অধরাই রয়ে গেছে ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’র স্বপ্ন
১৯৫৪ সালে অর্থনীতিবিদ আর্থার লুইস বলেন যে কৃষি ক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত শ্রমিকেরা ভারী যন্ত্রশিল্পের কাজে চলে আসাটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বাভাবিক পদ্ধতি। শিল্পের বিকাশের পেছনে অন্যতম যুক্তি হিসেবে এই তত্ত্বের অবতারণা বার বার হয়েছে, ভারতবর্ষের পরিকল্পনা ভিত্তিক উন্নয়নের পেছনেও লুইস তত্ত্ব কাজ করেছে।
২০১৪-র সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকারের ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’ প্রকল্পের ঘোষণার পরেও লুইসের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উল্লেখ বারবার হয়েছে, কিন্তু একবিংশ শতকের অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং-এর কতটা ক্ষমতা রয়েছে কৃষির শ্রমকে কর্মসংস্থান দেওয়ার তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কুড়ি বছর আগেও ভারী শিল্পে যা কর্মসংস্থান সম্ভব ছিল আজ তার ভগ্নাংশ কর্মসংস্থানও সম্ভব নয় কারণ নতুন প্রযুক্তি শ্রমকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে, মানুষের হাতের জায়গায় যন্ত্রের হাত কাজ করে দিচ্ছে।
‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’ প্রকল্পের ধাঁচ দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর মাধ্যমে চীনের সফল ম্যানুফ্যাকচারিংকে অনুকরণ করার একটা প্রবল প্রচেষ্টা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল সেই চীনও নেই, আর সেই অর্থনীতিও নেই। চীনের চোখধাঁধানো ম্যানুফ্যাকচারিং সাফল্য এসেছিল মূলত সেই সময় যখন বিশ্ব অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান। চীনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং সস্তা শ্রম প্রথম বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থাগুলির সামনে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আরো বেশী লাভ করার এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। বেশীর ভাগ বহুজাতিক তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং দ্রব্য তৈরী করার কারখানা চীনে সরিয়ে নিয়ে আসে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্যে। এর ফলে চীন পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম “ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে”।
কিন্তু ২০০৮-এর সারা বিশ্বের প্রবল অর্থসংকটের পরে দুনিয়া জুড়েই অর্থনীতি থমকে রয়েছে, এবং এখনো পর্যন্ত সেই আগের বৃদ্ধির ধারেকাছেও ফেরত আসতে পারে নি, তার মানে দাঁড়ায় বিদেশে রপ্তানি করে নিজের দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং-এ বৃদ্ধি ঘটানো খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় ২০১৪ সালে এসে চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং সাফল্য ভারতে “কপি-পেস্ট” করাটা অনেকটাই অসম্ভব উচ্চাকাংখা বলেই বোধ হয়েছিল কিছু অর্থনীতিবিদের, কিন্তু নতুন সরকারের সাথে সাথে নতুন আশাবাদী ভাবনাচিন্তারও জন্ম হয়েছিল বলে সেই সব মতামত খুব একটা হালে পানি পায় নি। প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’ ঘোষণার পরে। এখন সময় এসেছে এই বহুল প্রচারিত প্রকল্পের একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়নের।
প্রথমেই দেখা দরকার সরকার কি কি করতে চেয়েছিল ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’র মাধ্যমে। প্রকল্পটির সরকারী ওয়েবসাইট অনুযায়ী অন্যতম লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে –
২০২২ সালের মধ্যে জি ডি পি অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের অবদান ২৫ শতাংশ করে ফেলা (চীনের জি ডি পিতে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর অবদান ৩০ শতাংশর আশেপাশে)
২০২২ সালের মধ্যে ১০ কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরী করা ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে
বিদেশী পুঁজির জন্যে অর্থনীতির নানা সেক্টর আরো মুক্ত করে তোলা
ভারতীয় অর্থনীতিতে অতিরিক্ত আভ্যন্তরীণ পুঁজি তৈরী করা
এইভাবে ভারতকে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর “গ্লোবাল হাবে” পরিণত করা
এবারে এক এক করে দেখা যাক সরকার কত দূর এগোতে পেরেছে এই লক্ষ্যগুলির দিকে।
২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর অবদান মোটামুটি ১৭ শতাংশ ছিল, ৮ বছরে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল – অর্থাৎ প্রতি বছরে ১ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটানোর দরকার ছিল ম্যানুফ্যাকচারিং-এর জি ডি পি-তে অবদান ২৫ শতাংশ করে তুলতে। গত তিন বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর জি ডি পি-তে অবদান ১৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে (অর্থাৎ তিন বছরে ১ শতাংশ বৃদ্ধি), এবং সরকার এই অবদান ২৫ শতাংশ অবদি নিয়ে যাওয়ার জন্য লক্ষ্য সাল ২০২২ থেকে ২০২৫-এ আরো তিন বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
একই ভাবে ২০২২ সালের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং-এ ১০ কোটি নতুন কাজ তৈরী করার অর্থ প্রতি বছরে ১.২৫ কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরী করা। লেবার ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল ২০১৬ থেকে জানুয়ারী ২০১৭-এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং-এ কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৯৫,০০০ – অর্থাৎ লক্ষ্যপূরণের ধারেকাছেও না।
লেবার ব্যুরোর কর্মসংস্থান সার্ভের পরিসংখ্যানকে পরবর্তী কালে সমালোচনা করেন নীতি আয়োগের ভূতপূর্ব ভাইস চেয়ারম্যান অরভিন্দ পানাগারিয়া যেহেতু এই সার্ভে অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান দেখায় না, প্রায় সাথে সাথেই কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বলেন যে দেশে কর্মসংস্থান আসলে বেড়েছে কিন্তু সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার পদ্ধতির অভাবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
অনতিকাল পরে বেসরকারী পরিসংখ্যান কোম্পানি সি এম আই ই-র কনজিউমার পিরামিড সার্ভের ফলাফলে দেখা যায় যে সারা দেশে ১৫ লাখ কর্মসংস্থান কমে গেছে ২০১৭-র প্রথম তিন মাসে। ফলত এটা বলা যেতেই পারে যে নতুন কর্মসংস্থান বিগত এক বছর যাবত বিশাল পরিমাণে বেড়েছে এর কোন তথ্যপ্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি, পক্ষান্তরে দেশে সার্বিক কাজের অভাব ঘটেছে এই ধরনের তথ্য আসতে শুরু করেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
বিদেশী পুঁজির জন্য নানা সেক্টর খোলা হয়েছে বিগত তিন বছরে – এটা ঠিকই, কিন্তু তার ফলে এখনো পর্যন্ত সেই পরিমাণ বিদেশী পুঁজি আসে নি যা দিয়ে ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’র মত উচ্চাকাংখী প্রকল্পকে সফল করা যেতে পারে। তাছাড়া বিদেশী পুঁজির সিংহভাগ এসেছে নানা কোম্পানির ইকুইটিতে, অর্থাৎ নতুন প্রকল্পে বিদেশী পুঁজি সেই ভাবে আসে নি। এর মানে এটাই দাঁড়ায় যে বিদেশী পুঁজি দিয়ে দেশে “ম্যানুফ্যাকচারিং বিপ্লব” এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের হালও খুব একটা ভাল নয়। জি ডি পি-র শতকরা অনুপাতে দেশের আভ্যন্তরীণ পুঁজি নির্মাণ (যা বিনিয়োগের সমার্থক) যদি দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে ২০১১র জুন মাসের পর থেকে এটি লাগাতার কমতে থেকেছে – জুন ২০১১তে এই পুঁজি নির্মাণ ছিল জি ডি পি-র ৩৫.৪%, যা মার্চ ২০১৭তে এসে কমে গিয়ে জি ডি পি-র ২৮.৫% হয়ে গেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং ইনডেক্স অফ ইণ্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন (আই আই পি) বৃদ্ধির হার ২০১৩-১৪ সালের -০.৮% থেকে বেড়ে ২০১৫-১৬তে এসে ২.০% হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আর্থিক সংকট পূর্ববর্ত্তী ২০০৭-০৮ সালের ১৮.৪% অথবা ২০১০-১১ সালের ৯%-এর ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে নি।
শিল্পকে দেওয়া ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটা আভাস দেয় কারণ শিল্পপতিরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন কারখানা তৈরী করেন বা পুরনো কারখানার সম্প্রসারণ ঘটান। বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র – সব ধরনের শিল্পদের দেওয়া ব্যাংক ঋণের বৃদ্ধির হার স্মরণাতীত কালের মধ্যে সব চেয়ে কম হয়ে ২.৭%এ পৌঁছেছে ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে, সাম্প্রতিক কালে ২০০৯-১০ সালেও শিল্পকে দেওয়া ব্যাংক ঋণের বৃদ্ধির হার ২৪.৪% ছিল।
ডিসেম্বর ২০১৬তে আর বি আই ২০১১-১২ পর্যন্ত ভারতীয় অর্থনীতির উৎপাদনশীলতার সূচক প্রকাশিত করে, ২০০৮-এর পরে এই সূচক বিপজ্জনক ভাবে কমতে থেকেছে প্রত্যেক বছর – সোজা ভাষায় বললে ভারতীয় অর্থনীতির উৎপাদনশীলতার হার সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমশ নিচের দিকেই গেছে, ওপরের দিকে নয়। এর সাথে এটাও বলা দরকার যে ২০১৬-১৭র তৃতীয় ত্রৈমাসিক ফল অনুযায়ী ভারতীয় শিল্প তার মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৭২.৭% ব্যবহার করছে, একটু অন্য ভাবে বললে – শিল্পের ২৭.৩% উৎপাদন ক্ষমতার কোন ব্যবহারই ঘটছে না।
দেশী বা বিদেশী কোন রকম পুঁজির বৃদ্ধি ঘটে নি গত তিন বছরে, কর্মসংস্থান স্বাভাবিক ভাবেই আশানুরূপ নয়, শিল্পপতিদের ব্যাংক ঋণ না নেওয়া দেখে এটাও বলা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি তাঁরা প্রত্যাশা করছেন না, সাথে উৎপাদনশীলতাও নিম্নমুখী। এই সমস্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান দেখার পরে অবশ্যই এটা বোধ হয় বলার আর কোন দরকার পড়বে না যে ‘মেক ইন ইণ্ডিয়া’র মাধ্যমে ভারতকে “ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে” পরিণত করার “চৈনিক” স্বপ্ন বিগত তিন বছরে অধরাই থেকে গেছে, বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব একটা ঘটে নি।