আমার সাথে একবার মৃত্যুর দেখা হয়েছিল। সে আজ থেকে বছর এগারো আগে। তিনি আমার মাথায় স্নেহের হাত রেখেছিলেন। ডাক্তারেরা তাকে নিজেদের মতো করে লিখেছিলেন 'অ্যাকিউট হেমাটোমা ইন দি বেসাল পার্ট অফ লেফ্ট অ্যান্ড রাইট ফ্রন্টাল লোব্স উইথ পেরিলিশন্যাল ঈডিমা'। ওঁর কী মনে হয়েছিল তা জানিনা, হয়তো আমাকে বলে গেছিলেন, ঠিক মনে নেই, কিন্তু থাকেননি ভদ্রলোক। আমিই থেকে গেছিলাম। পরে, অনেক পরে,ধীরে ধীরে অচেনতা, অ্যামনেশিয়া, পেইনকিলার ইঞ্জেকশান সবার কোলাকুলি থেকে বেরোবার শেষে আস্তে আস্তে বুঝেছিলাম মৃত্যু আমার জন্য কী রেখে গেছেন। একটা খিলান, যা দিয়ে অন্য কোন জগতে পা রাখা যায়। কিম্বা হয়তো রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম একটা, যার নম্বর নয় পূর্ণ তিনের চার -- নাইন অ্যান্ড থ্রী কোয়ার্টার্স।
এই দুনিয়ায় বিনা শুল্কে কিছুই হয়না। কোন কিছু পেতে গেলেই আগে দাম দিতে হয়। আমিও দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি এই খিলানটা দেখতে পাবার আগে শুধু গুণে গুণে দেওয়া সেই হিসেবের কড়ি গুলোই চোখে পড়েছিল। স্মৃতি, স্বাদ, গন্ধ। দিদিরা অনেক যত্ন নিয়ে মনে করানোর চেষ্টা করত -- 'সেই যে রে মনে নেই সেদিন এই এই হয়েছিলো, আমরা এই এই করেছিলাম' -- আমি ক'টা বইয়ের পাতা দেখতে পেতাম শুধু, তাতে কোন অক্ষর নেই, জল পড়ে সব লেখা ধেবড়ে গেছে। খাবার সময় জিভের ওপর শুধু স্পর্শ পেতাম, আর কিচ্ছু না। ভীষণ অন্ধকার, স্তব্ধ এক স্পর্শ শুধু, যেন রবারের টুকরো চিবিয়ে যাচ্ছি। ল্যাবে একদিন কার হাত থেকে মারক্যাপ্টো-এথানলের শিশি পড়ে ভেঙ্গে গেলো। আমার গন্ধহীন দুনিয়ায় এতটুকু ঢেউ উঠল না। সব স্থির, একটা পাতাও নড়েনা। ডাক্তারবাবু নিজের মত করে বললেন 'অ্যানোস্মিয়া'। দুবছর ধরে ক্রমাগত ফেন্টয়েন খেতে খেতে দাঁতের মাড়িরা স্পঞ্জের মত অন্তঃসারশূন্য হয়ে উঠল। এতটুকু টানাপোড়েনে ঝরঝর করে রক্ত ঝরায়। শুল্ক। মাশুল, হিসেবের কড়ি।
একদিনে কোন কিছু হয় না। হয় নি। একদিনে কোনকিছু বোঝা যায় না। আমিও বুঝি নি। আস্তে আস্তে ওরা ফিরে আসছিল। যেন কেউ খুব যত্ন করে একটা নব্ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার দুনিয়ার ফোকাস অ্যাডজাস্ট করছে। যেন অঝোর বৃষ্টির ওপাশে একটা দারুণ লাল মেপ্ল গাছ ... ধীরে ধীরে বৃষ্টি কমে আসে। স্বাদেরা ফিরে এলো, সবাই নয়, মনে হয় ৭০ ভাগ। গন্ধরা। সবাই নয়, হয়তো ৬৫ ভাগ। ওদের সঙ্গেই আরো একজন এসেছিলো, ঐ খিলান। বা প্ল্যাটফর্ম। ওর নাম বিভ্রম।
অনুভূতিরা সবাই একরকম হয় না। সবাই এক জিনিষ ভালোবাসে না। বিভ্রমকেও সব অনুভূতিরা পাত্তা দেয় নি। ওদের অনেকেই নিজেদের দুনিয়া নিয়ে খুশি ছিল, নিজেদের জীবন, কেরিয়ার, লাভলাইফ, নিজেদের বন্ধুবান্ধব ক্লাব পোকারগ্রুপ নিয়ে খুশি ছিল। শুধু দুজনের হাত ধরেছিল বিভ্রম। দৃষ্টি আর ঘ্রাণ। ভিজুয়াল অ্যান্ড অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন -- ডাক্তারবাবু বলেন, নিজের মত করে।
শুনেছি অক্সিপিটাল লোবে চোট লাগলে ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হতে পারে। না, আমার তো সেখানে চোট লাগেনি। তবু, বিভ্রম আমার চোখের বারান্দায় একটা সাদা কাঠের রকিং চেয়ার রেখে চলে গেছে। মাঝে মাঝে এসে বসে রোদ্দুরে, কি বৃষ্টিদিনে, তারাদের রাত্রে। একদিন আমি লোকাল ট্রেনে করে শেয়ালদা সাউথ স্টেশনে যাচ্ছিলাম। আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে। আমি দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে স্টেশনের মস্ত বাড়িটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। এমন সময় এক মুহূর্তের জন্য সব বদলে গেলো। স্টেশনের বিল্ডিংএর জায়গায় একটা প্রকান্ড ভাঙা রাজবাড়ি আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। একেবারে স্পষ্ট, দিনের আলোর মত। পরের মুহূর্তে -- অনুগ্রহ করে শুনবেন ডানকুনি লোকাল আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। বিভ্রম।
আরো একদিন। উইসকনসিনের ম্যাডিসন শহরে থাকি। দুপুরবেলা আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। আমার সামনে জানলা। জানলার বাইরে একটা সবুজে সবুজ রেনট্রী। এর'ম দুপুরে বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা যায়না। আমি বৃষ্টি দেখি, কালো আকাশ দেখি, রেনট্রীর সবুজে জলছল ঊর্মি নূপুর দেখি। হঠাৎ দেখলাম ওর ডালে ডালে গোলগাল সবুজ আম ধরে আছে। সুপুষ্ট নধর। পলক ফেলতেই ভোঁ ভাঁ। কেউ কোত্থাও নেই। বিভ্রম!
আরো কতজন যে আছে! রোজরোজ, এখানে ওখানে। সবার কথা বলে কত পাতা ভরাব? কোনদিন দেখলাম রান্নাঘরের মেঝে থেকে একটা সাদা নোটন পায়রা চক্কর খেয়ে ছাদের দিকে উড়ে গেলো। কোনদিন জানলার কাঁচের এপাশে কমলারঙের ওকপাতা ঘুরে ঘুরে কার্পেটের ওপর এসে নামলো। কোনদিন হয়তো অন্ধকার শোবার ঘরে দেখতে পেলাম কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাদা-নীল জাহাজী পোশাক তার। সবই ঐ এক দু সেকেন্ডের জন্য। তারপরেই ওরা হারিয়ে যায়। বিভ্রম আমার চোখের বারান্দায় সাদা রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে থাকে। আপনমনে।
এবার ঘ্রাণের কথা বলি। ভারি খামখেয়ালি হয়ে গেছে ও, সেই সময়ের পর থেকে। এক একদিন আমি কোন গন্ধই পাই না, মনে হয় ঘ্রাণশক্তি যেন কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। এক একদিন পাই, আবছা, কোনদিন বা আরেকটু বেশি। কোনদিন এক গন্ধকে আরেক গন্ধ ভেবে ভুল করি। প্যারোস্মিয়া। এতে অবাক হবার কিছু নেই। আমাকে ডাক্তারবাবু বলেই দিয়েছিলেন 'যেটুকু গন্ধ পাবে জানবে তাই অনেক। যেখানে যেভাবে চোট পেয়েছো তাতে যে আদৌ কোন সেন্স অফ স্মেল ফিরে এসেছে তাই জানবে মিরাক্ল'। মিরাক্ল, জাদু। হ্যাঁ, আমি ম্যাজিকে বিশ্বাস করি।
আমার অ্যানোস্মিয়া, প্যারোস্মিয়ার চৌহদ্দিতে বিভ্রম আরো একজনকে নিয়ে এলো। ফ্যান্টোস্মিয়া। অশরীরি গন্ধ। যা নেই তার গন্ধ। কোন বসন্তবিকেলে ডেইজি ফুল ভরা মাঠের মধ্যে আমি তীব্র রাবার পোড়ার গন্ধ পেলাম। তারাভরা রাত্রে সমুদ্রের ধারে বালিতে বসে থাকতে থাকতে পেলাম মিডনাইট পয়জনের গন্ধ। কোন শান্ত ভোরে দুটো ছটফটে চিকাডী দেখতে দেখতে হঠাৎ টোস্টেড নারকেলকোরার গন্ধ। প্রতিটা গন্ধই স্পষ্ট খুব, কোন আবছা ঝাপসা ভাব নেই তাতে। ফ্যান্টম অফ স্মেল।
আরো অবাক লাগে এক একদিন। যখন মস্তিষ্ক টিডলি উইংকস খেলতে নামে বিভ্রমের সাথে। আপনারও অবাক লাগবে, যদি শোনেন। একদিন আমি পেস্টো বানাচ্ছিলাম। পেস্টো, সেই যে ইতালির। তারজন্য পালং পাতা, আরুগুলার পাতা, বাদাম সব একসাথে বাটতে হয়। মিক্সির ভেতরে সবুজ রঙের মিশ্রণ তৈরি হলো একটা। ঢাকনা খোলার আগেই আমি ধনেপাতার চাটনির গন্ধ পেলাম। কিন্তু পালং বা আরুগুলা কারুর গন্ধের সাথেই ধনেপাতার এক বিন্দু মিল নেই। আমার ধরণা, ঐ সবুজ বাটনা দেখে বোকা মস্তিষ্ক ভেবে নিয়েছে ওটা ধনেপাতারই চাটনি। তাই সেই গন্ধই পেলাম আমি, অশরীরী গন্ধ।
আরেকদিনের কথা শুনুন। এই অলফ্যাক্টরি ধাক্কা খাবার পর থেকেই মাছের গন্ধ অসহ্য লাগে আমার। খাবার সময় অতটা নয়, কিন্তু রান্নার সময়, একেবারে অসহ্য। তাই মাছ রান্নার পরে আমি রান্না ঘরে ফাব্রীজ স্প্রে করে দিই। সেই স্প্রে তে অনেকদিনই আপেল-দারচিনির গন্ধ, কোনদিন হয়তো লেবুর, কোনদিন ভ্যানিলা-প্যাশনফ্রুটের। সেদিন সদ্য রান্নাঘরে ঢুকে খানদুই তেলাপিয়া মাছ বার করে থ' হতে দিয়েছি জলের মধ্যে। তখনো রান্নাবান্নার ঢের দেরী। আমি বারান্দায় গিয়ে পাখিদের খাবার দিয়ে আবার ফিরে আসি। রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখি আপেল-দারচিনির গন্ধে ঘর ম' ম' করছে। মস্তিষ্ক কি মাছ দেখেই ভেবে নিল রান্না হয়ে গেছে?
বললাম তো, সবার কথা লিখতে গেলে পাতা ফুরোবেনা। শুধু আরেকদিনের গল্প বলে শেষ করবো। বলেছি না আমি ম্যাজিকে বিশ্বাস করি? এদিনের গল্পে একটুখানি ম্যাজিক রয়েছে।
আমি ল্যাবে বসে কম্পিউটারে একটা প্রোগ্রাম চালিয়ে ভাইরাসদের হাল-হকিকৎ এর খবর নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার সত্বাময় চকোলেট কেক এর সুগন্ধ ছেয়ে গেলো। সদ্য বেক হওয়া ডার্ক চকোলেট, সামান্য কফির হিন্ট, হয়তো একটু দারচিনিও আছে, স্বর্গীয় গন্ধ! ঐ ঘরে কোনদিক দিয়েই এমন গন্ধ এসে ঢুকতে পারেনা। অসম্ভব! কাজে মন লাগছিল না ঐ গন্ধ পাবার পর থেকে। আইপি-ল্যাব বন্ধ করে দিয়ে ইয়াহু খুলি। দেখি প্রথম পাতাতেই এই বড়ো একটা চকোলেট কেকের ছবি! এর ব্যাখ্যা করতে পারিনি কিছুতেই। ম্যাজিক ছাড়া কী বলবো?
এইই বিভ্রমের গল্প। এগারো বছর আগে একজন ঘুমপাড়ানী বুড়ো এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যে উপহার দিয়ে গেছিলেন সেই গল্প। এখনও আমার ব্রেনে এনকেফালোম্যালেশিয়া আসন পেতে রয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এই নিয়ে আরো জানি। পড়ে ফেলি অনেক কিছু। জিজ্ঞেস করি যাঁরা জানেন তাঁদের। আবার পরের মূহূর্তে ভাবি -- থাক। ভালো লাগে এই অন্য দুনিয়ায় মাঝে মাঝে পা রেখে ফিরে আসতে। ম্যাজিক দুনিয়ার সমস্তটা জেনে ফেলে কী লাভ? ভালো লাগে এইই। ভালো লাগে যখন বিভ্রম আমার ঘাড়ের ওপর ফুঁ দেয়। আমার কানে কানে হাওয়ার স্বরে ফিসফিস করে বলে-- 'আলোহোমোরা'।
--------------------------------------------------------------------------------------------
ছবি ঃ সুমেরু মুখোপাধ্যায়
লেখাটি কাগুজে গুরুতে প্রকাশিত।