বহুদিন ধরেই মানুষজনের মধ্যে কথা চালাচালি কানাঘুষো—বিশেষ করে অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি ও বাইপাস সার্জারির (সি এ বি জি) রমরমা যখন শুরু হল—বাপরে! স্টেন্টের কী দাম! এক-একটা অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি করতে কমসে-কম দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা। হবেই তো। স্টেন্টের দামই কোনোটা এক লাখ টাকা, কোনোটা-বা তিন লাখ টাকা বা তারও বেশি। কারও যদি তিনটে ‘ব্লক’ থাকে তার খরচ সাড়ে চার লাখ টাকা থেকে ছয় লাখ টাকা, কী তাকেও ছাপিয়ে যায়—সেটা নির্ভর করে, কে কেমন বেসরকারি হাসপাতালে (থ্রি-স্টার,ফোর-স্টার নাকি ফাইভ-স্টার) যান তার ওপর। এত বিপুল অঙ্কের টাকা খোলামখুচির মতো খরচ করা কী সাধারণ মানুষের কম্ম! টাকা তো আর গাছে ফলে না। কিন্তু কী করা যাবে—প্রাণের দায় বড়ো দায়। মানুষজন তাই উপায়ান্তর না পেয়ে ধার-দেনা করে, ঘটিবাটি বাঁধা দিয়ে কোনোমতে খরচের ধাক্কাটা সামলান। নিট ফল? সে-কথায় না হয় পরে আসা যাবে। কিন্তু এর মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেল এক-একটা স্টেন্ট থেকে নাকি হাসপাতালগুলো ৬৫০ শতাংশ থেকে ৯০০ শতাংশ মুনাফা করে। ভাবা যায়! হাসপাতালগুলো যে মুনাফার লোভে মুড়িমুড়কির মতো অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি করতে থাকে এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? এসব দেখেশুনে আচমকাই কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। এমন জুলুমবাজি তো বরদাস্ত করা যায় না। ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (ওষুধ-বিষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জাতীয় কর্তৃত্ব) স্টেন্টের দাম বেঁধে দিয়ে ফরমান জারি করলেন। কী সেই ফরমান?
আজ থেকে কোনো ওষুধ-মাখানো অনাবৃত তারের খাঁচার (drug-eluting) কিংবা জৈব-শোষণযোগ্য (bioresorbable) স্টেন্ট দেশের কোথাও স্থানীয় করসহ ২৯৬০০ টাকার বেশি দামে বেচা যাবে না। এমনকী হাসপাতাল ডিলার বা নির্মাতাদের ঘরে যত স্টেন্ট মজুত আছে সেগুলো এই দামেই বেচতে হবে। অনাবৃত তারের খাঁচার (bare metal) স্টেন্টও ৭২৬০ টাকার বেশি দামে বেচা যাবে না। (এন এন এস, ১৪ ফেব্রুয়ারি,২০১৭)
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে: সর্বোচ্চ দামের নীচে যেসব স্টেন্ট বিক্রি হয়, সেগুলোকে সেই একই দামে বেচতে হবে। বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ দামের ওপর স্থানীয় কর ও ভ্যাট (VAT) ছাড়া অন্য কোনো মাশুল বসানো যাবে না। এন পি আর এ (National Pharmaceutical Pricing Authority) হাসপাতাল/নার্সিং হোম/ক্লিনিক-দের, যারাই করোনারি স্টেন্ট ব্যবহার করে, তাদের নির্দেশ দিয়েছে, বিলে নির্দিষ্টভাবে ও আলাদাভাবে স্টেন্টের দাম উল্লেখ করতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে ব্র্যান্ড নাম, প্রস্তুতকারক/আমদানিকারকের নাম, ব্যাচ নম্বর এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি বিবরণ। এর সঙ্গে হাসপাতাল/নার্সিং হোমের আঙিনায় সবার সামনে টাঙিয়ে দিতে হবে নির্মাতা/আমদানিকারকদের থেকে নেওয়া সমস্ত স্টেন্টের দামের তালিকা।
স্টেন্টকে শিডিউল-১ ড্রাগ হিসেবে চিহ্নিত করার পর জানুয়ারি মাসে স্টেন্ট-এর সঙ্গে জড়িত সকলকে নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনার শেষে স্টেন্ট-এর দাম বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে, স্টেন্ট সরবরাহের প্রতিটি ধাপে অনৈতিকভাবে দাম বাড়ানো হয়; ফলে অযৌক্তিক চড়া দামে স্টেন্ট কিনতে বাধ্য হয়ে রোগীরা পড়েন চরম আর্থিক দুর্দশায়। এর সঙ্গে আছে ডাক্তার-রোগীর মধ্যে স্টেন্ট-সংক্রান্ত খবরাখবর আদান-প্রদানের মধ্যে নানারকম বিভ্রান্তিমূলক অসংগতি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে—জনস্বার্থে, রোগীরা যাতে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন, তাই স্টেন্ট-এর দাম বেঁধে দেওয়া হল। বীরেন্দর সাংওয়ান দিল্লি হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। বিষয়: স্টেন্ট-এর দাম বেঁধে দেওয়া আর স্টেন্টকে জাতীয় অত্যাবশ্যক ওষুধ তালিকার আওতায় আনা। এইটি বিবেচনা করে করোনারি স্টেন্টকে জাতীয় অত্যাবশ্যক ওষুধ তালিকার আওতায় আনা হয়েছে।
ফরমান জারির পরে পরেই
ফরমান পেয়েই তো স্টেন্ট-নির্মাতা, হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের মাথায় হাত। তড়িঘড়ি নির্মাতারা ও পরিবেশকরা হাসপাতালগুলো থেকে সর্বাধুনিক স্টেন্টগুলো তুলে নিলেন। কী কারণ? না, স্টেন্টগুলোতে নতুন করে লেবেল সাঁটতে হবে। যেসব হাসপাতাল থেকে স্টেন্ট তুলে নেওয়া গেল না, তাদেরকে মুখে বলে দেওয়া হল দামি ও উঁচু মানের স্টেন্টগুলো যেন রোগীদের না দেওয়া হয়। অথচ এন পি পি এ (National Pharmaceutical Pricing Authority)-র স্পষ্ট নির্দেশ: নির্মাতা, আমদানিকারক ও খুচরো ব্যবসায়ীরা এই মুহূর্ত থেকে বেঁধে- দেওয়া দামে স্টেন্ট বেচবেন; কোনো কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করার চেষ্টা যেন না করা হয়। এই মর্মে এন পি পি এ সব রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি দিয়েছে: বাঁধা-দামে রোগীরা যেন সবরকমের স্টেন্ট পায়।
ওদিকে হৃদ্রোগবিশারদরা বলছেন: বি ভি এস (bioresorbable vascular scaffold) স্টেন্ট—যা রোগগ্রস্ত ধমনিকে সারিয়ে শরীরেই শোষিত হয়ে যায়—কোথাও মিলছেই না। ‘কোম্পানি ওগুলো তুলে নিয়ে গেছে নতুন দাম সাঁটবে বলে কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, ওগুলো আর হাসপাতালে ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।‘—বলেছেন বম্বে হাসপাতালের এক প্রবীণ হৃদ্রোগবিশারদ। (টি এন এন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) ডি ই এস (drug eluting stent)-এর সর্বশেষ-রূপগুলোও মুম্বাইয়ের বেশির ভাগ হাসপাতাল থেকে এক নিমেষে উধাও।
২৯৬০০ টাকায় স্টেন্ট-এর দাম বেঁধে দেওয়ার আগে পর্যন্ত এই দু-রকম স্টেন্ট-এরই দাম ছিল দেড় থেকে দু-লাখ টাকা। বুধবার অনেক হাসপাতালেই অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি বাতিল হয়ে গেছে দাম নিয়ে নির্মাতা ও সরবরাহকারীদের মধ্যে টানাপোড়েনের ফলে।
মুম্বাই মেট্রোপলিটান এলাকায় বছরে প্রায় ১২০০০ অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি হয়। বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ের বেশির ভাগ হাসপাতালেই পুরোনো স্টেন্ট দিয়েই কাজ চালাতে হয়। গত দু-বছর ধরে, যেগুলো সেকেলে হয়ে গেছে বলে, আর ক্যাথ-ল্যাব-এ রাখা হত না।
যে ৫২ রকমের ডি ই এস ব্র্যান্ড এ-দেশে আমদানি হয়, বিশ্বমানের নিরিখে সেগুলোর গুণগত মানে ইতরবিশেষ তেমন নেই অথচ দামে এত বিপুল ফারাক কেন?—এটা একটা বিষম ধাঁধা—মন্তব্য করেছে এন পি পি এ। আমদানি-করা ডি ই এস-এর জন্যে খরচ পড়ে স্টেন্ট পিছু ১৬৯১৮ টাকা।
হাসপাতালগুলোর কারসাজি
স্টেন্ট-এর দাম আর তো ৩০০০০ টাকার ওপর নেওয়া যাবে না। মুনাফা তো একদম তলানিতে ঠেকে গেল! এই ডাহা লোকসান কী করে ঠেকানো যায়। ফন্দিফিকির আঁটা চলতে লাগল। ৫ কোটি দামের ক্যাথল্যাব মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কর্মীদের মাইনে বাদ দিয়ে বছরে অন্তত ২৫ লাখ টাকা তো চাই। সে জন্যে বাড়িয়ে দাও অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টির প্রক্রিয়াগত খরচ। এখন থেকে বিলে বাড়তি যোগ হবে জুনিয়র টেকনিক্যাল চার্জ, জুনিয়র কার্ডিয়োলজি চার্জ, সিনিয়র কার্ডিয়োলজি চার্জ, ক্যাথল্যাবে থাকাকালীন চার্জ, বাড়তি সার্জেন–এর চার্জ ও হাসপাতালে বাড়তি সময়ে থাকার চার্জ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হায়াদ্রাবাদের এক ডাক্তারের মন্তব্য: ‘স্টেন্ট ব্যবসায়ে হাসপাতালগুলোর বিশাল মুনাফা হয়, কিন্তু এন পি পি এ-এর নির্দেশের পর তাদের ব্যবসাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একটা উপায় হচ্ছে সবরকম প্রক্রিয়ার দাম বাড়িয়ে দেওয়া।’
শুধু কী তাই। যে সার্জারি-উপকরণগুলো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হয় (ডিসপোজেবল) সেগুলোকে ওরা বার বার ব্যবহার করে। যেমন ক্যাথেটার, গাইড অয়্যার, বেলুন ইত্যাদি।আর প্রত্যেক রোগীর থেকে নতুনের দাম নিয়ে নেয়। এই কায়দায় ওদের উপকরণ-পিছু ২০০০০-৩০০০০ টাকা লাভ হয়।
টি ও আই বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে, এই ব্যবসার চাবিকাঠি যাঁদের হাতে, যাঁদের মধ্যে কার্ডিয়োলজিস্টরাও আছেন, দুদিন আগেই গোপনে শলা-পরামর্শ করেছেন কী উপায়ে এই নির্দেশকে কলা দেখানো যায়—সাপও মরে অথচ লাঠিও ভাঙে না।
তেলেঙ্গানার ১৪৫টা ক্যাথল্যাব সেন্টারে মাসে ৬০০০ স্টেন্ট লাগে, যার মধ্যে রাজ্য সরকারের টাকায় আরোগ্যশ্রী প্রকল্পের ১০০০ স্টেন্টও আছে। এন পি পি এ দাম বেঁধে দেওয়ায় হাসপাতালগুলো পড়েছে মহা আতান্তরে—মন্তব্য করেছেন এই ব্যবসার খোঁজখবর রাখেন এমন একজন।
এইজন্যেই ফেটে গেল এতদিন সযত্নে লুকিয়ে রাখা বোমাটা। স্টেন্ট ব্যবসা এতটাই মুনাফা দেয় যে আমেরিকা থেকে আমদানি কিছু কিছু ব্র্যান্ডে ৮০০ শতাংশের ওপরও মুনাফা হয়। ম্যাক্সকিয়োর গ্রুপ হাসপাতালের এম ডি ডা. অনিল কৃষ্ণ বলেন: ‘১ লাখ টাকার ওপর দামের দামি স্টেন্টগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে ৪০০০০ টাকায় শস্তা দামের স্টেন্ট এখনও পাওয়া যাচ্ছে। এখন আর জৈব-শোষণযোগ্য স্টেন্ট বাজারে নেই, বহুজাতিক সংস্থাগুলো মনে করছে অযৌক্তিকভাবে দাম এতটা কমিয়ে দেওয়ায় ভারতের বাজার তাদের পক্ষে ব্যবসা করার অনুপযুক্ত।’ (টি এন এন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) তিনি স্বীকার করেছেন যে তাঁদের গোষ্ঠীতে অনেক কুলে কালি দেওয়ার লোক আছেন, যাঁরা পেশার বদনাম ছড়াচ্ছেন; কিন্তু তিনি এন পি পি এ-এর সঙ্গে কোনোমতেই একমত হতে পারছেন না যে হৃদ্রোগ চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সকলেই ওই এক গোত্রের।
স্টেন্ট-নৈতিকতা নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে বিতর্ক
এন পি পি এ স্টেন্ট-এর দাম বেঁধে দেওয়ার ফলে শুধু যে হাসপাতাল আর স্টেন্ট-নির্মাতারা জোর ঘা খেয়েছে তাই নয়, স্টেন্ট বসানোর যৌক্তিকতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও তুমুল বিতণ্ডা বেঁধে গেছে। এদেশে স্টেন্ট বসানো হবে কী হবে না, তা ঠিক করেন একজন মাত্র কার্ডিয়োলজিস্ট। কিন্তু কিছু উন্নত দেশে পদ্ধতিটা অন্যরকম। সেখানে একটি ‘হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ দল’ সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন। যে দলে থাকেন একজন কার্ডিয়োলজিস্ট, একজন কার্ডিয়োথোর্যাদসিক সার্জেন, একজন কার্ডিয়্যাক অ্যানাস্থেসিয়োলজিস্ট, একজন জেনারেল ফিজিসিয়ান ও একজন বাইরের লোক। এ দেশের সবথেকে খারাপ ব্যাপারটা হল, ঠিকঠাক রীতি মেনে স্টেন্ট বসানো হচ্ছে কী না তার নজরদারি করার জন্যে কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই। স্টেন্ট বসানোর কোনো মেডিক্যাল অডিটও হয় না।
নিজাম’স ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেস-এর কার্ডিয়োথোর্যাওসিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান ডা. আর ভি কুমার বলেছেন: ‘কয়েকটি উন্নত দেশে যেমন করা হয় তেমনটি না করে, তৃতীয় পক্ষের নজরদারি, মেডিক্যাল অডিট, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ দলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ব্যতীত রোগীর বুকে স্টেন্ট বসানোতেই স্টেন্টের বহুল অপব্যবহার হচ্ছে না তো।’ (টি এন এন, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যের বৃত্তে-র পত্রিকার ৩৩ তম সংখ্যায় ডা. গৌতম মিস্ত্রীর ‘বুকের ব্যথার ব্যবসা’ নিবন্ধটিতে একটু চোখ বোলানো যেতে পারে। তিনি লিখছেন: ‘তবে অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি কি একটি সর্বতোভাবে বাতিলযোগ্য চিকিৎসা? উত্তর হল, না। হার্ট অ্যাটাকের অব্যবহিত পরে চটজলদি প্রাইমারি অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি করে ফেলাটা সর্বোত্তম চিকিৎসা। সবরকমের ওষুধের দ্বারা বুকের ব্যথার উপশম করা না গেলেও ক্রনিক (ইস্কিমিক) হৃদ্রোগে অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি সাময়িকভাবে বুকের ব্যথার উপশম করতে পারে সেটাও ফেলনা নয়। এর বাইরে হৃদ্রোগের যে সুবিশাল অংশ পড়ে থাকে তাদের অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি করে বিশেষ কিছু পাবার থাকে না, কিছু ওষুধপত্র ব্যবহার করলেই চলে। রোগটি যে নির্মূল হচ্ছে না সেটা বলাই বাহুল্য। অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি অথবা গুটিকয় অতিরিক্ত ওষুধে—এ দুটোর দ্বারা যদি সমমানের কর্মক্ষম জীবন উপহার দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে চিকিৎসকের কর্তব্য হল দুটো বিকল্পকে রোগীকে বুঝিয়ে বলা।‘ (পৃ. ২১)
বিসমিল্লায় গলদ
দাম বেঁধে দেওয়ায় স্টেন্ট-এর ব্যবসাতে রোগীর পকেট লুঠ করে হাসপাতালগুলো কীভাবে মুনাফার পাহাড়ের ওপর চড়ে বসে, তার বেশ কিছু কথা ফাঁস হয়ে গেল। অনেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই ব্যবস্থা নেওয়াকে তারিফ জানালেন। স্টেন্ট নিয়ে হাসপাতালগুলোর মুনাফাবাজি কিছুটা মার খেল—এ কথাও সত্যি। কিন্তু এতেই কী সব মুশকিল আসান?
আজ গোটা দুনিয়া জুড়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবায় পুঁজিপতিরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছেন। কারণ একটাই। এই পরিষেবা-ক্ষেত্রে মুনাফার অঙ্ক এতটাই চড়া যে পুঁজিপতিদের চোখও কপালে উঠে যায়। অন্য আর পাঁচটা ব্যবসার থেকে এই ক্ষেত্রটি যে অনেক বেশি উর্বর সেটা বুঝতে তাঁদের এক মুহূর্তও সময় লাগেনি। সেইজন্যেই দেখা যায় বিশ শতকের শেষ দিক থেকে এদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য উদ্যোগের বোলবোলাও। কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের সরকারগুলোই এদের হাতে ধরে সাদরে ডেকে এনেছেন স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি বিধানের অছিলায়। এ কথা তো স্পষ্ট—যাঁরা ব্যবসা করতে এসেছেন, তাঁরা ব্যবসাই করবেন। চাইবেন আরও বেশি বেশি মুনাফা, সে ক্ষেত্র স্বাস্থ্যই হোক কী শিক্ষা কিংবা অন্য কিছু। গাছের গোড়ায় সার-জল দিয়ে পুষ্টি বাড়িয়ে তারপর দু-একটা ডালপালা ছাঁটলে কী আর তাকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা যায় বরং আরও ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে। স্টেন্টের বেলাও তাই ঘটছে। একটা দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে তো কী হয়েছে? আর দশটা থেকে ওই মুনাফা-ঘাটতি পুষিয়ে নেব—সে পথেই হাঁটছে হাসপাতালগুলো, স্টেন্ট-নির্মাতা ও সরবরাহকারীরা, সঙ্গে আছেন বেশ কিছু লোলুপ হৃদ্রোগবিশারদ।
অথচ ডা. শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশনের সুপারিশের বেলায় কেন্দ্রীয় সরকার চোখে ঠুলি এঁটে কানে তুলো গুঁজে চুপটি করে বসে আছে। কী সুপারিশ করেছিল কমিশন? কমিশনের মনে হয়েছিল যে রাষ্ট্র অনায়াসে দেশের আপামর মানুষজনের স্বাস্থ্য রক্ষার ভার নিজের হাতে নিতে পারে। তাহলে মানুষজন যে পকেটের কড়ি ফেলে চিকিৎসা করাতে করাতে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে পা বাড়ায়, তা ঠেকানো যায়। আর এর জন্যে সরকারকে খুব বেশি একটা কিছু করতে হবে না। স্বাস্থ্যখাতে সরকার এখন (২০১১) যা ব্যয় করে (মোট স্থূল উৎপন্ন বা জি ডি পি-র ১.৪ শতাংশ) তার থেকে ২০১৭-য় মাত্র কিছু শতাংশ বেশি (জি ডি পি-র ২.৫ শতাংশ) ও ২০২২-এর মধ্যে ৩ শতাংশ বরাদ্দ করলেই সরকার সবার জন্যে স্বাস্থ্যের ভার নিজের হাতেই নিতে পারে। কেন্দ্রে পূর্ববর্তী ইউ পি এ সরকারের আমলেই ডা. শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন এই সুপারিশ করেছিল। সেই সরকার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে টালবাহানা করছিল। শুধু তাই নয় দ্বাদশ পরিকল্পনায় তারা যে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা নীতি নিল, তা আসলে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের দিকেই পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ল। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জি ডি পি-র ১.৪ শতাংশ থেকে সামান্য বাড়িয়ে করা হল ১.৫৮ শতাংশ। বিশদে জানার জন্যে পড়ুন: শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ প্রকাশিত ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য: আমাদের অধিকার’ প্রচারপত্রটি। এর মধ্যেই কেন্দ্রে এসে পড়ল বিজেপি-র নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার। তারা এসে প্রথমেই যেটা করল: স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ২০ শতাংশ (৫০০০ কোটি টাকা) কমিয়ে দিল। স্বাস্থ্যখাতে খরচ ২০১১-র জি ডি পি-র ১.৪ শতাংশ থেকে আরও কমিয়ে ১.০০৪ শতাংশ করে দিল। স্পষ্টই বোঝা যায় কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কোনোরকম ইচ্ছেই তাদের নেই। এদেশে সরকারের মদতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পুঁজিপতিরা যে আরও অনেকদিন ধরেই দাপিয়ে বেড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকেই জানি, হয়তো অনেকে জানি না যে পৃথিবীর মোট ১৯৬-টি দেশের মধ্যে ৯৩টি দেশে সবার জন্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু আছে। তার মধ্যে ইংল্যান্ডের মতো ধনী দেশ যেমন আছে, তেমনি আছে গরিব দেশ শ্রীলঙ্কা। সেসব দেশে প্রাথমিক স্তর, মধ্যম স্তর এবং চূড়ান্ত স্তর—সব স্তরেরই মানুষজনের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে। সেসব দেশে মানুষজনকে পকেটের কড়ি ফেলে চিকিৎসা করাতে হয় না। প্রয়োজনীয় অর্থ জোগানের জন্যে রাষ্ট্র নানা বিকল্প ব্যবস্থা নেয়। সেগুলো সম্পর্কে ভালো করে জানতে উল্লিখিত প্রচারপত্রটি পড়ুন। স্বাস্থ্যের অধিকার আমাদের একটি মানবাধিকার। সে অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না। ১৯৭৮-এর সেপ্টেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আলমা-আটায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ২০০০-এর মধ্যে ‘সবার জন্যে স্বাস্থ্য’-র কথা ঘোষণা করে। তাতে ভারতও এক স্বাক্ষরকারী দেশ। সতেরো বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু আমাদের সরকার এখনও নানাভাবেই মানুষজনের স্বার্থ ও অধিকার উপেক্ষা করে দেশি-বিদেশি পুঁজিকে মদত দিয়েই চলেছে। যদিও মাঝে মাঝে স্টেন্ট-এর দাম বেঁধে দেওয়ার মতো এমন কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে যাতে মনে হতে পারে সরকার স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে।
রাজ্যে ভোজবাজি
কেন্দ্র এত ‘জনদরদি’ কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে; এ রাজ্যের ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকারই বা পিছিয়ে থাকে কী করে? কেননা বেশ আগে থেকেই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোলনলচে ঢেলে সাজাবার জন্যে একের পর এক ফরমান জারি করেছে, এমনকী ‘ফ্রি’-তেও চিকিৎসা করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদেরই একাংশে অভিমত: ফ্রি-তে ‘হ্যাঁচ্চো’র চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসাই করা যায় না। হবে কী করে? স্বাস্থ্য বিভাগের পরিকাঠামোর ব্যবস্থাটাই এমন যে সেখানে হাজার-এক ভালো ভালো ফরমান হাসপাতালের এ-গেট দিয়ে ঢুকে ও-গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। কথাটা যে সরকারের কর্তারা জানেন না তাও নয়। সরকারি হাসপাতালের হালহকিকত নিয়ে কিছু কথা না হয় পরে বলা যাবে। আর একটা কথাও আমরা সবাই জানি, এ রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষই চিকিৎসার জন্যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরই ভরসা করে, বড়ো বড়ো বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন হাতে-গোনা ধনী লোক ও সচ্ছল মধ্যবিত্ত। তবু তাদেরই জন্যে হালে স্বাস্থ্য রক্ষা নিয়ে রাজ্য সরকার কীভাবে ফের উঠেপড়ে লাগলেন, সেটাই বরং বলা যাক।
শুরুটা হয়েছিল হাসপাতাল ভাঙচুর দিয়ে। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে পেটের ব্যথায় ছটফট করতে থাকা কিশোরী সায়েকা পরভিনকে সি এম আর আই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার অপারেশনের জন্যে সি এম আর আই এক লক্ষ টাকা চেয়েছিল। সেই টাকা জোগাড় করতে না পারায় রোগিণীকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়েছিল বলে রোগিণীর বাড়ির লোকের দাবি। এমনকী তার শরীরের অবস্থা যখন খুব খারাপ হতে শুরু করে তখন কী চিকিৎসা হয়েছিল বা আদৌ হয়েছিল কী না—কিছুই নাকি জানানো হয়নি বাড়ির লোককে। রোগিণী মারা যায়। এলাকার লোকজন জড় হয়ে মারধোর ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনায় এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিল-এর অসংগতিতে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে (২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে ধরে ধরে কর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তাকে অনেকেই বেনজির বলে মনে করছেন। বস্তুত, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কর্তারা কীরকম ফাঁপরে পড়েছিলেন তা টিভির পর্দায় ও পরের দিনের কাগজে মানুষজন দেখেছিলেন। দু-একটি নমুনা:
অ্যাপেলো হাসপাতাল
প্রশ্ন: আপনাদের বিল বেড়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশ অভিযোগ করেছে। কেন? পাঁচতারা হোটেলেও এত খরচা হয় না।
কর্তৃপক্ষের উত্তর: আমরা দামি দামি রোবোটিক সার্জারি, পেট সিটিস্ক্যান ও রেডিয়োথেরাপি মেশিন ব্যবহার করি, সে জন্যে খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া বহু জায়গা থেকে সংকটাপন্ন রোগীদের আমাদের এখানে পাঠানো হয়, তাদের চিকিৎসাও বেশ খরচের ব্যাপার।
প্রশ্ন: মেশিন তো কেনেন ব্যবসার জন্যে। টাকা তোলার জন্যে একটু ধৈর্য ধরুন। কতগুলো মেশিন কিনেছেন যে বিল এত চড়া? সাধারণ মানুষের জন্যে তো একটা বাজেট বিভাগ খুলতে পারেন।
উত্তর: প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি বাজেট বিভাগ খুলব।
বেলভিউ ক্লিনিক
মুখ্যমন্ত্রী: আপনাদের পরিষেবা খারাপ হয়েই চলেছে। অনেক বাড়তি খরচ, নার্সিং পরিষেবাও ভালো নয়। আমি একটুও সন্তুষ্ট নই।
উত্তর: আমাদের নার্সরা সব সরকারি হাসপাতালে চলে যাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী: এতে সরকারের কী করার আছে! আপনারা ভালো মাইনে দিন ওরা থেকে যাবে।
সি এম আর আই
মুখ্যমন্ত্রী: ভাঙচুরের ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু আপনাদের বিলও তো খুবই চড়া।
উত্তর: কথা দিচ্ছি বিলে স্বচ্ছতা আনব আর সরকারের সব পরামর্শ খোলা মনে নেব।
আমরি
প্রতিনিধি: আরও স্বচ্ছতা দরকার—আমরা একমত। একটা ফিক্স প্যাকেজ শুরু করেছি। এতে প্যাকেজের ওপর এক টাকাও বেশি পড়বে না।
মুখ্যমন্ত্রী: রোগীর অবস্থা খারাপ হলেও টাকা নেবেন না? নাকি একরকম টাকায় ভর্তি করবেন আর নেবেন আর একরকম।
উত্তর: না ম্যাডাম।
রুবি হাসপাতাল
মুখ্যমন্ত্রী: এ বার রুবি মানে যেখানে মানুষ স্যাটস্যাট চলে যায় আর বিল বেড়ে যায়।
প্রতিনিধি: আমরা ম্যাডাম রোড ট্র্যাফিক অ্যাক্সিডেন্ট বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছি।
মুখ্যমন্ত্রী: রুবির চার্জ খুব বেশি। বিল বাড়ানো নিয়ে ভুরিভুরি অভিযোগ। রুবি রোগীদের রেকর্ড দিচ্ছে না। আপনারা ই-প্রেসক্রিপশন, ই-রেকর্ড চালু করুন।
মেডিকা
মুখ্যমন্ত্রী: জমি নিয়েছেন নিখরচায়?
উত্তর: না টাকা দিয়ে কিনেছি।
মুখ্যমন্ত্রী: লিজ নিয়েছেন বলুন।
উত্তর: হ্যাঁ, কিস্তিতে।
মুখ্যমন্ত্রী: অনেক টাকা আপনাদের। অনেক ইনকাম আপনাদের। তাহলে ইনস্টলমেন্ট কেন?
উত্তর: থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ।
মুখ্যমন্ত্রী: কিডনি চক্র বন্ধ হয়েছে আপনাদের?
উত্তর: কোনোদিনই ছিল না।
মুখ্যমন্ত্রী: ছিল তো। কেন্দ্র কাগজ পাঠিয়েছে আমাদের। কোর্টের ফিক্সড ল ছিল না বলে পার পেয়ে গিয়েছেন। ফারদার যেন না হয় এই সব চক্র।
কে পি সি
মুখ্যমন্ত্রী: লোক মরে গেলেও ছাড়েন না আপনারা। . . . মরে গেলে আর কার থেকে নেবেন।
উত্তর: ইয়েস ম্যাডাম। এটা একবার হয়েছিল তারপরে আর কোনোদিনও হয়নি। আর কোনোদিন হবেও না।
হাসপাতালগুলো সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী যা যা বলেছেন, তা এ রাজ্যের মানুষজনের সকলেরই কম-বেশি জানা। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো একটু খুঁটিয়ে পড়লে বেশ মজা পাওয়া যায়। সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নগুলোকে মরিয়া হয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেখানে পেরে ওঠেননি সেখানে উত্তরগুলো এতটাই জোলো যে তা পাঠকের হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে। কেউ বলেছেন, দামি মেশিনের জন্যে বিল বেশি; কেউ-বা নার্সরা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে বলে পরিষেবা ভালো দিতে পারছে না, পরোক্ষে মেনে নিচ্ছেন রোগীদের কাছ থেকে সরকারি হাসপাতালের থেকে অনেক গুণ বেশি টাকা নিলেও নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মাইনে দেন খুবই কম। আর একটা জবাব তুলনাহীন। মুখ্যমন্ত্রীর স্যাটায়ার ‘স্যাটাস্যাট চলে যায়’-এর জবাব: পথ-দুর্ঘটনার বিনা পয়সায় চিকিৎসা করা হয়। অর্থাৎ পথ-দুর্ঘটনায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা করলে রোগী তো মারা যাবেই। তবে এ সওয়াল-জবাব থেকে স্পষ্ট, হাসপাতাল কর্তারা, প্রত্যক্ষে হোক বা পরোক্ষে, অভিযোগগুলোর সত্যতা মেনে নিয়েছেন।
দু-দিন যেতে না যেতেই অ্যাপেলো হাসপাতালের নামে জুলুমের অভিযোগ। অ্যাপেলো থেকে রোগী সঞ্জয় রায়কে পি জি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় বকেয়া বিলের কয়েক লক্ষ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত অ্যাপেলো রোগীকে ছাড়তেই চায়নি। সারাদিন টালবাহানা করে রাত ন-টায় তাঁকে ছাড়া হয়। পরদিন ভোরে পি জি-তেই রোগী মারা যায়। মল্লিকবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নামে রোগীর পরিজনরা অভিযোগ করেন, চিকিৎসক বাইরে অথচ তাঁর নামে বিলে রোজ এক হাজার টাকা ভিজিটিং চার্জ। বর্ধমানের পি জি নার্সিংহোমে তপন লেট পেশায় কৃষিজীবী তাঁর সদ্য প্রসূতি মেয়ে চুমকিকে ভর্তি করান। বিল হয়েছিল ৪২০০০ টাকা। অত টাকা জোগাড় করতে না পেরে তপনবাবু গলায় দড়ি দেন। এই ঘটনাগুলোও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মুখ্যমন্ত্রীর ‘ধমকচমককে’ এরা কেউই খুব একটা পরোয়া করে না। যদিও মৃত সঞ্জয়ের স্ত্রী রুবি রায় ফুলবাগান থানায় এফ আই আর করলে রাজ্য সরকার তদন্ত শুরু করেন। সেই চাপে অ্যাপেলোর পূর্বাঞ্চলের সি ই ও রূপালি বসু ইস্তফা দেন।
দাওয়াই: নয়া স্বাস্থ্য বিল
নতুন স্বাস্থ্য বিলের খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, বামফ্রন্ট সরকার ২০১০-এর ২৯ জুলাই যে বিল ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড রেগুলেশন)’ পাশ করিয়েছিল তার সঙ্গে নতুন বিলে্র বিশেষ তফাত নেই। যদিও তখন তৃণমূল কেন্দ্রে আইন না হওয়া পর্যন্ত এই বিল পাশ করানোর কোনো যুক্তি নেই বলে এর বিরোধিতা করেছিল।
বিল এনে আইন করে স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীদের মুনাফাবাজির কতটা ঠেকানো যাবে সে নিয়ে ঘোর সংশয় আছে। সংশয়ের কারণও আছে। গোড়াতে বিলকে আইনে পরিণত করতে হবে; তারপর তার বিধি বা rules তৈরি করতে হবে, তবেই কর্পোরেট হাসপাতাল/নার্সিং হোমগুলো আইন মেনে চলছে কিনা তা সরকারের পক্ষে তদারকি করা সম্ভব। সরকার এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে মাথায় বসিয়ে একটি কমিশন তৈরি করেছে যার ওপর এই তদারকির ভার। কিন্তু কমিশনের রায় মানা-না-মানা নির্ভর করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নাগরিক অধিকারের ওপর। তারা আদালতে মামলা ঠুকতেই পারে। মামলা নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। যে মানুষজন চিকিৎসার খরচই জোগাতে পারেন না তাঁরা মামলার এত খরচ জোটাবেন কোথা থেকে? অনাবাসী ডা. কুণাল সাহা তাঁর স্ত্রী অনুরাধা সাহার চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এনেছিলেন আমরি-র বিরুদ্ধে। সে মামলা চলেছিল দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ডা. সাহা একে ডাক্তার তায় সচ্ছল মানুষ, তিনি পেরেছিলেন। আমজনতার পক্ষে কি তা আদৌ সম্ভব? ঢাকুরিয়া আমরিতে আগুন লেগেছিল। তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। ফের তো তাদের ব্যবসা চালাতে দেওয়া হল। ব্যবসার রমরমারও কিছু কমতি নেই। এছাড়া আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে আসার কায়দাটা যে উঁচুতলার মানুষের ভালোরকম রপ্ত, সে তো আমরা নিত্যরোজই দেখি। তার ওপর সম্প্রতি একটি বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উদ্বোধন করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন: তিনি বেসরকারি উদ্যোগের বিরোধী নন তবে সকলের থেকেই নৈতিকতা কাম্য। স্বাস্থ্য নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের থেকে নৈতিকতা আশা করা আর সোনার পাথরবাটি চাওয়া একই কথা। ব্যবসার লক্ষ্যই হল মুনাফা। আর নৈতিক উপায়ে কখনোই মুনাফা হয় না। সুতরাং বেসরকারি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে মানুষজনের ‘সবার জন্যে স্বাস্থ্যের অধিকার’ সুনিশ্চিত করা যায় না।
বিকল্প
রাজ্য সরকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে জেনেরিক ওষুধ চালু আরও টুকিটাকি কয়েকটি সংস্কার আনার অনেক আগে থেকেই (২০০২) শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ যে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে তার মূল কথাগুলো এইরকম:
এইভাবে আজও চলছে। উত্তরবঙ্গে তিন জায়গায় মাসে একটা করে মেডিক্যাল ক্যাম্প চলছে। বাঁকুড়ায়, সুন্দরবনের সরবেড়িয়ায় মোটামুটি এই একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা চলে। আরও বেশ কিছু সংস্থা এই একই পথে পা বাড়াচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য হলেও কিছু গরিব মানুষ অন্তত চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। এই পরীক্ষানিরীক্ষাও সরকারের সামনে তুলে ধরে, সামান্য অর্থেও যৌক্তিক বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব।
রাজ্য সরকারের মানুষজনের প্রতি আন্তরিক দরদ থাকলে ডা. শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ রাজ্যে অন্তত ‘সবার জন্যে স্বাস্থ্য’ প্রকল্পটি কাজে লাগানোর জন্যে এগিয়ে আসতে পারে। এ রাজ্যে স্বাস্থ্য-বাজেট খতিয়ে দেখে কতদূর কী করা যায় না যায় তা নিয়ে আলোচনা চালাতে পারে। যদি সত্যিই তা করা হয় তাহলে আমরা আগ্রহী। শুনছি নাকি নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে ডাক্তারি ছাত্রদের তাইকোন্ডো প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অর্থাৎ আত্মরক্ষার জন্যে মারামারি শিখতে হবে। কালে কালে হয়তো দেখা যাবে সব পেশার মানুষজনকেই বেঁচে থাকার জন্যে মারামারি শিখতে হচ্ছে। আমজনতা যদি তাদের হক আদায়ের জন্যে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হতে চায়, তবে তাদের কি খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে!
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, টাইমস নিউজ সার্ভিস, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি-৩ মার্চ, ২০১৭
•যে যে জায়গায় শুধু ‘হাসপাতাল’ লেখা হয়েছে সেগুলোকে ‘বেসরকারি হাসপাতাল’ পড়তে হবে।