জৈব সম্পদে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ চিরকালই হাজার হাজার বছর ধরেই প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে খাদ্য, বস্ত্র, জ্বালানি ও বাসস্থানের সংগ্রহের ব্যবস্থা করে এসেছে। সিন্ধু সভ্যতার বয়স কম বেশি ৫০০০ ধরলে ভারতীয় সভ্যতা টিকে রয়েছে এই দেশজ বীজ ও দেশজ কৃষি ব্যবস্থা দিয়েই। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এশিয়ার চীন সব দেশেই তাই হয়েছে। বিগত এই ৫০০০ বছরে খাদ্য তালিকায় কোন নতুন ফসল সংযোজিত হয়েছে কি? বা কোন গৃহপালিত প্রাণী যার দুধ আমার নতুন করে খেতে শিখেছি? না, কোন কিছুই নতুন নেই। কোন ফসল খাব আর কোনটা খাব না সেটা ৫০০০ বছর আগেই আমাদের পূর্বপুরুষরা ঠিক করে দিয়েছেন। তাহলে কৃষির উন্নতি হয়েছে কি ভাবে? দেশে সবুজ বিপ্লবের নামে কর্পোরেট রাজ শুরু হওয়ার পর থেকে পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনাটার আমূল পরিবর্তন এলো। কৃষিকাজের জন্য যে স্থানীয় জৈব সম্পদ গুলো ব্যবহার হতো সেগুলোকে অবজ্ঞা করে ব্রাত্য করে দেওয়া হল। বিভিন্ন জৈব সারে ফসল চাষ, মিশ্র ফসল, দেশজ ফসলের বীজ, ফসল আচ্ছাদন, ফসল চক্র, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বাছাই, রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ, যৌথ ভাবে পুকুর কাটা, জল সেচের পদ্ধতি, গৃহ ভিত্তিক খাদ্য প্রক্রিয়া করন ইত্যাদি সবই কিছুকেই খারাপ বলা হল।
কৃষি ব্যবস্থা হয়ে উঠল বাজার নির্ভর। দোকান থেকে রাসায়নিক কৃষি উপকরণ ও বীজ পয়সা দিয়ে কেনা শুরু হল। কৃষকরা প্রত্যক্ষ করলেন বীজও বিক্রি হতে পারে, পণ্য হতে পারে। আগে বীজ পরস্পরের মধ্যে বিনিময় হত। বিক্রির কোন প্রশ্নই ছিল না। কারখানায় উৎপাদিত রাসায়নিক সার, কীটনাশক বিষ এবং উচ্চ ফলনশীল এর নামে আধুনিক জাতের রোগ পোকা প্রবণ বীজ না হলে চাষই হবে না। কৃষকরা এতদিন নিজের পরম্পরাগত কৃষি জ্ঞানকে অবলম্বন করে চাষ করতেন। কোম্পানিরা চাইছিল কৃষকরা যেন নিজেরা কৃষিকাজ নিয়ে আর ভাবনা চিন্তা না করতে পারেন এবং সমস্ত ব্যবস্থাটাই কোম্পানি নির্ভর হয়ে যায়। এখন তাদের পোয়াবারো। কৃষকরা বলেন “রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া কি চাষ করা যায়”- ঠিক যেমনটা কোম্পানিরা চাইছিলেন। এমন হল যে কৃষকরা বলতে শুরু করলেন “দেশজ বীজ দিয়ে তো চাষই করা যাবে না, ফলন কম”। রাসায়নিক কৃষির বয়স ভারতে ১০০ বছরও হয় নি। ভারতের বহু দুর্গম জায়গায় যেমন উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যে, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশায় সার ও বিষ ছাড়াই দেশজ বীজ দিয়েই হাজার হাজার বছর ধরে চাষবাস চলছে। বিশেষত ঝুম চাষ। প্রথাগত ভাবে কোন গোবর সারও বিশেষ দেওয়া হয় না। মানুষের রোগভোগও কম। একেই প্রাকৃতিক চাষ, দেশজ চাষ বা টেঁকসই চাষ বলা যেতে পারে। কিন্তু জৈব কৃষি বলা যাবে না। এখন সমতলে যা অবস্থা তাকে সুস্থায়ী ব্যবস্থা বলা যাবে না। আগে পরিবেশ, মাটি, দেশজ বীজকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। জলের অপচয় কমাতে হবে। মিশ্র চাষ ব্যবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। ভারতে জৈব সারের অভাব নেই, আবার জৈব কৃষি মানে শুধু জৈব সার দেওয়া নয়, অনেক পদ্ধতির সমন্বয়।
১৯৭৫ সালে ১ কেজি রাসায়নিক সার দিয়ে প্রায় ১৫ কেজি দানাশস্য উৎপাদিত হতো আর এখন ১৫ কেজি রাসায়নিক সার দিয়ে ১ কেজি দানাশস্য উৎপাদন হচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা ক্রম হ্রাস-মান ফেরতের নীতি (ল’ অফ ডিমিনিসিং রিটার্ন)। আলুর জমিতে যেখানে আগে বিঘায় ৫০ কেজি সার ব্যবহার হত এখন ২৫০ কেজি। হিসাব করলে প্রতি হেক্টরে প্রায় ২০০০ কেজি, বিশ্বে সর্বাধিক। কিন্তু গড় হিসেবে ভারতে প্রতি হেক্টরে ১৮০ কেজি সার ব্যবহার হয়। জল, জমি ও মাটি বিষিয়ে গিয়েছে। মানুষের রোগভোগ বেড়েছে, উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ঔপনিবেশিক ধারনায় দুর্ভিক্ষের জুজু ও উৎপাদন কম হবে বলে রাসায়নিক নির্ভর চাষ শুরু হল। যার পোশাকি নাম নাম সবুজ বিপ্লব। এমন আধুনিক ফসলের জাত তৈরি করা হয়েছে যে ফসল রাসায়নিক সার সহ্য করতে পারবে ফলন ও বেশি হবে। ধীরে ধীরে ফলন কমবে আবার নতুন জাত আসবে কিন্তু রাসায়নিক সার ও পোকা মারা বিষ কিন্তু প্রয়োগ বেশি করতে হবে। সেই ভাবেই উৎপাদন বেড়েছে, কৃষির উন্নতি হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। পরিবেশ, জল কতটা দূষিত হল, কি পরিমাণ মাটির তলার জল তোলা হল, মাটির উর্বরা শক্তি কতটা হ্রাস পেল সেদিকে কোন নজর দেওয়া হল না। দেশে বেশি ফলনের উচ্চ ফলনশীল দেশী জাত ছিল তাই দিয়ে এই কাজ হতে পারত। মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মাটি সুরক্ষিত থাকত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কিন্তু সেটা করা হলে রাসায়নিক সার, বিষ ও বীজের ব্যবসাটা হবে না। রাজ্যে কম করে ৪০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। নিয়ামকরা চাষবাস করেন না কিন্তু বিদেশী প্রভুর কথা অন্ধভাবে মান্য করেন বিভিন্ন বাধ্যকতায়। এখন ৩০৫ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও ১১৬ টি দেশের ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১০৩ নম্বরে। এখন বেশি উৎপাদনটাই সমস্যা, কম উৎপাদনের নয়।
মানুষের লোভ বহুলাংশে বেড়ে গিয়েছে। কৃষকরাও এই সমাজের বাইরে নয়। সবাই তাড়াতাড়ি বড়লোক হতে চায়, বেশি ফলনের আশায় জমির থেকে সবটুকু নিংড়ে নিতে চায়। এর জন্য প্রচুর সার ও বিষ দিতে হচ্ছে কারণ প্রতিবেশী দিচ্ছে।
ভারতে ১১৭টি জেলায় ছড়িয়ে থাকা বৃষ্টি নির্ভর চাষের এলাকাই বেশী। এখান থেকেই ৪৮ শতাংশ চাষ করা খাবার এবং ৬৮% চাষ না করা ফসল পাওয়া যায়। আউশ ধান, বিভিন্ন ধরনের কোদো, শ্যামার মত মিলেট, ডাল শস্য, তুলো, তৈল বীজ চাষ করা হয়। সেচের অভাবে ফসল নষ্ট হওয়ার ভয় ছিল না। ১৯৬১ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগের ইকনমিক রিসার্চ সার্ভিস খাদ্য, পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য চাল ও গমকে বেছে নিয়েছিল। অথচ ভারতে খাদ্যশস্য হিসেবে বিভিন্ন আঞ্চলিক মিলেট, রামদানার মত ফসল ছিল। শুধু সেচ নির্ভর ফসল চাষের ফলে ও অসেচ এলাকাকে ঢালাও সেচের আওতায় নিয়ে আসার ফলে অসেচ এলাকার ফসল ও অজস্র দেশজ ফসল হারিয়ে গেল। আধুনিক জাতের ফসলে রাসায়নিক সার দিলে সেচ দিতেই হবে। বাপ-ঠাকুরদার আমলের দেশজ ফসলকে অবজ্ঞা করতে শেখানো হল। সেই ভাবেই মিডিয়া প্রচার করল। ভারতে এক কালে ৮২০০০ দেশী ধান, ৩৮০০০ গম, ৫০০০০ রকমের মিলেটের জাত, ১০৯৮৮ অড়হর, ৪৮৩৮ রকমের তুলো, ৩৬৮৬ রকমের বেগুনের চাষ হত, খুব সামান্যই এখন কৃষকের মাঠে অবশিষ্ট আছে।
প্রায় ৬০ রকমের গরু পালন করা হত। দেশী গরু গির, রেড সিন্ধীর দুধ যথেষ্ট হয়, খাওয়ার পর বেশীর ভাগ মানুষের শরীরে কোন অসুবিধা হয় না, একে এ২ দুধ বলা হয়। এখন এ২ দুধের চাহিদা বাড়ছে। বিদেশী হলস্টিন ও জার্সির দুধ এ১ দুধ। দেশী গরুর কোন মূল্যায়ন না করে ঢালাও বিদেশী গরুর সংকারয়ন করা হল। ওই সব গরু আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খায় না। পালনের খরচ অনেক। গির গরু শূন্য থেকে ৪৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা মানিয়ে নিতে পারে। দেশের আবহাওয়ার উপযুক্ত গাছকে বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি সবুজায়ন করার জন্য, কৃত্রিম জঙ্গল তৈরির জন্য জন্য অস্ট্রেলিয়া মরুভূমির ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে দেওয়া হল মাইলের পর মাইল জমিতে। ওই গাছের পাতা কোন প্রাণী খায়না, পাখি বাসা বাঁধে না, ওই গাছের নীচে কোন গাছ জন্মাতে পারে না, জল প্রচুর শোষণ করে। একবার কিছু সুবিধা পেলে মানুষ আর সহজে ছাড়তে চায় না। ওই গাছ থেকে ২ বছরেই লগ পাওয়া যায়, কেটে দিলে আবার হয়। দ্রুত অর্থ উপার্জন করার জন্য পরিবেশকে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে। দেশের বহু জঙ্গলের গাছ আজ বিপন্ন হতে বসেছে। শাল, সেগুন, গামার, চাপ, ধ, ও সুন্দরী গাছ কাটা হচ্ছে আইনের তোয়াক্কা না করে, জঙ্গল ফাঁকা হয়ে বাগানে পরিণত হচ্ছে।
দেশজ ফসলের কোনরকম মূল্যায়ন না করে আমরা পাশ্চাত্য চশমা পরে বলতে শুরু করলাম দেশি মানেই খারাপ, উৎপাদন কম। সেই ভাবে গোটা ভারতবর্ষে কালো মানুষ থাকে অথবা ফর্সা মানুষ থাকে অথবা গোটা ভারতবর্ষের মানুষের গড় উচ্চতা চার ফুট? অতি-সরলীকরণ করে জনমানুষের প্রচার করা শুরু হল এবং প্রোপাগান্ডা এমন ভাবে করানো হল হল ওই মিথ্যেটা সত্যি হয়ে গেল। ১৯৫২ সালে ভারতবর্ষে কর্ণাটকে প্রতি হেক্টরে কিরুবিল্লাইয়া ধানের উৎপাদনের হয়েছিল ১২ টন। সেই কৃষককে ভারত সরকার কৃষি পণ্ডিত পুরষ্কারে ভূষিত করেছিল। অবশ্য এর আগেও ইংরেজের নথিতে সালেম ও থাঞ্জাভুর জেলায় প্রতি হেক্টরে ১২ টন ফলনের রেকর্ড রয়েছে। ১৯৬৬ সালে আই আর ৮ ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ৬ টন হতেই তাকে বলা হল উচ্চ ফলন শীল ধান। সেটা রাসায়নিক সার বিষ দিয়েই করতে হবে। কেউ বলবেন তাহলে ওই দেশী উচ্চ ফলনশীল ধান কোথায় গেল? ইংরেজ আমলের কথা ছেড়েই দেওয়া হল। তাঁদের দায় ছিল না ওই জাত গুলোকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার। নিজেরাও ভাতের ভক্ত ছিলেন না। ১৯৫২ সালে কিরুবিল্লাইয়া ধানের জাতের বিভিন্ন রাজ্যে ট্রায়াল করা যেতে পারত। কোন এক অজানা কারণে তা হয় নি। কিন্তু পর পর খরা, বন্য ও চাষ না করার জন্য সালেমের ধানের মত ওই ধানও হারিয়ে গেল। সব তথ্য চেপে যাওয়া হল। কারণ ওই দেশী উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো কৃষকের কাছে থাকলে রাসায়নিক সার, বিষ ও বীজের ব্যবসা হবে না।
কিন্তু এখনো দেশী উচ্চ ফলনশীল ধান যেমন কেরালা সুন্দরী, বহুরূপী, তালমূলী, বাংলা পাটনাই, কেশব-শাল হেক্টরে ৫- ৬ টন ধান দিতে পারে সার ও বিষ ছাড়াই। ফুলিয়ার কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে দেশী ধানের মূল্যায়ন চলেছে, প্রায় ৪০০ দেশী ধান নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ আজ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশী ধান উৎপন্ন করে। ওই কেন্দ্র কৃষকদের মধ্যে ভিন রাজ্যের কালাভাত, কলাবতী, মুগোজাই, খাড়া, মল্লিফুলো, আদানছিল্পা, জয়প্রকাশ ১১০/ ৭২ ইত্যাদি ধানের প্রচলন করিয়েছে, তাছাড়া রাজ্যের কেরালা সুন্দরী, বহুরূপী, চমৎকার, মল্লিফুলো, দুধেরসর, লাল দুধেরসর, রাধাতিলক,সাটিয়া ইত্যাদি ধানকে আরো বেশি কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালে কালাভাত উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪০০ টনের উপর, ভারতের কোন রাজ্যে তা হয় নি। এই দেশজ চাষে বাইরের কোন রাসায়নিক সার-কীটনাশক লাগে না, বছর বছর বীজও কিনতে হয় না, উৎপাদন ব্যয় কম। বেশি ফলনেরও ধান আছে, ঔষধি ও সুগন্ধি চালের ভাল বাজার দরও আছে।। কিন্তু এক আশ্চর্যজনক কারণে এর কোন প্রচার-প্রসার হচ্ছেন না। কৃষক গোষ্ঠী ও কৃষকরা যারা বুঝতে পেরেছেন তাঁরা তাঁদের মত করে দেশী ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষ করছেন, সংরক্ষণ করছেন এবং বাঁচিয়ে রাখছেন। বহু জৈব উৎপাদন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তাঁরা নিজেদের মত করে কলকাতা ও জেলায় বিপণন করছেন। পালিশ না করা চালের চাহিদা বেড়েছে এবং এটিসি ফুলিয়ার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে রাবার হালার অনেক জায়গায় দেওয়া হয়েছে। কৃষক গোষ্ঠীরাও কিনছেন। এটা ১০ বছর আগে ছিল না।
সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট খুব উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু ওই দেশে আগে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে গ্লাইফোসেটের মত ভয়ংকর বিষাক্ত গাছ মারা বিষ নিষিদ্ধ করেছিল। সাম্প্রতিক কালে রাসায়নিক সার ও বিষ নিষিদ্ধ করার মত দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। জৈব চাষের জন্য দেশের সংকট হয়েছে বলে অহেতুক দায়ী করা হচ্ছে। আসলে কোভিড, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য পর্যটন শিল্প মার খাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি, চিনের থেকে নেওয়া বিপুল বৈদেশিক ঋণ, রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, কর্পোরেটের বিভিন্ন হিসেব নিকেশ ও পুঁজি নিয়ে টানাটানি। চীন থেকে প্রচুর টাকার জৈব সার কেনার পর গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং বকেয়া টাকা দিতে চীনকে দিতে অস্বীকার করে। অবশ্য দেশে জৈব কৃষি করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা হয় নি, ছিল হঠকারিতা। কিন্তু জৈব কৃষিকে দোষারোপ করার জন্য সার ও কীটনাশক বিক্রেতার লবি উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু দেখুন ১৯৯০ সালের আগে থেকে কিউবার উপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিউবায় সব রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্কটের মধ্যে পড়েও কিউবা পৃথিবীতে জৈব কৃষিতেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়। খাদ্য সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছিল।
গান্ধীজী ১৯৩৫ সালে তাঁর হরিজন পত্রিকায় চকচকে পালিশ করা মিলের চাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন কারণ ওই চাল খেয়ে ভারতবাসীর স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। আজকে তাঁর কথা মিলে গিয়েছে। মধুমেহ রোগ ঘরে ঘরে। অন্যান্য কারণের সঙ্গে আগাছা নাশক গ্লাইফোসেটও দায়ী। বিভিন্ন খাবার ও জলের মাধ্যমে গ্লাইফোসেটের অবশেষ শরীরে প্রবেশ করে এবং ইনসুলিন তৈরির প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয়। সেটা মানুষের শরীরের উপর নির্ভর করে। অনেকের শরীরে হয় না বা দেরীতে হয়। তাছাড়া ওই বিষ কিডনির রোগ ও ক্যানসার সৃষ্টি করে। রেললাইনে ও সবজির ক্ষেতে ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বিষমুক্ত খাবার নিয়ে কেউ সচেতন নয়। শুধু কোভিড নিয়েই সচেতনতা হচ্ছে। শহরতলীতে এখন সবাই বাইরের হোটেলের খাবার ও অস্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুডে মজেছেন। অনেকেই বাড়িতে রান্না করছেন না। টিভি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত।
এদিকে অপুষ্টি ক্রমবর্ধমান। অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য বিশেষ কিছু ফসলে প্রথাগত প্রজনন, বাইরের থেকে খাবারে লোহা ও জিঙ্ক মৌলের লবণ মিশিয়ে ও জিন পরিবর্তনের দ্বারা ফসলের “পুষ্টিগুণ” বাড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই ভাবে তৈরি “পুষ্টিকর ফসল” খেয়ে ভারতবাসীর অপুষ্টি দূর করা যাবে বলে দাবী করা হয়েছে। এই নতুন “পোষান অভিযান” প্রকল্পের মাধ্যমে অপুষ্টিতে ভোগা গরীব গরিব মহিলা ও শিশুদের জন্য ২০২৪ সালের মধ্যে রেশনে, অঙ্গনওয়াড়ী ও দুপুরের খাবারে জৈবিক ভাবে “পুষ্টি সমৃদ্ধ” চাল দেওয়া হবে। অনেক রাজ্যেই চালু হয়ে গিয়েছে। বাইরের থেকে লোহা ও জিঙ্কের লবণ– ফেরাস সালফেট ও ফেরাস ফিউমারেট ও জিঙ্ক সালফেট গমের ও ভুট্টার আটার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে। চালের গুড়োর সঙ্গে ওই সব লবণ, ভিটামিন ইত্যাদি মিশিয়ে কৃত্রিম চাল তৈরি করার পরে নিদিষ্ট পরিমাণ সাদা চালের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত দেশজ ফসলে লোহা ও জিঙ্ক চিলেট ( বিশেষ গঠন) আকারে থাকে, শরীরে আয়ন ফর্মে শোষিত হয় না। লোহার পরিমাণ বৃদ্ধি হলে শরীরে বিষক্রিয়া হতে পারে কারণ লোহা শরীর থেকে সহজে বের হয় না। প্রাকৃতিক ফসলে লোহা, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, কোবাল্ট, তামা, ম্যাঙ্গানিজ প্রোটিন ও শর্করা ইত্যাদির স্বাভাবিক মাত্রা থাকে। রক্তাপ্লতা রোধে ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি ১২ আলাদা করে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় যদিও তা প্রচলিত ফসলেই পাওয়া যায়। পানীয় জলে থেকেও আমরা লোহা পেতে পারি। দেখতে হবে তা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় না হয়। অনেক দেশী চালের প্রতি ১০০ গ্রামে লোহার পরিমাণ ৩.২ মিগ্রা (লাল বহাল) থেকে ৮.৫ মিগ্রা (লাল গেতু)। জিঙ্ক মৌলটি মানব দেহের ৩০০’র বেশি এনজাইমে পাওয়া যায়। বিপাক ক্রিয়ায় লোহার পরেই এর স্থান। আন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে, ক্ষত সারাতে, ডি এন এ সংশ্লেষণে ও শ্বাসনালীর সংক্রমণ কমাতে অংশ নেয়। দেশী চালে ৩.৩ মিগ্রা (দ্বারকা শাল) থেকে ১৫ মিগ্রা (গরীবশাল ধান) প্রতি ১০০ গ্রাম চালে থাকে। ছোলার ডালে ৬ মিগ্রা ও তিলে ১২ মিগ্রা ও বরবটিতে ৪.৬ মিগ্রা ও তিল তেলে ১২.২ মিগ্রা থাকে। ধান জিঙ্ক ও লোহার গবেষণা করেছেন ড. দেবল দেব। (দেবল দেব ও তাঁর সহযোগী বৃন্দ, কারের্ন্ট সায়েন্স,ভলিউম ১০৯, নং ৩, ১০ অগাস্ট ,২০১৫)। অথচ প্রতি ১০০ গ্রাম কৃত্রিম চালে লোহা ও জিঙ্ক থাকবে প্রায় ২ মিগ্রা। ডাল ভাত খাওয়ার সময় সঙ্গে লেবুর রস দিয়ে খাওয়ার চল আছে। আম্লিক মাধ্যমে ডালের লোহা শোষিত হয়। আমিষ জাতীয় ফসলে লোহার পরিমাণ বেশি থাকে এবং সহজে শোষিত হয়। কিন্তু এর জন্য বিষক্রিয়া হয় এবং কোলন ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে।
আরো উদ্বেগের বিষয় হল চাল -গম ছাড়া অন্যান্য “কৃত্রিম পুষ্টিকর” ফসল গুলি জিন পরিবর্তিত কিনা। খাদ্য হিসেবে জিনশস্য খাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। ওই ফসল চাষের জন্য প্রচুর রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আগাছা নাশকের প্রয়োজন এবং ওই সব বিষের অবশেষ ফসলে ও মাটিতে থাকবে। অবশ্য হাইব্রিড ফসলেও বেশি সার ও বিষ লাগে। ইদানীং রাসায়নিক কৃষির জন্য মাটিতে অনুখাদ্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। এই কারণে ফসলেও লোহা, জিঙ্ক ইত্যাদি কম পাওয়া যাচ্ছে। রাসায়নিক সারের থেকে আসা ভারী ধাতু-ক্যাডমিয়াম, শিশা ইত্যাদি ও কীটনাশকের অবশেষও ফসলে চলে যাচ্ছে। তাহলে তথাকথিত “কৃত্রিম পুষ্টি যুক্ত ফসলে”ও ওই বিষ সমূহ থাকবে। তাহলে ওই “বর্ধিত পুষ্টির” কি মূল্য থাকল? যে মাটিতে জৈব সার ও অন্যান্য উদ্ভিদ মৌলের উপস্থিতি কম সেই মাটিকে অসুস্থ ও মৃত মাটি বলা চলে। রাসায়নিক সারে চাষ হওয়া ফসলে পুষ্টিগুণ ও স্বাদ কম থাকে। উল্লেখ্য আধুনিক জাতের ফসলে সাধারণত পুষ্টিগুণ কম থাকে। জীবন্ত মাটিতে যদি পর্যাপ্ত মৌল থাকে তাহলে তা ফসলেও চলে আসে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ভারতে নিযুক্ত কৃষিবিদ স্যার আলবার্ট হোয়ার্ড আশংকা প্রকাশ করেছিলেন অসুস্থ ও মৃত মাটিতে জন্মানো ফসল খেয়ে মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমাদের দেশের অজস্র ফসল পুষ্টি গুনে সমৃদ্ধ। পর্যাপ্ত জৈব সার ও খনিজ না থাকা মাটিকে অসুস্থ মাটি বলে। সেই সব ফসলের পুষ্টি মূল্য বিচার করা হয় নি। বেশি খরচ করে নতুন করে ওই সব কৃত্রিম ফসল তৈরি না করে যা আছে তাই জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন।
গান্ধীজী বলেছিলেন গ্রামে কুটির শিল্প ও কৃষকের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে যাতে মানুষ সারা বছর কর্মসংস্থান হয়। গ্রাম থেকে মানুষ শহরে ছুটবে না। আজ কৃষকরা কৃষিকাজ ছেড়ে জনমজুর খাটতে ভিন রাজ্যে ও শহরে পাড়ি দিচ্ছেন, পুরুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে গ্রাম। চাষ লাভজনক হচ্ছে না। কৃষকরাও বলতে শুরু করেছেন চাষে লাভ হচ্ছে না, উপকরণ বেশি দিয়েও ফলন কমছে। বিশ্ববাণিজ্য চুক্তিতেও বলা হয়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ জমির থেকে কৃষককে সরাতে হবে। মানে এক কথায় উচ্ছেদ। আর সেই ফাঁকা জায়গায় কারখানা হবে। বর্তমান নিয়ামকরা মনে করছেন শহরের উন্নতিটাই দেশের বিকাশের সমার্থক। কৃষককে শ্রমিকে পরিণত করতে হবে। মানুষকে কৃষিকাজ থেকে সরিয়ে আনলেই নাকি দেশের উন্নতি। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। গ্রামে মুদির দোকানে একটাও গ্রামের উৎপাদিত কৃষিপণ্য পাওয়া যায় না। কোথাও পান, কাঁচা লংকা, তেজপাতা ইত্যাদি থাকতে পারে। যদি গ্রামের উন্নতি চাই গ্রামের উৎপাদিত কিছু কৃষিজ পণ্য অন্তত রাখতে হবে। চাল, ডাল, তেল রাখা যেতে পারে, কিছু জেলায় আলু, পিঁয়াজ রাখা যায়। এর জন্য চাই গ্রামের প্রতি মমত্ব বোধ। আবার এর মধ্যে প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত কিছু মানুষ গ্রামে চাষবাস করে জীবন কাটানোকে জীবিকা করছেন।
আবার দেশের ফসলের উপরের গুরুত্ব দিয়ে পুষ্টিগুণের কথা জনসমক্ষে প্রচার করলে মানুষ সহজেই ওই খাবারে আকৃষ্ট হবেন। এর জন্য সবাইকে আন্তরিক ভাবে সচেতন হতে হবে। দেশকে ভালবাসতে হলে দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস, চাষ পদ্ধতি, অবস্থান, জঙ্গলের ফসল ও দেশজ বীজকে চিনতে হবে। ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারে মাধ্যমেই ভারতবাসীকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব। সবাইকে একই ধরনের খাবার খাওয়ানোর বাধ্য করা যাবে না। এর মধ্যে বহুজাতিকের দালালি ও খাদ্য রাজনীতি না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। ফাস্ট ফুড নয়, বিজ্ঞাপনের খাবারও নয়। বাড়াতে হবে জনসচেতনতা, জোর দিতে হবে জনস্বাস্থ্যে। পাতে লেবু, টক দই, শুক্ত, শাক পালিশ না করা চাল ও মরশুমি সবজি ও ফল দরকার। পুষ্টিকর কালাভাত, লালচাল, ফেন ভাত, বিভিন্ন মিলেট, রঙিন ও স্থানীয় ফসলের চাষ বাড়তে হবে এবং সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, কৃষক গোষ্ঠীর উপর জোর দিতে হবে। অনেক কম খরচেই কোন ঢক্কা নিনাদ ছাড়াই সেটা সম্ভব। অবশ্যই জৈব সার প্রয়োগে/ প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল গুলির চাষ করা দরকার। আধুনিক জাতের বীজ জৈব সার দিয়ে চাষ নয়। সেই সঙ্গে চাই বিশুদ্ধ পানীয় জল। ইদানীং বৈদ্যুতিন মাধ্যম দ্বারা (রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়া) পরিস্রুত জল খাওয়ার চল হয়েছে। যন্ত্রের দামও বেশী, বিদ্যুৎ না থাকলে অচল। এখন একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সাধারণত ওই ভাবে পরিস্রুত জলে অনেক খনিজ পদার্থ বেরিয়ে যায়। আগের ফিল্টার ক্যান্ডলের পরিস্রুত জল এখনও অনেকেই খাচ্ছেন। খরচ কম, বিদ্যুৎ ছাড়াই চলে।