বিজেপির একটি প্রচার কয়েকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে, যে, নতুন নাগরিকত্ব আইনের ফলে বাঙালি হিন্দুদের বিপদের কোনো কারণ নেই। সমস্যা কেবল সংখ্যালঘুদের। সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো র একটি চমকপ্রদ বিবৃতি এসেছে কাল। তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই ধরণের প্রচারের কোনো ভিত্তি নেই। কয়েকটি প্রশ্নোত্তরে ব্যাপারটা বুঝে নেওয়া যাকঃ
১। এই আইনের ফলে বাঙালি হিন্দুদের আর কোনো চিন্তাই নেই?
সম্পূর্ণ উল্টো। বাঙালি হিন্দুদের আতঙ্কের যথেষ্ট কারণ আছে। সরকার স্পষ্ট করে জানিয়েছেঃ দেড় লক্ষের বেশি 'অবৈধ বাংলাদেশী হিন্দু' (সংখ্যাটা কীকরে জানা গেল জানা নেই) বসবাসকারীরা কোনোভাবেই সরাসরি ভারতের নাগরিক হতে পারবেন না। প্রথমে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে। খুঁটিয়ে দেখা হবে। আবেদন মঞ্জুর হলে, অর্থাৎ, 'ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে শরণার্থী' প্রমাণ করতে পারলে তবেই নাগরিকত্বের প্রশ্ন। প্রমাণ করতে না পারলে কী হবে? কেউ জানেনা। ডিটেনশন ক্যাম্প উঠে যাবার কোনো কথা এখনও শোনা যায়নি।
২। বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু 'শরণার্থী'রা কি স্বাগত?
একেবারেই না। সরকার স্পষ্ট করেই জানিয়েছে হিন্দু হোন বা যাই হোন, কাট-অফ ডেটের পর বাংলাদেশ থেকে যাঁরা আসছেন, কেউই এই আইনের সুবিধে পাবেন না। অর্থাৎ কোনোভাবেই নাগরিকত্ব পাবেন না। তার আগে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা? তাঁদের প্রমাণ করতে হবে তাঁরা ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত। কীকরে প্রমাণ করবেন, সেটা অবশ্য জানা নেই।
৩। এই আইনের ফলে 'আসাম চুক্তি' কি উঠে গেল? বা গুরুত্ব কমে গেল?
একেবারেই নয়। আসাম চুক্তি থাকছে। অর্থাৎ এন-আর-সি ও থাকছে। ১৯ লক্ষ বাদ পড়া মানুষও, যাঁদের বেশিরভাগই বাঙালি, বাদ পড়েই থাকছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ এখনো আগের মতোই অনিশ্চিত।
গত নির্বাচনের সময় বিজেপি বা সঙ্ঘপরিবার আসামের বাঙালি সংখ্যাগুরুকে বুঝিয়েছিল, যে, তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। এন-আর-সি কেবল সংখ্যালঘু তাড়ানোর কল। অনেকে সেই ফাঁদে পা-ও দিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, যারা বাদ গেছেন, তাঁদের বেশিরভাগ অংশটাই বাঙালি হিন্দু। এমনকি বিজেপির নেতা-নেত্রীরাও বাদ পড়েছেন। হয়রানি শিকার হয়েছেন, আসামের প্রায় প্রতিটি বাঙালি পরিবার।
বাংলায়ও বিজেপি একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তারা সংখ্যাগুরুদের বোঝানোর চেষ্টা করছে, যে, নতুন আইনে তাদের কোনো সমস্যা নেই। আশ্চর্যজনকভাবে তাতে কেউকেউ আনন্দও করছেন। সংখ্যাগুরুদের সমস্যা বেশি এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশই নেই। কিন্তু সংখ্যাগুরুর ঘর পুড়বেনা তা নয়। এবং একবার ঘর পোড়ার পর সে আগুন আর নিভে যাবার সম্ভাবনা নেই।
দিল্লির কাজকর্মের যা গতি-প্রকৃতি এখনও দেখা যাচ্ছে, তাতে সমস্যা, আশঙ্কা গুরু বা লঘুর নয়, গোটা বাঙালি জাতির। গোটা সরকারি ব্যাখ্যায় কেবল বাংলাদেশ শব্দটাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে। অন্য কোনো দেশের কথা নয়। আর এসেছে বাঙালি জাতির কথা। 'আসামকে কি হিন্দু বাঙালির বোঝা বইতে হবে?' সরকারি ঘোষণায় এরকম একটা প্রশ্ন এসেছে। তার উত্তরে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যে, শুধু আসামকে বইতে হবেনা। কিন্তু বাঙালি যে দেশের পক্ষে 'বোঝা' এ একেবারে নিশ্চিত। আরেকটি জরুরি প্রশ্ন হল 'বাঙালি জাতি কি আসামে আধিপত্য বিস্তার করে ফেলবে?' যেন সেটাই দেশের বড় সমস্যা। তার উত্তরে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, না। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা সবাই অসমীয়া হয়ে গেছেন ("adapted themselves to Assamese langulage") ।
অর্থাৎ, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, বাঙালি হিন্দু হল বোঝা, এবং বাঙালি 'আধিপত্য'কে সরকারিভাবেই বিপদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আসামে 'অবৈধ বাংলাদেশী' হিন্দুর একটা মনগড়া সংখ্যাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। কারা এই 'বাংলাদেশী হিন্দু?' আসামে বা গোটা দেশে? কেউ জানেনা। জানা সম্ভবও না। তাই খুব সম্ভব গোটা বাঙালি জাতিকেই বাংলাদেশী না হবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। ভারতের অন্য কোনো জাতির এই সমস্যা হবেনা, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালিই সন্দেহের পাত্র। দীর্ঘদিন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যাঁরা এই বাংলায় বসবাস করে এসেছেন, প্রত্যেককে সম্ভবত আরও একবার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। কীভাবে প্রমাণ হবে? কেউ জানেনা। না করতে পারলে কী হবে? কেউ জানেনা।
আসামের বাঙালিরা ঝুঁকি নিয়ে পস্তাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের এবং ত্রিপুরার বাঙালিদের আশঙ্কিত এবং সাবধান হবার সময় এসেছে। নতুন আইন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার পর জীবন আর ঠিক বলিউডের সিনেমা নয়। পাকিস্তানি বা বাংলাদেশী 'বহিঃশত্রু', 'অনুপ্রবেশকারী' বা 'সন্ত্রাসবাদী'দের গুড়ুম-গুড়ুম গুলি করে সিধে করা হচ্ছেনা, এবার ভারত রাষ্ট্রের নিশানার সামনে সাধারণ বাঙালি। একটা দেশভাগ, একাধিকবার উদ্বাস্তু হবার যন্ত্রণা যারা পেরিয়ে এসেছে। স্বাধীনতায় সবচেয়ে বেশি রক্ত যারা ঝরিয়েছে। তারাই আবার পরীক্ষার সামনে। দিল্লির অবিমৃষ্যকারিতায় দেশভাগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হয়েছিল বাঙালি। হিন্দু এবং মুসলমান, উভয়েই। আবারও কি তাইই হবে?
সরকারী বিবৃতিঃ https://twitter.com/PIB_India/status/1205998025576857600
মিডিয়ায় আসুক না আসুক, আমরা এই সমস্ত খবর দিয়ে চলব। পেতে চোখ রাখুন, এই পাতায়। আপডেট দিন আপনিও।