ফেমিনিজমের এখন থার্ড ওয়েভ যাচ্ছে! অনেকের মতে দ্বিতীয় তরঙ্গেই নারীবাদের সব চাওয়া মিটে গেছে। নতুন করে নারীবাদ মানে র্যা ডিক্যাল মুভমেন্ট বৈ বেশি কিছু হবে না। ভোটাধিকার, সমপারিশ্রমিক তথা লৈঙ্গিক সমতা দ্বিতীয় ওয়েভেই হয়ে গেছে। এখন যারা নারীবাদী হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতে চায় তাদেরকে একপক্ষ “কিটিবাদী” আখ্যা দেয়। এবং মজার বিষয়, বিগত সময়ে নারীবাদের উপর একচ্ছত্র জনসমর্থন থাকলেও থার্ড ওয়েভে সেটা কমছে।
সেই অনুযায়ী বাড়ছে নারীবাদীদের সংখ্যা। বাড়ছে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী নারীদের সংখ্যা। অপরদিকে যারা বলে লৈঙ্গিক সমতা এসেছে, তারাই রাতের বেলার জবে ছেলেদের অগ্রাধিকার দেয় বেশি। এখনও রাত ১২ টার পরে মেয়েদের সেফটি নিয়ে তারাই দোনোমনো করে। কোন মেয়ে ধর্ষণ হবার পর শালীন না অশালীন ড্রেস পরেছিল তা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলে।
দুই দুইটি ওয়েভ মেয়েদের শরীরের জমিদারী থেকে পিতৃতন্ত্রকে হটাতে পারেনি। পারছে না এখনো। তৃতীয় ফেমিনিজম ওয়েভের এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের ছোটবেলায় ৮ই মার্চ উইমেন’স ডে নিয়ে আমাদের অত মাথাব্যথা ছিল না। আমরা ৯০ দশকের স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা কেবল জেনারেল নলেজে ভালো নম্বর পেতে ৮ই মার্চ নারী দিবস তা জানতাম।
সময় বদলেছে। এখন বিশ্বে ঘটা করে নারী দিবস পালন করা হয়। র্যাালি, সেমিনার করা হয়। নতুন নতুন নাটক সিনেমা বিজ্ঞাপন বানানো হয় এই দিনকে সেলিব্রেশন করার জন্য।
নারী দিবস জিনিষটা আমার কাছে হিপোক্রেসি মনে হয়। একদিন নারী নারী করে পালন করে পরদিন আবার সেই নারীর উপর হিংসা, জোচ্চুরি নয়?
তবে সদর্থকভাবে দেখতে গেলে যেহেতু একটা দিন পেয়েছি, সেদিন একুল ওকুল ভুলে একটু রাস্তায় নামতে পারি মেয়েরা মিলে! বলতেই পারি নিজেদের কথা! ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে জীবনের চাপে সবসময় বলতেও পারি না মনের কথা। সেই কথাই যদি একদিন রাস্তায় নেমে সকলকে বলি ক্ষতি কোথায়!
তাই এইবার ২০১৭ সালে ৮ই মার্চ বাংলাদেশে উইমেন মার্চ করলাম আমরা। উইমেন চ্যাপ্টার, বাংলাদেশের সর্বপ্রথম নারীদের জন্য অনলাইন পোর্টাল। উইমেন চ্যাপ্টারের এডিটর সুপ্রিতি দি পুরো মার্চটির আয়োজন করেছিলেন। পাশে ছিলেন জাকিয়া আপা, সঙ্গীতা আপু, লীনা আপু এবং আরও অনেকে। এই অধমকেও রাখা হয়েছিল অর্গানাইজিং কমিটিতে । যদিও এই অধম র্যাটলির আগে ফেস্টুন বিলানো ছাড়া আর কোন কাজ করে নি।
এবছর জানুয়ারিতে ইউএসএ মেয়েদের উইমেন মার্চ নাড়া দিয়েছিল বাংলাদেশী নারীদের মনেও। আর তাই সুযোগ পেয়ে বিশাল মানুষের জমায়েত হয়েছিল এবার বাংলাদেশের উইমেন মার্চে।
তবে মজার কথা হচ্ছে পুরুষের সংখ্যা বেশি ছিল এই উইমেন মার্চে। এটা একটা ভালো দিকও। নারী সাইক্লিস্ট এবং বাইকারদের মনোহর মার্চ, সময়টাকে আরও উদ্দীপ্ত করে দেয়।
বুধবার বেলা তিনটায় শুরু হবার কথা ছিল উইমেন মার্চ। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ঈশ্বর (না প্রকৃতি !) বারোটা বাজিয়ে দেয়। বৃষ্টি শুরু হলে সাময়িক পন্ড হয় মার্চের সময়। এরপরেও জমায়েত হতে থাকে মানুষের। সবশেষে বিকাল পাঁচটায় মার্চ শুরু হয় প্রজন্ম চত্বর থেকে শেষ হয় শহীদ মিনারে।
অনেক টিভি সাংবাদিক এলেও, সংবাদে এক দুই সেকেন্ডের বেশি উইমেন মার্চের ক্লিপ দেখানো হয় নি। কারণ কোন সেলিব্রেটি ছিল না সেখানে। ছিলাম কামলা খাটা মেয়েরা যারা আদতে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট ক্রিয়েট করে জিডিপি বাড়াই।
“মেয়ে প্রতিবাদ করো”, “মেয়ে তোমার শরীর ট্যাবু নয়”, “সাহস করে ঘুরে দাঁড়াও” এরকম অসংখ্য ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মেয়েরা। আর পাঁচ বছর আগেও এটা দেখা যেত না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ আইনে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। এতে নারীর উন্নতি আরও কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাবে, সঙ্গে অল্প বয়সে মা হওয়া মেয়ের সংখ্যা বাড়বে। নারীর জরায়ু বরাবরের মতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ফেস্টুনে ছিল এই নিয়েও প্রতিবাদ।
আর পাঁচ বছর আগে একত্রে এত মেয়ে নিজের প্রতিবাদের কথা বলছে এটা ভাবা যেত না।
তাই পত্রিকায় আসুক আর না আসুক, টিভিতে কেউ দেখুক না দেখুক, সেলিব্রেটি সমাগম হোক আর না হোক বাংলাদেশের প্রথম এই উইমেন মার্চ ইতিহাস হয়ে থাকবে।
স্পষ্ট বলছি, আর একশ' বছর পর যখন বাংলাদেশের নারীবাদ নিয়ে কেউ আলোচনা করবে, সেদিন উইমেন মার্চ কে তারা উল্লেখিত করবে এক দুর্দান্ত বিপ্লব হিসেবে।