শিক্ষার মূলত দুটি কার্যগত বৈশিষ্ট্যের প্রথমটি হল এটি একটি ধারক হিসাবে ক্রিয়াশীল; অর্থাৎ এটি সামাজিক আদানপ্রদান ও সামাজিকীকরণের মাধ্যমে জনচেতনা, সমাজনীতি, ব্যক্তি ও সমাজজীবনের অভ্যাসগত পালনীয় লক্ষ্য-কর্ম-দর্শন ও মননের একটি গড় সূচক নির্ণয় করে। এই গড় সূচকটি ধর্ম, সংস্কৃতি, ভৌগলিক অবস্থান এবং সর্বোপরি রাজনীতি ও অর্থনীতির দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত এবং প্রায় স্থিতিশীল। ধারকের এই আপাত স্থিতিশীলতা সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোগুলিকে স্থায়িত্ব প্রদান করে। শিক্ষার দ্বিতীয় কার্যগত বৈশিষ্টটি বৈপ্লবিক; অর্থাৎ যুক্তি, নতুন চিন্তাভাবনা, তত্ত্ব, দর্শন, আবিষ্কার বা উন্মোচন, যা ধারক হিসাবে শিক্ষার কার্যগত বৈশিষ্ট্যের সাথে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে অবস্থান করে। দ্বিতীয় কার্যগত বৈশিষ্টের চরিত্রই হলো ধারকের অপেক্ষাকৃত চেতনার স্থিতিশীলতাকে এবং সেই সংক্রান্ত সামজিক ক্ষমতাকাঠামোকে আঘাত করা, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে স্থিতিশীলতাই হয়ে ওঠে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার মূল চালিকাশক্তি। এই প্রতিক্রিয়াশীলতা একটি সহনশীল প্রাথমিক দূরত্ব বজায় রেখে এই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ সাধনের প্রক্রিয়াটি ঘটায়নি, বরং দেশে দেশে, যুগে যুগে এরা সরাসরি সংঘর্ষে উপনীত হয়েছে। এই প্রাথমিক সংঘর্ষের তীব্রতা বরাবরই সর্বগ্রাসী। অগত্যা খুন হন ব্রুনো, জন হাস, সক্রেটিস, গ্যালিলিও অথবা হালের দাভালকর, কালবুর্গি, পানসারে, অভিজিৎ, ওয়াশিকুররা। অনেক পরে নবচেতনা জ্ঞান দর্শন ইত্যাদিকে অধিগ্রহণপূর্বক আত্তীকরণে প্রচলিতকরন করা হয় ঠিকই, কিন্তু তা প্রচলিতের নিয়ম অনুযায়ী চেতনা অপেক্ষা অধিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে অবস্থান করছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবোধের পরিপন্থী হিন্দু মৌলবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে আত্তীকরন করেছে এবং তা প্রচার করছে। সাধারণের অনেকেই জাতিয়তাবোধের চেতনা, সমাজচেতনা এবং তার গতিপথ এবং সেই সংক্রান্ত ইতিহাস পর্যালোচনা বা পরিলক্ষ্য করে স্বীয় চেতনার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হননি বা সুযোগ পাননি, বরং প্রচলিত অভ্যাসকে অনুকরণ করে ধারণ করাই তাঁদের অধিক সহজতর বোধ হয়েছে। কাজেই তাঁরা তথাকথিত ‘দেশপ্রেম’ শব্দটির আড়ালে লুকিয়ে থাকা জিঘাংসা ও তার ফলশ্রুতিকে চিহ্নিত করতে পারছেন না। ফলে নিজ বোধের উত্তরণ অপেক্ষা উদ্বুদ্ধ হিংসাত্মক সত্ত্বাকে সমস্যা সমাধানের আশু ও অদ্বিতীয় পথ মনে করছেন। ধারক উৎপন্ন প্রচলিত এবং প্রচলিতত্তোর নতুন, এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব ক্ষমতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। দ্বান্দ্বিক এই ক্ষমতাকাঠামোটির নির্মাণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সংশ্লিষ্ট বা সমকালীন অর্থনীতি ও ধর্মীয় সমাজকাঠামোর রাজনৈতিক সমীকরণ, অথবা অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমীকরণ। অপেক্ষাকৃত প্রচলিত স্থিতিশীল জনমননের বাজারজাত বর্তমান পোশাকি নাম হল ‘আবেগ’, যা কখনও ধর্মীয় কখনও বা জাতীয় বা যেকোনো গোষ্ঠীপরিচিতি নির্ভর; অর্থাৎ যা কিনা সংখ্যার বিচারে গরিষ্ঠ বা গরিষ্ঠতর।
বর্তমানে ‘দেশপ্রেম’ নামের আড়লে একযোগে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপের যে মারাত্মক প্রকোপ তা মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও সাধারণ জনতার একটি বড় অংশের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে উৎসাহ প্রদান সাতচল্লিশের দেশভাগের পটভূমিকায় গণঅসুস্থতা ও বিকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। বিগত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিতকে অধিক ধারণ করে উৎকৃষ্ট শ্রমিক উৎপাদনে এতটাই সচেষ্ট ও সক্রিয় ছিলো যে প্রচলিতকে অতিক্রম করে নতুন কে ধারণ করার কথা তো দূর, নিদেনপক্ষে শোনা বা বোঝার ন্যূনতম প্রয়াসের প্রবণতাটুকুও জনমানসে সঞ্চারিত করা সম্ভব হয়নি। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে প্রাথমিক বা উচ্চপ্রাথমিকে ভারতবর্ষকে ‘মাদারল্যান্ড’ বা ‘মাতৃভূমি’ হিসাবে মানচিত্র ও তেরঙা শাড়ি পরিহিতা এক কাল্পনিক মাতৃমূর্তির সাথে জোরপূর্বক জুড়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে দেশ বলতে মানুষ ও জনজীবনের বৈচিত্র বর্জিত আদি মাতৃরূপ (মাদার আর্কিটাইপ) এবং ভূমি, তেরঙা, বর্ডারলাইন ও ভক্তিরস মিশ্রিত হাঁসজারু ন্যায় যে দেবোপম চিত্রকল্প শিশুমন অধিগ্রহণ করে, তা ভারতীয় সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলি শতবার ঝরঝরে মুখস্থ লিখে ফেলা সত্ত্বেও অপসারিত হয়না। কারণ তা দৃশ্যমান নয়, বরং উল্টোটাই যে সত্যি সেটা প্রমান করে দেয় আজকের নামীদামী কর্পোরেট স্কুল। বাকস্বাধীনতার ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে স্বাধীন মত প্রকাশের জেরে শিক্ষককে রাতারাতি পদত্যাগ করতে বাধ্য করে এবং সর্বসমক্ষে তা প্রকাশ করে দুহাতে হাততালি কুড়ায়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, মানুষ বা লিঙ্গবৈষম্যবিরোধী চেতনা এসবকিছুর অবস্থান মনন ও যাপন থেকে হাজার যোজন দূরেই থেকে যায়। বিগত প্রায় তিন দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে পুঁজির আগ্রাসন শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করেছে। কাজেই প্রায়োগিক উৎকর্ষতা লাভ করলেও পণ্যায়িত শিক্ষা বাজারের দাবী মেনেই চেতনার প্রসার বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি চ্যুত হয়েছে। এই প্রাতিষ্ঠানিক অর্ধশিক্ষাই বাজারে ক্রয়যোগ্য লভ্য শিক্ষাগুলির মধ্যে সর্বাধিক চাহিদাযুক্ত ও সবচেয়ে দামী পণ্য।
শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি বরং নতুন চর্চার বা আবিষ্কারের কয়েকটি সীমায়িত ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে মাত্র। সেই নতুন চর্চা বা গবেষণার সীমায়িত ক্ষেত্রগুলি জ্ঞানচর্চার বিচারে গরিষ্ঠ একটি ক্ষমতাশীল শ্রেণির জন্ম দিয়েছে।এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাক্ষেত্র এবং সেই সংক্রান্ত ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রমাগত বৃহত্তর অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্য দিয়েই স্বীয় ক্ষমতার সংজ্ঞায়ন করেছে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যতিরিকে সামাজিক শিক্ষা, অশিক্ষা, অর্ধশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা প্রভৃত্তির প্রত্যেকটিই একেকটি ক্ষমতাশীল মেরু। মনে রাখা দরকার ক্ষমতার একক অবস্থান সম্ভব নয়, আসল শব্দটি হলো ক্ষমতাকাঠামো। এই ক্ষমতাকাঠামোর অন্তঃস্থ ক্ষমতাসীন মেরুগুলির পারস্পরিক প্রায় বিপরীত বা বিপরীতধর্মী অবস্থান ক্ষমতার অসম বণ্টনের সমীকরণের আপাত রূপটি সুচিত করে এবং একটি অস্থির টর্ক প্রস্তুত করে, যে অস্থিরতার নির্ণায়ক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও সংযোগ। এরাই ঠিক করে দেয় কোন ক্ষমতাশীল মেরুটি কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতে অধিক ক্ষমতাশীল হিসাবে সমাজের ভাষ্য হয়ে উঠবে। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা বা উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার ফলস্বরূপ বৌদ্ধিক শ্রেণিগত বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা ও অর্ধশিক্ষার ব্যাপক প্রসারহেতু নতুন চিন্তাধারা বা দার্শনিক ভাবনার অভাব ও চূড়ান্ত অসহনশীলতার রূপটি হলো বর্তমানে জনমানসে সঞ্চারিত ঘৃণা ও হিংস্রতা। এই হিংস্রতা এতটাই অন্ধ যে শুধু বহিরাঙ্গের রূপকেই বিবেচ্য জ্ঞান করে, সারবস্তু বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তাই ‘দেশপ্রেম’র নামে নির্বিচারে চলে গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠন। পোটেনশিয়াল খুনি, ধর্ষক, গুন্ডা, হুমকি প্রদানকারী, অকারন নিগ্রহকারীরা জাতীয় পতাকা হাতে ‘ভারতমাতা কি জয়’ শ্লোগান দিলেই হয়ে যান ‘দেশপ্রেমিক’। বর্তমান রাজনীতির অন্ধকারময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচ্ছন্ন ধর্মীয় মৌলবাদী, প্রায় স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী আঁতাতের ভাষ্যটি জিতে যায়। কৌশলে অপপ্রচারকে হাতিয়ার করে উচ্চশিক্ষারত ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, গণআন্দোলনের কর্মী বা মুক্তচিন্তকদের সাথে জুড়ে দেওয়া ‘দেশদ্রোহ’র ট্যাগকে সত্য মেনে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় অজস্র মিস্টার হাইড, তাঁরা কেউ ধর্ষণের নিদান দেন, কেউ বা গণপ্রহার বা প্রকাশ্যে গুলি করে মারার হুমকি দেন। অনেকটা গোরক্ষক বাহীনির ধাঁচে সরাসরি নিগ্রহের ভিডিওগুলি বিনোদনভুখ জনতার নৃশংসতার ক্ষিদেতে সোল্লাসে শান দিতে থাকে।
‘অদ্ভুত আঁধার’-ই যখন পৃথিবীর রূঢ়তম সত্য, তখন শিশুর সারল্য বা কৌতূহল নয়, বরং তার অনুকরণশীলতা ও প্রশ্নহীন আনুগত্যই ক্ষমতার একান্ত কাম্য। এই লক্ষ্যেই স্বঘোষিত ধর্মগুরু, বলিউড স্টার, ক্রীড়াবিদ প্রভৃত্তি পাবলিক ফিগারদের ব্যবহার করে তাঁদের ভাষ্যটিই উত্তম অতএব অভীষ্ট ও অনুকরণীয়, এই বিজ্ঞাপণ সারাক্ষণ চলছে। সুকৌশলে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন অভাব। দৃশ্যত যা কিছু অভাব সেইটাই যখন সমাজের বৃহত্তর ও ক্ষমতাশীল অংশের ভাষ্য, তাহলে তাদের দেখানো প্রকট বা প্রচ্ছন্ন সমাধানের রাস্তাটিই হিংসাত্মক হলেও একোমব্যদ্বিতীয়ম সত্য, এই কৃত্রিম জনমত তৈরি করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই বিজ্ঞাপণের সাফল্য নজরকাড়া, কারণ এক বিরাট অংশের মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। যাঁরা প্রভাবিত হলেন তাঁরা সংখ্যার ও ক্ষমতার বিচারে গরিষ্ঠতর এক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়াকেই ক্ষমতাশীল ও ক্ষমতাসীন অতএব নিরাপদ পক্ষে অবস্থান মনে করছেন। এভাবে প্রায় চিন্তাভাবনা বর্জিত বৃহত্তর ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রবণতাটি আসলে গণ আত্মবিশ্বাসহীনতা ও তার পরিচিতিসত্ত্বার বিপর্যয় বা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসকেই নির্দেশ করে যা তার মিথ্যাপ্রচার বা অপপ্রচার জাত অর্জিত জ্ঞান, ও অর্ধশিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। সারা পৃথিবীব্যাপী মানবসম্পদের চূড়ান্ত শোষণ করে মুষ্টিমেয়র অধীনে অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে নীল নকশা প্রতিনিয়ত তৈরী হয়ে চলেছে তারই বাস্তবিক রূপ দেওয়ার জন্য চেপে ধরা হচ্ছে যাবতীয় প্রশ্ন, যুক্তি, বিশ্লেষণ, প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের একটি বিরাট অংশও এই চক্রান্তে সামিল। স্বাভাবিক নিয়মে উল্টোদিকে জোরালো হয়ে উঠছে সম্মিলিত প্রতিবাদের কণ্ঠও। মিছিল, মানববন্ধন, সভা, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি প্রয়োজন ঠিকই; কিন্তু যদি এই প্রতিবাদ বিচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র উচ্চমেধা শ্রেণীর প্রতিবাদ হয়ে থেকে যায়, তাহলে কোন এক পরিস্থিতে আন্দোলনের জয় হলেও ভবিষ্যতে বৃহত্তর বিপর্যয়ের সম্ভাবনার অঙ্কুরোদগম শুধুমাত্র ক্ষমতামেরুর অবস্থান বদলের সেই প্রবণতাতেই অন্তর্নিহিত থাকবে। তাই গণ চেতনার বিকাশ ও বোধের উত্তরণ ঘটানোর লক্ষ্যে শিক্ষার বৈপ্লবিক দিকটির সার্বজনীন হয়ে ওঠা প্রয়োজন। তত্ত্ব, যুক্তি, দর্শন ইত্যাদির সাথে বৃহত্তর অংশের সমন্বয় সাধন এবং অতি অবশ্যই উচ্চমেধা বা শিক্ষা সংক্রান্ত ক্ষমতামেরুর বিলোপসাধন একান্ত প্রয়োজন।