এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • খানাকুল - ২

    ন্যাড়া লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১০৫৫ বার পঠিত
  • এর আগে - https://www.guruchandali.com/blog/2019/01/10/1547060078721.html

    অযোধ্যার নবাবির পত্তন করেছিলেন প্রথম সাদত আলি। পারস্যের লোক। দিল্লির মুঘল বাদশা তাঁকে অযোধ্যার নাজিম করে দেন। সেই নাজিমই লক্ষ্ণৌর কাছে ফয়জাবাদের রাজধানী স্থাপন করে অযোধ্যার নবাবি শুরু করেছিলেন। তৃতীয় নবাব সুজা-উদ-দৌলার আমলে রাজধানী চলে আসে লক্ষ্ণৌতে। সেই থেকে অযোধ্যা আর লক্ষ্ণৌ সমার্থক হয়ে ওঠে। তদ্দিনে দিল্লির অস্তগামী ছায়া পড়েছে লক্ষ্ণৌতে। লক্ষ্ণৌ তখন হিন্দুস্তানী সংস্কৃতির শুধু ধারক-বাহকই নয়, তার অগ্রডোমও বটে। আর সেই সংস্কৃতির মধ্যে খাবার-দাবার অন্যতম মূলস্তম্ভ।

    সুজা-উদ-দৌলা যখন লক্ষ্ণৌর নবাব তখন তাঁর রান্নাঘরের দায়িত্বে ছিলেন হাসান রেজা খান। হাসান রেজা খান পরিচিতি মির্জা হাসানু নামে। মির্জা হাসানুর সহকারী ছিলেন যিনি, হাসানুর অনেককালের বন্ধুও বটে - তাঁরা একই সঙ্গে বড় হয়েছেন, তাঁর নাম মৌলবী ফজল আজিম। বলাই বাহুল্য, এসব পদের যাঁরা থাকতেন তাঁরা সবাই রইস আদমী। লক্ষ্ণৌর ক্রিম অফ ক্রিম। তো এই ফজল আজিম খাবার পরিবেশনের যে তারিকা শুরু করেছিলেন, তা তাঁর পরেও বহুদিন অব্দি চলেছে। যদিও তারই রকমফের রাজা-বাদশাহদের মহলে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। নবাবি পাকোয়ান থেকে খাবার খ্বানে (খ্বান মানে থালা বা ট্রে। পহ্লবী শব্দ। এরথেকে দস্তরখ্বান বা দস্তরখান।) সাজিয়ে, তাকে শালু মুড়ে পাকোয়ানপ্রধানের শিলমোহর লাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হত নবাবের খাসমহলে। সে খাবার নিয়ে যে্ত যে পরিচারক ও, মূলতঃ, যে পরিচারিকারা, তাঁদের সঙ্গে যেতেন হয় পাকোয়ানপ্রধান স্বয়ং বা তাঁর সহকারী অথবা অন্য কোন উচ্চপদের অধিকারী কোন রসুই অধিকারিক। তাঁর উপস্থিতিতে যতক্ষণ না নবাবের বেগমের খাস পরিচারিকার সঙ্গে খাবার হাতবদল হচ্ছে ততক্ষণ খাবারের দায়িত্ব তাঁর। খাস পরিচারিকাকে শিলমোহর ভেঙে খাবার দস্তরখানে সাজাতে হত বেগম 'বহু বেগম'-এর উপস্থিতিতে। খাবারে বিষপ্রয়োগের ভয় ছিল সর্বদাই। চোখের আড়াল করা যেত না এক মুহূর্তের জন্যেও।

    প্রতিদিন নবাব সুজা ও বেগমের খাবার আসত ছ'টি ভিন্ন রসুই থেকে। প্রথমটি হল মির্জা হাসানুর তত্বাবধানে নবাবের খাস যে পাকোয়ান, সেখান থেকে। এ রসুইখানার জন্যে বরাদ্দ ছিল দিনে দু'হাজার টাকা। বাবুর্চি-খানসামাদের মাইনে-টাইনে এর বাইরে। দু'হাজার টাকা দিনে শুধু খাবার-দাবারের জন্যে। অর্থাৎ মাসে ষাটটি হাজার টাকা। আজকের দিনে সে টাকার মূল্য কত ভাবতে মাথা ঘুরে যায়। আন্দাজ দিতে দিতে বলি ১৯৫৮ সালের ১০০ টাকা ২০১৯ সালে সাড়ে সাত হাজার টাকার সমান। এই যদি ব্যাপার হয় তাহলে ১৯৫৮ সালের দু'শো বছর আগে দিনে দুশো টাকার মূল্য আজ কত দাঁড়িয়েছে তা বের করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হল।

    যাকগে এ গেল নবাবের খাস রসুইঘরের কথা। দ্বিতীয় যে রসুইঘর থেকে নবাব ও বেগমের দৈনন্দিন খাবার আসত সেটিও নবাবের খাস পাকোয়ান - কিন্তু এটি মূল পাকোয়ান নয়, তার অধীনে আরেকটি পাকোয়ান। কিন্তু সেটি যে গুরুত্বে কোন অংশেই খাটো নয় তা বোঝা যায় এ থেকে যে এই দ্বিতীয় পাকোয়ানের দায়িত্বেও ছিলেন মির্জা হাসানু। পরে সেটির ভার নেন একজন খোজা - আনওয়ার আলি খান। এ পাকোয়ানের দৈনন্দিন বরাদ্দ ছিল তিনশ টাকা। তিন নম্বর রসুই ছিল নবাবের বেগমের, তাঁর খাসমহলের সঙ্গে লাগোয়া। সেই পাকোয়ানেরও দায়িত্বে ছিলেন আরেক খোজা, বাহার আলি খান। চার নম্বর পাকোয়ান ছিল নবাব সুজা-উদ-দৌলার মা নবাব বেগমের। বাকি দুই পাকোয়ান ছিল নবাবের দুই শালার - বহু বেগমের দুই ভাই - মির্জা আলি খান আর নবাব সালার জঙ।

    নবাব সুজা-উদ-দৌলার পঁচিশ বছর পরে নবাব হলেন সাদাত আলি (দ্বিতীয়)। 'গোরস্থানে সাবধান' গল্পে ফেলুদাকে সিধুজ্যাঠা কী বলছেন শুনুন - "...সাদত আলি তখন লখনৌ-এর নবাব। দিল্লির পিদিম তখন নিবু-নিবু, যত রোশনাই সব লখনৌ-এ। সাদত ইয়াং বয়সে কলকাতায় ছিল, সাহেবদের সঙ্গে মিশে ইংরিজি ভাষাটা একটু ভাসাভাসা শিখেছিল, আর শিখেছিল ষোল আনা সাহেবিয়ানা। আসাফ-উদ-দ্দৌল্লা মারা যাবার পর ওয়জীর আলি হল নবাব। সাদত আলি তখন কাশীতে। মন খারাপ, কারণ আশা ছিল আসফের পর সেই গদিতে বসবে। এদিকে ওয়জীর ছিল অকর্মর ঢেঁকি। ব্রিটিশরা তাকে বরদাস্ত করতে পারলে না; চার মাসে তার নবাবী দিলে বরবাদ করে। মনে রেখো, অযোধ্যায় তখন কোম্পানির প্রতিপত্তি খুব; নবাবরা কোম্পানির কথায় ওঠে বসে। ওয়জীরকে হটিয়ে তারা সাদতকে সিংহাসনে বসাল। সাদত খুশি হয়ে ব্রিটিশকে অর্ধেক অযোধ্যা দিয়ে দিলে।

    "সে সময়ে লখনৌ-এর অলিতে-গলিতে সাহেব। নবাবের ফৌজে সাহেব অফিসার, সাহেব গোলন্দাজ; তা ছাড়া সাহেব ব্যবসায়ী, সাহেব ডাক্তার, সাহেব পেন্টার, সাহেব নাপিত, সাহেব ইস্কুল মাস্টার; আবার কেউ কেউ আছে যারা এসেছে শুধু টাকার লোভে; নবাবের নেক নজরে পড়ে দু-পয়সা যদি কামাতে পারে। এই শেষ দলের মধ্যে পড়ে টমাস গডউইন। ইংলন্ডের ছোকরা–সাসেক্স না সাফোক না সারি কোথায় তার বাড়ি ঠিক মনে নেই - সে দেশে বসে নবাবীর গল্প শুনে এসে হাজির হল লখনৌতে। সুপুরুষ চেহারা, কথাবার্তা ভাল, রেসিডেন্ট চেরি সাহেবের মন ভিজিয়ে তার কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিয়ে গিয়ে হাজির হল নবাবের দরবারে। সাদত জিজ্ঞেস করলে, তোমার গুণপনা কী। টমাস শুনেছে নবাব বিলিতি খানা পছন্দ করে - রান্নার হাত ভাল ছিল ছোকরার - বললে আমি ভাল শেফ, তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে চাই। নবাব বললে খাওয়াও। ব্যস - গডউইন এমন রান্না রাঁধলে যে সাদত তক্ষুনি তাকে বাবুর্চিখানায় বাহাল করে নিলে। তারপর থেকে নবাব যেখানে যায় সেখানেই মুসলমান বাবুর্চির পাশে পাশে যায় টমাস গডউইন। লাটসাহেব শহরে এলে সাদত তাকে ব্রেকফাস্টে ডাকে - সাহেব খুশি হলে সাদতের মঙ্গল - ভরসা টমাস গডউইন। আর নতুন কোনও ডিশ পছন্দ হলেই আসে বকশিশ। নবাবি বকশিশ জানো ত ? দু-দশ টাকা কি দু-চারটে মোহর হাটে গুঁজে দেওয়া ত নয় — লখনৌ-এর নবাব! হাত ঝাড়লেই পর্বত।?"

    টমাস গডউইন হয়ত গল্প। কিন্তু বাকিটা নয়। কারণ এই গল্প লেখা ঠিক আগেই 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' ছবির জন্যে সত্যজিৎ রায় লক্ষ্ণৌ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন লক্ষ্ণৌ আর লক্ষ্ণৌর নবাবদের নিয়ে। তাই বলি খানাপিনা ইয়ার্কির ব্যাপার নয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১০৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ন্যাড়া | ***:*** | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৭:১৭47652
  • .
  • swati ray | ***:*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৩২47654
  • টমাস গডউইন গল্প হোক আর নাই হোক, নবাবী খানার সঙ্গে ইউরোপীয়ান খানার মিশেল হয়েছিল কি? হলে সেটা কি দাঁড়ালো - সেটা তো একটু বল! আমাদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ঘরানার রান্না তার শুরু কি এই ভাবে?
  • ন্যাড়া | ***:*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:০৯47655
  • দাঁড়া। এখন তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি পড়ছি। এখনও টমাস রো এসে পৌঁছয়নি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন