এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বলি!

    Tridibesh Das লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৯ মার্চ ২০২০ | ৩২৯৭ বার পঠিত
  • কলকাতা থেকে বাসে একঘণ্টা। জায়গাটা নামেই মফস্বল, বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোলেই হুট করে জনবসতি কমে আসে। লোকালয়ের প্রান্তে বাগদী পাড়া, ছড়ানো ছেটান দশ বারোটা ঘর। তারপর দুপাশে চাষের জমি, মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। ঘণ্টা খানেক পর পর ধুলো উড়িয়ে বাস চলে যায়। ওই রাস্তা ধরে আরও চার পাঁচ কিলোমিটার এগোলে চোখে পড়বে একটা দহ, শ্যাওলায় কালো হয়ে যাওয়া ঘাট। অনেক আগে এই অঞ্চলে বসতি ছিল। এদিক ওদিকে পরিত্যক্ত কিছু বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কোনটার ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে, কারো দেওয়াল। ভেতরে আগাছার জঙ্গল, সাপ খোপের আড্ডা। দহের চারপাশের পাকা রাস্তা এখন ঢেকে গেছে মুথো ঘাসে। বাঁদিকের এবড়ো খেবড়ো জমিতে জীর্ণ এক কালী মন্দির, পলেস্তারা খসে পড়ছে। সামনের চত্বরে হাড়িকাঠটা মন্দিরের অতীত গৌরবের সাক্ষী। এই মন্দির নিয়ে অনেক জনশ্রুতি আছে। কেউ বলে ডাকাতে কালী, কেউ কেউ বলে মড়কা কালী।

    ওই জায়গাটা টানে আমায়। ছেলেবেলায় জ্যাঠার মুখে শুনেছিলাম ওখানেই আমাদের আদি নিবাস। বহু বছর আগে দাদুরা অজ্ঞাত কারণে ভিটে ছেড়ে প্রায় একবস্ত্রে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। বাবা তখনও প্রাইমারীতে। কৌতূহল হত পৈতৃক ভিটে দেখার। গ্রীষ্মের ছুটিতে জ্যাঠার সাথে দুতিনবার গিয়েছি, লুকিয়ে। বাবা একদম পছন্দ করতেন না, চাইতেন না আমি যাই। খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন বাবা, অতীতের কথা কখনো বলতে শুনিনি। অথচ ওখানে গেলে জ্যাঠার মুখচোখ অন্যরকম হয়ে যেত, বদলে যেত চলাফেরা। ঋজু হয়ে হাঁটতেন, অচেনা অহংকার ফুটে উঠত গলায়। অতীতের নানা ঘটনা বলতেন। গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে প্রৌঢ় লোকটির মুখে সেসব ঘটনা শুনে গা ছম ছম করে উঠত। ঘটনা না বলে গল্প বলাই ভাল, আজকের দিনে কেউ বিশ্বাস করবে না। অনেক আগের ভয়ানক এক মড়কের কথা বলতেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকত মৃতদেহ, বাড়ি বাড়ি শোনা যেত কান্নার রোল।

    মাকে সন্তুষ্ট করতে খুব ধুমধাম করে ওই কালী মন্দিরে পূজা দেওয়া হয়েছিল, সব উপাচার মেনে। মড়ক থামেনি। আশে পাশের গ্রামেও মৃত্যু ছড়িয়ে পড়েছিল। লোকে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিল, অসুস্থ আত্মীয়দের ফেলে। যজমানরা এসে প্রপিতামহের কাছে কেঁদে পড়েছিলেন। এক শনিবারে মাকে সন্তুষ্ট করতে জোড়া মহিষ বলি দিয়েছিলেন প্রপিতামহ। অনেকে বলে ভোর রাতে মায়ের মন্দিরে আরও এক বলি হয়েছিল। আগের সন্ধ্যে থেকে বাগদীদের একটি ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ছেলেটি অবাধ্য প্রকৃতির, প্রবীণদের অপমান করতে বাধত না। ঐ বয়েসেই তার নামে মহিলাদের অনেক অভিযোগ। সকালে বাজার যাবার সময় কেউ কেউ মন্দিরের চাতালে চাপ চাপ রক্ত দেখেছিল, তখনো ধোয়া হয় নি। গ্রামের লোক এই নিয়ে টুঁ শব্দ করেনি। বাগদিরাও কেউ থানায় যেতে সাহস করে নি, ওদের অনেকের নামেই চুরি ছিনতাইয়ের বিস্তর অভিযোগ। মড়ক কিন্তু থেমেছিল। যারা পালিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছিল এক এক করে।

    শুনতে শুনতে ভয়ে জ্যেঠুর কাছে সরে আসতাম। ওই পরিবেশে, ওই নির্জন প্রকাণ্ড দহের ঘাটে বসে সব সত্যি মনে হত। মনে হত কলকাতা আর এই অঞ্চলের মধ্যে কয়েক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। অনেকবার ভেবেছি জিগ্যাসা করব ওনারা কেন ভিটে মাটি ছেড়ে শহরে চলে এসেছিলেন। সাহস হয় নি। উনিও কখনো বলেন নি, হয়ত অপ্রিয় কোন ঘটনা ছিল। দুরন্ত বাগদীদের কেউ কি বকেয়া হিসাব মেটাতে চেয়েছিল? মন্দিরে আবারো কোন বলি হয়েছিল যা গ্রামের লোক মেনে নিতে পারেনি? অথবা মড়ক ফিরে এসেছিল? জেঠু আমাকে মন্দিরে ঢুকতে বারণ করতেন, বলতেন আগে প্রস্তুত হও। বাবা কিন্তু জানতে পেরেছিলেন ভিটেয় যাতায়াতের কথা। কাউকে না জানিয়ে দিল্লিতে বদলি নিয়েছিলেন, জোর করে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের। এর পর দীর্ঘদিন কেটেছে প্রবাসে। শুনেছিলাম মৃত্যুশয্যায় জেঠু অনেক খুঁজেছিলেন আমাকে। বাবা আসতে দেন নি।

    রিটায়ারমেন্টের পরে এখন অখণ্ড অবসর। বড় ছেলে সপরিবারে হায়দ্রাবাদে, ছোট ব্যাঙ্গালোরে। পৈতৃক ভিটেতে মাঝে মাঝে চলে আসি। বাজার থেকে চল্লিশ মিনিটের হাঁটা। ওদিকে কেউ চেনে না আমায়, মাথাও ঘামায় না। আশ্চর্য, এত বছর পরেও জায়গাটা একই রকম রয়ে গেছে, পরিত্যক্ত, জন শূন্য। অমঙ্গলের ভয়ে কেউ ভেড়ে নি। আমার তাতে অসুবিধা নেই। মন্দিরের পাশে প্রকাণ্ড অশ্বত্থ, বট আর নিম জড়াজড়ি করে উঠেছে। গোড়ায় বাঁধান বেদী। সেখানে বসি, পুষ্করিণীর ঠাণ্ডা হাওয়া স্পর্শ করে যায়। দুপুরে শুকনো পাতা উড়ে যাবার, দূরে বাঁশের ডালে ডালে ঘষা লাগার শব্দ আসে। চুপ করে শুনলে মনে হয় সেই সাথে হাওয়ায় ভেসে আসে অনেক ফিসফিসানি। মনে হয় চারপাশে এখনো অনেক রহস্য ছড়িয়ে আছে। নিশি পাওয়া মানুষের মত একা একা ঘুরে দেখি সব কিছু। প্রতিটা জায়গার সাথে সখ্যতা করতে হয়, সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। তখন সে নিজেই উন্মুক্ত করে দেয় যত রহস্য। একদিন খুঁজে পাই মন্দিরে মাতৃ মূর্তির পেছনে চোরাকুটিরের সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি।

    আর একদিন পেয়েছিলাম পাতকুয়োটা। মন্দিরের ঠিক পেছনে, ওপরে কাঠের তক্তা ফেলা। শুকনো পাতার আস্তরণে ঢাকা পড়ে, না জানলে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। ঘুরতে ঘুরতে হোঁচট খেয়েছিলাম। কাঠের পাটাতন সরাতে দেখি হাতের নাগালে স্বচ্ছ টলটলে জল, কুয়োর অনেক নিচ অব্ধি দেখা যাচ্ছে। ঠাণ্ডা জলে হাত মুখ ধুতে গিয়েও থমকেছিলাম। যা ভেবেছিলাম কলকাতার ল্যাব রিপোর্টে ঠিক সেটাই বলেছিল। জলে অজস্র বিষাক্ত, প্রাণঘাতী জীবাণু থিক থিক করছে। ভয়ানক সঙ্ক্রমণের জন্যে এক ফোঁটাই যথেষ্ট। পরের বার সঙ্গে ফ্লাস্ক এনেছিলাম। নির্জন এই মন্দির প্রাঙ্গণে, এই আধা অরণ্যে, এই পুষ্করিণীর বাতাসে কিছু একটা আছে। স্বভাব বদলে দেয়। নিজেকে বিচারক মনে হয়, কাঁধে চেপে বসে জগতের ভাল মন্দের দায়। সন্তু - বেনেপুকুরের নতুন মস্তান, পেছনে ক্ষমতাশীল দল। পাড়ার যাবতীয় দুষ্কর্ম চালাচ্ছিল এতদিন, এখন তার কুদৃষ্টি পড়েছে ছোট ভাইয়ের মেয়ের ওপর। সন্দেশের একটা প্যাকেটে একফোঁটাতেই কাজ হয়। বন্ধু শ্যমলের জন্ম রুগ্ন ছেলে, বাবা মা সর্বস্বান্ত হচ্ছে ওর চিকিৎসায়। এক ফোঁটা। কেউ সন্দেহ করে না।

    জানি এখনো অনেক কিছু জানা বাকি আছে। ফিরে ফিরে যাই ভিটেয়। সময় সব বলে দেবে। ছোট ভাইয়ের ছেলেকে দেখি, মনে পড়ে জ্যেঠুর কথা, সেই রকম ঋজু শরীর, অহংকারী চাওনি। ভাবি ওকে আনব একদিন, সব চিনিয়ে দেব।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৯ মার্চ ২০২০ | ৩২৯৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    লাল রঙ - Nirmalya Nag
    আরও পড়ুন
    বাবর - upal mukhopadhyay
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একলহমা | ২৯ মার্চ ২০২০ ১৯:৫২91875
  • চমৎকার হয়েছে। পরের গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।
  • Rajkumar Raychaudhuri | ২৯ মার্চ ২০২০ ২২:০৩91877
  • golpota ki niye? onek gulo bishoy vir koreche. bishoy ta nirrdisto korle valo jomto. lekhar hat ta darun

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন