২৪শে অক্টোবর ১৯১৭, দুর্গা পুজোর মহানবমীর দিন আগুন লেগেছিল রায়বাগানের মতিলাল সেনের বাড়িতে। সেখানেই থাকত রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির সমস্ত ছবির ফিল্ম। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল ভারতের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের সারাজীবনের পরিশ্রমের যাবতীয় ফসল। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল এক অবিশ্বাস্য ইতিহাস! পরের এক শতাব্দী জুড়ে মান্যতা এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এক ঐতিহাসিক ভুল তথ্য!
না! দাদাসাহেব ফালকে নন!
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রকৃত পথিকৃৎ ছিলেন এক বঙ্গসন্তান। তাঁর নাম হীরালাল সেন।
চাঁদের মাটিতে অনেক নভশ্চরই পা রেখেছেন কিন্তু বিশ্ব মনে রেখেছে নীল আর্মস্ট্রংকেই! এভারেস্টে উঠেছেন অনেক পর্বতারোহীই কিন্তু প্রথমে মনে ভেসে আসে তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারীর ছবিটাই! টেস্ট ক্রিকেটে আরো এক ডজন ব্যাটসম্যান ১০,০০০ রান করলেও গাভাসকারের রেকর্ড থেকে যাবে চিরদিন অমলিন!
কিন্ত দুৰ্ভাগ্যবশত উপমহাদেশের চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাসে আমরা ভুলে থেকেছি প্রকৃত পিতৃপরিচয়! অবহেলায় মুছে ফেলেছি হীরালাল সেনের নাম!
না! ১৯১৩ সালে তৈরি ফালকের রাজা হরিশচন্দ্র নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রেরনাম, "আলিবাবা ও চল্লিশ চোর"। ১৯০৩ সালে হীরালাল সেন সেই ছবিটি বানান। এমনকি তারও বছর পাঁচেক আগে ১৮৯৮ সালে তৈরি করেছিলেন প্রথম এদেশের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্ছবি ফ্লাওয়ার্স অফ পার্শিয়া।
হীরালালের ছবির কথায় আসার আগে চলচ্চিত্র চর্চার সেই আদিযুগের সময়সারণিটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। সে যুগে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড কোম্পানির একটি ফোটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা হত। তথ্য বলছে, ১৮৮৭ সালে হীরালাল সেন নামে এক সদ্যতরুণ সেই প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। কোনো নেটিভের পক্ষে এই কৃতিত্ব সেযুগে কম কথা নয়! আর শুধু একবার নয়! পরের দশ বছরে এই তরুণটি সাত বার এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন - এই তথ্যটা মনে রাখলে বুঝতে পারব আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর প্রতিভার মাপ। সময় থেকে অনেকখানি এগিয়ে ভাই মতিলাল এবং দেবকীলালকে নিয়ে ঢাকা মানিকগঞ্জের আদিবাড়িতে ফটোগ্রাফির স্টুডিয়ো খুলেছিলেন যুবক হীরালাল ।
এই সময়েই সাগর পারে ঘটে যাচ্ছে আর এক যুগান্তর!
১৮৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার ব্রডওয়েতে বিখ্যাত উদ্ভাবক, আবিষ্কারক বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন তাঁরই আবিষ্কৃত যন্ত্র ‘কিনেটোস্কোপ’ দিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র দেখিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন। এর পর এলো নতুন যন্ত্র ‘ভিটাস্কোপ’। ফলে, একসঙ্গে অনেকে মিলে ছবি দেখার নতুন দিগন্ত খুলেগেল। তারপর প্যারিসের লুমিয়ের ব্রাদার্সের সিনেম্যাটোগ্রাফ শুরু হল চলচ্চিত্রের বিশ্বজয়।
বিশ্বের নানা দেশে, আমেরিকা থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এমনকি পরাধীন ভারতেও আছড়ে পড়লো চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসাহের ঢেউ! ১৮৯৬ সালের ৭ই জুলাই বম্বের এসপ্ল্যানেড ম্যানসনের ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র দেখাবার ব্যবস্থা হল। ১৮৯৭ সালে, কলকাতার স্টার থিয়েটারে একটি স্টেজ শো তে প্রফেসর স্টিভেনসনের সৌজন্যে প্রথম চলচ্চিত্র দেখতে পেল বঙ্গবাসী। সেই চলমান ছায়াছবি দেখে ফটোগ্রাফি অন্তপ্রাণ হীরালালের যেন ঘোর লেগে গেল।
প্রতিভাবান ফটোগ্রাফার হীরালাল সেন, স্টিভেনসনের ক্যামেরা ভাড়া নিয়ে তৈরি করে ফেললেন কোনো ভারতীয়ের বানানো প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলছবি 'দ্য ফ্লাওয়ার অফ পারসিয়া'। ১৮৯৮ এর ১০ই ডিসেম্বর, স্টার থিয়েটারে ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ নাটকের সঙ্গে দেখান হল হীরালালের তোলা চলচ্চিত্র।
বিজ্ঞাপনের ছবি তোলার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই পথিকৃৎ। সি.কে সেনের ‘জবাকুসুম কেশতৈল’, বটকৃষ্ণ পালের ‘এডওয়ার্ডস এন্টিম্যালেরিয়া স্পেসিফিক’, ডব্লিউ মেজর অ্যান্ড কোম্পানির ‘সার্সাপেরিয়া’র বিজ্ঞাপন করেন। এদেশে তো বটেই বিদেশেও এর আগে বিজ্ঞাপনের ছবি তোলা হয়েছে বলে শোনা যায় না ! প্রায় ৪০টি সিনেমা বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন সুহৃদ অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ বিভিন্ন থিয়েটারের দৃশ্যগুলি। ১৯০১ আর ১৯০৪ - এর মধ্যে ক্লাসিক থিয়েটারের পক্ষে তিনি অনেকগুলি ছবি নির্মাণ করেন। যার মধ্যেরয়েছে ভ্রমর, হরিরাজ, বুদ্ধদেব সহ আরও বেশকিছু ছবি।
আর দেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছিলেন ১৯০৩-এ। নাম আলিবাবা ও চল্লিশ চোর। ওই ছবিটি বানানো হয়েছিল ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের মঞ্চসফল থিয়েটারের ওপর ভিত্তি করে। শুধু তাই নয় ! ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রটিও।
২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫।
চলছে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল। মহামিছিল, জনসমুদ্র। বক্তাদের মধ্যে রয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। হীরালাল সেন তাঁর ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে বসালেন ট্রেজারি বিল্ডিং-এর মাথায় যাতে ছবি তুললেও ভিড়ের পেছনে প্রধান বক্তা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে তাঁর ক্যামেরাতে ধরা যায়। ড্রোনফটোগ্রাফির একশো বছরেরও আগে এরিয়াল শটের কথা যিনি ভাবতে পারেন তাঁকে ক্ষণজন্মা বলতেই হয়! এটাই ছিল ভারতের সর্বপ্রথম পলিটিক্যাল ডক্যুমেন্ট্রি ফিল্ম। ১৯০৫-এ ছবির বিজ্ঞাপনে বলাহয়েছিল "আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা"। ছবির শেষে গাওয়া হয়েছিল "বন্দে মাতরম"। এর আগে পৃথিবীর অন্যও কোন প্রান্তে রাজনৈতিক তথ্যচিত্র কি আর কেউ তোলা কথা ভেবেছিলেন? জানা নেই।
হীরালাল ছিলেন প্রকৃত অর্থেই শিল্পী। তাঁর বাণিজ্যিক বুদ্ধির অভাবে ১৯১৩ সালেই বন্ধ হয়ে যায় তাঁর স্বপ্নের 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি'। ১৯১৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যু হয় হীরালাল সেনের। তার ঠিক দু'দিন আগে ভাই মতিলালের বাড়ি সংলগ্ন ওয়্যার হাউসে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁর সারা জীবনের কাজ।
পরিচালক অরুণ রায়ের হীরালাল নামের এই বায়োপিকটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভুলে যাওয়া এই প্রথম পুরুষটির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করার একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা। সমগ্র বাঙ্গালি জাতির পক্ষ থেকে একটা প্রায়শ্চিত্তের প্রয়াসও বলা যায়! আত্মবিস্মৃত বাঙালি হীরালাল সেনের নামই মনে রাখে নি ! তাঁর জীবন নিয়ে খুব বেশি তথ্য যে হাতের কাছে ছিল না সেটা বলাই বাহুল্য। অরুণ রায়ের কৃতিত্বটা সেখানেই ! বিস্মৃতির নিথর সমুদ্র ছেঁচে তিনি শুধু অতি উজ্জ্বল এই রত্নটিকে শুধু তুলেই আনেন নি দিয়েছেন প্রাপ্যমর্যাদা!
অভিনয় এ ছবির সম্পদ।
বৃদ্ধ অসহায় গিরীশ ঘোষের ভূমিকায় খরাজ মুখোপাধ্যায়ের পরিণত অভিনয় মনে থাকবে অনেকদিন। জবাকুসুম তেলের মালিক সি কে সেনের ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তী সেযুগের সফল ব্যবসায়ীর ভূমিকায় চমৎকার। হেমাঙ্গিনীর ভূমিকায় অনুষ্কা চক্রবর্তী আর কুসুমকুমারী ভূমিকায় তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস যথাযথ এবং বিশ্বাসযোগ্য। জামশেদজী ফ্রামজী ম্যাডানের চরিত্রচিত্রণে হয়ত আর একটু ভাবনা চিন্তার পরিসর ছিল। এই চরিত্রটিতে ছিলেন আমাদের সকলের প্রিয় এবং অত্যন্ত গুণী অভিনেতা শাশ্বত। কিন্তু ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাণের পথপ্রদর্শক, পরিবেশক এবং প্রযোজক এই দূরদর্শী এবং জীবৎকালেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা এই ঐতিহাসিক মানুষটি কি ঐরকম সত্যিই ওই রকম কমেডিয়ান আর ভিলেনি মেশানো মানুষ ছিলেন!
নায়ক হীরালালের ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেছেন তরুণ ডাঃ কিঞ্জল নন্দ। প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রতিটি নিঃশ্বাসে, চাহনিতে,পদক্ষেপে, উচ্চারণে তাঁকে হীরালাল সেনই মনে হয়েছে। ক্যান্সার রোগাক্রান্ত রোগীর ভূমিকায় শরীরের ওজন কমিয়ে রুগ্ন শয্যাশায়ী হীরালালের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় সর্বোচ্চমানের।
ছবিটা হয়ত আরো খানিকটা ছোট হতে পারত, আরো সিনেম্যাটিক হতে পারত, পিরিয়ড পিস হিসেবেহয়ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল জনসমুদ্র না হোক সে সময়ের কলকাতাকে আরো একটু বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখানো যেত কম্পিউটারের করিকুরিতে, কিন্তু সেসব কথা থাক!
অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঠিক আগে মুক্তি পাওয়া এই একটি স্বল্প বাজেটের ছবি র কৃতিত্ব হলোএতদিনের বহুপ্রচারের ঢক্কানিনাদিত মিথ্যা ন্যারেটিভের গ্যাসবেলুনটিকে এই ছবিটি আলপিনের একখোঁচায় ফুটো করে ভারতীয় ছায়াছবির প্রকৃত জনক কে তুলে ধরেছে বিশ্বের সামনে, সসম্মানে প্রতিষ্ঠিতকরেছে তার বিস্মৃত পিতৃপরিচয়!
সেটা কিন্তু কম কথা নয়।
তথ্যসূত্র ::