাজের হিসেবে। এখানেই গোলমাল বাধে কাজের মাইনে ঠিক করার ক্ষেত্রে। বাইরের গ্রামগুলিতে যেখানে জীবনযাত্রা একটু কম টাকাতেও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, স্বভাবতই সেখান থেকে আসা মেয়েরা যে কাজটা হাজার টাকার নীচে করতে রাজী হয়ে যান, কলকাতার শহরতলির মেয়েরা সেটা করতে রাজী হতে পারে না। এবং নির্দিষ্টকরণ নেই বলে কম টাকায় অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মালিকেরও খাটিয়ে নেওয়ার রাস্তা খোলা থাকে। আর এই রেষারেষিতে পরিচারিকাদের নিজেদের মধ্যেই গন্ডোগোল বেধে যায়। বাইরের থেকে কাজ করতে আসা মেয়েদের অনেক সময় নিজেদের এলাকায় কাজে ঢুকতে দেন না শহরতলির মেয়েরা। অথচ যদি ভেবে দেখা যায় সমস্যা অনেক গভীরে। গৃহশ্রমে মজুরী ঠিক করলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত নড়ে যেতে পারে। পরিবারের মধ্যে প্রয়োজনীয় শ্রম একটি শ্রমিকের শ্রমশক্তির যোগান দেয় যে শ্রমশক্তির বিনিময়ে শ্রমিকটি সামাজিক উৎপাদনে শ্রমদান করতে সক্ষম হয়। তাই একেবারে সরাসরি না হলেও আসলে তো সামাজিক উৎপাদনের সাথে মিশে থাকে গৃহশ্রমের ধারণাটি। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্যই আসলে সেই গৃহশ্রমের মূল্য যা কোন শ্রমিক পান না, পান পুঁজিব্যবস্থার ওপরের তলার লোক। এখন এখানেও সহজ সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করেছে। যে মধ্যবিত্ত বাড়িটি পরিচারিকার কর্মক্ষেত্র সেই বাড়ির গৃহকর্তা অন্য কোথাও নিজের শ্রম দেন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে গৃহকর্ত্রীটিও দেন। তাদেরকে প্রদেয় শ্রমমূল্যেই আসলে বাদ থেকে যায় গৃহশ্রমের মূল্য তাই তারাও পারেন না সঠিক মূল্য দিয়ে প্রয়োজনীয় গৃহস্থ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে, তাদেরও অনেক কম মানের বেতন দিতে হয় পরিচারিকাদের। অথচ কাজটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে সেটি না হলে কোন পরিবার টিকেই উঠতে পারবে না।
পরিবার যখন কর্মক্ষেত্র
সবসময়েই কি কর্মক্ষেত্র মাত্রই শোষণের জায়গা? না, তা নয়। পরিবারের সদস্যদের সাথে এক ধরণের সম্পর্কও থাকে পরিচারিকা মেয়েদের। অনেক অনেক উদাহরণ আছে যে একজন পরিচারিকা হয়তো একটু কম টাকাতেও রাজো হয়ে গেছে কোন বাড়ির কাজে, শুধু বাড়ির মালকিনের ব্যবহার ভালো বলে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো শুধু বৌদির কথা ভেবে বাড়তি কাজ করে দেন তারা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি প্রচুর মেয়েরা হয়তো কারও কারও বাড়িতে ২০ বছরও কাজ করেছেন বা করে চলেছেন। সেক্ষেত্রে সর্বদা মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বিরাজমান থাকে এমনটা নয়, সেখানে থাকে অন্য কিছু বিশ্বাস অ নির্ভরশীলতার গল্প। হ্যাঁ এই বিশ্বাস শব্দটি এই কাজের ক্ষেত্রে একটি অনন্য ভূমিকা রাখে। বাড়িতে কাজ করতে আসা মায়াটির হাতে পুরো বাড়ির সমস্ত খুঁটিনাটির দায়িত্ব ছেড়ে রাখা অনেকটাই বিশ্বাস এবং ভরসার স্থল থেকে হয়। আবার পরিচারিকার ক্ষেত্রেও একটা নির্ভরতা তৈরী করে এই পরিবার বা কাজের জায়গাগুলো। অনেকেই স্বামীর মারের ভয়ে মাসের পর মাস কাজের বাড়ির বৌদির কাছেই হয়তো টাকা জমান। এক্সট্রা ছুটি নিলে হয়তো মাইনে কাটেন না অনেক বাড়িতে। এক্ষণে ছুটির বিষয়টাও বলে রাখা ভালো। এই কাজের ক্ষেত্রে ছুটির যদিও নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই, তবে ধরে নেওয়া হয়েছে মাসে চারদিন অন্তত সবেতন ছুটি প্রাপ্য। তা যা বলা হচ্ছিল, অনেক বাড়িতে হয়তো ছুটি বিষয়টাকে এতো কড়াকড়ি নজরে দেখা হয় না। মাইনে কাটা দস্তুর হলেও কেটে নেয় না এক্সট্রা ছুটিতে। হয়তো একটু বেশী কাজ করিয়ে নেয় অন্য দিন। অনেক বাড়িতে কাজের মেয়েরা সময়ে অসময়ে ছেলের পড়াতে কিংবা বরের অসুখে খানিক অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে। কাজের বাড়ির মেয়ের বিয়েতে জোটে ভালো একটা শাড়ি। দেখতে খুবই টুকিটাকি কিন্তু আসলে এই সম্পর্কের জেরেই টিকে থাকে শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্বের অন্য পিঠটা। কিন্তু সেসবও দ্রুত বদলাচ্ছে। খোলনলিচা বদলে যাচ্ছে সম্পর্কগুলোর। চারদিকে ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে আয়া সেন্টার। এই ছুটে চলা জীবনে পাশ ফিরে অন্য মানুষটির কথা ভাবতে বয়েই গেছে আমাদের!
অবশ্বাস আর সামাজিক মর্যাদাহানির কাহানি
পরিবার কর্মক্ষেত্র হওয়ার কারণেই সমাজের অন্যান্য বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে ঢুকে পড়ে সেখানে। শ্রেণীবৈষম্য তো আছেই, তার সাথে আছে জাতপাত ধর্মের ভেদ। মেয়ে বলে বেশী করে হেনস্থার অভিযোগ ভুরি ভুরি। অনেক বাড়িতে আজও বেসিনের তলায় বা তাকের একটু নীচের দিকে আলাদা কাপ, আলাদা প্লেট রাখা থাকে চা জলখাবারের। যাদের ছোঁয়া দিয়ে সাংসারিক সব কাজ চলছে, তাদের ছোঁয়াতেই আবার আপত্তি। সামাজিক মর্যাদাহানির আরও অনেক রূপ প্রকট হয়ে ওঠে সময়ে সময়ে। যেমন চুরির অপবাদ দেওয়া। বছর তিনেক আগে বন্দনা মাহাকুড়ের ঘটনা আমাদের জীবনে একটি বড় ঘটনা। একটি ১৪ বছরের মেয়েকে দেড় লক্ষ টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে দমদমের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়, মারধোর দিয়ে নির্যাতনের চরম সীমায় চলে যায়। এমন সময় আমরা খবর পাই, অনেক ঝামেলা করে পুলিশ এবং বস্তিবাসী গিয়ে উদ্ধার করে আনে মেয়েটিকে। তো এই হল বাস্তব পরিস্থিতি। এরকম ছোটখাট থেকে বড়সড় অনেক ঘটনাই ঘটে যা সামাজিক দৃষ্টিতে অবমূল্যায়ণকর। এর সাথে যৌন হেনস্থা তো আছেই। যৌন হেনস্থার সাথে সাথেই তাড়া করে ফেরে অবিশ্বাসী কিছু চোখ। এরকম ঘটনাও ঘটেছে বাড়ির কর্তা যৌন হেনস্থা করেছে অথচ জানাজানি হতেই কাজ চলে গেছে পরিচারিকাটির সাথে জুটেছে ‘চরিত্রহীনা’র তকমাও। বাড়ির দিদিরা অনেক ক্ষেত্রেই কাজে রাখতে চান না এরকম ‘বাজে’ চরিত্রের মেয়েদের। এই ঘটনাগুলি সংখায় হয়তো কম। কিন্তু শুধু মেয়ে বলেই এই যে অপদস্থ হওয়ার বিষয় এটা কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। অনেক পরিচারিকা দিদিদের বলতে শুনেছি, একটু ভালো শাড়ি পরে গেলে বা সেজে গেলে কাজে নিতে চায় না, বা নিলেও কথা শোনায়। অর্থাৎ আর একটি মেয়ের বিদ্বেষের মুখে পড়তে হয় সন্দেহের শিকার হতে হয়। অদ্ভুত এই দাঁড়িপাল্লার খেলা। শ্রেণী বৈষম্য তফাত হিসেবে চাক্ষুস বোঝা না গেলেই কিন্তু ভয়ানক চিন্তার ভাঁজ পড়ে বৈষম্যের ওপরের তলার মানুষের।
পরিচারিকাদের অধিকার রক্ষার লড়াই অনেক কঠিন। দাবী যত না বেশী সরকারের কাছে, তার চেয়ে অনেক বেশী সামাজিক। সরকার হয়তো নিয়ম করে মাসে চারটে ছুটি কিংবা নির্দিষ্ট ন্যূনতম মাইনে ঠিক করে দিতেই পারে, কিন্তু সামাজিক অসাম্য ও ঘৃণা মোছাবে কি করে? এরপরেও নোংরা গ্লাসে চা খেতে দেওয়া থাকবে, বাথরুম ব্যবহার করতে না দেওয়াও থাকবে, থাকবে অবিশ্বাস আর সন্দেহও। সুতরাং এই লড়াই শুধু কাঠকাঠ নিয়ম করে কিছু সুযোগ সুবিধা আদায়ের লড়াই নয়। এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে মানুষগুলি কর্মদাতা বা দাত্রী, তাদের এ বিষয়ে আরও সক্রিয়, সচেতন এবং সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে হবে। তাই পরিচারিকাদের এই লড়াইতে তাদেরকেও পাশে থাকতে হবে। কারণ শেষত তারাও প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল নিজেদের পরিবার টিকিয়ে রাখতে এই ‘কাজের মেয়ে’দের ওপরেই।