আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
এখানে বণিকরা লেখকদের উদ্ভাবন করে
এবং লেখকরা উদ্ভাবিত হয়।
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
যে দেশের বুদ্ধিজীবী অধ্যুষিত সরকার
শীতের ইথারের মধ্যে
গরীব মানুষদের ঘর ভেঙে দেয় –
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
যেখানে অবশ অক্ষরমালা চিবুতে চিবুতে
কবিরা গরু হয়ে যায়
উল্টোটাও যে হয় না এখনও বলা যায় না।
আমার ভাগ্য আমি নিজেই ভেঙেছি
তাই বাতিল স্টীমরোলারের
কাছে বসে থাকি
বসে থাকি আর
রাস্তা বানাবার গল্প শুনি
এই কবিতাটি পড়ে, নিজেকে কি ইতর মনে হয়? হয়! মনে কি হয়, লজ্জাতুর আমি, যাই গে, এবার থেকে বাতিল স্টিমরোলারের পশ্চাদ্দেশে ভ্যাবলার মতো বসে থাকি। বসে থাকি, আর, মানুষের মল-মূত্র-বীর্যপাত, ওদিকে আবার রক্ত-ঘাম-অশ্রুপাতের-ওপর-দাঁড়িয়ে-ওঠা যা কিছু হ্যাপেনিং, সেদিকে তাকিয়ে আরও ক্যাবলা বনে যাই ? হয়! হয়! মনে হয়! ব্যাস্। নবারুণ ভট্টাচার্য-র ‘ইতরের দেশ’ কবিতাটি পাঠের পর এইসব উপলব্ধি মন থেকে খসে পড়ে যদি রাস্তায়, চকমকি পাথরের মতো, কিংবা ছাগলনাদির মতো, তো, আমি কিঞ্চিৎ অধিকারী ওঁর ‘স্মরণ’ লেখার জন্য, ওঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। আমার এক ঢাঙামতো বন্ধু একবার এসে জানাল, ‘জানিস, একজন আছেন, বাপ্পাদা! ভালো নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। ইনি নাকি কোনও কিছুর সঙ্গেই কম্প্রোমাইজ করেন না, ব্যাপক লড়াকু আর কাউকেই ছেড়ে কথা বলেন না, বস! চোখের সামনে, কর্যাপ্ট কাউকে দেখলে না, হুঁ হুঁ, খিস্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে দেন!’
চোখ কপালে উঠল আমার। ওমা! তা আবার হয় নাকি ? আসলে তো আমরা এভাবেই অবাক হতে অভ্যস্ত। কেউ, একজন অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলে, চমকে উঠি। ভুলে গেছি, এসবই মানুষের স্বাভাবিকতা!
তারপর তো দেখলাম, আমরা, যারা মাটিতে মিশে যেতে-যেতে, ধুলোর থেকেও ধুলো হয়ে যেতে-যেতে, খুব ফিসফিস করে খুব পাশের জনেরও কান ছুঁতে না পারে যেন, এইভাবে বেঁচে–থাকার ঘৃণা, অনীহা, রিজেকশন-কে উচ্চারণ করি, তখন একজন কবি, সগর্জন, শিরোনাম দিচ্ছেন রচনার, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ ...
তারপর তো দেখলাম, কোনো এক সভাতেই বুঝি-বা, বিদেশি-বিদেশি চেহারার মানুষটিকে। আলাপ করতে ইতস্তত করি। নিজেকে তো অন্ধ-চৌবাচ্চার মধ্যে শ্যাওলা-ধরা দেয়ালগুলিতে গোঁত্তা খেতে-খেতে, ঘুরে-ঘুরে আধমরা তেলাপিয়ামাছ বলে মনে হয়! তাই আর কী! অথচ, কেমন আন্তরিকভাবে কাছে টেনে নিলেন উনি। আলাপ গড়াল সেখান থেকে আরও অন্য-কোনওখানে। আরও আন্তরিকভাবে, পানীয় অফার করলেন।
‘ভাষাবন্ধন’ বেরোচ্ছে। অল্টারনেটিভ ম্যাগাজিন হিসাবে সে-পত্রিকার তখন দিব্যি নামডাক! নবারুণদা ফোন করছেন বারবার, নরমে-গরমে, ‘লেখা কই ?’ ‘লেখা কদ্দুর হল ?’ তাগাদা দিচ্ছেন। নামি পত্রিকার ইন্টেলেকচুয়াল, বিপ্লবী, সম্পাদক, যিনি স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, এমন স্বাভাবিক মানুষের মতো অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ কি তাঁর সাজে ? আমি আবারও অবাক হই! মনকে বলি, ‘আনইউজুয়াল !’
তা-ও তো, তখনও হারবার্ট পড়িনি। ফ্যাতাড়ুদের বৃত্তান্ত তো নয়-ই! হারবার্ট পড়তে দিল আমারই হাতিবাগান পাড়ার কোনও এক বন্ধু। পড়লাম আর শিউরে-শিউরে উঠলাম। এই বেস্-এর ওপর দাঁড়িয়ে, আমি লিখব কী করে? কোন কনভিকশন নিয়ে ? লিখব, আর ভুশ করে ডুবে যাব তো ছাইগাদায়। ব্যবহৃত হব, আধো-অন্ধকার, পুরনো বাড়ির কলতলায় বাসন-মাজার আঁশটে কাজে। বাড়িগুলি প্রোমোটারের হাতে চলে গেলে, কাঁসা-পিতল বাতিল হয়ে গেলে, সে-কাজেও লাগব না আর !
হারবার্ট পড়তে-পড়তে, ভেবেছি, অ্যান্টি-হিরো তো নয়, এই ভদ্রলোক-ই প্রকৃত হিরো। মৃত্যু-উপত্যকা যে-দেশ, সেখানকার আইকনিক ফিগার আর কেমনতরোই বা হতে পারে!
নবারুণদা, নবারুণ ভট্টাচার্যকে নিয়ে লিখতে বসি যদি, টানা, নিটোল ন্যারেটিভ লিখে-ওঠা, আমার দ্বারা সম্ভব নয়। সে-সবের জন্য জ্ঞানীগুণিজন আছেন। আমি শুধু পাতাল কেটে-কেটে, ভেতরে সেঁধানোর পথে কিছু-কিছু অ্যানেকডোট দিয়ে যেতে পারি। জাস্ট এটুকুই। আর হ্যাঁ, হারবার্ট-কে চলচ্চিত্রে রূপায়িত করার জন্য সুমন মুখোপাধ্যায়ের কাছে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ, উহুঁ, অমন মন-ছোঁয়া একটা শিল্পকাজ আমাদের উপহার দেবার জন্য নয়, নবারুণ ভট্টাচার্য নামটা তো আর বারবার উচ্চারিত হয় না এই বঙ্গদেশে। আইটি-তে কর্মরত উচ্চঘরের মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম, অনেক সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীও ওঁকে চেনেন না, কিন্তু সিনেমার কল্যাণে লোকে দু-চারবার, হল-ফেরত, বলতে শুরু করেছিল, ‘‘কার লেখা গো ওই ছবিটা ?’ ‘‘ও ! ওটা ? দেখলাম তো নাম রয়েছে নবারুণ ভট্টাচার্য বলে একজনের।’ যেভাবে মিসেস রায় ফোন করে মিসেস তালুকদারকে শুধোন, ‘ওই-যে দাদার কীর্তির গানটা, চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে... একটা মেয়ে গাইছিল সেদিন, নামটা মনে আছে তোমার?’
আমাদের এই মৃত্যুমুখি জীবন-উপত্যকায়, এই দেশে, বারবার নবারুণ ভট্টাচার্যের ফিরে-আসা উচিত। তাতে, যদি বা মানুষের মগজ একটু-আধটুও আন্দোলিত হয়।
(লেখাটি গৌতম ঘোষদস্তিদার সম্পাদিত “রক্তমাংস” পত্রিকায় শ্রাবণ, ১৪২১ সংখ্যার নবারুণ ভট্টাচার্য স্মরণ অংশে পূর্ব প্রকাশিত)