প্রগতিশীল সমস্ত প্রোপাগান্ডাকে পরাস্ত করে বিপুল জনমত নিয়ে পুনর্বার প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ভেবেছিলাম তিনি হবেন না। দেশের কৃষকরা যখন একনাগাড়ে দশবছর ধরে প্রতিদিন পঁয়তাল্লিশ জন করে আত্মহত্যা করবার রাস্তাকে ছেড়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন, যখন দলিতরা তাদের উপর চলতে থাকা মনুবাদী-ব্রাহ্মন্যবাদী-হিন্দুত্ববাদী অত্যাচার সহ্য করবেন না ঠিক করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের আসীন হওয়াকে আরো একবার জোর গলায় প্রচার করতে শুরু করলেন, যখন জানা গেল গত বিয়াল্লিশ বছরে বেকারত্বের হার মোদী জমানায় সবচেয়ে বেশি, যখন বোঝা গেল নোটবাতিল আর জিএসটি অসংগঠিত ক্ষেত্র আর পেটি কমোডিটি প্রোডাকশনের পেশা অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চল আর ছোট শহরের জীবন এবং জীবিকা লাটে তুলে দিয়েছে, তখন শুধু আমিই নই, আমার মতন আরো অনেকেই ভেবেছিল মোদী আর আসছে না। অর্থনীতি আর সমাজজীবনের এই প্রেক্ষাপটে রাহুল গান্ধী – দরিদ্রতমদের বছরে বাহাত্তর হাজার করে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তবুও মোদী এলেন। সপা-বসপা জোট সত্ত্বেও তিনি এলেন। বরং ভোট বাড়িয়েই এলেন। পরিসংখ্যান বলছে যেখানে ২০১৪-য় সারা দেশে বিজেপির ভোট ছিল ৩১.৩% , ২০১৯-এ তা বেড়ে হয়েছে ৩৭.৪% । অর্থাৎ ছ’শতাংশের বেশি। কিভাবে এটা সম্ভব হল? কি করে ভোট বেড়ে গেল? ইভিএমে কারচুপির বিষয়টা যদি আমরা বাদ দিই (কারণ সেক্ষেত্রে কোন আলোচনাই অবান্তর) তাহলে এবিষয়ে অনেকগুলি মত আছে। একটি হল মোদীর চেহারা। বহু মানুষ মনে করছেন দেশ চালাবার জন্য ওরকম বলিষ্ঠ কোন বিকল্প বিরোধীদের ছিল না। এছাড়া নানান অঙ্ক কষে নানান জোট করবার আগে থেকেই বিরোধীদের নেতা নেত্রীরা কে প্রধানমন্ত্রী হবে তা নিয়ে লাফাতে শুরু করেছিলেন। অন্ধ্র থেকে উত্তর প্রদেশ, মায় আমাদের বাংলা, বিরোধীদের এরকম আচরণ জনগণ নাকি পছন্দ করেনি। এছাড়া আরো একটি ব্যাপার আরএসএসের সহায়তা। আরএসএস নাকি মাসছয়েক আগে থেকেই তাদের সাংগাঠনিক কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল এবং তার ফলেই নাকি বহু অপরিচিত মুখও এবার জিতে গ্যাছেন। এগুলো ছাড়া আরো অনান্য কারণে যেতে গেলে রাজস্থানের কি রসায়ন, উত্তর প্রদেশের কি অঙ্ক সেসবে অমিত শাহ কি চাল খেলেছেন তার ডিটেলে যেতে হয়। সেগুলোতে না গিয়েও সাধারণভাবে এই কথা বলা যায় যে উপরোক্ত কারণগুলির প্রতিটাই কমবেশি সত্যি। অর্থাৎ ডিটেলড কোনো রসায়ন এই কারণগুলিকে নস্যাৎ করতে পারবে না। কিন্তু এগুলোর প্রতিটাই আংশিক চিত্রকে ধরছে। সাধারণীকৃত বিষয়টিকে সামনে আনছে না। এইসব কারণগুলির থেকে বিমূর্ত নির্যাসগুলি আমরা যদি নিই তাহলে দেখব এবারের নির্বাচনে মোদী বা বিজেপি বা আরএসএস - মোদীর মধ্যে দিয়ে এমন একটি ইমাজিনেশন দিয়েছে যা আসলে সাধারণীকৃত। যার মধ্যে রাজ্যের আঞ্চলিক পার্থক্য, জাতির বিচ্ছেদ এইগুলো অতিক্রম করে একটা সাধারণীকৃত বিমূর্ত ইমাজিনেশন আছে এবং সেটা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষকে, তার আপন কাঠামোয় আত্মীকৃত করে নেবার ক্ষমতাসম্পন্ন। এই ইমাজিনেশনটি ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় সত্তার একটি ইমাজিনেশন এবং যার সমস্ত এসেন্সই হিন্দুধর্মীয়। ঘটনা হল ভারতে হিন্দু ধর্মের মানুষই বেশি থাকে। তারা প্রতিদিন, চলতে থাকা নানান ধর্মীয় বা সামাজিক সংস্কার পালন করে থাকে। তাই এই জনসমষ্টির মধ্যে বিজেপি কৃত ঐ হিন্দুধর্মীয় বা হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ইন্ডিয়ান হবার পোটেনশিয়াল সবসময়ই হাজির থাকে। আশেপাশের অনান্য অবস্থা এবং নানান শর্তের উপর নির্ভর করে, সে প্রকটভাবে ওইটা হয়ে উঠবে কিনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গের কথা। (উত্তরপ্রদেশে সপা-বসপা’র ভোট কমে যাওয়া এবং বিজেপির ভোট বাড়া, বিহারে আরজেডির একটিও সিট না পাওয়া – প্রেক্ষাপট, রসায়ন আলাদা হলেও, এই সবই, আলাদা আলদা ভাবে একই প্রবণতাকে রিফ্লেক্ট করে)।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূলের প্রবল অগণতান্ত্রিক এবং অমার্জিত শাসনব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট ছিল। দ্বিতীয়ত এদের বড় অংশ প্রত্যেক দিনের জীবনে হিন্দুধর্মীয় আচার-সংস্কার পালন করে। তাই ব্যাপক বেকারত্বের অন্যদিকে তৃণমূলের ভোট সুরক্ষিত রাখার ফর্মূলা হিসেবে নামকেওয়াস্তে ‘ইমাম’ আর ‘মোয়াজ্জেম’ ভাতা এই হিন্দু সত্তাকে বিজেপির খেলাধূলার অনুকূল করে দিয়েছে।
শুধু বাম্ফ্রণ্ট নয় তৃণমূলেরও বড় অংশের হিন্দু ভোট চলে গেছে বিজেপিতে। শুধু বামফ্রণ্টের ১৯ শতাংশ ভোট ট্রান্সফার হলে ২০১৬-র নিরিখে বিজেপির ভোট হয় ২৯ শতাংশ। ২০১৯-এ আরো অতিরিক্ত ১১ শতাংশ এল কোথা থেকে? কংগ্রেসের ভোট কমেছে ৪ শতাংশ। যার অধিকাংশই সংখ্যালঘু ভোট যেটা গেছে তৃণমূলে। ফলত তৃণমূলের বড় অংশের ভোট বিজেপিতে এবং সিপিএমের, কম হলেও, একটা অংশের ভোট তৃণমূলে না গেলে তৃণমূলের ৪৫% আর বিজেপির ৪০%-র হিসেব মেলে না। (ধর্মের ভিত্তিতে এরকম শার্প পোলারাইজেশনের ভোট, গোটা রাজ্য জুড়ে পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনো হয়েছে কিনা আমার জানা নেই)।
একটু কান পাতলেই বোঝা যাবে, যতই তৃণমূলের অত্যাচারে এবং অন্য কোন শক্তিশালী বিকল্প না পেয়ে হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যখন বিজেপিকে গিয়ে ভোটটা দিল সে রাষ্ট্রীয়-সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে বিজেপির ঐ সাধারণীকৃত ইন্ডিয়ানের ধারণাটির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করল।
এই সাধারণীকৃত ধারণা অন্যান্য নানান শর্তের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়, কিন্তু এর তৈরি হওয়া এবং সময়ে সময়ে তার প্রতি আত্মসমর্পণ করাই হল মনুষ্যজাতির বৈশিষ্ট্য। এর দুটো দিক। প্রথমটি হল এই যে, সমাজ আপাতভাবে বিচ্ছিন নানান ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের অজস্র কন্ট্রাডিকশনের জটিল সমাহার। কিন্তু সমাজে টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন এইসব ক্ষেত্রের যেসব ডাইনামিক্স বা কন্ট্রাডিকশন, আলাদাভাবে সেগুলো একে অপরের থেকে স্বাধীন। অর্থাৎ একটি বিচ্ছিন্ন সামাজিক ক্ষেত্র অপর আরেকটির উপর নির্ভর করে না। কিন্তু মানুষের ধর্ম ক্রমাগত একটি সাধারণ বয়ানের সন্ধান করা। বহুর থেকে একের দিকে যাত্রা। তাই এই আপাত-বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রগুলির ইন্টারসেকশনের একটি জায়গায় সে ক্রমাগত যেতে চায়।
দ্বিতীয়টি আধুনিক সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত (প্রাক-আধুনিক যুগেও এটা প্রযোয্য হতে পারে তবে সীমিত ক্ষেত্রে)। এখানে একজন মানুষ কারোর ছেলে/মেয়ে, কারোর বোন/ভাই, কারোর সহকর্মী, কারোর প্রেমিক/প্রেমিকা, কারোর কমরেড, কারোর বন্ধু/বান্ধবী ইত্যাদি বহুকিছু। এই অসংখ্য পরিচয় বিচ্ছিন্নভাবে, একে অপরের সাথে সম্পর্কহীনভাবে বজায় রাখতে গেলে সে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় তার প্রয়োজন পড়ে একটি সাধারণ অর্গানাইজারের। যেটি তার এই বিভিন্ন পরিচয়কে আপাতভাবে এক সুরে বাঁধতে পারে। এবং নানাভাবে এই একটি অর্গানাইজারের আওতাতেই মানুষ থাকতে চায়। যাতে করে সে সুস্থভাবে সামাজিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। (এই অর্গানাইজারটি সর্বদাই পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে সরাসরি প্রত্যক্ষ করবার অতীত হয়ে থাকে)।
বলা বাহুল্য, প্রচন্ড সামাজিক-অর্থনৈতিক দুরবস্থাই আসলে বিজেপির এরকম উত্থানের কারণ। আমরা ভেবেছিলাম সে হারবে কারণ দেশ চালাতে গিয়ে সে মানুষের দুরবস্থার সমাধান করতে পারল না। কিন্তু সে জিতে গেল কারণ মানুষকে সে দিয়েছে এই দুরবস্থায় বেঁচে থাকার একটি আইডিয়া। মানুষও হয়তো তাই চায়। তাকে শুধু ভুলিয়ে রাখা হয় না সেও ভুলে থাকতে চায়। এইখানে মানুষকে ছোট মনে হয়। কিন্তু বিজেপি তাকে যতই বিকৃতভাবে ব্যবহার করুক না কেন, যখন দেখি এই প্রক্রিয়ায় লুক্কায়িত আছে এম্পেরিসিষ্ট বোঝাপড়া এবং তার দেওয়ালগুলিকে নস্যাৎ করে দেবার একটি সম্ভাবনা, তখন বিষয়টি সঞ্চার করে আগ্রহের।
বিজেপির ‘ভারতীয় মানব’ নির্মাণের বিপরীতে আমাদের দেশের বুর্জোয়া লিবারেল, সরকারী বাম, অনগ্রসরদের প্রতিনিধি সকল পার্টিই মনে করেছিলেন ‘সংবিধান’ হবে একটি সমকক্ষ ভাবনা। ‘সংবিধান’ অর্থাৎ “আম্বেদকর এবং তাঁর রচনা করা আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, সামাজিক ন্যায় সুরক্ষিত করা রাষ্ট্রকাঠামোটিই শেষ হয়ে যাবে বিজেপির হাতে”, এই ছিল তাদের বয়ান এবং প্রধান বয়ান। অর্থাৎ এর মধ্যে দিয়ে যাকে উঁচুতে তুলে ধরা হয় তা হল আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তার ভাবনা। বলা বাহুল্য এই আইডিয়াটির গায়ে এখনো পর্যন্ত যতটা পরিমাণ আমদানি করা মালের গন্ধ লেগে আছে এবং ভারতের সিংহভাগ জনমানসে এটা এখন পর্যন্ত এতটাই অসম্পৃক্ত যে, এটার মধ্যে দিয়ে কখনই বিজেপির সাধারণীকৃত ভারতীয়ত্বের ভাবনাটিকে প্রতিহত করা যায় না। এর জন্য ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এবং ভারতবর্ষে বিকৃত এবং অসম পুঁজিবাদী উন্নয়নের ইতিহাস একান্তভাবে দায়ী। বরং বলা যায়, এই সংবিধান যে বিষয়টিকে ভারতবাসীর মনে এবং আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জগদ্দল পাথরের মতন অপরিহার্য করে তুলেছে তা হল সংসদীয় গণতন্ত্র। এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় কোনভাবেই সম্ভব নয়।
তাহলে এই অবস্থায় কি দিয়ে বিজেপির বয়ানকে প্রতিরোধ করা যায়? কমিউনিস্টরা কি কেইন্সীয় অর্থনীতি দিয়ে চাকরী আর শ্রমিকের মাইনে বাড়ানো বা পিকেটিয় প্রেসক্রিপশন ক্যাপিটালের শেয়ার কমানো আর এসবের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানের বয়ানই বলে যাবে? বলা বাহুল্য, সামাজিক ন্যায় আর সংবিধানের পাশে অর্থনীতির কর্মসূচী নিয়ে এই দাওয়াইটিকেই বুর্জোয়া-লিবারেলদের সঙ্গে সঙ্গে সরকারী বামেরাও সমস্বরে সমোচ্চারণ করে গ্যাছে। এবং এটি শুধু এই নির্বাচনেরই ঘটনা নয় বরং সুদূর অতীত থেকেই এই ট্রাডিশন সমানে চলে আসছে। অ-সরকারী বামেরাও এবিষয়ে মৌলিকভাবে বিকল্প কোন পদাঙ্ক অনুসরণ করেন বলে দেখা যায় না। সম্পূর্ণ লেফট-লিবারেল ডিস্কোর্সটাই এই কথাগুলোই আউড়ে যায়।
অথচ কথাটা ছিল-“কমিউনিস্টরা তাদের মত এবং পথের কথা লুকিয়ে রাখতে ঘৃণা করে”। অবশ্য এর মানে আমি একথা বলতে চাইছি না যে কমিউনিস্টরা শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা বা মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য দাবী করবে না। এইসবই তারা করবে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করবে, তার চেয়েও বেশি বলবে তার নিজস্ব দর্শনের কথা, এই দুনিয়া নিয়ে তার বিশ্ববীক্ষাটির কথা। সেই কথাটি ‘শ্রমে’র। মার্ক্সীয় দর্শন, মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা বা মার্ক্সীয় অর্থনীতির গোড়ার কথা এই শ্রমের কথা। এই দুনিয়া চলে শ্রম দিয়ে। বস্তুর ভ্যালু আসে শ্রম থেকে। এখানে বিনিময় হয় যে সাধারণ মাধ্যমটির জন্য তা হল শ্রম। আগে মানুষ ভোঁদড় আর হরিণ শিকার করত। দুটোর শিকারে যতটা করে সময় লাগত সেই অনুপাতে সে দুটো শিকারকে ভাগ করে নিত। একজন করত অপরজনের জন্যে, অপরে করত আরেকের জন্যে। যখন ছুতোর টেবিল বানায় আর তাঁতি বানায় বস্ত্র, তাদেরও বিনিময় হয় ঐ কতটা শ্রম ব্যয় করা হল তার উওর ভিত্তি করে। কাপড় ছাড়া ছুতোরের চলে না, টেবিল ছাড়া তাঁতির। তাই শ্রমের মাধ্যমে তারা যখন নিজের প্রয়োজনটা বুঝে নিচ্ছে, একইসাথে সেইসময় অন্যের প্রয়োজনটিকেও মিটিয়ে দিচ্ছে। এ খাটছে ওর জন্য, ও খাটছে এর জন্য। আধুনিক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রচন্ড জটিলতার কারণে আমাদের মনে হয়, হয়তো বা দ্রব্যের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটছে দ্রব্যের। এখানে মানুষ শিকার হয় পণ্যরতির। শ্রমের ধারণা হয়ে যায় হাওয়া। কিন্তু আসলে, মূল সুরটি একই থাকে, এ খাটে ওর জন্য ও খাটে এর জন্য। দুনিয়া চলে শ্রম দিয়ে। মানুষ শ্রম করে সহযোগিতার জন্য। শুধুমাত্র এই শ্রমের প্রেক্ষিতই বুঝিয়ে দেয়, এই পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে মানুষ, তা সে যতই নির্লিপ্তভাবে হোক না কেন, শেষত, মূল নির্যাসে – সহযোগী হতে বাধ্য।
বস্তুত, সমাজ যেখানে বহু আপাত-বিচ্ছিন্ন জটিল ক্ষেত্রগুলির (উদা- পুঁজির সম্পর্ক এবং লিঙ্গবৈষম্যের সম্পর্ক, সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক এবং জাত-জাতি বৈষম্যের সম্পর্ক) সমাহার সেখানে, ‘শ্রম’ই হল তাদের মধ্যে সাধারণীকৃত বিষয়। এর মধ্যে সম্ভাবনা আছে – আঞ্চলিকতা, জাত-জাতি, জাতীয়ত্ব এই সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে উন্নত একটি মনুষ্যত্বে পৌছনোর। বহুকে সে আত্মীকৃত করে নিতে পারে। আজকের সময়ে কমিউনিস্টদের কর্তব্য এই শ্রমের জয়গান গাওয়া। এই কথা সদর্পে ঘোষণা করা- এই দুনিয়া চালায় শ্রমজীবি মানুষেরা, এই দুনিয়া চলে শ্রম দিয়ে। এই নগর-সভ্যতা-জ্ঞান-তৃপ্তি সকলেরই পিছনে শ্রম। যার অঙ্গাঙ্গী আরেকটি দিক – সহযোগিতা এবং এই প্রক্রিয়া ছাড়া দুনিয়া একদিনও চলতে পারে না।
বস্তুত আরএসএস নির্মিত ভারতবর্ষের আইডিয়া যেরকম আধা ভৌতিক আধা পার্থিব, পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে তাকে অনুভব করা যায় না, বিমূর্ত শ্রমও সেরকম। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সাধারণীকৃত ধারণা। এবং তার চেয়েও বেশি বাস্তব। বা বলা যায় শ্রমজীবি মানুষের মনুষ্যেতর জীবন (অর্থাৎ শ্রেণীবিশ্লেষণ) এবং তা থেকে উত্তীর্ণ হবার লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। তাই বহুর থেকে একে উত্তীর্ণ হবার জন্য আরএসএসের যেটা ভারত, লিবারেলদের ‘সংবিধান’ সেখানে অকেজো এবং কমিউনিস্টদের ‘শ্রম’ অনেক বেশি সম্ভাবনাসম্পন্ন, কারণ দেশ কাল নির্বিশেষে এই বিষয়টি সর্বত্র বিরাজমান। (অবশ্য এরই মাঝে আরেকটি কথা মাথায় রেখে দেওয়া উচিত যে, বস্তুর ভ্যালু কেবল শ্রম থেকে আসে না, তা আসে প্রকৃতি থেকেও। এবং বিমূর্ত শ্রমকে মাপা যায় না। তাই যে যতটা শ্রম করবে সে ততটা পাবে এরকম কথা কমিউনিস্টরা বলে না। অবশ্যই সমানুপাতিক পাবে বা প্রয়োজন মতো পাবে। এর পরের বিষয়গুলিতে এই কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অনুভূত হতে পারে)।
কিন্তু এ’তো গেল বিষয়গত ধারণা। সাধারণীকৃত বিষয়। বিষয়ীর কি হবে? সে কি দেশ কাল আঞ্চলিকতা এই সমস্ত কিছু অতিক্রম করে সুপার-কিছু দিয়ে নিজেকে অর্গানাইজ করবে? ইণ্টারন্যাশনালিস্ট, চীনের চেয়ারম্যান ইত্যাদি কিছু? না। এটা করতে গেলে সে আবার ব্যর্থ হবে। এই সুপার-কিছু গুলো এতদূরের বস্ত এবং পঞ্চেন্দ্রিয়ের এত বেশি বাইরের এবং মনের মাধুরীর যোগানগুলো এখানে এত বেশি আমদানী করা যে বিষয়ীকে অর্গানাইজ করবার জন্য তা কোনভাবেই উপযোগী নয়। বিজেপির ‘ভারতীয়’-র কাছে তো নয়ই। এগুলো অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে থাকবে দৈনন্দিন জীবনের আরো কাছাকাছি থাকা উপাদানগুলি। বিজেপির সমসত্ত্ব ভারতীয়ের উল্টোদিকে, ‘শ্রমে’র দর্শনের সাথে (যা কেবল জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ নয়) সম্পৃক্ত হবার সম্ভাবনা সম্পন্ন সহজসাধ্য কোন জীবনদর্শনই আজকের আধুনিক সভ্যতায় ঐ প্রয়োজনীয় বিষয়ীগত অর্গানাইজার-টির যোগান দিতে পারে। অন্যান্য রাজ্যের সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় এখানে শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলব। পশ্চিমবঙ্গে এই বিষয়ীগত অর্গানাইজারের উপাদান আমাদের সন্ধান করতে হবে আমাদের বাঙালি জাতির মধ্যেই। এইখানটিতে একটি বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যেন বিষয়ী এই অর্গানাইজার কোনভাবেই শত্রুভাবসম্পন্ন কোন এক্সটার্নালিটির উপর ভিত্তি করে তৈরি না হয়। এক্ষেত্রে সমস্যা দ্বিবিধ। প্রথমত, অপরজাতিকে শত্রু মনে করে কোন জাতি ঋজুতার সঙ্গে দাঁড়াতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই ধারণাটি আবার একটি বিক্ষিপ্ত ধারণা হবে, সেজন্য ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে সাধারণীকরণের কোন ক্ষমতাই তার থাকবে না। ম্যাচ জিতে বিজেপি আবার বেরিয়ে চলে যাবে এবারের মত। বরং এই বিষয়ীর নির্মাণ হতে হবে, সাধারণীকৃত মনুষ্যত্বের দিকে যাত্রা করবার যে চেষ্টা বাঙালি অতীতে করেছিল তার উপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে আমাদের সহায় হবেন রবীন্দ্রনাথ-মুকুন্দ দাস-নজ্রুল ইসলাম-ভূপেন্দ্রনাথ-শ্রীচৈতন্য এবং আরো অনেকে। এঁদের সাধারণীকৃত মনুষ্যত্বের দিকে যাত্রা সম্পৃক্ত হয়ে উঠবে ‘শ্রমে’র বিষয়গত ধারণার সঙ্গে। বিরোধ হয়তো কিছু জায়গায় বাধবে-কিন্তু সেখানেই আমাদের সৃষ্টিশীলতা এবং দৃষ্টিভঙ্গী। কোন সময়ে কোন সামাজিক ব্যবস্থায় তারা এসব করেছিলেন সেদিকে সংবেদনশীল থাকতে হবে আমাদের। তাহলেই মুকুন্দ দাসের “ছেড়ে দাও কাঁচের চুড়ি-বঙ্গনারী/ কভু হাতে আর প’রো না” – হয়ে উঠবে পণ্যপ্রীতির বিরুদ্ধে আমাদের সাধারণীকৃত বিষয়ীর নির্মাণে একটি উপাদান (এই গানটি বস্তুত সাম্রাজ্যবাদ, পণ্যপ্রীতি এবং ড্রেন অফ ওয়েলথ-এর বিরোধী একটি গান)। আমাদেরকেও অংশ নিতে হবে আজকের জীবনের দৈনন্দিনতায়, জীবনের কাছাকাছি থাকা এরকম সাধারণীকৃত মনুষ্যত্বের নির্মাণে। আমাদের প্রতিনিয়ত লক্ষ্য থাকবে – এই নির্মাণ কিভাবে বিশ্বজনীন ‘শ্রমে’র সাথে সম্পৃক্ত হয় বা তার পরিপূরক হয়ে ওঠে।
একথা সত্যি যে এই সমগ্র প্রক্রিয়া, বিজেপি-আরএসএসের উগ্রতার মতন উগ্র নয়। এর শেষ স্নিগ্ধতায়। তাই, প্রবল অর্থনৈতিক দুরবস্থায় প্রচণ্ড উগ্রতার প্রয়োজনে কখনো হয়তো ম্যাচ জিতে যেতে পারে বিজেপি। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে যতদিন পর্যন্ত না ‘শ্রম’-এর (আর প্রকৃতির) একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শ্রমজীবি মানুষের জয় করবার জন্য পড়ে আছে গোটা বিশ্ব। এইসময় পুঁজি আর তার দালাল বিজেপির বিরুদ্ধে ‘শ্রমে’র গান গাওয়া দলের লড়াইয়ে উগ্রতাও থাকবে। আর তার সমসত্ত্ব ‘ভারতীয়’-র বিকল্প হিসেবে থাকবে আঞ্চলিক সাধারণীকৃত মনুষ্যত্ব। এবিষয়টিতেও আলাদা করে অগ্নিযুগের বিপ্লবী বাঙালিরা আমাদের যথেষ্ট রসদ যুগিয়ে গেছেন।
অবশ্য এত কিছু সত্ত্বেও বিজেপির তরল উগ্রতার কাছে আমরা হয়তো অতটা উগ্র না হতে পেরে হারতে পারি। তাতে ক্ষতি নেই। কারণ আমাদের বোঝাপড়া জিতবে বলে আমরা তার হয়ে দাঁড়াই না, তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি সেজন্যই তার পক্ষ নিই। আর একারণেই বুর্জোয়া লিবারেলদের ফাঁদে পা দেওয়া আমাদের আর উচিত হবে না। আমরা তাদের সাথে কখনো-সখনো সমঝোতায় আসব, কিন্তু আমাদের টার্মসে। আমরা সেখানে দেখব – আমাদের বোঝাপড়া এর ফলে কতটা এগিয়ে গেল কতটা সুবিধা পেল। এই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই আজকের সময়ে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতটিকে বিচার করতে হবে কমিউনিস্টদের। একে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। এবং সেই অনুযায়ী কমিউনিস্টদের পুনর্বিন্যাস করতে হবে তাদের সাংগাঠনিক কাঠামো। বিজেপির জয়ে আমরা ভয় পেয়েছি। কারণ আরএসএস তার বিশ্বাসে অবিচল। আরএসএসকে আমরা ভয় পাই কারণ বিজেপি নামক বস্তুটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় হাজির। সমাজের সামগ্রিক রূপান্তর এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে প্রতিদিনই চাই বা না চাই অংশ নিতে হয় এবং যা সমাজেরই অংশ – এই সম্পূর্ণকে নিয়ে ভাবনা চিন্তার দিন কমিউনিস্টদের এসেছে।
শেষকালে আরেকটি কথা। বিজেপির জেতার পর বহু বামপন্থী, প্রগতিশীল – সেই পুরনো বুলি আউড়াতে শুরু করেছেন। ‘আমরা লড়াই করব, আমরা মানুষের পাশে থাকব, লড়াইয়ের মাঝে আমাদের লাল পতাকা থাকবে’। এই কথা গুলির মধ্যে কেবল এবং কেবল লড়াইয়ের সুরই প্রকট। এসব কথা অতি প্রাচীন। শুধু এসব করতে আমরা কমিউনিস্ট নই। শুধু লড়াই করে আমরা বাঁচতে চাই না। আমরা জয়ও করতে চাই। লড়াই আমরা করব, সেখানে লাল পতাকাও উড়বে। কিন্তু একথা আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের সামনে এই দুনিয়া পড়ে আছে জয় করবার জন্য। লাল পতাকা শুধু লড়াইয়ের ময়দানে দেখবার স্বপ্নই আমরা দেখি না – তাকে লাল কেল্লায় ওড়াবার সংকল্পও আমরা করেছি।