।। *লক্ষীসরা* ।।
বিজলি আজ খুব ব্যস্ত। তাহেরপুরে সক্কালবেলাতেই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা নীহর পড়ে আজকাল। কাল নক্ষীপূজো, সরাগুলান আজ কালিনারায়নপুর হাটে নিয়ে যেতি হবে। এই নক্ষীপূজোতেই সরা বেচি দুপয়সার মুখ দেখতি পায় বিজলিরা। শান্তিপুরী সরা, জটূলিদাদুর মুখে শুনেছে বিজলি কত রকমের সরা আছে, ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা আর বিজলীর মা খুড়িমারা যেটা আঁকে সেই শান্তিপুরী সরা। আগে ঘরে ঘরে নক্ষী'মার মুর্তি পূজো হতো না, সরাপূজোই হোত বেশি ঘরে। ফরিদপুরী সরা চৌখুপি, মা নক্ষীর চিত্র আঁকা সবেতেই, এই সরা বেচেই দু পয়সা এই কোজাগরী পূজোর আগে।
বাপটাকে বলতি হবে দুলাল কাকার ভ্যানটা নিয়ে সরাগুলান পৌঁছে দিতে। রাতে কি ছাঁইপাঁশ গেলে দিনভর বাপটা পড়ি পড়ি ঘুমায়। কালিনারায়নপুর ইষ্টিশানের পাশের বিলে জলসিঙারার তুলার ইজারা নিছে ঠিকাদার, জলের উপর লতিয়ে আছে পানি ফলের লতাপাতা, ডুব দিয়ে এক নিঃশ্বাসে তুলতি হয় সিঙারাফল, এক কুড়ি দশ টাকা দেয়, ভাইটা এখন সকাল হলিই চলি যায় সিঙারাফলের চক্করি; কোন সুবিস্তা ভাইয়ের থেকে হবিনি।
এখুন তো ইসকুলও বন্দ, আগে তাও খেতি দিত বলি তাও ইসকুল যেত। পড়ার চেয়ি যায় বেশি প্যাটের টানে। ইসকুলির খাবার পর ঘন্টা ঢং ঢং হলিই দে ছুট বাড়ি বলি ব্যাগ বগলে।
এখন শাকসবজি ফল মূলের আগুনপারা দাম, কি এক রোগির জন্যি কারুর কোন কাজ নাই, বিপিএল কাডের চালটুকুই পায় বিজলিরা, চারটে প্যাট, মাসের রেশন চালে দশ দিনও চলে না। গোপালদাদা, ভীমখুড়োরা আর টেরেনে হকারি করতি যায় না। টেরেন বন্ধ। কবে চলবে কে জানে ?
এখন বাড়িতি বিজলিই ভরসা, মা'টা সরা আঁকে ভালই, কিন্তু হাঁপিয়ে যায় একটুকুতেই, কয়দিন শরীরটাও খারাপ, বিজলি পয়সা জমালি একবার কেষ্টনগরি নে যেয়ি বড় ডাক্তার দেখাবে। সরার সাথে ধানের শীষের ছড়া, দুই কুড়ি ডিজাইন ছড়া নিয়ে এসিচে বিজলি গোকুলদাদার কাছ থিকি, বিক্কিরি হলি আজকেই পয়সা ফিরট দিতি হবে। আর নাল শাপলা, খরিদ্দার বাবুরা বলে পদ্ম। সেটা তুলে নিয়ে আসে দুলকি বিলের থেকে। ওর পাশে হাটে বসে বেচে, লগনসা ২০ ট্যাকায় বিক্কিরি এক একটা ফুল।
গেরামে বাপটার বদনাম আছে, লোকে বলে চোর, বার দুই পুলিশও ধরে নে গেছিল, তাহিরপুরির থানাতে মা গিয়ে পুলিশবাবুদের হাতে পায়ে ধরি ৫০০ ট্যাকা দিয়ে ছেইড়ে নে এসছে বাপটাকে দু দুবার। তবুও শিক্ষা হবেনি। কাল রেতে বলছেল, নক্ষীপূজোর রাইতে যখন ফটফটি জ্যোস্নায় দিগ্বিবিদিক ভেসি যায় তখন গেরস্থির ঘরি চুরি করতি পারলি তাকে বলে উস্তাদ চোর।
বিজলিকে সক্কাল সক্কাল হাটে পৌঁছতি হবে, ভ্যানে বসি বিজলি দ্যাখে চখাচখির ওড়াউড়ি, শাপলা ফোটা বিল, কচুরিপানা আর কুচোশ্যাওলা ভরা জমিদারী পুকুর, রোদ তেতি উঠছি, হাটে গি তিরপল টানাতি হবি, বিজলি কোমরে একবার পয়সার থলিটা পরখ করে। মা বাপটার জন্যি এক পয়সা ঘরেতে রাখেনি, হালদারজেঠির কাছে জমা রাখে।
বেচাকিনা শেষ, দিনের আলো মরি আসছে, সারাদিনে একবারও ভাত খেতি পারেনি বিজলি, শুধু পাউরুটি ঘুঘনি, এখনও দুটো সরা পড়ি আছে; আজ নক্ষীপূজো কাল তো আর কেউ সরা কিনবেনে। তিরপল গুটোতি গুটোতি ভাবে বিজলি আজ সরা দুটোতে মা নক্ষীর পূজো চড়ালি কেমন হয় ?
তাদের ঘরি কি মা নক্ষী আসবিনি ? কি মনে করি একটা বাতাসার প্যাকিট, আর ২০০ গেরাম খই নিলে বিজলি হাটের দুকান থিকে, লাল শাপলা ও একটা দিয়ে গ্যাছে দুলকি, আস্তে আস্তে গাঁয়ের পথ ধরে বিজলি। রাত হই গ্যাছে। কোমরের পয়সার থলিটা ভারিই লাগছে।
আজ নক্ষীপূজো। সাদা ফটফটে জ্যোস্নায় খাল বিল ভেসি যাচ্ছে, তাহিরপুরি ঢোকার মুখে লাইটপোষ্টটাতে হলুদ আলো। ঐ তো ওদের ঘর, খাপরা ছাওয়া। কিন্তু উঠোনে এত লোক কেন ? কমলার মা, জোচনজেঠা, রাঙি টুনিরা, দেখে মা'টা শুয়ি আছে বারান্ডায়, একটা সাদা চাদর ঢাকা, বাপটা মাথা ধরে বসি, কি হোল কি ? দিন তিনেক ধরি জ্বর হইছিল বটে, আশাদিদিরা ওষুধও দিইছিল, কিন্তু এমন জ্বরজালি তো বিজলিরও হয় কখনোসকনো।
বিজলিরে...... বলে ডুকরি উঠল বাপটা তোর মা' আর নাই রে, চলি গেল কোজাগরী তে; নক্ষীঠাকুরির কাছে ঘরের নক্ষী চলি গেল।
নক্ষীপূজোর খই-বাতাসা ফুল হাতে নিয়ে এক নক্ষীর শোকে পাথর হই বসি থাকল ভবিষ্যতের নক্ষী বিজলি সেই নক্ষীর সরা দুটো সামনে রেখি।।
*সমরজিৎ জানা*