আজ আমি এক ডাক্তার দিদির গল্প শোনাবো। ডাঃ পারমিতা মুৎসুদ্দি। আমার প্রথম পোস্টিং খড়গ্রাম হাসপাতালে যোগ দেওয়ার থেকেই শুনে যাচ্ছিলাম এখানে একজন মহিলা ডাক্তার আছেন। যিনি বর্তমানে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। হাসপাতালে তখন চরম অবস্থা। আছি দুজন মেডিকেল অফিসার। আমি আর ডাঃ সঞ্জীব রায়। আরেকজন অবশ্য ছিলেন। আমাদের বিএমওএইচ ম্যাডাম। কিন্তু তিনি অনেকটা গেছোদাদার মত। কোথায় যে কখন থাকতেন বলা ভারি শক্ত। অত কঠিন অঙ্ক করতে পারলে কি আর ডাক্তারি পড়ি। আমরা দুজন চিকিৎসক মিলে খড়গ্রাম ব্লকের সাড়ে তিনলক্ষ মানুষের ষাট বেডের একমাত্র হাসপাতালটি চালাতে গিয়ে নাকানি চোবানি খাচ্ছিলাম। এর উপর আবার সঞ্জীবদা সকাল, সন্ধ্যে প্র্যাকটিস করত। ফলে আমি কথা বলার একজন লোকও পাচ্ছিলাম না। এ সময় আমার সবচেয়ে ভালোলাগার কাজ ছিল সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে কোয়ার্টারের দরজা জানলা বন্ধ করে খিস্তি দেওয়া। সবচেয়ে বেশী খিস্তাতাম নিজেকে। এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে চাকরী করতে আসার জন্য। তারপরই কোনো রোগী বা রোগীর বাড়ির লোকের উপর রাগ হলে তাকে। এবং তখনও অপরিচিত ডাঃ পারমিতা মুৎসুদ্দিও আমার খিস্তির হাত থেকে রক্ষা পেত না। মনে মনে বলতুম, “শালা, এখানে আমাদের দুজনের ফাটছে, আর একজন ঘরে বসে টাকা গুনছে।” এই ভাবে একনাগাড়ে খিস্তি করার পর আমার মনের হতাশা কিছুটা কেটে যেত। আমি আবার একটি সুদীর্ঘ নাইট ডিউটি করার মনোবল অর্জন করতাম। এই দুরাবস্থা কিছুটা কাটল পীযূষদা আমাদের হাসপাতালে আসার পর। এবং সুদীর্ঘ দুই মাস পরে আমি তিনদিনের জন্য বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেলাম। পীযূষদার খড়গ্রাম হাসপাতালে প্রথম পদার্পণ রীতিমতো ঐতিহাসিক ঘটনা। সেই গল্প পরে শোনানো যাবে। আজ পারমিতাদির গল্প বলি। পীযূষদা হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর আমার খিস্তির রুটিনের বিশেষ পরিবর্তন হল না। আগে একজন মিলে খিস্তাতাম, এখন একসাথে দুজন। পীযূষদার মত এমন সৎ নারীবিদ্বেষী সহকর্মী পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। দুজনে একটা বিষয়ে একশ শতাংশ সহমত ছিলাম যে ডাঃ পারমিতা মুৎসুদ্দি একজন অত্যন্ত ফাঁকিবাজ মহিলা চিকিৎসক। তিনি যদি সত্যি সত্যিই আদর্শ চিকিৎসক হতেন তাহলে মাতৃত্বকালীন ছুটি না নিয়ে হাসপাতালে ডিউটি করতেন। পারমিতাদি যেদিন দুটি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে টলমল করতে করতে একাই তার কোয়ার্টারে ঢুকল, কোয়ার্টারের তালা খুলতেই তার পনের মিনিট লাগল, সেদিন একটু থমকে গেছিলাম। ঐ ছোটখাটো চেহারার মহিলা দুটো বাচ্চাকে সামলে চব্বিশ ঘন্টার-আটচল্লিশ ঘণ্টার ম্যারাথন ডিউটি করতে পারবে? তার মধ্যে একজন আবার দুধের শিশু। অন্যটি শিশুটি যে কি চিজ কেউ না বুঝলেও আমি পরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। আমি আর পীযূষদা একটা বিষয়ে একমত হলাম, দু চার দিন ডিউটি করার পরই ঐ মহিলা ‘ই এল’ অথবা মেডিকেল কিছু একটা ছুটি নিয়ে পালাবে। অতএব নারী জাতির উপর আমাদের বিদ্বেষ আরও বেড়ে গেল এবং আমাদের খিস্তির পরিমানও সমানুপাতে বেড়ে গেল। আমরা এই সিদ্ধান্তে এলাম যে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ানো পুরোটাই সরকারী অর্থের অপচয়। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই মহিলা একা একাই লড়ে যেতে শুরু করল। বৃদ্ধা মাসীর কাছে দুটি বাচ্চাকে রেখে একবার হাসপাতাল আর একবার কোয়ার্টারের মধ্যে দৌড়া দৌড়ি করে ডিউটি করে যেতে লাগল। একবারও আমাদের কাউকে বলল না, ঘন্টা খানেক ডিউটিটা একটু দেখে দেওয়ার জন্য। যা ভাবা হয়েছিল, তা না হওয়ায় আমরা একটু হতাশই হয়ে পড়লাম। একদিন আগ বাড়িয়ে বলতে গেলাম, “দিদি তোমার কোনও সাহায্য লাগলে বোলো।” পারমিতাদি একগাল হেসে বলল, “ তোদের অনেক জ্বালিয়েছি। আমার ছুটি নেওয়ার জন্য তোদের অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয়েছে। তোদের কোনও সাহায্য লাগলে বলিস।” তা সাহায্য আমি কম নিই নি। ডিউটি করতে করতে বোর হয়ে গিয়ে পারমিতাদিকে বলেছি, “আধ ঘন্টা একটু দেখে দাও না। ক্যানেলের পারে সূর্যাস্ত দেখে আসি।” তারপর আধ ঘন্টার নাম করে কান্দিতে ডাঃ সঞ্জয় গুপ্তের ঘরে আড্ডা মেরে তিন ঘন্টা পর ফিরে এসেছি। ফিরে দেখেছি পারমিতাদি এক সাথে বারোটা ইনজুরি রোগী নিয়ে নাকানি চোবানি খাচ্ছে। বিন্দু মাত্র লজ্জিত হইনি। কারণ ততদিনে পারমিতাদি আমার সত্যিকারের দিদি হয়ে উঠেছে। আর দিদি যদি ভাইদের জন্য এটুকু না করে, তাহলে জগত টিকে থাকবে কি করে? পারমিতাদির বড় ছেলে গুগুল কিন্তু মায়ের মত অতটা সাধা সিধা ছিল না। পারমিতাদি দুপুর বেলায় কোয়ার্টারে থেকেই ডিউটি করত। যে সব রোগী খুব খারাপ নয় তারা এমারজেন্সি থেকে টিকিট করে কোয়ার্টারে এসে পারমিতাদিকে দেখিয়ে যেত। গুগুল বারান্দায় তক্কে তক্কে থাকত। পেশেন্ট কোয়ার্টারের সামনে আসলেই সে বলত, “মা তো ঘরে নেই। তোমারা ওখানে ঐন্দ্রিল মামাকে গিয়ে দেখাও।” বলে তার ছোট্ট হাত তুলে আমার কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দিত। পারমিতাদির ডিউটি সব সময় খারাপ যেত। হাসপাতাল শুদ্ধু আমরা সবাই পোস্ট গ্রজুয়েশানের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে এসেছি, দিদি একাই ডিউটি করছে। বলা কওয়া নেই, খড়গ্রামের মোড়ের নয়ানজুলিতে ভোর ছটার তারাপিঠের বাস উল্টে গেল। একসাথে ষাট পঁয়ষট্টি জন আহত রোগী। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত। কোনও ঝামেলা ছাড়াই পারমিতাদি একা পুরোটা সামলে ছিল। নিঃসন্দেহে আমাদের সব মেডিকেল অফিসারদের মধ্যে পারমিতাদির সাহস ছিল সব চেয়ে বেশী। কেউ অন্যায় সুযোগ নিতে চাইলে, সে স্থানীয় এম পি, এম এল এ বা রাজনৈতিক দলের মস্তান যেই হোক, সুবিধা করতে পারত না। বরঞ্চ অনেক সময় রনং দেহী দিদিকে আমরা গিয়ে সামলেছি। পালস পোলিওতে পারমিতাদির সাথে সাদল গিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকার সময় বুঝেছি আমি আসলে অত্যন্ত ভীতু একজন মানুষ। আর বেশী ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি করতে চাই না। শেষ করার আগে একটা গল্প শোনাই। একদিন ডিউটির মধ্যে এক অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত নানা বয়সের পুরুষ রোগী আসতে শুরু করল। মানুষগুলির বক্তব্য একই। তাদের ইয়ে... মানে মূল যন্ত্রটা আরকি... আস্তে আস্তে শরীরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কয়কজন আসছে অত্যন্ত আপত্তি জনক ভঙ্গীতে। এক হাত লুঙি বা প্যন্টের মধ্যে ঢুকিয়ে যন্ত্রটাকে শক্ত করে চেপে ধরে রয়েছে। ‘কোরো’ রোগের কথা বইয়ে পড়েছি। এটা এক ধরণের ‘মাস হিস্টোরিয়া’ যে রোগে এলাকার বহু মানুষ একসাথে আক্রান্ত হয়। সাইক্রিয়াট্রি বইতে পড়েছিলাম। কিন্তু নিজে যে কোনও দিন সেই মাস হিস্টেরিয়ার সম্মুখিন হব স্বপ্নেও ভাবিনি। অবশ্য এর পরে আরও একটা গণ হিস্টেরিয়ার সম্মুখিন হয়েছিলাম এই খড়গ্রামেই। সেটা ছিল মেহেন্দি কাণ্ড। আক্রান্তরা ছিল কম বয়সী মেয়ে এবং ব্যাপকতা ছিল অনেক বেশী। সে গল্প অন্য একদিন শোনাবো। ‘কোরো’ অসুখেই ফেরত আসি। ওয়ার্ডে রোগীতে ছয়লাপ। অসুখের ভয়ে লোক জন লাজ লজ্জা ভুলেছে। জামা কাপড়ের ঠিক নেই। নার্স দিদিরা কোনও মতে অন্যদিকে তাকিয়ে স্যালাইন চালাচ্ছে। তাদের অবস্থাই সবচেয়ে শোচনীয়। রোগীদের কাণ্ডকারখানা দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সেদিনের রাত্রি ‘কোরো’র কল্যাণে নির্ঘুম কাটল। সারা রাত্রি রোগী এসেছে। কারো কপালে চন্দনের ফোঁটা, কারো আবার সারা গায়ে চুন লেপা। ‘কোরো’ রোগের ওষুধ। সকাল সাতটায় ডিউটি পরিবর্তন। ভাবলাম আউটডোরের আগে ঘণ্টা খানেক অন্তত ঘুমিয়ে নি। সবে শুতে যাচ্ছি, হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। দেখি পারমিতাদি। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমাকে দেখে বলল, “অসম্ভব, আমি ডিউটি করতে পারব না। যত সব অশিক্ষিত, আনকালচার্ড লোকজন। তুই আজকের দিনটা টেনে দে।” “পারমিতাদি, আমি কাল রাতে একটুও ঘুমাই নি। আমি আর পারব না।” “আমিও পারব না। ছি ছি, তুই বল আমার পক্ষে ঐ সব পেশেন্ট দেখা সম্ভব।প্লিজ ভাই, অন্তত ঐ পার্ভাটেড লোকগুলোকে তুই দেখ।” অগত্যা আবার এমারজেন্সিতে গেলাম। সেখানে ভালোই ভিড় জমেছে। বেশীরভাগেরই একই সমস্যা। সমস্যার কথা শুনতে শুনতে আমি ঘুমে ঢুলছিলাম। ঘুমাতে ঘুমাতেই রোগী দেখছিলাম। হঠাৎ পিঠে কে হাত দিল। তাকিয়ে দেখি পারমিতাদি। দিদি বলল, “যা ঘুমিয়ে নে। আমি ডিউটি করছি। ডাক্তারি যখন পড়েছি তখন... বল বাবা, তোমার কি হ’ল...” পারমিতাদির লেকচার শুনতে পাচ্ছিলাম, “এরকম অসুখ হতে পারেনা। বিশ্বাস না হলে স্কেল দিয়ে মেপে দেখ। এখন মাপবে, আবার এক ঘণ্টা পরে মাপবে...দেখবে একই আছে।” চিকিৎসক জীবনের শুরুতেই আমি পারমিতাদিকে পেয়েছি। তার রোগীর প্রতি অসামান্য কর্তব্যবোধ দেখেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখেছি। তার অসাধারণ মেধা দেখে অবাক হয়েছি। আরও অবাক হয়েছি দিদির মাটির কাছাকাছি থাকার বাসনা অনুভব করে। নারী দিবসে তাই পারমিতাদির মত সকল নারীকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই। যারা নিঃশব্দে ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাচ্ছে। নারী হিসাবে আলাদা কোনও সুযোগ কখনও দাবী করেনি।