সিন্ধুলিপি যেমন প্রায় দেড়শো বছর ধরে নানান পণ্ডিত গবেষকের কাছে একটি খুব শক্ত চ্যালেঞ্জিং সমস্যা হিসেবে আদৃত হয়েছে, তেমনই অনেক অত্যুৎসাহী পাঠোদ্ধারকের নানান অদ্ভুত পাঠোদ্ধারের দাবিতে লাঞ্ছিতও হয়েছে খুব বেশি। এই ভুলভাল পাঠোদ্ধার সম্পর্কে খুব মজার একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ভারততাত্বিক আসকো পারপোলা (Asko Parpola), তাঁর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত "Deciphering the Indus script" নামের বিখ্যাত বইতে। পারপোলা দেখিয়েছেন যে, স্প্যানিশ মিশনারি পণ্ডিত ফাদার হেরাস (Enric Heras de Sicars ওরফে Henry Heras) তাঁর ১৯৫৩ সালে লেখা একটি বইতে সিন্ধুলিপির অদ্ভুত সব প্রোটো-দ্রাবিড়ীয় পাঠোদ্ধার ক'রে খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন। এমনকি হেরাসের গবেষণার সম্মানার্থে ভারতীয় সিকিউরিটি প্রেস উনিশশো একাশি সালে হেরাসের ছবি আর মহেঞ্জোদারোয় পাওয়া একটি সিন্ধুলিপিযুক্ত সীলের ছবি পাশাপাশি রেখে প্রায় কুড়িলক্ষ ৩৫ পয়সার ডাকটিকিটও ছাপায়। এখন দেখা যাক ফাদার হেরাসের পাঠোদ্ধারের ধরণ ঠিক কিরকম ছিল!
হেরাস উবাচ: " সিন্ধুলিপির চিহ্নটির মানে কাঁকড়া আর তার ধ্বনি হলো nand. এবার আমরা চিহ্নটিকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে নেবো। হুম! তাহলে উলটো ক'রে পড়লে এর ধ্বনি হবে danan, যার শব্দগত মানে এক উদারমনা এবং মুক্তমনা ব্যক্তি। হুম। এবার এই চিহ্নের একটা সংক্ষিপ্ততর ফর্ম ও তো আছে। সেটি হলো । বামে ঘোরালে । এই চিহ্নে কাঁকড়ার দাঁড়া কেটে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে যখন, তখন এর ধ্বনি থেকে "d" বাদ দিয়ে থাকে "nand" এর "nan" । "nan" মানে good, ভালো। হুমমমমমম!"। প্রিয় পাঠক পাঠিকা, এই হুম-ধ্বনিগুলি আমার। স্বপ্নাদেশে এমন সব পাঠোদ্ধারের নির্দেশ পেয়ে ফাদার হেরাস নিশ্চয়ই খুশী হয়ে খুব হুমহাম করতেন। এইটুকু আমার কল্পনা। বাকিসব পারপোলার উদ্ধৃতি অনুযায়ী হেরাস নিজের বইতে ঠিক এমন ভাবেই লিখে গেছেন। খালি তাও নয়, হেরাস এই পদ্ধতিতে সিন্ধুলিপির সীল, ট্যাবলেট ইত্যাদি ঘেঁটে পড়ে বেমালুম পড়ে ফেলেছেন নানান অদ্ভুত বাক্যও। যেমন, হেরাসের মতে সিন্ধুসভ্যতার অতি প্রগতিশীল মানুষজন তাঁদের অনেক কষ্ট করে বানানো সীলমোহরগুলিতে নাকি লিখে গেছেন "The mother of the middle of the year walking ant-like" অর্থাৎ "বছরের মধ্যিখানের মা পিঁপড়ের মতো হেঁটে চলেছেন", বা "There is no feast in the place outside the country of the Minas of the three fishes of the despised country of the woodpeckers", অর্থাৎ "তিনটি মাছের মীনার দেশের বাইরে যে ঘৃণ্য কাঠঠোকরাদের দেশ আছে সেখানে অধুনা কোন ভোজ হইতেছে না"। পারপোলা মন্তব্য করেছেন যে, ফাদার হেরাসের এইসব অনির্বচনীয় পাঠোদ্ধার কেন সর্বজনগ্রাহ্য হয় নি, তাই নিয়ে নিশ্চয়ই পাঠকের আর কোন ব্যাখ্যা লাগবে না! আপনাদের এখন নিশ্চয়ই মাথা কেমন কেমন করছে এইসব পাঠোদ্ধার পড়ে। আমার তো করেছিল। এখন দুঃখের কথা এই যে, এত মজার শুনতে না হলেও, এখনো অব্দি যে প্রায় একশো পাঠোদ্ধারকের দাবি রয়েছে সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার নিয়ে, তাঁদের অনেকেই এরকম সব অদ্ভুত স্বপ্নাদিষ্ট পাঠপ্রক্রিয়ায় আগ্রহী। পদ্মশ্রী গবেষক ইরাভথম মহাদেবন তাঁর ১৯৮৬ সালে লেখা ভীষণ দরকারি গবেষণাপত্র "Towards a grammar of the Indus texts: intelligible to the eye, if not to the ears"-এ, তাঁর পূর্বসূরী এবং সমসাময়িকদের কাজের সংক্ষিপ্তসার করার সময়ে, এরকম সব পাঠোদ্ধারের সম্পর্কে বলেছেন, "আমি এরকম ধরণের কিছু পাঠোদ্ধারের প্রচেষ্টাকে নীরবে টপকে যাবো, বিশেষ বিশ্লেষণ না ক'রেই, তাদের প্রকৃতির সম্পর্কে খানিকটা আঁচ করতে পেরে"।
এখন প্রশ্ন হলো, কে কী উপায়ে সিন্ধুলিপিকে এমন সব পাঠোদ্ধারের হাত থেকে উদ্ধার করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে প্রাচীন গ্রীসের লিনিয়ার বি লিপির পাঠোদ্ধারমূলক গবেষণার ইতিহাসে ভীষণ উল্লেখযোগ্য অবদান যাঁর, সেই মার্কিনী গবেষিকা এলিস কোবারের (Alice Elizabeth Kober) দর্শনে। এই লিনিয়ার বি লিপিও ঠিক সিন্ধুলিপির মতই অপঠিত অবস্থায় ছিল বেশ কিছুদিন। ঠিক সিন্ধুলিপির মতোই, এই লিপিকেও নানান অদ্ভুত ভাবে পড়ে ফেলার চেষ্টা করা হতো। কোন কোন গবেষক ভাবতেন এই লিপিতে গ্রীক কবি হোমারের ইলিয়াড ওডিসির মতো কিছু লেখা আছে হয়তো। তবে এখন যেমন বেশিরভাগ গবেষক সিন্ধুলিপিতে প্রাচীন সংস্কৃত বা প্রাচীন তামিল শব্দ খোঁজেন (তাতে হয়তো বা আপত্তির কিছু নেই), সেরকম অনেক গবেষকই লিনিয়ার-বি লিপির মধ্যে প্রাচীন ইটালির ইট্রুস্কান ভাষা খোঁজার এলোপাথাড়ি চেষ্টা করতেন। যেহেতু সিন্ধুলিপির মতো লিনিয়ার-বি লিপির সঙ্গেও তখনো অবধি অন্য কোন লিপির বা ভাষার সংযোগ পাওয়া যায় নি, এইসব পাঠোদ্ধারের দাবিকে ঠিক বা ভুল কিছুই প্রমাণ করা অসম্ভব ছিল। এমতাবস্থায় এলিস কোবার এইরকম তড়িঘড়ি পাঠোদ্ধারের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে গিয়ে অত্যন্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে লিনিয়ার-বি লিপির চিহ্নগুলি একে অন্যের সঙ্গে যে নক্শায় বসে তার সম্যক স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস করেন। সেই বিষয়টির আর গভীরে না গিয়ে এইটুকু বলি যে, এলিস কোবারের অকাল মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পরে যখন মাইকেল ভেন্ট্রিস নামের এক ইংরেজ আর্কিটেক্ট শেষমেশ লিনিয়ার-বি লিপির পাঠোদ্ধার করেন, সেই পাঠোদ্ধারের পথে কোবারের করে যাওয়া স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিসের খুব বড় অবদান ছিল। কোবারের মতে, কোন অচেনা লিপি ঠিক কী উপায়ে লেখা হচ্ছে তা অনুসন্ধান না ক'রে, সেই লিপির উপরে কোন ভাষাকে বা তার শব্দগুলিকে চাপিয়ে দেওয়া অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার কাজ। আমি কোবারের অনুসারী, তাঁর এই দর্শনে সম্পৃক্ত। প্রথমে কোবারের, পরে ভেণ্ট্রিসের (Michael Ventris) গবেষণায় লিনিয়ার-বি লিপি, যা ঠিক সিন্ধুলিপির মতো অজানা অন্ধকারে ছিলো, আলোর মুখ দেখলো। তখন তো কম্পিউটার ছিল না। কোবার লিনিয়ার-বি লিপি-চিহ্নদের নানান প্যাটার্ন সূচীবদ্ধ করতে, তাদের হাতে লিখে টুকে রাখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তখন ইউরোপে কাগজ ভীষণ দুর্লভ। এদিকে এই অনূঢ়া গবেষিকা ভীষণ ধূমপান করতেন। তিনি কাগজের অভাবে, সিগারেটের প্যাকেট কেটে কেটে নিজ হাতে এক লক্ষ আশি হাজার লিপিচিহ্নের প্যাটার্ন লেখা কার্ড বানান। এই পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ধৈর্য, কাজের প্রতি সততা, নিবেদন- ভাবা যায়? মাইকেল ভেণ্ট্রিস, অন্যদিকে, নিজের চোদ্দ বছর বয়স থেকে লিনিয়ার-বি লিপির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও প্রথম দিকে বাকিদের মতো আলটপকা এলোপাথাড়ি পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় থাকতেন, বিশ্বাস করতেন যে লিনিয়ার-বি ইট্রুস্কান ভাষায় লেখা, আর সেই ভাষার ধ্বনি বসিয়ে বসিয়ে কোনভাবে একদিন পড়ে ফেলা যাবে এই লিপিকেও। তবে, ভাগ্যক্রমে, পরের দিকে কোবারের কিছু গবেষণা পদ্ধতি ভেণ্ট্রিসেকেও ঠিক পথে চালিত করে, আর এই লিপির পাঠোদ্ধারে সুবিধা ক'রে দেয়। কিন্তু ভেণ্ট্রিসের একটি মহৎ গুণ ছিল এই যে, তিনি তাঁর চিন্তাধারায় নমনীয় ছিলেন, আর সহ-গবেষকদের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় না গিয়ে, তাঁদের সঙ্গে একসাথে পাঠোদ্ধারের চেষ্টা চালাতে বিশ্বাসী ছিলেন। তখনকার যুগে, লিনিয়ার-বি লিপির সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন লিখে, নিজের পয়সায় সেই প্রশ্নতালিকা তিনি দেশ বিদেশের গবেষকদের কাছে পূর্বপ্রদত্ত ডাকটিকিট প্রিপেইড স্ট্যাম্পসহ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে প্রত্যেক গবেষক নিজের মতামত লিখে সেই চিঠি পোস্ট করতে পারেন। সেইসব উত্তর তিনি বিনা পয়সায় বাকি সব গবেষকদের কাছে বিলি করার ব্যবস্থাও করেছিলেন।
সিন্ধুলিপি প্রকৃতিগত দিক দিয়ে লিনিয়ার-বির মতো নয়। তাই পাঠোদ্ধারের জন্য লিনিয়ার-বি পাঠোদ্ধারের পদ্ধতি পুরোপুরি নকল ক'রে লাভ নেই এই ক্ষেত্রে। কিন্তু যে গবেষক বা গবেষিকা সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধারের বেশ অনেকটা এগোতে চাইবেন, তাঁদের প্রকৃতিগতভাবে খানিকটা কোবার, খানিকটা ভেণ্ট্রিসের মত হতে হবে বলে আমার বিশ্বাস। অধ্যবসায়ী, বিনয়ী, উদারমনা, আর সৎ না হলে এই সুবিপুল কর্মকাণ্ড নিষ্পন্ন করা যাবে না।
যাঁরা বর্তমান যুগের কম্পিউটার সায়েন্সের নানান এনক্রিপশন ডিক্রিপশন পদ্ধতি, এবং ক্রিপ্টোগ্রাফির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, আন্তর্জালের মাধ্যমে আমরা একে অন্যকে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ পাঠাই, তারা অনেক সময়েই কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংকেতবদ্ধ (encode) এনকোড করা থাকে, যাতে সেই সংকেতবদ্ধকরণের এনকোডিং এর প্রাতিজনিক গোপন চাবিকাঠিটি জানা না থাকলে, কোনভাবেই কোন রামশ্যামযদুমধু মেসেজটি পড়ে না ফেলতে পারে।
আমার মতে প্রাচীন লিপিগুলির পাঠোদ্ধারের সময়েও, প্রাচীন সময়ের মানুষেরা ঠিক কেমন পদ্ধতিতে তাঁদের চিন্তাভাবনাকে লিপি-রূপে লিখে যেতে চেয়েছিলেন তা না জেনেবুঝে, সেই লিপি পড়ে ফেলার চেষ্টা বাতুলতা। আমি ঠিক কেন এই কথা বলছি তা আরো একটু খোলসা ক'রে বলি কেমন?
আজকের দিনে পৃথিবীর বেশিরভাগ লিপি আবুগিদার (Abugida) মাধ্যমে লেখা হয়। অর্থাৎ আমাদের লিপিগুলির প্রত্যেক মৌলিক চিহ্ন (বর্ণমালার এক একটি বর্ণ ধরুন) হয় শুধু একটি ব্যঞ্জনবর্ণ বা স্বরবর্ণকে বোঝায়, নয় একটি অক্ষরকে। ইংরাজী ভাষার যে বর্তমান লিখনপদ্ধতি, সেটি সম্পূর্ণ অ্যালফাবেটিকাল। সেখানে এক একটি স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ এক একটি আলাদা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। আবার বাংলা, হিন্দি, কন্নড়, আদি নানান ইন্ডিক ভাষার বর্তমান লেখনী অক্ষরধর্মী, সিলেবিক। কারণ এখানে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের এক একটি জুটি এক এক আলাদা চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ এখানে 'ক' আর 'ই' বর্ণ আলাদা আলাদা ভাবে লিখলেও, ক'য় হ্রস্ব-ই লেখার সময়ে আমরা একটি নতুন চিহ্ন 'ি' ই-কার এর ব্যবহার করি। এখন আবুগিদা দিয়ে লেখার সময়ে, আমাদের মস্তিষ্ক শুধু একটি চিহ্ন এবং তার ধ্বনিকে নিয়েই মাথা ঘামায় না কি? সেই চিহ্নের অন্য কোন আলাদা মানে সচরাচর করে না। কিন্তু প্রাচীন কালে ঠিক এইরকম ছিল না! আগেকার দিনে, এক একরকম দেশের লিপি, এক এক রকম ভাবে লেখা হতো। যেমন, অনেক লিপিতেই রেবাস প্রিন্সিপল (rebus principle) আংশিকভাবে ব্যবহৃত হতো।
রেবাস প্রিন্সিপল ব্যাপারটা না, খুব মজার। ধরুন আপনার ভাষার একাক্ষরী কিছু শব্দের জন্য আপনি কিছু শব্দচিত্র (logogram/pictogram) ব্যবহার করেন। যেমন "মা" শব্দটির জন্যে , আর "খা" ধাতুর জন্য , শব্দচিহ্ন ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে এই দুটি শব্দচিত্র দৃশ্যতঃ তাদের অন্তর্নিহিত অর্থকে খুব সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তাই না? এইবার, যদি "মাখা" শব্দটি আপনি লিখতে চান, তাহলে তার জন্য আবার একটি নতুন শব্দচিত্র উদ্ভাবন না ক'রে, "মা" এবং "খা" শব্দচিত্রকে এক্ষেত্রে শুধু তাদের ধ্বনির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরুন, আপনি "মা" ধ্বনির জন্য কে, আর "খা" ধ্বনির জন্য কে ব্যবহার করলেন। আর এক্ষেত্রে যে এই শব্দচিহ্নগুলিকে ধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করছেন তা বোঝাতে তাদের রাখলেন একটি বন্ধনীর মধ্যে-> । ব্যাস, পড়া হয়ে গেলো "মাখা"। সেই ভাবেই, "পা" এবং "খা" এর শব্দচিত্র ব্যবহার ক'রে আমরা লিখে ফেলতে পারি "পাখা" । বিখ্যাত ভাষাবিদ Noam Chomskyর মতে মানুষের ব্যবহৃত ভাষাগুলি তাদের অর্থবহন করার পদ্ধতিতে সচরাচর "economy of derivation" এবং "economy of representation" এর মধ্যে সবসময়ে একটা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে "economy of representation" মানে, কোনো একটি প্রক্রিয়ায় অন্য কোন মানুষকে কোনো কথা বোঝাতে গেলে আপনাকে কতটা কম পরিশ্রম করতে হবে। আর এইক্ষেত্রে "economy of derivation" এর সহজ অর্থ হলো, কোন একটি কথার মানে বুঝতে গিয়ে আপনাকে কতটা কম পরিশ্রম করতে হবে। যদি কোন ভাষার "লার্নিং কার্ভ" বা শেখার পদ্ধতি খুব ভজকট এবং শ্রমসাধ্য হয়, তাহলে সাধারণতঃ মানুষ সেই ভাষাকে খানিকটা এড়িয়ে চলে, বা নিজের মতো সহজ ক'রে নেয়। আমার মতে ভীষণ ব্যাকরণধর্মী সংস্কৃত ভাষা হয়তো এর একটি ভালো উদাহরণ। এখন মানুষের লিপির সম্পর্কেও কিন্তু সেই একই কথা খাটে। এখন যেমন মানুষ বুঝে গেছে যে ধ্বনিচিহ্ন দিয়ে নিজেদের ভাষাকে লিপিবদ্ধ করা সরলতম মিতব্যয়ী পদ্ধতি, লেখক এবং পাঠক দুজনেরই পক্ষেই, প্রাচীন মানুষের সেই কথা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। তাই তারা প্রথমদিকে হয়তো এক একটি শব্দ এক একটি চিহ্ন দিয়ে লিখতো। কিন্তু এরকম অনেক অনেক শব্দের আলাদা আলাদা চিহ্ন আনতে গেলে তো ইকোনমি অফ ডেরাইভেশন আর ইকোনমি অফ এক্সপ্রেশন, উভয়ই মার খেয়ে যাবে তাই না? তাই আমদানি হয় রেবাস পদ্ধতি। রেবাস আসলে প্রকৃতিগত ভাবে, কিছু বিশেষ প্রজননক্ষম (generative) নিয়মের উপর ভিত্তি ক'রে আলাদা আলাদা শব্দ সংকেতবদ্ধ করার ক্ষমতা, যাতে পাঠক সেই শব্দগুলিকে সহজেই বুঝে নিতে পারে। এখন, রেবাস তো এর মধ্যে শুধু একটি প্রক্রিয়া। আরো অনেক পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রাচীন লিপিগুলিতে। যেমন ইজিপশিয়ান হিয়েরোগ্লিফিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে একটি শব্দ লেখে, আর ঠিক কোন কোন স্বরবর্ণ বসিয়ে শব্দটি পড়তে হবে, তা বুঝে নিতে হয় সেই শব্দের শেষে দেওয়া determinative বা semantic classifier-জনিত শব্দচিত্র দিয়ে। সেটা আর এক মজার নিয়ম। বাংলায় প্রয়োগ করলে সেটি এইরকম দাঁড়াবে। ধরুন, আপনি ইজিপশিয়ান পদ্ধতিতে, কিন্তু বাংলা হরফে, "নদী" আর "নাদ" এই দুটি শব্দ লিখতে চান। আপনি দুই ক্ষেত্রেই কেবল "ন" এবং "দ" বর্ণ লিখে, প্রথম ক্ষেত্রে একটি জল-বোধক শব্দচিত্র, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একটি microphone এর ছবি দিয়ে দেবেন semantic Classifier হিসেবে। নদী-> ; নাদ -> । অর্থাৎ শব্দের শেষের এই ইডিওগ্রাফিক চিহ্নগুলির (ইডিওগ্রাফ অর্থাৎ যে চিহ্ন একটি আইডিয়াকে বোঝায়, বিশেষ কোন শব্দকে নয়) সূত্র ধ’রে এখানে আপনি সেই শব্দটির ঠিক ধ্বনিটি আন্দাজ ক'রে নিচ্ছেন। কিন্তু গ্রীকদের লিনিয়ার-বি লিপি প্রত্যেক শব্দকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে পুরো বানান ক'রেই ব্যক্ত করে। তাই লিনিয়ার-বি লিপিকে আলফা-সিলেবারি বলা হয়। যদিও, কিছু বিশেষ বহুল ব্যবহৃত শব্দকে (যেমন "ঘোড়া", "দাস", "দাসী", ইত্যাদি), তারা কখনো কখনো ছোট ক'রে লেখার জন্য শব্দচিত্র বা লোগোগ্রাফি দিয়েও লেখে।
এবার ইজিপশিয়ানদের গণিতশাস্ত্রে ব্যবহৃত কিছু চিহ্ন নিয়ে আপনাদের একটা মজার গল্প বলি! আমরা তো এখনকার দিনে যোগ, বিয়োগ, এইসব সাধারণতঃ '+' এবং '-' চিহ্ন দিয়ে বোঝাই। এখন ইজিপশিয়ানরা তাদের বাচ্চাদের যোগ বিয়োগ বোঝাবার জন্য এক অসাধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। দুটি সংখ্যাকে 'যোগ করা' মানে তো খানিকটা দুইটি সংখ্যার "একসঙ্গে আসা', বা 'going into', বা 'going together' বোঝায়। তাই তাঁরা যোগকে 'per' ধনি দিয়ে বোঝাতেন, যে 'পার' ধ্বনির আর একটি অর্থ "বাড়ি"। অর্থাৎ তাঁরা যোগ করাকে, "বাড়ি যাওয়ার" সদর্থক মানের সঙ্গে তুলনা করতেন। বাড়িতে মানুষ যেমন মিলেমিশে থাকে আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে, যোগ হওয়া সংখ্যাগুলিও তেমনই খানিকটা মিলেমিশে থাকবে, এইরকম আর কি। আবার বিয়োগ করাকে তাঁরা একই ভাবে 'বাড়ি থেকে বেরোনোর' সঙ্গে তুলনা করতেন। তাই “Ahmes papyrus” নামক একটি প্রাচীন হিয়েরোগ্লিফিক গণিতসম্বন্ধীয় ডকুমেণ্টে, "যোগ করা" বোঝাতে "বাড়ির দিকে চলন্ত পা"-র চিহ্ন ( ) ব্যবহার করা হয়েছে। আর "বিয়োগ" করা বোঝাতে "বাড়ির দিক থেকে দূরে হাঁটা পা"। কী কাণ্ড! আচ্ছা, ইজিপশিয়ানদের ভাষা না জেনে, তাঁদের অঙ্কের নানান সূত্র না মিলিয়ে, খালি সাদা চোখে দেখে, আপনি আমি কেউই কি কখনো বুঝতে পারবো এরকম সব জটিল সিম্বলিজম-এর ব্যবহার? আমরা কি বুঝতে পারবো যে ইজিপ্টের নানান ভগ্নাংশ বোঝাতে যে চিহ্নগুলি ব্যবহার করা হতো সেইগুলি ইজিপশিয়ান পুরাণ অনুযায়ী ইজিপ্টের দেবতা হোরাসের চোখের নানান অংশ, যে চোখ নাকি দেবতা 'সেত' এর সঙ্গে যুদ্ধ করার সময়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, আর দেবতা 'থত' সেই চোখ আবার মায়াবী পদ্ধতিতে জুড়ে হোরাসকে ফেরত দেন।
এই সব গল্প বলার মূল কারণ হলো এই যে, আমরা আজকের আধুনিক চোখে একটি চিহ্নের যে শব্দার্থ বার করতে পারি, তার সঙ্গে প্রাচীন মানুষের ব্যবহৃত সিম্বলিজমের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন যোগ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। যেমন আমরা যদি একটা "ইঁদুরের ছবি" এঁকে তাকে "কম্পিউটারের মাউজ" বলি, তাহলে সেটি কি কোন প্রাচীন মানুষ বুঝতে পারবেন? সিম্বলিজম তো ভীষণ ভাবে দেশ, কাল, পাত্র, যাপনের সঙ্গে জড়িত। তাহলে কোন সাহসে, কোন ভরসায়, আজকের বহু গবেষক সিন্ধুলিপির এক একটি চিহ্নকে অবলীলাক্রমে, "এটা মাছ", "এটা গাছ", "এটা কার্তিক ঠাকুর", "এটা গণেশ" এসব বলে বলে পড়ে ফেলেন? এই অস্মিতা/ অজ্ঞতার বিরুদ্ধেই আমার গবেষণার জেহাদ।
এবার নিশ্চয়ই আপনারা একমত যে, কোনো লিপি ঠিক কোন পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের কাছে অর্থপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেয়, তা না বুঝে সেই লিপিকে পড়তে যাওয়া সম্পূর্ণ বাতুলতা। অথচ, যে কোন পাঠোদ্ধার না হওয়া লিপির ভাগ্যে ঠিক এই দুর্দশাই লেখা থাকে। ১৮৭৫ সালে প্রথম সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরের ছবি প্রকাশিত হবার পর থেকে, গত একশো পঞ্চাশ বছরে বহু পণ্ডিত গবেষক যেমন সিন্ধুসভ্যতা এবং তার লিপিকে নিয়ে দিগন্ত-উন্মোচনকারী সব কাজ করেছেন, তেমনই তাঁদের কেউ কেউ ইচ্ছেমতো নিজেদের কল্পনা অনুসারে এই লিপির অদ্ভুত সব পাঠোদ্ধারও করেছেন। সবচেয়ে সমস্যার কথা এই যে, এই লিপির চিহ্নগুলি শব্দচিত্র না অক্ষরচিত্র তাই নিয়েও নানা মুনির নানা মত। যেমন, চিহ্নটি সিন্ধুলিপির অধিকাংশ বাক্যাংশের শেষভাগে বসে। এটি সিন্ধুলিপির সবচেয়ে বারংবার ব্যবহৃত চিহ্নও বটে। এখন বিখ্যাত এপিগ্রাফিস্ট বা লিপিবিদ ইরাভথম মহাদেবনের মতে, এই চিহ্নটি দ্রাবিড়ীয় পুংলিঙ্গবোধক একবচনের সর্বনাম, যা বাক্যাংশের শেষে বসে। তা ছাড়াও মহাদেবন মনে করেন যে এই চিহ্নটি যাগযজ্ঞে ব্যবহৃত উৎসর্গপাত্রও বোঝায় কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু গবেষক ওয়েলসের (Brian Wells) মতে, চিহ্নটি ক্রিয়াপদের শেষাংশ যার ধ্বনি খানিকটা "-ay" এর মতো শোনায়, আর যা ক্ষেত্রবিশেষে আদি-দ্রাবিড়ীয় শব্দসংগ্রহে "গরু" এবং "মা" শব্দের সমার্থক। বুঝুন অবস্থাটা। একই চিহ্নকে এক পণ্ডিত বলেন "উৎসর্গ পাত্র", অন্য পণ্ডিত বলেন "মা" এবং "গরু"। একজন তাকে বলেন সর্বনাম, অন্যজন বলেন ক্রিয়াপদ। আবার বোনটার (Steve Bonta) মতে, একটি মূল-শব্দাংশ (root) যা কিনা অধিকার-জাতীয় শব্দ, মানে "আমার", "তাহার", ইত্যাদি বোঝায়। এইজন্যই হয়তো বিখ্যাত গবেষক পশেল (Gregory Possehl) বলে গেছেন “কোনো কোনো সিন্ধুলিপির গবেষকের ক্ষেত্রে কিছুটা অধৈর্য তাঁদের প্রারম্ভিক কিছু প্রাক্-কল্পনা থেকে দ্রুত একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত ও পাঠে পৌঁছে যেতে প্ররোচিত করেছে”। তবে এইক্ষেত্রে এই কথাও মনে রাখতেই হবে যে, এইসমস্ত গবেষকের অসাধারণ অক্লান্ত গবেষণার অনেক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দিকও রয়েছে। এঁদের অনেকের জ্ঞানই সমুদ্রপ্রমাণ। তাঁদের কারোর কারোর পাঠপদ্ধতি মেনে নিই বা না নিই, এঁরা আমাদের মতো যে কোন নতুন গবেষকের কাছে প্রণম্য এবং প্রাতঃস্মরণীয়। এঁদের কাজ ছাড়া, এঁদের তৈরি সিন্ধুলিপির কর্পাস বা ডেটাবেজ না থাকলে, আমরা আমাদের কাজ হয়তো শুরু করতেই পারতাম না।
প্রথম ভাগ, যেটি জুলাই ৯ তারিখে নেচার ব্র্যাণ্ডের জার্নাল প্যালগ্রেভ কমিউনিকেশন্স এ প্রকাশিত হলো, সেটি সিন্ধুলিপির গঠনগত দিকগুলি নিয়েই মুলতঃ ভাবে। আর পরের গবেষণাটি অনেক বেশি পাঠোদ্ধারকেন্দ্রিক কাজ। এখন আমার প্রকাশিত গবেষণার কাজটি মূলতঃ দুইটি মূল জিনিস প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
ক) সিন্ধুলিপিতে উৎকীর্ণ সীলমোহর আর মৃৎ-ট্যাবলেটগুলি আজকের দিনের ডাকটিকিট, মুদ্রা, র্যাশনটোকেন ইত্যাদির সঙ্গে তুলনীয়। আর সিন্ধুলিপিতে লেখা বার্তাগুলি কোন ভাবেই আধুনিক ভাষায় যেরকম "freely composed narrative" লেখা হয় তা নয়। মুদ্রার বা ডাকটিকিটের বিশেষবিশেষ অংশে যেমন বিশেষবিশেষ তথ্য দেওয়া থাকে, ঠিক সেরকমই এগুলির বিশেষবিশেষ স্থানে বিশেষ ধরণের বা শ্রেণীর শব্দচিত্র থাকে, যারা কার্যগতভাবে (functionally) কিছুটা একরকমের। অর্থাৎ এই উৎকীর্ণ সীলমোহর আর ট্যাবলেটগুলি "formalized data carriers", যাদের মধ্যে "document specific syntax" আর "linguistic syntax", দুই রকমেরই syntax বা গঠনপদ্ধতি দেখা যায়।
খ) দ্বিতীয়তঃ এই সিন্ধুলিপিতে লেখা বার্তাগুলির অধিকাংশ কেবলই "শব্দচিত্র" সমাহারে logographically লেখা। অর্থাৎ প্রায় নব্বই শতাংশ উৎসাহী মানুষ যেভাবে "বানান ক'রে ক'রে" বা রেবাস পদ্ধতিতে এগুলি পড়ার চেষ্টা করেন, তাঁরা, আমার মতে, ভ্রান্ত। এমন নয় একথা অন্য কেউ আগে একেবারেই বলেন নি। মহাদেবন, যিনি ভারতবর্ষে কম্পিউটার ব্যবহার করার প্রায় আদিযুগে, তিনিও এই লিপিকে logographic ই মনে করেন। কিন্তু মুশকিলের কথা এই যে, পারপোলা, যিনি বিশ্বের সবচাইতে অগ্রগণ্য ইন্ডোলজিস্ট এবং অগাধ বিশাল পণ্ডিত, তিনি কিন্তু "রেবাস পদ্ধতি" ব্যবহার করেন এই লিপির পাঠোদ্ধারের জন্য। আর তাঁর মতে কিছু কিছু প্রাচীন তামিল নাম যেমন "Aru-min", "Vel-min" ইত্যাদি এই লিপিতে উৎকীর্ণ সীলমোহরগুলিতে লেখা আছে। একইভাবে ওয়েলস, যিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিন্ধুলিপি নিয়ে ডক্টরেট, এবং এই সম্পর্কিত দু-দুটি বইএর লেখক, তিনিও "রেবাস পদ্ধতিতে" একটি খরগোসের ছবিওয়ালা তাম্রফলকের উৎকীর্ণ লিপিতে খরগোসের জন্য ব্যবহৃত প্রাচীন-তামিল শব্দ "Kevi-yan" রেবাস পদ্ধতিতে পড়ে ফেলেছেন বলে দাবী করেন। অথচ মহাদেবনের কথা মানতে হলে, এইভাবে রেবাস পদ্ধতিতে এই শব্দগুলি পড়াই যায় না। আবার এঁদের কথা মানতে গেলে হয়তো খানিকটা ভুল প্রমাণিত হয় মহাদেবনের মূল পদ্ধতিটিই। এমতাবস্থায়, আমার কাজটি বেশিরভাগ সিন্ধুলিপির বাক্যাংশে, তার চিহ্নদের শব্দচিত্র হবার একটি অকাট্য প্রমাণ দিতে পেরেছে, এবং বিভিন্ন লিপিচিহ্নের এক অতি প্রয়োজনীয় শ্রেণিকরণ (typological and functional classification) করে নিয়েছে, বিভিন্ন লিপিকেন্দ্রিক তথ্যপ্রমাণের (script-internal evidence) মাধ্যমে। গ্রীক লিনিয়ার-বি লিপির পাঠোদ্ধারের পথে অত্যন্ত প্রভাবশালী গবেষিকা কোবার-এর করে যাওয়া structural analysis যেমন পরবর্তীকালে ভেণ্ট্রিস- এর মাধ্যমে লিনিয়ার-বি লিপির পাঠোদ্ধারের প্রথম সোপান ছিল, আমারও এই আশা যে, আমার স্ট্রাকচারাল কাজটি, আগামী দিনে সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সদর্থক ভূমিকা নেবে।
যদি এখন জিজ্ঞাসা করেন আমার এই কাজটি এখনকার গবেষকদের কাছে ঠিক কী বার্তা পৌঁছে দেবে, তাহলে, আমার প্রিয় একটি আধুনিক বাংলা সিনেমা "হাওয়া বদলের" গান "ভয় দেখাস না প্লিজ" এর প্রথম লাইন একটু বদলে দিয়ে, একটু মজার ছলে হলেও, আমি আমার সহগবেষকদের বলতে চাই, "নাম খুঁজবেন না প্লিজ, আমরা দেরি হলেও সঠিক পড়তে চাই"। আমার গবেষণা অনুযায়ী সিন্ধুলিপির সীলমোহরগুলিতে সেই সব সীলমোহরের মালিকদের নাম লেখা থাকতো না কোনভাবেই। কোনো ধর্মীয় মন্ত্র, বা দেবদেবীর নামও লেখা থাকতো না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যা লেখা থাকতো তা হলো, ব্যবসাবাণিজ্য করার জন্য, ব্যবসাবাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য। একথা সত্যি যে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সীলমোহরগুলিতে মালিকের নাম খোদাই করা থাকতো। কিন্তু আমাদের আজকের ভারতের ডাকটিকিট বা পয়সায় ‘জাতির জনক’ গান্ধির ছবি ছাড়া কোন মানুষের নাম লেখা থাকে কী? না তো? সিন্ধুসভ্যতার মানুষরা তাই মেসোপটেমিয়ানদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন নি।
যেহেতু আমার প্রথম গবেষণাপত্রটি এই লিপির গঠনগত দিক, বা স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস নিয়ে, সেই গবেষণাপত্রের সীমার মধ্যে থাকতে চেয়ে আমি এই লিপি-নিদর্শনগুলিতে ঠিক "কী" লেখা থাকতো তাই নিয়ে আর কথা বলবো না এক্ষুনি। কারণ সেই বিষয়ে আলোকপাত করতে আমার দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি আশা করি অনতিবিলম্বে প্রকাশিত হবে। কিন্তু যেহেতু আমার প্রকাশিত গবেষণাটি নানান ইন্টারডিসিপ্লিনারি পদ্ধতিতে প্রমাণ ক'রে দিয়েছে, যে অধিকাংশ সিন্ধুলিপিতে উৎকীর্ণ সীলমোহর আর ট্যাবলেট বানান ক'রে বা রেবাস দিয়ে লেখা নয়, স্বাভাবিক ভাবেই তারা বানান করে কারোর নাম বোঝাতেও পারে না তাই না? নাম বোঝানোর দরকার হলে আমাদের সিন্ধুসভ্যতার মানুষজন হয়তো অন্য কোন লিখন-প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতেন।