আমরা চাই না, বা ভেঙে বললে বলতে হয় আমি চাই না যে বিজয় দিবসে আনন্দ উল্লাস ছাড়া আর ভিন্ন কিছু লেখি। কিন্তু লিখতেই হয়। আমি যখন দেখি কত সহজেই মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখা হয় এখন এই দেশে তখন না লিখে উপায় থাকে না আর। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম বড় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিন্দু মাত্র টান না নিয়ে, এইটা বিভীষিকা মনে হয় আমার। যদি আমরা হুট করে কারো দয়ায় ভিক্ষায় স্বাধীনতা পেতাম তবুও যুক্তি মিলত। তা তো না, আমাদের চেয়ে দাম দিয়ে স্বাধীনতা কিনেছে কে আর? নয় মাস আমাদের উপরে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজির বিহীন। অথচ এখন কত সহজে আমরা আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ছোট করি!
আকরাম নামে এক মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনেন। যশোরের মনিরামপুরে বাড়ি আকরামের। যুদ্ধের মধ্যে আসাছে লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে। মা ছেলেকে দেখে ভাত রান্না করছে। ছেলে গরম ভাত নিয়ে বসছে। খেয়েই পালাবে এখান থেকে। এর মধ্যে রাজাকাররা খবর পেয়ে গেছে। বাড়িতে এসে চড়াও হয়েছে। ধরা পরে গেল আকরাম। ক্যাম্পে সাতদিন ধরে চলল নানা অত্যাচার। আকরাম ভেঙে পড়ার লোক না। মুখ থেকে কিছু বের করতে পারবে না বুঝে তাঁকে নিয়ে আসছে বধ্যভূমিতে। মেরে ফেলবে সবার সামনে যেন সবাই শিক্ষা পায়। যিশুকে যেমন নিজের ক্রুশ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল আকরামকেও তিনটা বাঁশ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হয় বধ্যভূমিতে। দুইটা বাঁশ মাটিতে পুতে আরেকটা আড়াআড়ি বাঁধে। আকরাম নিজেই করে এই সব কাজ। আকরাম মৃত্যুতে একটু ভীত না, বরং কে মারবে তাঁকে তা সে নিজেই জানতে চায় তাদের কাছে। তখনও তিনি জানেন না কীভাবে মারা হবে তাঁকে। হয়ত ভেবেছিলেন ফাঁসি দিবে বা গুলি করবে। কিন্তু না!
খাসি জবাই করার পরে যেমন পায়ের গোড়ালিতে শিক গেঁথে উল্টো করে ঝুলান হয় তেমন করে পায়ের গোড়ালিতে শিক গেঁথে উল্টো করে ঝুলান হল আকরামকে ওই বাঁশের উপরে। এরপরে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস চাকু দিয়ে কেটে কুকুরকে খেতে দিল, মাংস কেটে চোখের সামনে এনে দেখানো হল তাঁকে। এক সময় পেটের বাম দিক থেকে ডান দিকে চাকু টেনে চালিয়ে দেওয়া হল, শেষে গলায় চাকু চালিয়ে মেরে ফেলা হল আকরামকে! লাশ ঝুলি রইল সেখানেই।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন আনন্দবাজার পত্রিকায় এই ঘটনার বিবরণ লেখেন তখন অনেকেই এর প্রতিবাদ করে ছিলেন। মানে মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এমন কাণ্ড হতে পারে! প্রতিবাদ করে মৈত্রেয়ী দেবী এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে চিঠি লিখেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় মনিরামপুর বাজারে গিয়ে জিজ্ঞাস করতে বলেছেন, বলেছেন ডজনখানেক চাক্ষুষ সাক্ষী বাজারেই পেয়ে যাবে যে কেউ!
শুধু মৈত্রেয়ী দেবী না, অনেকেই নৃশংসতা নিয়ে প্রশ্ন করে এখন। বিশ্বাস করতে চায় না, আরে এমন আবার হয় না কী! অথচ আমরা জানি এমনই হয়েছে এই দেশে। রাষ্ট্রের সরাসরি ঘোষণায় হয়েছে এমন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আরেকটা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেই এই সুযোগে। তিনি বাংলাদেশে আসছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। সাতক্ষীরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রাতে ছিলেন। হঠাৎ মনে হল জীবনানন্দ দাসের উপরে ডকুমেন্টারি বানালে কেমন হয়। মানে এই গ্রাম বাংলার যে বর্ণনা কবি দিয়ে গেছেন তার ছবি তুললেন, দোয়েল পাখি গাছপালা এগুলার ছবি আর কি! তিনি পরেরদিন দোয়েল পাখির খোঁজে বের হলেন। এবং জীবনের মত দোয়েল পাখির প্রতি যত কবিত্ব ছিল সব উবে গেল তাঁর। দেখলেন নদীর ধারে লাশের স্তূপ, দোয়েল পাখি একটা শবের উপরে চড়ে লাশে যে পোকা দিয়েছে তা টেনে টেনে খাচ্ছেন! দূরে আরেকটা কুকুর অন্য আরেকটা শব দেহের পায়ের মাংস খাচ্ছে! তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন কোনদিন কি দোয়েল পাখি মাথায় আসলে এই দৃশ্য ছাড়া অন্য কোন কিছু মাথায় আসবে? তিনি এই দৃশ্য ভুলতে পারবেন? ভুলা সম্ভব না। কিন্তু আমরা কেন জানি পারি! আমাদের এই সব এখন আর গায়ে লাগে না। বেশি বেশি মনে হয়। অথচ এমন উদাহরণ আমার মত নবিসও হাজার হাজার জোগাড় করতে পারব। একটু খাটলে চাক্ষুষ সাক্ষীর মুখ থেকে শোনা যাবে নৃশংসতার ইতিবৃত্ত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি শুধুমাত্র আদেশ পালনের জন্য যুদ্ধ করত তাহলে সেই যুদ্ধ হত ভিন্ন রকম। তারা তা করেনি। তারা উপভোগ করেছে এই গণহত্যা। আমি এখন মাঝে মধ্যেই ভাবি যে কী পরিমাণ, কী অপরিসীম ঘৃণা কারো মনে থাকলে এমন করে গণহত্যা চালানো যায়! বাঙালি জাতিটার প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত, জেনারেল থেকে শুরু করে সৈনিক, সবার সমান ঘৃণা কাজ করেছে। আর আমাদের দেশের মানুষ এখনও অনেকেই মুসলিম বলে পাকিস্তানকে মনে প্রাণে সমর্থন করে। যেখানে তারা বাঙালীদেরকে প্রকৃত মুসলমান বলেই মনে করত না! হিন্দুদের তো মানুষই মনে করত না তারা। জেনারেল নিয়াজি নিজেই বগুড়া সেনা ইউনিট পরিদর্শনের সময় জানতে চান কজন হিন্দু নাগরিক হত্যা করা হইছে? নিয়াজির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি জেনারেল গুল হাসান পরিদর্শনে আসলে প্রতিবারই জিজ্ঞাস করত এ পর্যন্ত কতজন বাঙালিকে হত্যা করা গেছে? বাঙালি হত্যার জন্য লিখিত আদেশ থাকত! পাকিস্তান এই সব এখন পর্যন্ত স্বীকার করেনি। পাকিস্তান যে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে এখন আসল সত্য জানতে আগ্রহী হবে তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায় না। নিজেদের পাঠ্য বইয়ে তো আজগুবি ইতিহাস লিখে রেখেছেই অন্য কোথাও এখন পর্যন্ত ভুল স্বীকারের কোন দায় দেখা যায় না, দুই একজন ব্যক্তিক্রম ছাড়া। তাই ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক ইকরাম সেহগাল লিখেন - "The army action in East-Pakistan was professionally correct and it was carried out with a surgicat precision... The major part of the army behaved as professional soldiers" (India Today, 21 August, 2000, p. 34, আমি নিয়েছি একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য/ আহমেদ রফিক বই থেকে।)
আমাদের রক্তের দাম এখন সস্তা মনে হয় অনেকের কাছে। অবলীলায় স্বাধীনতা, শহীদের সম্পর্কে হাস্যকর নানা কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন কিছু বললেই কারো গায়ে ফোস্কা পরে যায়। চেতনা ব্যবসায়ী বলে তেড়ে আসে একদল। রক্ত কত সস্তা এই দেশে যে এমন কাণ্ড ঘটে এই দেশে? লন্ডন টাইমস লিখেছিল - “If blood is the price of independence then Bangladesh has paid the highest price in history"
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফরাসী লেখক - দার্শনিক আন্দ্রে মালরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বলেছিলেন, "আমি সম্ভবত এমন এক প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি যেখানে মৃতের সংখ্যা জীবিতদের থেকে বেশি!!" এমন আর কোথাও নাই, এমন আর কোথাও হয়নি! আহা! এর মূল্য যদি বুঝত সবাই! এত এত শহীদ, এত এত স্বজন হারার হাহাকার, সব কিচ্ছু না? আমরা কেমনে পারি?
এত বাধা, এত এত সমস্যা আমাদের তবু আমরা যে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এইটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। এত এত রক্ত ত্যাগের পরে যদি আমরা হারিয়ে যাই তাহলে এর চেয়ে খারাপ, এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে জাতির জন্য? কিছুদিন আগে হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছে। একটা পৈশাচিক আনন্দ হয় যখন বুঝি এই লোকটা, যে সর্ব শক্তি দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা রুখে দিতে চেয়েছিল, যে আমাদেরকে তলা ছাড়া ঝুড়ি বলে তাচ্ছিল্য করেছিল সে আমাদের উত্থান দেখে যেতে পারেছে। এখন মরে গেছে, পনেরো বিশ বছর আগে মরলে হয়ত তাকে দেখিয়ে দেওয়ার তৃপ্তিটা আমরা পেতাম না। দেরি করে মরার জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে কিসিঞ্জার!
আমরা, আমাদের বাংলাদেশ সব সম্ভাবনাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে নানা দিকে বিজয় অর্জন করে যেতেই থাকবে। যাদের আত্মত্যাগ ছাড়া প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতাটা আমরা পেতাম না সেই সকল শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা সকলকে।
শেষ করি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে -
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।