সামনে বসা লোকটি হঠাৎ প্রবল আনন্দে এক হাত ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “বেশ হয়েছে।”
মেট্রোরেল সবে দমদম থেকে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে বেলগাছিয়ার দিকে। এমন হাঁক শুনে পাশে বসা মানুষেরা কান থেকে ইয়ারফোনের প্লাগ খুলে নিলেন ঝটিতি। কৌতুহলী চোখ। লোকটি ফের বলে উঠলেন, “দুলকি চালে কুকুর নিয়ে ঘোরার সময় মনে থাকে না? শাবাশ, জজসাহেব, শাবাশ। এবারে লোকগুলোর আদিখ্যেতা কমলে হয়।”
বুঝতে পেরেছিলাম, ভদ্রলোকের উত্তেজনা আসলে হাতে ধরা খবরের কাগজের জের। পাতাটি টেনে নিলাম। ইংরিজি দৈনিকের কোন সংবাদের জন্য লোকটির পরমানন্দ, তা আঁচ করে নিতে বেগ পেতে হল না। আনন্দের মূলে এক রটওয়াইলার। নামটি আমিও প্রথম জানতে পারলাম জীবনে। ইহা এক সাহেবি সারমেয়। তেরো বছর আগে এই কুকুরটি এক বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধকে তিনবার কামড়ে দেয়। ঘটনাস্থল মুম্বইয়ের সান্তাক্রুজ। সারমেয়টির মালিক ছিলেন এক ব্যবসায়ী। এই ত্রিফলা দংশনে বৃদ্ধ রক্তাক্ত হন। এক দশকেরও বেশি সময় পরে বিচার পেলেন তিনি। তিন মাসের জেল হয়েছে ওই ব্যবসায়ীর। আদালত বলেছে, “রটওয়াইলারের যেহেতু হিংস্র স্বভাব, তাই অন্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পশুটিকে সামলানোর দায়িত্ব মালিকের উপরেই বর্তায়।” বুঝতে কষ্ট নেই, এই দায়িত্ব সেদিন বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। ভুক্তভোগীর অবশেষে বিচার মিলল। ইতিমধ্যেই আনন্দ সংবাদটি রাষ্ট্র করে দিয়েছিলেন “বেশ হয়েছে” উক্তির মালিক। ভিড়ে ঠাসা মেট্রোরেলে এই আনন্দধ্বনি কোরাসের রূপ নেয় মুহুর্তে। গন্তব্য স্টেশনে না নেমে যাওয়া অবধি এই এক গাল হাসি লেগেছিল বহু সহযাত্রীর মুখে।
আমার কাকুস্থানীয় এক ব্যক্তি আছেন, যিনি তাঁর বংশপরিচয় দেওয়ার সময় বলেন, “পরিবারে আমি আছি, স্ত্রী আছেন। আর আছে আমার তিন সন্তান।” এই বাজারে তিন সন্তান শুনে লোকের ভ্রু কুঁচকে গেলে তিনি বিষয়টির খোসা ছাড়ান। খোলসা করে বলেন, “না না যা ভাবছেন তা নয়। আমার নয়নের মণি আমার মেয়ে আর দুটি প্রাণাধিক প্রিয় চারপেয়ে—জন্টি আর মন্টি।” প্রাণপ্রিয় সারমেয়রা কারও দিকে তেড়ে গেলে কাকুকে বলতে শোনা যায়, “নিশ্চিন্তে থাকুন। ও কিছু করবে না।” আদুরে গলায় জন্টি মন্টিকে বকেন, “ডোন্ট টাচ সোনা, ডোন্ট টাচ। কাম হিয়ার।” এর মধ্যে অবশ্য দুটির কোনও একটি, নিজের পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে সামনের অপরিচিত লোকটির কাঁধ অবধি বাড়িয়ে দিয়েছে থাবা। এহেন উৎপাতে অপরিচিতরা ভয়ে কাঁপতে থাকেন। আর “অ্যাই হ্যাট্” বলে গর্জন করে উঠলে কাকু এর দ্বিগুণ ডেসিবেলে গলা শানান—ভদ্রভাবে কথা বলতে শিখুন মশাই। আমি তো বলেছি ও কিছু করবে না। জন্টি মন্টি প্রভুর কাছে ফিরে এলে মাথায় ভাল করে মালিশ করে দিয়ে বলেন, “জিতে রহো বেটা।”
পুষে রাখা সারমেয়র যত্ন কিভাবে করা যায়, তা নিয়ে প্রায়ই পড়ি খবরের কাগজে। কালীপুজোর রাতে বাজির প্রবল আওয়াজে বাড়ির কুকুরটি যেন ভয় না পায়, জানালার সামনে মাইক বাজিয়ে ডিজে সঙ্গীত হলে প্রিয় সারমেয়টি যেন আতঙ্কিত না হয়, তা নিয়ে বহু টোটকা দেন পশু বিশেজ্ঞরা। হৃদযন্ত্রের সমস্যার ভোগা আপনার মানুষ-প্রিয়জনকে এই অত্যাচারের হাত থেকে থেকে কিভাবে নিরাপদ রাখা যায়, তার তুলনায় অনেক বেশি নিউজপ্রিন্ট খরচ হয় পোষ্যের যত্নের সন্ধানে। কিন্তু ঘরে পুষে রাখা অবাধ্য পশুকে কিভাবে লাগাম দিতে হয়, তা নিয়ে চোখে পড়ে না কিছু। অন্যের শরীরে দাঁত বসিয়ে দিলেও দিনের শেষে সেই সারমেয় ‘অবলা’ই থেকে যায়।
রুটিরুজির যোগাড়ে যে অঞ্চলে অফিস করতে যাই রোজ, তা তিলোত্তমা শহরের অত্যন্ত অভিজাত এলাকা বলে খ্যাত। এক বাহারি বাড়ি পাশের অন্য এক অট্টালিকাকে দশ গোল দেয়। তার গায়ে লেগে থাকা বাংলো আবার ওই অট্টালিকাকে বলে, কবে যে বড় হলাম চুপিসাড়ে। বিশালবপু বাড়িগুলোর সামনের রাস্তায় থুতু ফেলা মানা। দু কোয়া কমলালেবু মুখে পুরে খোসাটা ফুটপাতে ফেলার পর এমনই এক বাড়ির ব্যালকনি থেকে উড়ে এসেছিল, “রাস্তা নোংরা করছেন, লজ্জা করে না?” গলা উঁচিয়ে দেখি, হট প্যান্ট পরা কোনও এক কলেজ পড়ুয়া। মাথা নামিয়ে নেওযার পরে আরও দুটো কথা ঝরে পড়েছিল বর্ষার রাস্তায় ইস্তিরি ভাঙা প্যান্টে কাদা ছিটকে আসার মতো। “যত্তসব মিডলক্লাস।” তবে ওই রাস্তাতেই প্রতি কুড়ি পঁচিশ ফুট অন্তর দেখেছি সারমেয়র বিষ্ঠা। যে সময়ে অফিস যাই, সেই রাস্তাতে প্রতিদিন দেখি প্রাতঃভ্রমন করতে আসা বিদেশি ব্রিডের কুকুরবাহিনীকে। মর্নিং ওয়াক আর প্রাতঃকৃত্য একই সময়ে চলে। গলায় বেল্ট বাঁধা কুকুর আর ওই বেল্টেরই অপর প্রান্ত ধরে থাকা মনিব—কে যে আসলে কাকে টানে বুঝতে পারি না। তবে দেখেছি, সারমেয় এবং তার মনিবের গতিপথ হয় অনেকটা সাইন কার্ভের মতো, কিংবা প্রবল অস্থির কোনও শেয়ারের মতো। কোনও এক নিয়ম আছে হয়তো। প্রভুভক্ত কুকুর প্রভুর বাড়িটিকে চেনে বেশ। তাই প্রাতঃকৃত্য সারতে ভালবাসে বেশ কয়েকটি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। ফলে আগরওয়াল প্যালেসের গোল্ডেন রিট্রিভার নিজেকে আরাম দেয় ঘুটঘুটিয়া ম্যানসনের সামনের ফুটপাথে। আবার একই যুক্তিতে চামারিয়া ভবনের ল্যাব্রাডর হাল্কা হয় ঝুনঝুনওয়ালা ভিলার সামনের রাস্তায়। মনিবদের মধ্যেও হয়তো এ নিয়ে কোনও অলিখিত বোঝাপড়া আছে। কুকুরের মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, গরমকালে ঘরের এসির তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রির জায়গায় সারে বাইশ ডিগ্রি রাখা হলে পোষ্য সারমেয়টির মন একটু বেশি ভাল থাকে কি না তা নিয়ে যাঁরা পাঁচশ শব্দের নিবন্ধ লিখে ফেলেন, তাঁদের কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর খুব জানতে ইচ্ছে করে। ছোট বাইরে করার জন্য গাড়ির চাকাগুলো কেন সারমেয়দের এত প্রিয় তা গুগলকে শুধিয়েছিলাম। উত্তর পাইনি। দুনিয়ায় এত বস্তু থাকতে কি আনন্দে গাড়ির চাকাগুলো কুকুরদের চুম্বকের মতো টেনে ধরে তা ভাবতে বসলে আমার বিস্ময় ইউক্যালিপটাস গাছের মতো আকাশ ছুঁতে চায়। প্রভুভক্ত সারমেয় তার মনিবের বাড়িটির মতো গাড়িটিও চেনে বিলক্ষণ। তাই যে জন্টি সাদা মার্সিডিজে চড়ে, সে মূত্র ছুঁড়ে দেয় অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও কালো বিএমডব্লিউয়ের চাকায়। আবার নীল জাগুয়ারের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আকাশ দেখে যে মন্টি, সে হয়তো সিক্ত করে কোনও ধূসররঙা রেঞ্জ রোভার গাড়ির চাকাকে। বুঝতে পারি মালিকের প্রতি এই ভালবাসায় জন্টি-মন্টিদের খাদ নেই কোনও।
এমনই এক মনিবের থেকে জানতে পেরেছিলাম তাঁর প্রিয় চার্লির ক্রমশ বুদ্ধিমান হয়ে ওঠার কথা। গরম লাগলে সে রেফ্রিজারেটরের সামনে গিয়ে থাবা দিয়ে খটখট করে। এক মিনিট ফ্রিজের দরজাটা খুলে রাখতে হয়। তাহলেই ‘কুল’ হয়ে গিয়ে চার্লি তাঁকে আদর করে দেয়। শুনেছিলাম, স্মার্ট টিভিতে ওর প্রিয় ‘চ্যানেল’ নেটফ্লিক্স। চার্লির প্রিয় ওটিটি সিরিজও নাকি আছে কিছু। পরিচ্ছন্নতাবোধ প্রবল। ডিওডোরেন্টের গন্ধ নিতে পছন্দ বেশ। আর ঘরদোর নোংরা করতে নাকি একেবারে পছন্দ করে না। প্রিয় পোষ্যের পরিচ্ছন্নতাবোধ নিয়ে বহু চার্লির মালিকেরা কলার তোলেন। বাড়ি ‘পরিচ্ছন্ন’ রাখার বিষয়টা অনুমেয়। তাই যে যাঁর পোষ্য নিয়ে সকাল সন্ধ্যেয় দিব্যি বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। প্রভুভক্ত সারমেয় তার প্রভুকে খুশ্ রাখে দিব্যি। আর শপিং মলে পেট-ফুডের বিল বাড়ে।
ইংরিজিতে দেওয়া নির্দেশ ‘মানুষের চেয়েও বেটার’ বুঝতে পারা যে বুদ্ধিমান কুকুরেরা রাস্তা নোংরা করতে চায়, তা নিয়ে তাদের প্রভুদের কোনওদিনও বাধা দিতে দেখিনি। চারপেয়েরা এই অপকম্মোটি করার সময় সঙ্গে থাকা ব্র্যান্ডেড ক্যাজুয়ালস পরা দুপেয়েরা আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন উদাসভাবে। তিরিশ সেকেন্ড পরে সম্বিত ফিরে পান। এক পুলিশ কিয়স্কের পাশের দেওয়ালে তাঁর জার্মান শেফার্ডকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়াচ্ছিলেন এক মনিব। একটু আগেই পৌরসভা থেকে ঝাড় দিয়ে যাওয়া রাস্তা নোংরা হল জলদি। কিয়স্ক থেকে পুলিশবাবু বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “শেফার্ডটা কত পড়ল স্যার? কোথা থেকে নিলেন?” আইফোনে আঙুল চালাতে চালাতে প্রভু মুচকি হাসলেন। উত্তর দিলেন না। পুলিশবাবুও ফের ঢুকে গেলেন কিয়স্কে। এই লোকটিই সূর্য ডোবার পরে হয়তো তক্কে তক্কে থাকেন। আড়ালে আবডালে কত লোক রাস্তা নোংরা করে। একটু চেপে ধরলেই পঞ্চাশ-একশো পকেটে ঢুকে যায়।
দামি সারমেয়রা তাদের (ত-এ চন্দ্রবিন্দু লাগালেও মন্দ হতো না) মনিবদের প্রাণ ভরে, লেজ দুলিয়ে ভালবাসা দিক। দিতে থাকুক নিরন্তর। এটা প্রভুদের প্রাপ্য। জন্টি-মন্টি-চার্লি-লাভলি-রন্টিরা রাস্তায় যেখানে খুশি আলপনা-পাহাড় তৈরি করুক। এটাও শহরের প্রাপ্য। জুতো বাঁচিয়ে চলা আমাদের তাতে যে সত্যিই কিছু যায় আসে না। তবে পিলে চমকে ওঠে বিদেশি নবাবদের হঠাৎ উথলে ওঠা ভালবাসায়। রাস্তায় অফিসমুখো এই অধমকে দেখলেই তাদের কেউ কেউ আমার দিকে ছুটে আসতে চায়। আমায় শুঁকতে চায়। পায়ের ডগা থেকে হাঁটু, হাঁটু থেকে কোমর অবধি আমায় মাপে। ক্রমাগত গন্ধ শোঁকে। আমার মধ্যে কি যেন খুঁজতে চায়। গরর্-গরর্ করে। রাগী চোখে দেখে। প্যান্টটা হাতিবাগান থেকে কিনেছি বলেই কি এত রাগ? আর একটু হলেই হয়তো ভালবাসার আঁচড় পড়তো গায়ে। প্রভু “কাম হিয়ার” বলে আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দেন, সেদিনের মতো। দৈববাণী শুনতে পাই, “ও কিছু করবে না।” আমার কপালে ঘাম। রুমালটা বের করে নিই।
আদালতের এমন বিচারও আমার ঘাম মুছিয়ে দেয়। প্রবল ঘেউ ঘেউ করা চতুষ্পদরা আমার কাছে ঘ্যাঁকাসুরের থেকে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারল না এ জীবনে। এ আমারই পরাজয়। জানি, আমার মতো আরও বহু ভীরু আছেন এ ধরাধামে। ঘ্যাঁকের পরে ঘ্যাঁক যোগ হয়ে যে মানুষদের চামড়া ভেদ করে ঢুকে যায় দাঁত, তারা হয়তো এমন খবরে একটু হলেও নিরাপদ বোধ করবেন।
মুম্বইয়ের ওই বৃদ্ধও হয়তো শুনেছিলেন, “ভ্যাকসিন দেওয়া আছে। ও কিছু হবে না।”