৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস নিয়ে চারপাশের লোকজনেদের অনেক ভালো ভালো পোস্ট সোসাল সাইটে চোখে পড়লো। সেসব দেখে আমি নিজেও খানিক ভালো ভালো অভিজ্ঞতাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। ভেবে দেখলুম, ছড়ি, বেত, নীল ডাউন হওয়া আর কান ধরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো ভালো অভিজ্ঞতা আমার মাথায় আসছেনা।
শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের নিয়ে আদিখ্যেতায় ভেসে যাওয়ার দিনে এসব বাজে বকলে এ সমাজ কি আমায় মেনে নেবে?
মজার বিষয়টা হচ্ছে ইসকুল জীবনে যাদের কাছে মার খেয়েছি তাদেরকেই এই আধবুড়ো বয়সে দেখা হলেই প্রণাম ঠুকি। পেট চালাবার মতন কিছু একটা করতে পেরেছি জেনে তারাও বড্ড খুশি হোন। আশীর্বাদ করেন। চোখটা তখন অজান্তেই খানিক ভিজে যায়।
জীবন বড় অদ্ভুত। তাই না কালী দা?
কেমন আছেন এই বাংলার শিক্ষকেরা সেইটে জানার চেষ্টা খুব একটা হয়নি আজ অব্দি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ করে থাকতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়ত সেভাবে হয়নি।
সোসাল সাইটে এরাজ্যের শিক্ষকদের গ্রুপগুলোতে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় হল ডিএ। বকেয়া ডিএ কবে পাবো, কেন পাচ্ছিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।শিক্ষক আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত এক শিক্ষকনেতা আমায় একবার খুব আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন যে তিনি দুজন শিক্ষককে বকেয়া ডিএ নিয়ে থিসিসসুলভ আলোচনা করতে দেখেন কিন্তু কখনই কোনো ক্লাস লেসন নিয়ে আলোচনা করতে দেখেন না।
কথাটা উভয়তই সত্য। তবে এট্টু জিরেন দ্যান কর্তা। হেব্বি সিরিয়াস টপিক কিনা।
এইমুহুর্তে বাজারদরের প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের বেতন পর্যাপ্ত নয়। পোস্ট গ্রাজুয়েট স্কেলের শিক্ষকরা পান শুরুতে ওই ৩২ হাজার মতন। গ্রাজুয়েট স্কেলের শিক্ষকরা হাজার ছাব্বিশ মতন। প্রাইমারির শিক্ষকরা আরও কম। শুরুতে ওই ১৪-১৫ মতন। এগুলো একটু রকমফের হতে পারে। তবে মোটের উপর এটাই।
এসএসসি’র সুবাদে খুব কম শিক্ষকই বাড়ির কাছে পোস্টিং পান।বেশিরভাগকেই যাতায়াত করতে হয় বা বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হয়। ট্রেন যোগাযোগ না থাকলে বাসে যাতায়াত করতে বেশ ভালো খরচ হয়।
আজকের দিনে হাজার তিরিশ বেতন পাওয়া কারুর পক্ষে কি কোনো জেলাসদর শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে পরিবার সমেত সবকিছু কিনে খেয়ে খুব স্বচ্ছন্দে থাকা সম্ভব? উত্তর হচ্ছে না।
প্রপার শহর হলে দুকামরার বাড়িভাড়া গড়ে ছ-সাত হাজার টাকা। ইলেকট্রিক বিল আলাদা। অনেক জায়গায় জলের টাকাও নেয়। তার সাথে বাজার খরচ। পড়াশুনোর খরচ। ওষুধপত্র।
যদি পোস্ট গ্রাজুয়েট স্কেলের শিক্ষকদের অবস্থা এরম হয় তাহলে প্রাইমারি শিক্ষকদের অবস্থা কেমন?
আমি এক প্রাইমারি শিক্ষক কে চিনতাম। ভদ্রলোক বহরমপুর থেকে ধূলিয়ান যাতায়াত করতেন। রোজের ভাড়া আপ-ডাউন আশি টাকা। এরপরে সাইকেল গ্যারেজের ভাড়া আছে। ধূলিয়ান বাস স্টপে নেমে সেখান থেকে টোটোভাড়া আছে।কিছু বাস দু-পাঁচ টাকা কম ভাড়া নিত।
আমি দেখেছিলাম এক কাঠাফাটা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে সেই বয়স্ক শিক্ষকটি শনিবার দুপুরে হাফ ছুটির পর একের পর এক বাস ছেড়ে যাচ্ছেন সেই কম ভাড়ার বাসটির অপেক্ষায়।
হাজার কুড়ি বেতনের মধ্যে হাজার দুয়েক যায় যাতায়াতে। এরপরে ছেলেমেয়ের স্কুলের খরচ আছে। বাজার খরচ আছে। ওষুধপত্রের খরচ আছে।
লাটসাহেবের কুকুরের প্রতি ঠ্যাং এর খরচ কত মনে আছে তো?
অনেকের মনে হতেই পারে যে এই টাকাটা যথেষ্ট। এর থেকেও কম টাকাতে এদেশে লোকে জীবনযাপন করে থাকেন। কোনোটাই ভুল কথা নয়। তবে কিনা বিপিএল তালিকাভুক্ত লোকটিও তো স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার স্বপ্ন দেখেন । সেক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও খানিক স্বাচ্ছন্দ্য আশা করাটা অন্যায় নয় বোধহয়।
মুশকিল হচ্ছে শিক্ষকেরা বেতন বাড়াতে চাইলেই কিছু লোকের সমস্যা শুরু হয়। যে ভূমি রাজস্ব দপ্তরের করণিক উৎকোচ অর্থে মার্বেল শোভিত বাড়ি বাগান তিনি অব্দি শিক্ষকদের ডিএ’র দাবিতে অসন্তুষ্ট হোন।
শিক্ষক মানেই বুনো রামনাথ। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
এবারের কয়েনের উল্টোপিঠে আসি। ধরা যাক, শিক্ষকেরা প্রাপ্যের ৭০% বেতন পাচ্ছেন। তাহলে তো তার অন্তত ৭০% কাজ করা উচিত। সেটাও কি হয়?
রাজ্যের সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুলগুলোর গড়পড়তা হাল কিন্তু সেটা বলেনা। ASER নামের একটি বেসরকারি সংস্থা প্রতিবছর রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সার্ভে করে। আমিও কিছুকাল তাদের সাথে যুক্ত ছিলাম। বা প্রতীচির রিপোর্টও দেখা যেতে পারে। কোনোটাই কিন্তু আশাব্যঞ্জক নয়।
এই সোসাল সাইটেই আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলে শিক্ষকতা করেন অথচ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের ছেলে মেয়েকে বেসরকারি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে না পড়িয়ে সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলে পড়াচ্ছেন এরকম ক’জন আছেন। অ্যাকাডেমিকস নিয়ে একটু আধটু চর্চা করে থাকি। সেহেতু শিক্ষকতার সাথে যুক্ত পরিচিত লোকজন নেহাত কম নয়। দেখলাম ওই হাতেগোনা কয়েকজনকে পাওয়া গেলো যাঁরা নিজেদের ছেলে মেয়েকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি স্কুলে দেন নি।
তাহলে সরকারি স্কুলে পড়াশুনা হয় না, এই আপ্তবাক্যটা সেখানে যাঁরা পড়ান তারাও বেশ ভালোভাবেই বিশ্বাস করেন। তাই নয় কি?
এই পড়াশুনা না হওয়াটার দায় কি তাঁরাও এড়াতে পারেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে মোটামুটিভাবে যে উত্তরটা শুনেছি সেটা হল একটা ষাট সত্তর জনের ভিড়ে পূর্ণ ক্লাসে যেখানে অর্ধেক ছাত্রছাত্রী এর অক্ষরজ্ঞানটাই ঠিকঠাক থাকেনা সেখানে ঠিকঠাক শেখানোর আশা করাটা বাতুলতা মাত্র।
এখন মাস্টার মশাইদের অভিযোগটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। গ্রামের দিকে ক্লাস নাইনের লার্নার পাওয়া যাবে অনেক যে নিজের নামটাও ঠিকঠাক লিখতে পারেনা। থিওরি মাফিক একটা ক্লাসে তিন ধরণের লার্নার থাকে। অ্যাডভান্সড, মিডল আর স্লো। মাস্টার মশাই ক্লাসে গিয়ে দেখেন তিন নয় আদতে তিরিশ রকম লার্নার রয়েছে। বেচারা মাস্টারমশাই বিএড পড়তে গিয়ে শিখে এসেছেন যে ক্লাসে ওই মিডল লার্নারদের দিকে তাকিয়ে পড়াতে হয়। এবার ক্লাসে এসে ভ্যাবাচাকা খান এটা খুঁজতে যে কোনগুলো নর্মাল, কোনগুলো সেমি নর্মাল আর কোনগুলোই বা প্যারা নর্মাল। উপস্থিতির হিসেব নেওয়া, সার অমুকে মেরেছে তার বিচার করা আর পড়া ধরতে না ধরতেই ক্লাসের চল্লিশ মিনিট ফুস করে কেটে যায়।
কিন্তু এখানেই কি শেষ? প্রত্যেকটা ক্লাসে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী পিছিয়ে পড়া। তাদের আলাদা সময় দেওয়া সম্ভব নয়। বোঝা গেলো। কিন্তু খুব খারাপ ক্লাসেও পাঁচটা ভালো ছাত্রছাত্রী থাকে। তাদের তো ক্লাসের বাইরে অল্প সময় দিলেই চলে। সেটাও কি মাস্টার মশাইরা দিয়ে থাকেন?
এইখানে খুব জরুরি ভূমিকা ছিল বিএড কোর্সটার। বিএড এ মূলত শেখানো হয় যে কীভাবে পড়াতে হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা এই রাজ্যে বরাবরই অবহেলিত হয়ে এসেছে। আদ্যিকাল থেকে বিএড হচ্ছে কোনোরকমে শেষ করার মত একটা ডিগ্রি। সব্বাই ধরে নিলেন যে এমএ বা এমএসসি পাশ করা মানেই শিক্ষক হবার যোগ্যতা অর্জন করা। এমএ বা এমএসসি মানে সেই বিষয়ে মাস্টার হওয়া। সেই বিষয়টা কীভাবে পড়াতে হবে সেটা শেখার জায়গা কিন্তু বিএড।
ক্লাসরুমে পরিবেশ কীভাবে বজায় রাখবেন। পিছিয়ে পড়া ছেলে মেয়েদের কীভাবে চিহ্নিত করবেন। ডিস্লেক্সিয়া বা ডিসগ্রাফিয়ায় কেউ ভুগছে কিনা সেটা কীভাবে ধরবেন। কেউ ম্যালঅ্যাডজাস্টমেন্টের শিকার কিনা সেটা কীভাবে দেখবেন। কোন টিচিং স্ট্র্যাটেজিতে কোন টিচিং এইডসের মাধ্যমে পড়ালে সবচেয়ে ভালো ফিডব্যাক পাবেন। এ সবকিছু শেখার জায়গা কিন্তু ওই বিএড।
কিন্তু সেটা তো এই রাজ্যে নাম কে ওয়াস্তে পড়ানো হয়। পাশ করলেই হল। অগত্যা হবু শিক্ষক কীভাবে পড়াতে হবে সেসব কিস্যু শিখলেন না। ক্লাসে এসে নিজের অভিজ্ঞতামাফিক পড়ালেন। সেটা হয়ত খুব খারাপ হলনা। কিন্তু বিএড ঠিকঠাকভাবে করালে রেজাল্টটা আরও ভালো হতে পারতো।
এবার আসবে পরিকাঠামো। সর্বশিক্ষার কল্যাণে প্রচুর ক্লাসরুম হয়েছে। কিন্তু আদর্শ ছাত্র শিক্ষক অনুপাত মেনে চলা হচ্ছেনা। অজস্র শিক্ষকপদ ফাঁকা।স্কুলে কম্পিটার প্রোজেক্টর এম্নিই পড়ে থাকে।কেউ কেউ হয়ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবহার করেন।অসংখ্য আপার প্রাইমারি জুনিয়র হাইস্কুল হয়েছে যেগুলোতে সব বিষয়ের শিক্ষক অব্দি নেই। মেইন আকাডেমিক আর কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ এর পরিকাঠামোগত বিষয়ে ভালো বেসরকারি স্কুলগুলো যখন তখন পাঁচগোল দিয়ে যাচ্ছে সরকারি স্কুলগুলোকে।
তার উপরে যুক্ত হয়েছে গুচ্ছের নন অ্যাকাডেমিক কাজ। মিড ডে মিলের হিসেব রাখা।ডাইস,কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, মাইনরিটি’র ফর্ম জমা দেওয়া, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলানো, ড্রেস, ব্যাগ, জুতো, সাইকেল বিলি করা। প্রতিদিন নানাবিধ রিপোর্ট পাঠানো। এগুলো কোনোটাই অপ্রয়োজনীয় বলছিনা। কিন্তু এটাও সত্যি যে এই কাজগুলোর জন্য কিছু শিক্ষককে সময় দিতে হয় সব স্কুলেই। এমনিতেই শিক্ষক কম। আর কিছু শিক্ষক যদি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন তাহলে অ্যাকাডেমিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
এখানে একটা মজার বিষয় আছে। এই যে জামা, জুতো, সাইকেল সবই কিন্তু সোসাল ইনসেনটিভ, অর্থাৎ স্কুলে আসার জন্য এক ধরণের উৎসাহভাতা বলা যেতে পারে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এবং শিক্ষকবিহীন স্কুলে এসে কি ঘোড়ার ডিম লাভ হয় সেইটে নিয়ে কারুর কোনো ভাবনা নেই।
ভাবখানা এই যে স্কুলে তো এসেছে। এই ঢের। আর সব্বাই লেখাপড়া শিখলে দেশটা চলবে কী করে সার?
সবচেয়ে গোলমালের জায়গাটা হচ্ছে প্রাইমারি এডুকেশন। সব থেকে অবহেলিত। গ্রামের দিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা ক্লাস ফোর পাশ করে আসে তারা ইংরেজি দূরে থাক, বাংলাটাও ঠিক করে লিখতে পারেনা।ক্লাস ফাইভে এসে এদের নতুন করে কিছু শেখানোটা বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রাইমারি এডুকেশনের আগাগোড়া সংস্কার না করলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হওয়া অসম্ভব।
তাহলে কি অনন্ত অভিযোগমালাতেই দায় খালাসের পালা সাঙ্গ হবে? নিম্নোক্ত কারণসমূহের জন্য সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলগুলোতে পড়াশুনো হয়না এবং এ বিষয়ে শিক্ষকদের কোনো দায় নেই ধর্মাবতার।
এই ওকালাতানামাটুকু দেগে দিলেই কি দুই দুই এ চার হয়ে যাবে?
আজ্ঞে না। হবে না। শিক্ষকতা কিন্তু আর পাঁচটা পেশার মতন নয়। এবং এমএ বা এমএসসি পাশ করলেই কিন্তু কেউ শিক্ষক হয়ে যায় না। শিক্ষকতা করা মানে মানুষ তৈরি করা।ছাত্র-ছাত্রীকে নিজের ছেলে মেয়ের মতন ভালোবাসতে হয়। যিনি শিক্ষক হবেন তার একটা ছাত্র-দরদী মন থাকতে হবে।
ভবের বাজারে এই ছাত্র-দরদী মনটারই আজ বড্ড অভাব।
শিক্ষকতা বর্তমানে দশটা-পাঁচটার চাকরির মতন হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে অংক পারতুম না বলে যে মাস্টার মশাই আমাকে থাপ্পড় কষাতেন, তিনিই মাধ্যমিক টেস্টের আগে বাড়িতে ডেকে অংক করাতেন যাতে পাশটা করতে পারি। যখন লেটার পেলাম। মাস্টার মশাই আনন্দে কেঁদে ফেললেন।
সেই মাস্টার মশাইরা কোথায় গেলেন?যাদের স্কুল ছাড়ার সতেরো বছর পরেও রাস্তায় দেখলে ছুটে গিয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে।আমাদের প্রতিষ্ঠার গর্বে যারা গর্বিত হোন। তাঁরা কি সত্যিই হারিয়ে গেলেন? ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে প্রাণ ব্যাপারটা কি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা?
হারিয়ে বোধহয় যান নি। তবে সংখ্যাটা তো কমেছে ভালোই। শিক্ষকতা নিছক চাকরিতে পর্যবসিত হচ্ছে। তবে এরমধ্যেই কোথাও না কোথাও রূপোলি তো দেখাই যায়। SCERT এর প্রোজেক্টে গিয়ে দেখেছিলাম প্রত্যন্ত জেলা স্কুলগুলোতে কিছু মাস্টার মশাই সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে স্কুলের ছেলে মেয়েদের জন্য কত কী করে যাচ্ছেন।অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোতেই ছাত্র-দরদী শিক্ষকেরা মানুষ তৈরির আলোকবর্তিকাকে জ্বালিয়ে রাখছেন ভব্যিষতের জন্য। তারা দেখাচ্ছেন কীভাবে ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে অনেক পরিকাঠামোজনিত অভাব সহজেই ঢেকে দেওয়া যায় কী সহজে।
এই হাজার অন্ধকারের যুগে এইসমস্ত মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের প্রণাম রইলো।
বেশ একটা পজিটিভ এন্ডিং পাওয়া যাচ্ছিল। এইখানেই লেখাটা শেষ করে দিলে ভালো হত। তবে কিছু অপ্রিয় কথাবার্তা না বললেই নয়।
স্বীকার করি বা না করি শিক্ষা এই মুহূর্তে একটি প্রথম সারির পণ্য। গ্রামের দিকের স্কুলগুলোতে ড্রপ আউটের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখেছিলাম গরিব অভিভাবক প্রশ্ন করছেন, ‘সার, পড়িয়ে কী হবে?’। অর্থাৎ, আমাদের সরকারি শিক্ষা কর্মসংস্থানমুখী নয়। এইখানে কেউ বারো ক্লাস পাশ করলেও কোনো কাজের নিশ্চয়তা পায় না।এবং ফ্রি এডুকেশন বলে যাই বমি করা হোক না কেন, শিক্ষাটা কিন্তু এখনও সেই অর্থে ফ্রি নয়। দু-আড়াইশো টাকা বছরে স্কুলের বেতন লাগে। খাতা কলম কিনতে হয়। অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। স্কুলে পড়াশুনোটা হবেনা ধরেই আগাম প্রাইভেট দিতে হয়।সব মিলিয়ে খরচটা কিন্তু খুব কম হয়না।
এবং এই ‘প্রাইভেট পড়ানোটা’ মাঝে মধ্যে খুব লজ্জার ঠেকে। মুর্শিদাবাদ বীরভূম সীমান্তের একটি গ্রামের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। স্কুলের ছেলে মেয়েরা কেন পড়ছেনা তার উত্তর অভিভাবকের কাছে চাওয়া হয়েছিল। গরিব অভিভাবকেরা জানিয়েছিলেন যে তাঁরা তো প্রাইভেট এ ভর্তি করে দিয়েছেন নিজেদের ছেলে মেয়েকে। তাও তারা কেন শিখছেনা সেটা বুঝতে পারছেন না।
বাংলার শিক্ষক কুলের সামান্য প্রতিনিধি হিসেবে মাথাটা নিচু হয়ে গিয়েছিল। কারণ এই প্রায় অশিক্ষিত মানুষজনও কিন্তু নিজের ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের উপর ভরসা করছেন না।
আগেও বলেছি যে ঘাটতি কিন্তু শুধু পরিকাঠামোতে নেই। শিক্ষকদের মানসিকতাতেও আছে। অনেক শিক্ষক প্রাইভেট ট্যুইশনের টোল খুলে বসে থাকেন। কয়েকশো ছাত্র পড়ান। যে মাস্টার মশাই সকালে বিকেলে চারটে করে ব্যাচ পড়াচ্ছেন তিনি স্কুলে গিয়ে কী করে পড়াবেন? তিনি তো আর অতিমানব নন। এবং স্কুলে তো আর কৈফিয়ত নেওয়ার কেউ নেই। চল্লিশটা মিনিট কাটিয়ে আসতে পারলেই হল। জেলার খুব বড় স্কুলে গিয়ে দেখেছি মাস্টার মশাই চেয়ারের উপর বসে পায়ের উপর পা তুলে ‘অ্যা্য, তোরা রিডিং পড়’ বলে ঝিমোচ্ছেন।
শিক্ষকেরা এ সমাজে কিন্তু শ্রদ্ধা হারাচ্ছেন। ধারাবাহিক সামাজিক অবক্ষয়ের সার্বিক কুপ্রভাব তো আছেই। তবে এর সাথে একটা বড় অংশের শিক্ষকদের ফাঁকিবাজির ভূমিকাও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন সৎ শিক্ষকেরা।
সংবিধান অনুসারে শিক্ষা পাওয়াটা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে বকলমে প্রতিষ্ঠিত সত্য হল যে সরকারি স্কুলে কোয়ালিটি এডুকেশন পাওয়া যায় না। তার জন্য বেসরকারি স্কুলে যেতে হয়।চারিদিকে বেসরকারি স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি কিন্তু বেড়েই চলেছে।
সম্ভাব্য বিপদ টা দেখতে পাচ্ছি কি?এক শিক্ষাবিদ বন্ধুর কাছ থেকে শুনছিলাম যে ক’দিন আগেই নীতি আয়োগ একটা হুমকি দিয়েছে যে এত টাকা ঢেলেও যখন সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছেনা তখন তা বেসরকারি করে দেওয়াটাই ভালো।
সরকার পর্যাপ্ত বেতন দেয় না, পরিকাঠামো অপ্রতুল- সব সত্যি। তবে এর সাথে আমাদের মানসিকতাকেও প্রশ্ন থাকুক। পেটে লাথ পড়ার আগে ঘুরে দাঁড়ানোটা কিন্তু জরুরি।