এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • নবারুণ ভট্টাচার্য : সখা আঁতলেমি কারে কয়?

    অরুণা মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৫ আগস্ট ২০১৬ | ১৫৫২ বার পঠিত
  • নাকি পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে হাত ব্যথা হয়ে গেলেও কিসস্যুটি মিলবে না। নবারুণ ভট্টাচার্য এবং তাঁর লেখাদি সম্পর্কে কথাটা বললে উত্তরে বলতে হয়, মশাই, হয় আপনি সাহিত্য বোঝেন না নয় আপনার মস্তকের ভেতরের মালটি কালাহাণ্ডি পাঠিয়েছেন। যেহেতু গ্যাসের গৌরবে ঘুঁটে এবং গোবরের হাসার কাল গত, অতএব সে তুলনা দিতে বিরত থাকতে বাধ্য হতে হল। ‘হারবার্ট’ থেকে ‘কাঙাল মালসাট’ যাঁরা পড়েছেন (অবশ্য কজন হজম করতে পেরেছেন সন্দেহ আছে) তাঁরা আশা করি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে সর্বত্র নবারুণ আঁতেলদের বাতেল্লা মারার ঝোঁকের ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ মেরে ছেড়েছেন। এই ভাষায় একজন মহিলা হয়ে নিবন্ধটি লেখার জন্য এখনও জীবিত কিছু রানি ভিকটোরিয়া জমানার ডায়নোসর (ক্ষমা করবেন, ডাইনি কহি নাই অবশ্যই) গণ দুইটি চক্ষু কপালে তুলিয়া স্মেলিং সল্ট ঢুঁড়িবেন। বেগম জনসন অথবা দণ্ড বায়সটি কাছেপিঠে থাকিলে কি কইতেন (‘কাঙাল মালসাট’ যাঁরা এখনো পড়েননি অথবা রাবিশ ট্রাশ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন দ্রষ্টব্যটি, সেইসব কুইন ভিকটোরিয়া আমল আঁকড়ে থাকা যে পথে চলেছি সে পথেই চলব; আবার দ্রষ্টব্য : কুমার রায়ের ‘গ্যালিলিও’ নাটকের সেই বিখ্যাত দৃশ্য এবং ডায়লগটি) তাদের জন্য, জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, নবারুণের ইনভেনটিভ এবং ইনোভেটিভ ভাষা ও অ-নকলিয় শৈলি পড়ে বলতে প্রাণ চায়, স্ল্যাঙস্য স্ল্যাঙের গুরু, আহা, তোমার লগে লগে যদি ঘুরিতে পারিতাম তাইলে একলব্য নাও যদি হইতাম, অর্জুন, কর্ণ কিছু একটা হইয়া এমন মস্তিষ্ক জগতটি পতিত করে না ফ্যালাইয়া রাইখ্যা কিছু আবাদ তো অন্তত করা যাইত। অন্তত ঝোলা কাঁধে হাঁটু-ঝুল কুর্তা পরে কফি হাউস সরগরম করা সবজান্তা বাত সর্বস্ব আঁতেলগুলির বেলুন ফুস করার অম্লান বিশুদ্ধ সুনির্মলবাচক বিশেষণাদি যুক্ত আনন্দে এভাবে বঞ্চিত হতে হত না।

    একটু ভুলে যাওয়া আর না পড়তে চাওয়া সৈয়দ মুজতবা আলির স্টাইলে বলা যাক (এই সুযোগে তাঁকে স্মরণ তো করা যাবে, আর কিছু হোক না হোক), কিন্তু এহ বাহ্য। মূল বক্তব্যে চলে আসা যাক তাহলে। শিরোনামটি আরেকটি বার ভাল করে লক্ষ্য করতে অনুরোধ করি — সখা আঁতলেমি কারে কয়? ফরাসি ভাষা যাঁরা রপ্ত করেছেন তাঁরা জানেন — আমরা যারা ইংরিজি জ্ঞানের গুমরে/ঠেকারে (আবার দ্রষ্টব্য কারণ অতি সম্প্রতি শ্রদ্ধেয়া লীলা মজুমদার স্মরণ সভায় বিস্মিত চকিত আহত অবাক কর্ণে শুনে এলাম আধুনিক প্রজন্ম তাঁর বই তো দূর, নামটুকুও শোনেনি কেউ। তিনিই যখন বিস্মৃত তখন গিরীন্দ্রশেখর আর কি এমন বাড়তি সৌভাগ্য করিয়াছেন যে ‘লাল-কালো’র লাল রানির রূপের ঠ্যাকারে অস্থির কালো রানি না খেল চিনি না খেল গুড় মনে রাখতে হবে?) ডার্টি গ্রাসরুট বাংলা ভাষার ধুলো লাগার ভয়ে মাটিতে পা ফেলতে না চেয়ে হাই-হ্যালোর হ্যালোজেনে উদ্ভাসিত হই যেহেতু যুগটা বাংলিশ মিডিয়ম শিক্ষিত করতে চাওয়া বাপ-মায়ের আদুরে নাডু নয়, কুরকুরে চিবনো হ্যারি পটার বিমোহিত নাড়ুগোপালদের — ইনটেলেকচুয়াল কথাটি সেই ইংরিজির দৌরাত্ম্যে মার খাওয়া ফরাসি আঁতেলেরই অপভ্রংশ না হলেও সহোদরা বটে। আঁতেল শব্দটির ফরাসি শেকড়টি না জেনেই যাঁরা যত্রতত্র আকছার ব্যবহার করে থাকেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে এই উল্লেখ।

    লেখাটা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ান দিয়ে শুরু করাটা নেহাৎই অপ্রাসঙ্গিক ঠেকতেই পারে আর সেজন্যই একটু খোলসা করা দরকার মনে হচ্ছে। যেমন পেঁয়াজের ওপরের খোসাটা শুষ্কং কাষ্ঠবৎ অগ্রে তিষ্ঠায়, ছাড়ালে কে বলে নাই নাই হেথা কিছু নাই, ভেতরের ঝাঁঝাল টইটম্বুর রসের জ্বালায় বিখ্যাত শেফ কাপুর সায়েবেরও চক্ষু অশ্রুমান হয়ে ওঠে, অর্থাৎ নির্ঘাৎ বেশ কিছু শাঁসাল মাল পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি নবারুণের গপ্প(!?)গুলির ঝাঁঝে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা মায় তাবৎ মস্তিষ্ক (অবশ্যই সেটি যথাস্থানে বিরাজমান থাকলে তবেই) ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। জগত নিন্দুকময়, সুতরাং নবারুণই বা তাদের কৃপাধন্য না হইবেন কেন? কেউ কয় এক্কেরে ফালতু লেখে লোকটা। পেছনে ঘটকাদি পরিবারের স্ট্যাম্প মারা, তায় আবার বিশ্ববিখ্যাত মাতা ঠাকুরানির একমাত্তর দুধের বাছা, তাই লোকেরা বাধ্য হয়ে পেরাইজ টেরাইজগুলো নিজেদের পিঠ বাঁচাতে গছাচ্ছে আর কি, নইলে ওর লেখায় গাদাগুচ্ছের লোয়ার ক্লাসের থার্ড রেট গালাগালি ছাড়া আছেটা কি? বাকি পণ্ডিতমন্য জনগণমন শীয়র আঁতলেমি বলে স্রেফ নস্যাৎ করেটরে মহাসুখে নিদ্রার চেষ্টায় রত হন কারণ ভটচাজ মশাইয়ের হাটে হাঁড়ি ভাঙাতে অনেকের কপালেই বিনিদ্র রজনী যাপন করার সুদুর্লভ দুর্ভাগ্য জুটিয়াছে যে! তাহলে মনে হয় পেঁয়াজ-প্রসঙ্গ অবান্তর না ঠেকে কিছু কিছু বুঝি বলে মনে হচ্ছে এবার। মোদ্দা কথাটি হল, নবারুণের লেখায় সোজা সাপটা আদি রসাত্মক প্রেম ট্রেম অথবা তথাকথিত বাজার ক্যাপচার করা আনন্দময়ী জবর বিকিকিনি (বিকিনি খুলে ফেলার মতো রগরগে বর্ণনাসহ)র গল্প উপন্যাস কাহিনি কবিতা গরহাজির। আদি রসের অনটন নেই বটে তবে মূল বক্তব্যে পৌঁছতে গেলে এত পরতের পর পরত ছাড়াতে বুদ্ধিটিকে ভালমত খরচা করতে হবে যে ‘কাঙাল মালসাট’ গুলপট্টি, ‘হারবার্ট’ নিছক ভৌতিক নকল কল্পবিজ্ঞান লেখার বিফল প্রয়াস ইত্যাদি ইত্যাদি মনে করাটা খুবই স্বাভাবিক কারণ উইদ ডিউ এ্যাপোলজি, পাঠককুলজাত সাহিত্যের মুখে চুনকালি মাখান কুলাঙ্গার অপোগণ্ডগণ গ্রন্থপাঠের কালে বুদ্ধিটিকে (মেরুদণ্ডটিকেও) পকেটস্থ করিতে অধিক আত্মশ্লাঘাযুক্ত তৃপ্তিলাভ করিয়া থাকেন। এমত মতামত গোচরে প্রকাশ করার জন্য আশা করি আমাকে মানহানির মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে না। কারণ ইহ দেশ এবং দেশবাসীগণ ডেমোক্র্যাসিতে ঘোর আস্থাবান। আর সপক্ষে তো প্রসন্ন গোয়ালিনি বহু পূর্বেই বঙ্কিমচন্দ্র মারফৎ যুক্তি-তক্কো হাজির করেই গেছেন। ভাগ্যিস! অতএব অরসিকেষু রস আর নিবেদনং ইতি করে সহজ কথাটা সহজভাবেই বলে দিই — তামাম ফ্যাতাড়ু, ‘কাঙাল মালসাট’, ছোটগল্প ইত্যাদিতে নবারুণ বেগম ভিকটু স্টাইলের বিশ গজি গাউনের ল্যাজের ডিসেন্সি ডেকোরমের পর্দা ফাস করে সমূহ নেতা এবং ন্যাতাদের ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচন-কোঁদনটি তাঁদের আঁতে ঘা মেরেই বুক চিতিয়েই আশু বিপত্তির কু-ডাক আশংকাকে তুড়ি মেরে উড়িয়েই খোলাখুলি দেখানর হিম্মত করতে ছাড়েননি। সার্থক আঁতেল তিনি নন তো নিজেকে বিকোন লেখকরা নাকি? কিম্বা সেমিনারে লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে সমস্যার থেকে যাবতীয় দায় মুক্ত হলাম জাতীয় স্যুডো-আঁতেল প্রাজ্ঞ জনেরা?

    পাঠক আপত্তি তুলতে পারেন, ভূমিকার ভ্যান্তারা ছেড়ে আসল কথায় এবার আসুন। কিন্তু যদি কিঞ্চিৎ মনোযোগ সহকারে শুরু থেকে লেখাটা পড়ার ধৈর্য রেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন যে আগাগোড়া নবারুণের নিজস্ব চিন্তাধারা, স্টাইল-টেকনিক সম্পর্কেই আভাসে ইঙ্গিতে এমনকি সোজাসুজিও আলোচনা করার চেষ্টা করে আসছি। কতটা পেরেছি সে বিচার পাঠকের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি কারণ এমন একজন তীক্ষ্ণধী লেখকের সম্বন্ধে কিছু বলা ছেলেখেলা ব্যাপার নয়। যথেষ্ট ভেবেচিন্তে তবেই কলম খোলা উচিত। সে যাই হোক, এবার সরাসরি কাঙাল মালসাটের প্রসঙ্গ তুলে নবারুণ কোথায় অন্যদের থেকে আলাদা, তাঁর মেধা কোন যাতনায় নিত্য নিপীড়িত, সে নিয়ে আলোচনা করা যাক। যুগ যুগান্তর থেকে আমরা দেখে আসছি অসম্ভব প্রতিভাধর শিল্পী, লেখক, কলাকার মধ্যবিত্ত (টাকার অর্থে নয়) মানসিকতার সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে গ্রাহাম গ্রীনের ভাষায় leaning this side or that করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না বলে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন আর সেজন্যই তাঁরা সেই একঘেয়ে গতানুগতিকতার পৌনঃপুনিকতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফটিয়ে একটা নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে থাকেন। নবারুণ এর ব্যতিক্রম যে নন, তা তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায় খুব সহজেই। মননে তাঁর রয়ে গেছে (অন্তত আমি তাঁকে যতটা বুঝতে চেষ্টা করেছি) ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের ক্রন্দনধ্বনি; শেকড়ের সন্ধানে নয়, শেকড়ে ফিরে গিয়ে বাংলার অসম্ভব পুষ্ট ধৃতিমান হৃত গৌরব ফিরে না পাওয়ার বেদনা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে নিরন্তর। পারছেন না কিছুতেই হাঁটু গেড়ে বসে দাসের মত মেনে নিয়ে আধুনিক তাঁকে যেটুকু ডোল দিচ্ছে সেইটুকুই সই বলে হাত পাততে। আর সেজন্যই বোধহয় এত আত্মখনন —

    “চন্দনগরের জনৈক বিখ্যাত বাঙালি একবার লিখেছিলেন,

    ‘হারান চক্রবর্তী মহাশয় যথেষ্ট বলশালী ছিলেন। তিনি উদয়চাঁদ নন্দীর বাগানে একটি বড় লিচু গাছ বিনা অস্ত্রসাহায্যে ফেলিয়া দিয়াছিলেন। ... গগনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুরন্ত ঘোড়াকে ভূমি হইতে শূন্যে তুলিয়াছিলেন। প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বে পালপাড়ার বীরচাঁদ বড়ালের বাটীতে পালপাড়ার দলের উদ্যোগে ফরাসী গভর্নর বাহাদুরকে দেখাইবার জন্য ব্যায়ামক্রীড়ার ব্যবস্থা হইয়াছিল। লাটসাহেব তাহা দেখিয়া বাঙালির ছেলের বল ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন।’

    কে তিনি? তিনি কে গো? কে গা? এর একমাত্র জবাব বাঙালির নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। লজ্জায় আর কত অধোবদন হইতে হইবে?”

    যেহেতু শিশুকাল থেকে আমার পিতামহের ঘনিষ্ঠ মিত্র প্রয়াত শ্রীহরিহর শেঠ (শেঠ, শেট নয়) মহাশয়ের গৃহে বহুবার যাবার এবং তার সে যুগে শিক্ষা সচেতন মায়ের নামে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের মহান আদর্শে প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণ ভাবিনী নারী শিক্ষা মন্দিরে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাই সাহস করে বলতে পারছি বাঙালি বাস্তবিকই আত্মবিস্মৃত জাত বটে নাহলে শ্রীশেঠ মহাশয়ের অতুল দানে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতৃদেবের নামে গড়া অপার গ্রন্থ সম্ভারে সম্পন্ন নৃত্য গোপাল স্মৃতি মন্দিরটির নাম শুধু লোকমুখে কেন, এমনকি স্বয়ং গ্রন্থাগারের কর্মচারিদের মুখেও নিত্ত গোপালে পরিণত হয়ে যায়! শুধু তাই নয়, অবহেলায় বহু দ্বিতীয় সংস্করণ দুষ্প্রাপ্য ও প্রাপ্য সংস্করণ যোগ্য যথা ঢোঁড়াই চরিত মানস, বিভূতিভূষণ গ্রন্থাবলী ইত্যাদি বইগুলির দশা দেখলে কান্না পায়। বর্তমানে গ্রন্থাগারটি বিশেষ একটি পার্টির কুক্ষিগত এবং যথারীতি পারস্পরিক দলাদলির ও ক্ষমতা দখলের আদর্শ শিকারভূমি মাত্র। নবারুণ ভট্টাচার্যের নামটুকুও তারা কখনো শোনেনি! হে প্রাজ্ঞ পাঠক, এহেন দুর্দশার কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে?

    ‘কাঙাল মালসাট’ সম্পর্কে এই আত্মপ্রচারটুকুর নিতান্ত প্রয়োজন ছিল কারণ ‘কাঙাল মালসাট’ হাপিত্যেশ করা হাহাকারে ভরা নষ্ট ভ্রষ্ট চরিত্র বাঙালির জন্য। চাকতির বোম্বাচাক কিম্বা সেক্স ভকিলের অবাধ উল্লেখ ছলমাত্র অর্থাৎ পেঁয়াজের একটি খোসা অথবা পরত সে যে নামেই তাকে ডাকা যাক না কেন, নামে কি-বা আসে যায়। অর্থটি বোধগম্য হওয়া নিয়ে কথা। উপন্যাস(!)টিকে বুঝতে গেলে মালসাট অর্থাৎ ডুবোজাহাজের মতোই কিম্বা ডুবুরির মতো অর্থের অনেক গভীরে যেতে হবে যা বোধহয় আমারও সাধ্যাতীত। আমি নিজেও তো মনে হয় কিছুই বুঝিনি। যা বুঝেছি তা এই — কাঙাল শব্দটি দ্ব্যর্থক — গরীব অথবা ভিখিরি। বাঙালি এখন দুটোই। সিনেমা সিরিয়াল প্রযোজনা করছেন অবাঙালি। নৃত্য-সঙ্গীত পরিচালকও তাই। রামোজি সিটি সেখানে রমরমিয়ে সিটি বাজাচ্ছে, বাঙালি হিন্দী সংস্কৃতির কাছে বুলি মেলে বসে আছে হাপিত্যেশ করে। আর মালসাটের অর্থ যদি ডুবোজাহাজ হয় তাহলে ভ্রমেও ভাবিবেন না এটি submerine। এটি সেই ডুবন্ত জাহাজ যাকে আজ টেনে তুলে উদ্ধার করা বোধহয় অলীক কল্পনা।

    কাঙাল মালসাটের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ব্র্যাকেটে (চলবে) কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবারুণ যে একদা সাংবাদিক ছিলেন, সেটি এতে শুধু স্পষ্টই হয় না, তাঁর কলাম (column) লেখার স্টাইলটি সেই কথাই মনে পড়িয়ে দেয়। কখনো কোনকালে সমাজের ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে কলম তোলাই সাংবাদিকের ছিল আদর্শ। অসি অপেক্ষা মসি যে অধিক বলবান, সাংবাদিকগণকে সেই শিক্ষাই দেওয়া হত। নবারুণ নিছক কৌতুহল বশে অথবা অবসর বিনোদনের জন্য কিম্বা বোকা বাক্সে মুখ ডুবিয়ে বুঁদ করে রাখার জন্য যে লিখতে বসেননি, সেটা না বলে দিলেও চলবে। তিনি যে বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছেন, সে তো নিজেও স্বীকার করেছেন —

    ‘আমি লেখার ব্যাপারটা যেভাবে বুঝি সেটা নিছক আনন্দ দেওয়া বা নেওয়া নয়। আরও গভীর এক অ্যালকেমি যেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।’ (অন্ধ বেড়াল, মুখবন্ধ)

    সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের অ্যালকেমিই হল তাঁর রচনার মূল উৎসস্রোত সেজন্যই অতি স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানাতে দ্বিধা করেননি,

    ‘যে দশকে মানুষের এগিয়ে চলার, শোষণমুক্তি ও সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর মডেল পুঁজি ও প্রতিক্রিয়ার আঘাতে ও বামপন্থীদের আবশ্যিক আত্মসমীক্ষার অভাবের কারণে অনেকটাই তছনছ হয়ে গেছে।... এই দলিত মথিত মানুষ ও তাদের জীবনের এক বিচিত্র ক্যালেইডোস্কোপের মধ্যে আমার জীবন কাটছে। চারপাশে তাই আমি দেখি। কিন্তু চূড়ান্ত নিরিখে এই বাস্তবকে আমি চিরস্থায়ী বলে মানি না। বাস্তবকে পাল্টাতে হবে। হবেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চেতনা তৈরি করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের অবশ্যই একটা বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।’

    এজন্যই তাঁর কবিতায় হাঁটে হতভম্ব পিঁপড়ের সারি। এজন্যই ‘হারবার্ট’-এ পুলিশ অফিসারের কথায়, বিস্ফোরণ কোথাও কোনভাবেই ঘটে যেতে পারে। তবে ‘কাঙাল মালসাট’ সম্পর্কে একটি খেদ থেকে যায় — অত চাকতির চমক ধমক, ওঁয়া ওঁয়ার ধানাই পানাইয়ের পর হঠাৎ করে সব যেন মেনিমুখো ফিসস হয়ে গেল। ফিজিকস, আধ্যাত্মিক, কোক শাস্ত্রীয় যাবতীয় জ্ঞানার্জন অর্থাৎ ‘চুদিট্রন’-এর বাইরে তথা ও পরে গিয়েও সাম্প্রতিক অপহরণ জাতীয় ফিল্মী কায়দায় দণ্ড বায়স-পুষ্ট ভদি এবং কমরেড আচার্যের হাত মেলান আর তারপর দণ্ড বায়সের কাঙাল মালসাটের প্রকাশনার খবরটি বেগম জনসনকে দেবার জন্য উড়ে যাওয়া — সবটাই ফ্লপ ছবির ইঙ্গিত দেয়। কারণ আছে নিশ্চয়ই — নবারুণ ছেলেখেলা করতে লিখতে নামেননি সেটা বলা বাহুল্য। পাঠক একটু মনোনিবেশ সহকারে খেয়াল করুন প্রথম অধ্যায়ের শেষের বোল্ড টাইপে লেখাটি — হুজ্জত-এ বাঙ্গালা, হিক্‌মৎ-এ-চীন। অর্থাৎ চিনের যে বিপ্লবের সাহসটুকু আছে, বাঙালির সেটুকুও কেন, নামমাত্রও নেই। বাঙালি হুজুগে জাত, তার শুধু আছে বড় বড় বাত, তামঝাম আর তারপর হয় পিছুহটা নয় হেসে হেসে কান এঁটো করা করমর্দন। এটা অবশ্য আজ শুধু বাঙালির একার নয়, সর্বভারতীয় চরিত্র এবং চিত্র। তাই কি ব্র্যাকেটে (চলবে না) লেখকের প্রতিবাদ? আমার তো তাই মনে হয়েছে; এখন স্বয়ং নবারুণও এটা নাও মানতে পারেন যদিও তাতে আমার অভিমত এতটুকুও পাল্টাবে না। এজন্যই কাঙাল মালসাটে এত পরতের কথা তুলেছিলাম। পেঁয়াজের মতো খোসা ছাড়িয়ে হাত মস্তিষ্ক ব্যথা হবে শুধু, আধ-খেঁচড়া কেন, অতি চালাক বোদ্ধা পাঠক-সমালোচকের গলায় দড়ি ঝুললেও মনে হয় না পুরোটা কেউই বুঝতে পারবেন। এমনই গভীর নবারুণের ইন্টেলেক্ট (আঁতলামি)। সত্যিই কি আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কোনও বিপ্লব সফল হয়েছে — তা সে আই এন এ-রই হোক অথবা সত্তরের দশকের তরুণদের তরতাজা রক্তপাত — কোনটি বিপথগামী না হোক, ব্যর্থ হয়নি? নবারুণ কি ‘কাঙাল মালসাট’এ এটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখতে — দেখাতে বাধ্য করেননি? এখানেই ‘কাঙাল মালসাট’এর সার্থকতা। এখানেই সাংবাদিকের ভূমিকায় নবারুণ ভট্টাচার্য।

    ‘হারবার্ট’ নিয়ে বছর দুয়েক আগে যে নন্দন-নাটকটি রাজনেতা মিডিয়া মারফৎ অভিনীত হল তারপর আর কি করে বলি, অধিকন্তু ন দোষায়। আর বেশি কিছু বলে কেন আর লাজে লাজানো? তবু যখন ক্রিটিকের ভূমিকায় জানে ভী দো ইয়ারো ছবিটির সেই বিখ্যাত সিরিও-কমিক সীনটির (যাত্রা পার্টিতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ দৃশ্য) মতো আমাকে নকল সমালোচকের ভূমিকায় নামতেই হয়েছে, তখন চুপ, বিচার চল রহা হ্যায় বলে পার পাবার জোটি দ্যাখছি না। আমার চোখে হারবার্টের যাবতীয় যন্ত্রণা আসলে প্রধানত ব্যর্থ প্রেম সঞ্জাত। যৌন রোগাক্রান্ত পঙ্গু জ্যাঠামশায় যিনি নিজের সাধ্বী স্ত্রীকে অবহেলা লাঞ্ছনা করে আয়েশ ফুর্তি মারতে বাইজী বাড়ি যেতেন, বিকারগ্রস্ত অবস্থায় তাঁর পিউ কাঁহা বলে প্রেমিকার বিফল সন্ধান, হারবার্টের বন্ধুর বেপাড়ার মেয়ের দিকে তাকানর অপরাধে মাস্তানদের হাতে উৎপীড়িত হয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা, এমনকি স্বয়ং হারবার্টের উঠতি যৌবনে বুকির প্রতি ব্যর্থ প্রেম — সবকিছু মিলিয়ে এবং সেইসঙ্গে নকশাল হয়ে যাওয়া বিনু যে তাকে একমাত্র মানুষের সম্মান দিয়েছিল তার এনকাউন্টারে মৃত্যুই অর্থাৎ প্রেমহীনতাই হারবার্টকে মৃতদের আত্মার দিকে শুধু ঠেলেই দেয় না, সে তাদের কাছে পাবার তীব্র আকুতিতে ভোগে। এটা এক ধরণের সায়কোটিক রোগ বলে সায়কিয়াট্রিস্টরা চিহ্নিত করবেন। হতে পারে। তবে প্রেমহীনতা যে জীবন কেন বেঁচে থাকাটাকেই অতিষ্ট করে তোলে, সে বিষয়ে তো সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সে যে কোন ধরণের প্রেমই হোক না কেন। মানুষের প্রতি বিশ্বস্ততাও তো ভালোবাসারই প্রতিরূপ। যদিচ ফ্রয়েডিয় এবং বর্তমান বিশেষরূপে জ্ঞানীবৃন্দ অর্থাৎ বিজ্ঞানীগণের মতে প্রেম সেক্সওরিয়েন্টেড এবং মস্তিষ্কে ডোপানিনের ক্ষরণ যা এ্যান্ডোক্রিন গ্ল্যান্ডকে যৌনাত্মকভাবে উত্তেজিত করে তোলে সাথী নির্বাচনে। ইডিপস-ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের কথা নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলতে হবে না। তবুও বলতে দ্বিধা নেই, দেশপ্রেমও প্রেমেরই নামান্তরিত রূপান্তর আর নবারুণের বাঙালির জন্য যে হাহাকার তা সেই দেশপ্রেম থেকেই উদ্ভূত। তাই এত মরবিডিটি, এত ক্ষোভ, এত বিক্ষোভ। কে বলে নবারুণ যে প্রেম দেখিয়েছেন, তা বিকৃত, মেকি? হ্যাঁ, অবশ্যই ছলিত প্রেম, প্রেমের ছলনা বঞ্চনার ‘হারবার্ট’ থেকে নিয়ে ‘কাঙাল মালসাট’ অবধি ছড়াছড়ি। উল্লেখ্য,

    নগরপালের বুক পকেটে মিসেস জোয়ারদারের ভ্যালেন্টাইনস ডে-র কার্ড খামবন্দী। তাতে আঁকা ছিল একটি লাল হৃদয় এবং তলায় দুটি নীল রঙের ফিমেল ঠোট । তলায় লেখা ‘পাগলী’।

    বর্তমান শরীর-সর্বস্ব প্রেম গিয়ে ঠেকেছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে চুলোর দুয়োরে পাঠিয়ে। এও নবারুণের বিদ্রোহের প্রকাশ।

    প্রেম প্রসঙ্গেই এবার নবারুণের ছোটগল্পে আসা যাক। তবে তার আগে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘নঙ্গর চন্দ্র’ বা ‘দুখে কেওড়া’কে সামান্য একটু ছুঁয়ে যাব। দুজনেই নিরীক্ষণাত্মক লেখক এবং অফবিট দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে তুলে ধরেছেন। দুজনের লেখার মধ্যেই বাঁচার এবং বাঁচানর তীব্র তাগিদ। সে যেভাবেই হোক না কেন। নবারুণের ‘ভাসান’ গল্পটির কথা মনে করা যাক। পাগলটি যতদিন বেঁচে ছিল তার মনে হয়েছে, সে কবুল করতে দ্বিধা করেনি, পাগলীকে সে ভালোবাসে না। পাগলের মৃত্যুর আগে এবং পরে তাকে বাঁচানর তার যে আকুতি, সারারাত জেগে বসে পাগলের লাশটিকে কুকুর বেড়ালের দাঁত থেকে রক্ষা করার উন্মত্ত প্রয়াস এবং যখন অবশেষে অনেক আয়াসে পুলিশ তার হাত থেকে লাশটিকে উদ্ধার করতে পারে মুর্দা গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবার জন্য, তখন পাগলের আত্মা ভাবছে, আমি পাগলীকে ভালোবাসি। এ প্রেম অন্নময় মনময় স্তর পেরিয়ে অনেক ঊর্ধগামী আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন বই আর কি হতে পারে! নবারুণ যে দেহজ কামনার্ত প্রেমের বিশ্লেষণ করতে বসেননি এটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। জীবনের প্রতি অসীম মূল্যবোধ থেকে এমন গল্প জন্মায়। 

    রামকুমার যদিও নবারুণের মতো bizarre নন তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে কিন্তু জীবনের তাগিদটুকু যে কত প্রবল, প্রেমের আর্তি যে মনুষ্যত্বে ফিরিয়ে আনতে পারে মানুষকে, সেটি তাঁর গল্পে অত্যন্ত প্রকট। রামকুমারের ‘জৈষ্ঠ ১৩৯০, ঘুঘু কিংবা মানুষ’ অথবা ‘বনমালীর পৃথিবীতে ফেরা’ গল্পদুটি তার সাক্ষ্য দেয়। প্রথম গল্পটিতে সুচাঁদ অনাহার অনটনের জ্বালা, প্রকৃতির অনীহা আর সইতে না পেরে ভাবে সে ‘মরবে — এমন বাঁচার চেয়ে মরণ ভালো।’ কিন্তু আয়রনি এখানেই; মরতে গিয়েও সে বাঁচার টানে ফিরে আসতে বাধ্য হয়, কেননা ‘সুচাঁদ বোঝায় — ‘মরতুম বটে। সাঁওতালডির পোস্টটা ধরে তর তর করে উঠছি। আর একটুন হলেই হাত পাব। তা তারের উপরে একটা ঠাঙা ছিল। এক জোড়া ঘুঘু পিরিত করতে করতে বসলে গিয়ে ঠ্যাঙাতে। ঠিকা গেল তারে তারে। শালা খাঁইচে শক — চিৎপটাং। বলি খিদার জিনিস ভগবান দেছেন, মরতে যাব কোন দুঃখে? তার উপর তুই উপোস করে আছিস বটে।’ এ প্রেম দেহ সঞ্জাত কিছুতেই নয়। দুইটি ঘুঘুর দৈহিক মিলন দেখে যদিও তার নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়, তবুও এখানে অনাহারের যাতনা কষ্ট তার একার যে নয় এটুকু মানবিক বোধে সুচাঁদ সম্পূর্ণ অন্য একটি স্তরে উন্নীত হয় যে স্তর স্বর্গীয় প্রেমে পৌঁছে দেয়। সে ফিরে আসে মরা ঘুঘু দুটি হাতে এবং ‘হাঁড়ি চাপে, উনোন জ্বলে। অমর ঠাকুর আধসেরটাক চাল দেয়। জোড়া ঘুঘুর মাংস হয়।... সুচাদ বউয়ের গা ঘেঁসে চলতে চলতে গান ধরে –

    ঝিঙ্গালতে কাল্লালতে বাজ লাগলি
    মাইরি বাজ লাগলি
    তকে লাজ না লাগে লো
    মুচকা হাঁসলি
    মাইরি মুচকা হাঁসলি।’

    নবারুণের পাগলীর পাগলের প্রতি সুগভীর ভালোবাসার চেষ্টায় টিনের কৌটো জোগাড় করে রাত জেগে না ঘুমিয়ে মৃত পাগলের মুখে জল ঢেলে তাকে বাঁচানর নিষ্ফল প্রয়াস এবং আত্মহত্যা করতে গিয়ে বৌয়ের অনাহার-ক্লিষ্ট মুখ মনে করে ইলেকট্রিক তারে শক খেয়ে মরা ঘুঘু এনে বৌয়ের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়ার পেছনে একটিই অ্যালকেমি কাজ করছে যার সঙ্গে ডোপামিনের ক্ষরণের কোনই সম্পর্ক নেই। এটিই হল সমবেদনা, সমব্যথা, সমমর্মিতা যা মানুষকে মাত্র দুপেয়ে জন্তু হতে রক্ষা করে যদিও মানুষ আদপে বড় দরের পশুই। হয়তো সে কারণেই তার মধ্যে এত পাশবিকতা, হয় জাগ্রত নয় সুপ্ত যা সুযোগ পাওয়া মাত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দ্বিধা করে না। তবুও সে ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্ট জীব; পশুর থেকে সে আলাদা কারণ তার বিবেক, বুদ্ধি এবং হৃদয় ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেধা তাকে জীবনের প্রকৃত অর্থ চিনতে শিখিয়েছে যেমনটি ঘটেছে নবারুণ এবং রামকুমারের ক্ষেত্রে। রামকুমারের ‘বনমালীর পৃথিবীতে ফেরা’ কাহিনিটিতে কোথায় যেন নবারুণের মানুষের ছল কপটতার বিরুদ্ধে যে বৈপ্লবিক বিস্ফোরণের প্রকট বারুদ তার লুকোনো গন্ধ পাওয়া যায়। জীবনের প্রথম তালগাছে চড়ে নিচের দুনিয়ার এমনকি নিতান্ত আপনজনদেরও চতুর চাতুরি ও দ্বিচারিতা ব্যভিচার দেখে বনমালী ভাবে :

    ‘জীবনটাতে ঘেন্না ধরে গেছে এসব সাতপাঁচ দেখে। বাঁচতে গেলে মরতেই হয়। মাথা নীচু করে হাত দুটো ছেড়ে দিলেই সবকিছু থেকে মুক্তি। ... বনমালী নামতে থাকে। মাঝ বরাবর এসে গাছ থেকে চোখ সরিয়ে নীচের দিকে তাকায়।’

    একান্তভাবে যে জগতকে সে এতকাল চিনে এসেছে গাছের ওপর থেকে দেখে তার সবই যেন খেলার মতো মন হয় — ‘ঠিক যেমন পুতুল নাচের দলে যেমন কাহিনি দেখে বছর বছর।’ কিন্তু নামতে নামতে ‘চারপাশে তাকাতেই মনে হয় সবকিছুই যেন আবার অনেকটা আগের মতোই দেখছে। পুরনো জগৎ। বনমালী আবার উঠতে চায় গাছের উপরে। হয় নতুনভাবে জগৎটাকে দেখতে কিংবা গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরনো জগৎ থেকে নিষ্কৃতি পেতে।...’ কিন্তু ততক্ষণে নতুন করে জীবনকে দেখার দম বনমালী হারিয়ে ফেলেছে। রামকুমার বিরাটভাবে সবকিছু ভেঙেচুরে নতুন গড়ার কথা না বলে অবশ্য এই জ্বালা যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকার কথা বলছেন কারণ জীবন হাজার বৈপরীত্য বিরোধ নিয়েই চলছে যেমন তেমনই চলবে, তিনি ভাল করেই সেটা জানেন। পরিবর্তন আনা অত সহজ নয়। যুগে যুগে চেষ্টা করে গেছেন মহাপুরুষেরা কিন্তু পেরেছেন কই! তাই ‘পাঁচজন বনমালী কিংবা পাঁচটা তালপাতা কাঁকুরে পথে বুক ঘষতে ঘষতে এগোয়।’ শেষ লাইনটি মারাত্মক — ‘তালের পাতা শুকিয়ে জ্বালানি হবে।’ এইখানে যেন প্রতীক হয়ে উঠেছে তালের পাতার জ্বালানি। হারবার্টের ডায়েরি চুল্লিতে যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার অনৃত জীবনের প্রতি প্রতিবাদ জানায়, রামকুমারের তালপাতা জ্বালানি হয়ে বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে আরেক ধরনের চুল্লি জ্বালাবে — জীবনের চুল্লি। শুরু হবে আবার নতুন একটা দিন একটুখানি বাঁচার রসদ নিয়ে।

    শ্রেষ্ঠ গল্পের ভূমিকায় রামকুমার নিজের সম্বন্ধে জানাতে গিয়ে বলেছেন – ‘যাঁরা আমার গল্প-উপন্যাস পড়েছেন তাঁরা জানেন যে আমার গল্প কথনের ভঙ্গিটি কথকতার।’ কথক যেমন পৌরাণিক কথা-কাহিনি বিশ্লেষণ করেন ঠিক সেভাবেই রামকুমার দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত যে মাটি সারাটা বছর দাবদাহের আগুনে ঝলসায়, জোতদার হয় ঠকিয়ে নয় গায়ের জোরে ন্যায্য জমি কেড়ে উপবাসে বাধ্য করে, যেখানে পুলিশ জাল মামলায় ফাঁসায়, যেখানে জোর যার মুলুক তার রাজত্ব অবাধে চলে, সরকারি আমলা লোক দেখানি ভিজিট দেন এবং মৌজা ডোমপাটির বিনোদের মতো তথাকথিত নকশাল হয়ে যেতে হয় ক্রমাগত ঘা খেয়ে খেয়ে, যে ভূমি আকর্ষণকে বিকর্ষণে পরিণত করে তোলে, যেখানের মানুষজন বাঘ যেমন রক্তের স্বাদ পেলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তেমনি টাকার স্বাদে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ভুলে যায় প্রকৃতিও তার জীবনের অংশীদার : ‘...সংসারের মানুষের মুখ আছে — কান নাই, চোখ নাই। সংসারের মানুষ শুধু নিজের কথাই বলে, শোনে নিজের কথা, দেখে নিজের জিনিষ... হাতে একতারা উঠলে তুমি শুধু সুরটি ধরে আছ — গান গেয়ে চলেছে পথ, নদী — বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।’ এইরকম জীবনের নগ্ন কথা-কাহিনি শুনিয়েছেন যা বাস্তব, অতি ভয়ঙ্কর বাস্তব চিত্র একটি। সাংবাদিকও ভয়ঙ্কর রূঢ় নিষ্ঠুর কঠোর বাস্তবের যথার্থ চিত্র তুলে ধরেন। সেও এক ধরণের কথকতাই। এইখানেই, এই একই বিন্দুতে এসে মিলেছেন নবারুণ ও রামকুমার। যদি পৌরাণিক গাথাকে মিথ বা মাইথোলজি বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে মস্ত ভুল করা হবে কারণ myth is exaggerated truth । আমাদেরই মতো সাধারণ মানুষের কথা বললে জনমানসে তার বিশেষ প্রভাব পড়বে না, মন টানবে না। সেজন্যই দরকার এমন কারো কথা বলা যে অসাধারণ এবং এজন্যই এই exaggeration । ‘কাঙাল মালসাট’ বা ‘দুখে কেওড়া’ কিংবা ‘নঙ্গরচন্দ্র’ এরকমই exaggeration দেখিয়েছে বলে আঁতলামির চূড়ান্ত বলে গড্ডল পাঠক অনায়াসে রায় দিতে বিন্দুমাত্র দুবার চিন্তা করবেন না। ‘কাঙাল মালসাট’ই হোক অথবা ‘দুখে কেওড়া’ — দুটি গ্রন্থেই বাড়িয়ে চাড়িয়ে অতি বাস্তব সত্যকে চোখে তাদেরই আঙুল দিয়ে দেখান হয়েছে যারা হয় জেগে ঘুমচ্ছে নয় ধৃতরাষ্ট্র সেজে অন্ধত্বের ভান করে সামাজিক দায়িত্ব সযত্নে এড়িয়ে ব্যক্তিগত সুখ ভোগ করছে। ‘দুখে কেওড়া’র জ্যাকেটে রামকুমার লিখছেন : ‘একই দেয়ালের ওপর নিচে চাষি নঙ্গরচন্দ্র এবং দেশনায়ক প্রফুল্ল সেন, ইন্দিরা গান্ধি, জ্যোতি বসুর নাম দেখে বেশ অবাক লাগত। এই দু-পক্ষ সচরাচর কাছে আসে না। কিন্তু এসে গেসল আমাদের মেদ্যা পাড়ায়। লেখালেখির ভেতর ঢুকে ভাবতুম এ-দুয়ের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক গড়া যায় গল্প-উপন্যাসে? অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর সাহস পেয়েছিলুম দিবাকরের পিসির কথা ভেবে। দুর্গা মণ্ডপে কাঁথা সেলাই করতে করতে বুড়ি পিসি আমাকে রাজপুত্র-রাজকন্যাদের অনেক গল্প শুনিয়েছিল। ব্রাহ্মণঘরের বাল্য-বিধবা পিসি রাজপুত্র-রাজকন্যাদের মাছ-মাংস ইত্যাদি একশ আট পদের ভোজের ভেতর নিজের পছন্দের পুনকো-পোস্ত, মোচার ঘণ্ট ইত্যাদি অবলীলায় ঢুকিয়ে দিত। রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ঘোড়ার ঘাস থেকে বেশ খানিক তুলে রাখত নিজের রুগনো বাছুরটার জন্যে। পিসির কথনের কারুকুরি আমার অগম্য কিন্তু চেষ্টা তো করা যায়! গল্প না জমলেও নঙ্গরচন্দ্র ঠিকই থেকে যাবে। আলকাতরার চেয়ে পাকা রঙ নেই।’ এত বড় উদ্ধৃতি দেওয়ার পিছনে কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই আছে। কথা হচ্ছিল মিথ এবং বাস্তব নিয়ে। রামকুমার খুব স্পষ্টভাবে দুটির সম্পর্ক কী এবং কেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেটা বলে দিয়েছেন। এজন্যই নবারুণের ‘কাঙাল মালসাট’ই হোক কিংবা রামকুমারের ‘দুখে কেওড়া’ই হোক, মিথ ও বাস্তব কোনওভাবেই আলাদা জগতের কথা বলে না। নবারুণ যেভাবে উনবিংশ শতক এবং বিংশ-একবিংশ শতকের বেগম জনসন ইত্যাদির সঙ্গে দণ্ড বায়স ও বর্তমান সমকালীন যুগের সমস্যা, ভ্রষ্টাচারের কথা তুলেছেন stream  of conciousness technique স্টাইলে সেটি রামকুমারের দিবাকরের পিসির গল্পের ছলে রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ঘোড়ার ঘাস থেকে নিজের রুগ্ন বাছুরের জন্য কিছুটা তুলে রাখার সমতুল অনায়াসে বলা যায়। চাকতির খেল, তন্ত্রমন্ত্র, নগরপালের মুণ্ডু কাটা পড়া, কমরেড আচার্য এপিসোড এবং ফের নগরপালের মুণ্ডু নিজের থেকেই জোড়া লেগে যাওয়া, হারবার্টের ভূতের সঙ্গে কথোপকথন ও পরিশেষে তোষকে মোড়া ডিনামাইট ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢোকামাত্র ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ — এসবই বাস্তব সত্যকে অর্থাৎ বাস্তবে যা নিত্য ঘটে চলেছে সেটি ভাল করে পাঠকের হৃদয়-মস্তিষ্কে ঢোকানর জন্য একটি অকল্পনীয় জগত নবারুণ জেনে বুঝে তৈরি করেছেন মিথ এবং বাস্তবের সংমিশ্রণে যদিও আমার স্থির বিশ্বাস অধিকাংশ পাঠক গোলা এবং নবারুণের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বোঝার মতো ধী তাঁরা রাখেন না। সেজন্যই নবারুণের লেখাকে ফালতু আঁতলেমি বলে বাতিল করার এত প্রচেষ্টা পাতি-আঁতেল(!) সাহিত্যিক তথা রাজনৈতিক সমাজে। রামকুমারের ভাগ্যেও এর বেশি কিছু জুটবে বলে তো মনে হয় না। ‘কাঙাল মালসাট’এ নবারুণ ঐতিহ্যের অপলাপে যে খেদ প্রকাশ করেছেন, বাংলার এবং বাঙালির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে আকুল আবেদন জানিয়েছেন, সেটিই সপাট মঙ্গলকাব্যের ঢঙে লহনা-ফুল্লরা-শ্রীপতি-কালকেতু উপাখ্যান আবার নতুন করে নতুনভাবে কথকতা করে ঈনিড ব্লাইটন-হ্যারি পটার বিমুগ্ধ আজকের নিজের ঐতিহ্য-বিমুখ প্রজন্মকে সচেতন করে দিচ্ছেন। দুজনের উদ্দেশ্য একই এবং সাধুবাদযোগ্য, সন্দেহ নেই।

    আবার নবারুণের ছোটগল্পে প্রেম প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। কেউ কেউ উন্নাসিক জন কথাটা শুনে নস্যাৎ করে দেবেন। বুদ্ধিজীবীর নাকি হৃদয়বৃত্তি বলে কিছু থাকে না। হ্যাঁ, অবশ্যই নবারুণ প্যানপ্যানে ফিল্মী-সিরিয়ালি সস্তার আবেগ-প্রধান প্রেম কাহিনি এখন অবধি লেখননি, ভবিষ্যতেও লিখবেন এমনটি আশংকা করা যায় না। তাঁর প্রেমের আকাশের পরিধি আচরাচর ব্যাপ্ত, বিস্তৃত। সেখানে শুধু মানুষই নেই। আছে অবলা পশুও। মুখোশ আঁটা ভদ্র সমাজ যে পশুরও ইতরেতর জীব, শ্রেষ্ঠ গল্পের দ্বিতীয় কাহিনি ‘স্টিমরোলার’ তার জলন্ত প্রমাণ। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন ধনবান এসির আরামে white collar job-এ মত্ত তখন দুটি প্রাণী একরোখা রোদ্দুরের আগুনের ঝলকে পুড়ে খাক হয়ে ধুঁকছে — একটি কুকুর, অপরজন স্টিমরোলারের চালক। দুজনেই বুড়ো এবং না-খেতে-পাওয়া গোষ্ঠিভুক্ত। গল্পটি যদিও সরকারি অর্থাৎ governmental system এবং সরকারি কর্মচারিদের অসম্ভব উদাসীন কর্মবিমুখতার ওপর দারুণ কশাঘাত :

    ‘বুড়োর খুব দোষ ছিল না। জায়গাটা বুঝিয়ে দেবার লোক, সই করাবার লোক, গাড়ি দেবার লোক সবাই লেট। খবর মত জেনেছিল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে তাই খেয়েও আসেনি। সাঁয়ত্রিশ বছরের চেনা পোড়া পোড়া লোহার আর কয়লার মিলমিশের গন্ধ! আকাশ বেড় নিয়ে আগুনের ছুটোছুটি! নৃশংস সূর্য... পেটের মধ্যে দমকা খিদেটা মরে যাবার পরের গভীর ব্যথা, বার্ধক্য, শীর্ণ দুটো হাতে প্রতিদিন জোর কমে যাওয়া, চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি, ক্লান্ত পাতার নিচে ছানিপড়া ঘোলাটে তারা। যতদূর চোখ যায় সোজা সারবন্দী গাড়ির লাইন, বাড়ি, জনশূন্য রাস্তা।’

     নবারুণের সব গল্পের আলোচনা এত স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয় যদিও সম্পাদক আমায় খোলা ছুট দিয়েছেন। কিন্তু সব কথা বলতে গেলে একটা পুরো বই হয়ে যাবে বলে দু-একটি নিয়ে কথা সারছি। এবার সাঙ্ঘাতিক সেই ‘হালাল ঝাণ্ডা’ গল্পটির কথা তুলব যেখানে অতি সূক্ষ্মভাবে নবারুণ সমাজের হিপক্রিট কীটদের আক্রমণ করেছেন। মস্তানদের আমরা কী চোখে দেখি সেটা আর বলে দিতে হবে না। ওরা সমাজের পচা অঙ্গ কেটে ফেলে দিলে তবেই সমাজের সব অসুখ সেরে গিয়ে জীবন সুস্থ হবে — তাই না? আর যদি বলি পঙ্গু সমাজই মস্তান হতে ওদের বাধ্য করেছে — তাহলে? অন্তত ‘হালাল ঝাণ্ডা’ তাই-ই চোখে আঙুল দিয়ে ভব্যতার ঠুলি আঁটা ভদ্রলোকদের দেখিয়ে দিয়েছে যে আসলে তারা কতখানি নীচ অমানুষ। দুপেয়ে জীব মাত্র। পড়শীর বিপদে আপদে কিন্তু এই মস্তানরাই জান কবুল করে বুক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর ভদ্দরলোকেরা দরজা জানলা বন্ধ করে নিজেদের জান বাঁচানোর ফিকির খোঁজে। এও ভালোবেসে আত্মবলির কাহিনি। এটাই বোধহয় সাচ্চা কুরবানি। বড়লোকের ছেলে ব্যর্থ প্রেমিক গিনির দু-হাটুতে মহার্ঘ প্ল্যাটিনামের চাকতি লাগান আছে জেনেও তিন ছিঁচকে চোর যাদের পেটের খাতিরেও ছিনতাই করার সাহসটুকুও নেই সেই তারাই লোভী ধনবান লালার ভাড়াটে খুনিরা যখন গিনিকে খুন করে তার হাঁটুর প্ল্যাটিনাম চাকতি ছিড়ে খুঁড়ে নিতে এতটুকুও দ্বিধা করে না, তখন সেই না খেতে পাওয়া নর্দমার পোকারাই বন্ধুত্বের খাতিরে নয়, গিনির প্রতি অসীম ভালোবাসাতেই আর পিটারের রক্ষিতা চম্পার দিকে লালার কুনজরে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে লালার পোষা কুত্তা তাড়িকে মেরে নিজেরাও প্রাণ দেয়। চম্পার জণ্ডিস সারাতে তিন ছিঁচকে চোর কীই না করে — এমনকি ছিনতাইও —

    ‘এই রেটে মাঙ্গাই আর হারামিবাজি চলতে থাকলে আমরা বুঝতাম যে আমরা শালা পুরো চোর বা ছেনতাই পার্টি হয়ে যাব... কিন্তু আর কোনো লাইন ছিল না — ...কিন্তু আমরা বেঁচে ছিলাম। মরছিল গিনি... আর ধুঁকছিল চম্পা... চম্পা বিছানা থেকে নামতে পারে না।... হলদে হয়ে যায়। ...বেকরার ...এরকম করে আমরা আর কখনো কাউকে বাঁচাতে চেষ্টা করিনি। বেকরার বেকরার ...’

    এই নিজেদের জীবন দিয়ে আত্মদান শিক্ষিত ভদ্র সমাজের কাছে অভাবনীয় ভাবে আশাতীত। ‘মৃতদেহ দর্শন’ গল্পে নবারুণ যা লিখেছেন তা প্রতিটি লেখকের মূল মন্ত্র হওয়া উচিত —

    - ‘সাহিত্য জিনিসটা জানবে একটা মিস্টিক। হঠাৎ মনে পড়ে গেল — তুমি অনাময় দত্তের লেখা পড়েছ? জলে ডুবে সুইসাইড করেছিল।’

    - ‘পড়িনি; নাম শুনেছি।’

    - ‘ওর একটা গল্পে এটা ছিল — বার বার —হার্মাদ, হার্মাদ!’

    - ‘চললাম সমরদা।’

    -  ‘এসো। নিমজ্জিত লেখকরা সমুদ্রের তলার বালি বা লেকের দাম, শ্যাওলা এইসব ভালোবাসে।’

    -  ‘অসাধারণ কথাটা বললেন সমরদা।’

    - ‘কিছুই অসাধারণ নয়। ট্রটস্কির একটা লাইন নিজের খেয়ালে সাজিয়ে নিলাম। অরিজিনাল হওয়া খুব কঠিন, খুবই কঠিন।’

    খুব সত্যি কথা। খুব সত্যিটাই বলেছেন নবারুণ। মৌলিক চিন্তা কজন করে? গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসান অনেক সহজ। তাতে নিজেকে কঠোর সত্য এবং সমালোচনার হাত থেকে বাঁচিয়ে বাজারু পত্রিকার দাসানুদাস হয়ে মোটা টাকা তো কামান যায়। আর তারপর ফিল্ম টিভি সিরিয়ালের কল্যাণে ভালোমত রোজগার তো আছেই। এমন সুখের জীবন ছেড়ে বেহেড উন্মাদ ছাড়া কেউ সমুদ্রের তলার বালি কিংবা শ্যাওলা দাম নিয়ে পড়ে নিজের আখের নষ্ট করতে চায় নবারুণ বা রামকুমার জাতীয় লেখক ছাড়া? কিন্তু এমন সৃষ্টিছাড়া লক্ষ্মীছাড়া অর্থাৎ যাঁরা অর্থ বা যশের প্রত্যাশী নন, শুধু সমাজ-চেতনার দাবিতে, সমাজের আধা-ঘুমন্ত আধা-জাগন্ত মানুষজনকে সচেতন, জাগ্রত করবার বোঝা মাথায় তুলে নিয়েছেন, যেমন নবারুণ কারো পরোয়া না করে লিখে চলেছেন, হিপক্রিট ভিক্টোরিয়ান গেল গেল সব গেল রব তোলা তথাকথিত fake and fraud hypocrete সমাজ তাঁদের রুখবে কোন অছিলায়? তুমুল হুল্লোড় তুলেও যখন স্বয়ং সরকার বাহাদুরকে বাহাদুরি দেখাতে গিয়েও পিছু হটতে হয়েছে, তখন আম পাঠকের কথা তো দূর অস্ত। সাধ্য নেই কারো নবারুণ-রামকুমার আর ডি এক্স বিস্ফোটককে রোধ করার যাঁরা কসম খেয়েছেন লাল পতাকার আড়ালে মুখ না ঢেকেই, মার্কস-লেনিন-মাও না আউড়েই সমাজের অপাংক্তেয় সর্বহারাদের জীবনের বাস্তব চিত্র সর্বসমক্ষে তুলে ধরে মৃতপ্রায় মনুষ্যত্বের চেতনাকে জাগিয়ে তোলার। তাঁরা কতখানি সার্থক সফল হবেন তা মহাকাল জানাবে। কারণ কালের সম্মার্জনী কাউকে রেয়াত করে ছেড়ে দেবে না। সময় জানে কাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে হয়। কথাটা আমার নয়, সুসাহিত্যিক নকশাল আমলে পুলিশ উৎপীড়িত অত্যাচারিত কিন্নর রায়ের। বাস্তব সত্যটা সে ভালোমত জানে চেনে বলেই তার কথা ধার করলাম নাহলে নবারুণ জাতীয় ইনটেলেকচুয়াল সাহিত্যিককে, তার স্বরূপকে সাধারণ পাঠকের মর্মে পৌঁছান আমার পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবপর একটি দয়িত্ব ছিল। নবারুণ সম্পর্কে সংস্কৃতে একটি কথাই বলতে মন চায় : সর্বেসাং সুখিনা সন্তু / সর্বে সন্তু নিরাময়া... মা দুখিনা কশ্বচিৎ । কিন্তু হরি নয় হ্যারিঃভক্তি (রামদেব বাবার ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও) বাংরেজ সমাজ পাছে নারাজ হয়ে যান সেই ভয়ে ভারতীয় ইংরিজিতেই বলছি - Thank you Nabarun for caring the back-burnes । সত্যি করে সমাজের শ্যাওলা দামেদের তিনি অন্তর দিয়ে বুঝেছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন বলেই তিনি সত্যিকারের আঁতেল, মেকি নকলচি নন।

    (লেখাটি নীলকমল সরকার, মল্লিকা ধর, সঞ্জয় সরকার সম্পাদিত ‘অক্ষরেখা’ পত্রিকার রাজীব চৌধুরি সম্পাদিত নবারুণ ভট্টাচার্য সংখ্যা - ফেব্রুয়ারি, ২০০৮, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় পূর্ব-প্রকাশিত।)

    পূর্ব-প্রকাশিত বলে বিশেষ পরিমার্জনা না করেই লেখাটি রাখা হল।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৫ আগস্ট ২০১৬ | ১৫৫২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন