এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • ২১ শতকে মার্ক্সের চিন্তা ভাবনাকে ফিরে দেখা

    চিন্তা গোষ্ঠী
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৪ জুন ২০২৩ | ১২৬৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • এমন এক প্রলয়ের কালে আমরা যারা স্বপ্ন দেখতে জানি, তারা অন্ধ ও বধির হয়ে যাই নি, আমরা যারা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথ হাঁটি সেই স্বপ্ন আজ আমাদের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে। স্বপ্নভঙ্গকে আমরা হতাশার প্লাবনে ভেসে যেতে দেইনি বরং স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার অভ্যাস আমাদের ডুব দিতে শিখিয়েছে সমস্যার গভীরতম তলদেশে। আমরা এই প্রচন্ড প্রলয়ের মুখে লাথি মেরে এখনও রাস্তায় বা আলোচনা সভায় প্রতিবাদ জারী রাখার সাথে সাথে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি সাম্যবাদের বিজয়ের, সাম্যবাদী তত্ত্বের অগ্রগতির, নতুন করে সমস্ত ভাবনা-চিন্তাকে সজীব ও সৃজনশীল করে তোলার।
    ছবিঃ কচাস


    মার্ক্সের এবং অন্যান্য মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের ভাবনা চিন্তার বাস্তব ভিত্তি ছিলো ১৯ এবং ২০ শতকের প্রথমদিকাকার বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা পাল্টাতে শুরু করে ২০ শতকের গোড়াতেই এবং তা আমূল পাল্টে যায় ২০ শতকের মধ্য সত্তর দশক থেকেই।

    এখন ২১ শতকের দুই দশক অতিক্রান্ত। এই দুনিয়া অর্থনৈতিক জায়াগা থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জায়াগা থেকে অন্য এক তলে পৌঁছে গেছে। ফলে আমাদের আনেকেরই মনে হয়েছে ১৯ এবং ২০ শতকের প্রথমদিকাকার বাস্তবাতার উপর দাঁড়িয়ে যে তত্ত্বায়ান মার্ক্স ও সেসময়ের অন্যান্য মার্ক্সীয় চিন্তাবিদেরা করেছেন, তাকে ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে। যে কোন তত্ত্বের মতোই তা পুণর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। আমরা যারা এই ধরনের চিন্তায় কমবেশী একমত, তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছি। এই লেখাগুলো তারাই প্রতিফলন।

    আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন সব মানুষেরই থাকে। তাই আমরা এই লেখাগুলোকে চূড়ান্ত বলে মানি না। বরং আশা করি এই ভাবনাগুলির আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে আজকের দুনিয়াকে দেখা ও তাকে পাল্টানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।

    আমরা একা নই। সারা পৃথিবী জুড়ে মার্ক্স ও অন্যান্য মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের তত্ত্বগুলোকে নতুন আলোয় দেখায় প্রচেষ্টা চলছে। আমরা তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

    এই শ্মশান সময়েও কেন আমরা স্বপ্ন দেখছি

    যে মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে না, যখন প্রলয় আসে সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।

    বিংশ শতকের শেষভাগ ও একবিংশ শতকের শুরু থেকেই এক প্রলয়ের প্রচন্ড অভিঘাত সৌরমন্ডলের এই তৃতীয় গহকে গ্রাস করেছে। তথাকথিত সমাজতন্ত্রের অবসান ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির ক্রমাগত উত্থান, প্রকৃতিকে অবাধ লুন্ঠনের মাধ্যমে বিশ্বপুঁজিবাদের হিংস্রতম রূপ আজ আমাদের ধরিত্রীকে এক নরকের অগ্নিকুন্ডে পরিণত করেছে। দেশে দেশে দক্ষিনপন্থার উত্থান, ধর্মীয় ও জাতিগত মৌলবাদের বিষবাষ্পে ঢেকে গিয়েছে মননের দুনিয়া। আজ যখন স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতি আর একটি স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতা দখল ও জনতার অভ্যুত্থানকে নির্মম দমন (সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কা কান্ড, আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে তালিবান উত্থান ও অতীতে ইরানের শিয়া মৌলবাদের ক্ষমতা দখল দ্রষ্টব্য), ধর্মীয় ও জাতিগত মৌলবাদ যখন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় মেতেছে। যখন আজ রাশিয়া বিনা বাধায় ইউক্রেনের উপর আক্রমন নামিয়ে আনছে, অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলো নিশ্চুপ বা পাল্লা ঠিক রাখার খেলায় ব্যস্ত, আর নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন স্রেফ দুই রাষ্ট্রের মাতব্বরদের জেদ রক্ষার দায়ে। যখন আমেরিকায় কালো মানুষদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়ন চলেছে, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ময়নমারে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর অত্যাচার চরমে উঠেছে, আমেরিকা আফগানিস্তানকে ছিবড়ে করে দিয়ে তালিবানদের হাতে তুলে দিয়ে মজা দেখাছে, ইরানে, তুরস্কে স্বৈরাচার যা খুশী তাই করে চলেছে, তখন এমন এক প্রলয়ের কালে আমরা যারা স্বপ্ন দেখতে জানি, তারা অন্ধ ও বধির হয়ে যাই নি, আমরা যারা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথ হাঁটি সেই স্বপ্ন আজ আমাদের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে। স্বপ্নভঙ্গকে আমরা হতাশার প্লাবনে ভেসে যেতে দেইনি বরং স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার অভ্যাস আমাদের ডুব দিতে শিখিয়েছে সমস্যার গভীরতম তলদেশে। আমরা এই প্রচন্ড প্রলয়ের মুখে লাথি মেরে এখনও রাস্তায় বা আলোচনা সভায় প্রতিবাদ জারী রাখার সাথে সাথে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি সাম্যবাদের বিজয়ের, সাম্যবাদী তত্ত্বের অগ্রগতির, নতুন করে সমস্ত ভাবনা-চিন্তাকে সজীব ও সৃজনশীল করে তোলার।

    বিংশ শতকের শেষভাগ ও একবিংশ শতকের শুরু আমাদের যে অমোঘ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় তার নাম সমাজতন্ত্রের পরাজয়। আমরা খুঁজতে ও খুঁড়তে শুরু করি – কি ছিলো এই “সমাজতন্ত্র”?

    সমাজতন্ত্রের সঙ্কটের স্বরূপ - কল্লোল

    (এই লেখাটি ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে গুরুচন্ডা৯’র বুলবুলভাজায় প্রকাশিত “সমাজতন্ত্রের সংকট – কিছু ভাবনা” নামে ছাপা প্রবন্ধটির পরিমার্জিত রূপ)

    সমাজতন্ত্র সংকটে। আজ আর এই নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। একদিন ছিলো। কিন্তু অন্য একটা বিতর্ক আছে - আবার নেইও বটে। সংকটের শুরু কোথায়? বির্পযস্ত সমাজতন্ত্রের তলায় চাপা থাকা এই বিতর্ক খুঁড়ে আনা যাক। পুরোনো কাসুন্দি নেহাৎ খারাপ কিছু নয়।

    প্রশ্ন তুলেছিলেন বাকুনিন “শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র” নিয়ে। আশংকা প্রকাশ করেছিলেন সেই “রাষ্ট্র”এর রাশ নয়া অভিজাতবার্গের হাতে চলে যাবার। প্রশ্ন তুললেন রোজা লাক্সেমবার্গ, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র নিয়ে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে।

    কিন্তু, তখন সময় ছিলো আগুন জ্বালার। তাই বাকুনিন ও রোজার প্রশ্ন ও আশঙ্কা হারিয়ে গেলো। অসাফল্যের মতো অসফল রোজা ও বাকুনিনের প্রশ্নাবলী ও আশঙ্কাসকল উড়ে গেলো, পুড়ে গেলো, লেনিনিয় সাফল্যের ঝড়ে আর আগুনে।

    রোজা আর বাকুনিনের অবহেলিত প্রশ্নাবলীর ও আশঙ্কার আড়াল থেকে উঠে এলেন ক্রুশ্চভ, তার শন্তিপূর্ণ সহাবস্থানের তত্ত্ব নিয়ে। কেউ কেউ বললেন বুর্জোয়া রাস্তায় হাঁটছে লেনিনের পার্টি - লড়াই জারী আছে। সংকট রুশ এবং তার তাঁবেদারদের। সমাজতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক।

    হাঙ্গেরী ক্ষতবিক্ষত হলো রুশ ট্যাঙ্কের ধাতব বেল্টের তলায়। গোটা পূর্ব ইউরোপ জুড়ে রুশ ছায়া গাঢ়তর। কেউ কেউ বললেন - লেনিনের রাশিয়া, স্তালিনের রাশিয়া - সামাজিক সাম্রাজ্যবাদে পরিণত । কিন্তু লড়াই জারী আছে। সমাজতন্ত্রের পতাকা উড়ছে - চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েৎনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, আলবানীয়া, কিউবা ................। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

    পৃথিবী জুড়ে লড়াই তখন ঢেউ-এর মতো আছড়ে পড়ছে - এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা। নক্সালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ থেকে সরর্বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যারিকেডে। নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধবিরোধী মিছিল থেকে রোডেশিয়ার গেরিলা হানায়। চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা খেমার রুজ আর ভিয়েৎকং বাহিনী থেকে চিলির নির্বাচনে সালভাদোর আয়েন্দে। আর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পৃথিবী কাঁপানো বজ্রনির্ঘোষ - সদর দপ্তরে কামান দাগো।

    তবু স্ফুলিঙ্গ সমূহ দাবানলে পরিনত হলো না। শুরু হলো পিছু হাটার দিন। রোজা ও বাকুনিনের অবহেলিত প্রশ্নাবলী ও আশঙ্কার আড়াল থেকে এবার উঠে এলেন তেং শিয়াও পিং তার ইঁদুর ধরা বেড়ালের তত্ত্ব নিয়ে অনেকে বললেন - বুর্জোয়া রাস্তায় হাঁটছে মাও-এর পার্টি - তবু লড়াই .........

    ভিয়েৎনাম, আমার নাম তোমার নাম, সেই ভিয়েৎনামের হাতে আক্রান্ত কম্বোডিয়া। আনন্দবাজারে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে গণপ্রজাতন্ত্রী উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুং উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষনা করলেন তার ছেলেকে। চীন এবং ভিয়েৎনাম রাইফেল উঁচিয়ে ধরলো একে অন্যের বিরুদ্ধে। প্রায় সকলেই বলে উঠলেন - হচ্ছেটা কি !!!

    হঠাৎ উঠলো ঝড় অমাবস্যার রাতে, উত্তাল সমুদ্দুর। গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকা ..........। সোভিয়েৎ রাশিয়া, রুমানিয়া, য়ুগোশ্লোভিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, বার্লিন দেওয়াল এবং শেষ পর্যন্ত আলবানিয়া............. সবই আচমকা অতীত।

    সংকটে সমাজতন্ত্র। সংকটের বহি:প্রকাশ বড় বিচিত্র। পশ্চিমের পূব - পূর্ব ইউরোপ আর রাশিয়ায় এর বহি:প্রকাশ বেশ ঘটনাবহুল। বহুকাল ধরে, ষাঠের দশকের গোড়া থেকেই, আলবানিয়া, রুমানিয়া আর য়ুগোশ্লোভিয়া ছাড়া, গোটা পূর্ব ইউরোপই ওয়ারশ চুক্তির বকলমে রাশিয়ার ছায়ায় ঢাকা। সেই ছায়াচ্ছন্ন পূর্ব ইউরোপ আর রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের নামে চলেছে পার্টি এবং সরকারী আমলা পুঁজির শাসন – রাষ্ট্রীয় পুঁজি যার বিমূর্ত রূপ। আলবানিয়া, রুমানিয়া আর য়ুগোশ্লোভিয়ায় যা চলছিলো - তা এরই রকমফের মাত্র। সবখানেই সাধারনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব সংকটে। সংখ্যালঘু জাতির ওপর সংখ্যাগুরু জাতির ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি জাতি পরিচয়ও আধিপত্য কায়েম করছে। যদিও রাষ্ট্রীয় পুঁজির এই শাসনকে দুনিয়া সমাজতন্ত্র বলেই চিহ্নিত করতো। তাই যখন রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপের মানুষ কমিউনিষ্ট পার্টির শাসনকে অস্বীকার করলো - তখন নানান জাতি স্বত্তায় ভাগ হয়ে গেলো প্রতিটি "সমাজতান্ত্রিক'' দেশ। গড়ে উঠলো নতুন সব জাতিরাষ্ট্র - যারা জন্মলগ্ন থেকেই একে অপরের ঘোষিত শত্রু। যুদ্ধ, অনাহার আর মাৎসন্যায়ে ভেসে গেলো পশ্চিমের পূর্ব। বুর্জোয়া দুনিয়া পরম বিশ্বাসে বললো - সমাজতন্ত্র মৃত।

    সমাজতন্ত্রের সংকট তার চেহারা পাল্টে নিলো এশিয়ায়। চীন, উত্তর কোরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েৎনাম, লাওসে ক্ষমতায় রয়ে গেলো কমিউনিষ্ট পার্টি। দেশভাগ বা ওই জাতীয় কিছু ঘটলো না। যা ঘটলো - চীন-ভিয়েৎনাম, ভিয়েৎনাম-কম্বোডিয়া স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ। কিন্তু প্রায় অঘটনের মতো করে ঘটে গেলো - রাষ্ট্রীয় পুঁজির পাশাপাশি ব্যক্তি পুঁজির, বিশেষত: বিদেশী লগ্নী পুঁজির অনুপ্রবেশ। এখানেও সাধারনের ওপর দমন নেমে এসেছে অতীতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও। তবে সাধারনের সমস্যা এখানে যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে অনেক বেশী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। বুর্জোয়া দুনিয়া পরম বিশ্বাসে বললো - বাজারেই মুক্তি।

    বুর্জোয়া দুনিয়া যাই বলুক - সমাজতন্ত্র সংকটে তার জন্মলগ্ন থেকেই।

    এঙ্গেলস তাঁর "ওরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপারটি অ্যান্ড দ্য স্টেট'' - এ বলেছেন - "রাষ্ট্র কখনোই সমাজের বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো শক্তি নয়। হেগেলের মতে রাষ্ট্র ‘নৈতিক বোধের বাস্তব রূপ’ বা ‘যুক্তির প্রতিমূর্তি ও বাস্তব রূপ’। কিন্তু রাষ্ট্র এ সব কিছুই নয়। বরং সমাজবিকাশের এক বিশেষ স্তরে রাষ্ট্রের উদ্ভব। রাষ্ট্রের উদ্ভব মানেই, সমাধানের অতীত এক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে সমাজ। মীমাংসার সম্ভাবনাহীন এক দ্বন্দ্ব দীর্ণ সমাজ, যে দ্বন্দ্ব নিরাকরনে সে অক্ষম। পরষ্পর বিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিভূ বিভিন্ন শ্রেণী এই দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এই দ্বন্দ্বরত শ্রেণীসমূহ যাতে নিজেদের মধ্যে নিস্ফল সংগ্রামে নিজেদের এবং গোটা সমাজটাকেই ধ্বংস করে না ফেলে, তার জন্য এমন একটা শক্তির প্রয়োজন ঘটে যাকে আপাতভাবে সমাজের ঊর্দ্ধে মনে হয়। এই সব শ্রেণীদ্বন্দ্বকে প্রশমিত করে একটা ‘শৃঙ্খলা’র গন্ডীর মধ্যে আটকে রাখাই যার কাজ। এই শক্তি সমাজ থেকে উঠে এলেও নিজেকে তা সমাজের ঊর্দ্ধে স্থাপন করে এবং ক্রমশ: নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। এই শক্তিই রাষ্ট্র '' (নজরটান আমাদের)

    এঙ্গেলসের এই মত প্রসঙ্গে নানান ব্যাখ্যা রয়েছে। এঙ্গেলসের বক্তব্য অনুযায়ী অন্তত: দুই ধরনের শ্রেণীদ্বন্দ্ব আছে - "নিস্ফল'' এবং তাহলে অন্যটা নিশ্চই "ফলবতী''। মজাটা হলো, এই "নিস্ফল'' শ্রেণীদ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বে লিপ্ত শ্রেণীসমূহকে এমনকি গোটা সমাজকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। আর তাই হয়তো তাকে "প্রশমিত'' করে রাখাই রাষ্টের কাজ।

    লেনিন অবশ্য এই ধরনের ব্যাখ্যাকে পেতি বুর্জোয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর "রাষ্ট্র ও বিপ্লব''- এ লেনিন বলেছেন - "মার্কসের মতে রাষ্ট্র হলো শ্রেণীগত শাসনের যন্ত্র। এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণীকে পীড়ন করার যন্ত্র। যে "শৃঙ্খলা" শ্রেণী সংগ্রামকে প্রশমিত করে এই পীড়নকে বিধিবদ্ধ করে, সেই কায়েমী "শৃঙ্খলা" প্রবর্তন করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।'' (নজরটান আমাদের)

    লেনিন তাঁর ব্যাখ্যায় একটা নতুন উপাদান যোগ করেছেন - পীড়ন। কিন্তু উভয় ব্যাখ্যাতেই কিছু সত্যতা আছে। শ্রেণীদ্বন্দ্ব প্রশমিত করাই যদি রাষ্ট্রের কাজ হয়, তবে সেটা আপোষ-মীমাংসা বা পীড়ন যে কোনো উপায়েই হতে পারে। তবে সে বিতর্কে না গিয়ে ধরে নিচ্ছি লেনিনের ব্যাখ্যাই বেশী গ্রহনযোগ্য। কারন শ্রেণীদ্বন্দ্ব প্রশমিত করার কাজে রাষ্ট্রের পক্ষে পীড়নের পথ গ্রহন করার সম্ভাবনাই বেশী।

    লেনিন তাঁর "রাষ্ট্র ও বিপ্লব''- এ অন্য এক জায়গায় খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন - " রাষ্ট্র হলো বিশেষ দমনকারী শক্তি। শ্রমিক শ্রেণীকে দাবিয়ে রাখার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশেষ দমন যন্ত্র। সেই দমন যন্ত্রকে উৎপাটিত করে তার জায়গায় বুর্জোয়া শ্রেণীকে দমন করার জন্য শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব বিশেষ দমন যন্ত্র (শ্রমিক শ্রেণীর একাধিপত্য) প্রতিষ্ঠা করতে হবে।'' (নজরটান আমাদের)

    অর্থাৎ একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার, বুর্জোয়া বা সমাজতান্ত্রিক, যে ধরনের রাষ্ট্রই হোক না কেনো, তার কাজ একই থাকে - যে শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই, তাকে দমন করা।

    "কমিউনিষ্ট ম্যানিফেষ্টো''- তে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন - "শ্রমিক শ্রেণী তার রাজনৈতিক আধিপত্য প্রয়োগ করে, বুর্জোয়া শ্রেণীর কবল থেকে যাবতীয় পুঁজি ক্রমে ক্রমে ছিনিয়ে নেবে। রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণী রূপে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভুত করবে, এবং যথাসম্ভব দ্রুত উৎপাদিকা শক্তির পরিমান বাড়িয়ে তুলবে।'' (নজরটান আমাদের)

    অর্থাৎ আরও একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার, পুঁজির মালিকানা বদল হলেও তার চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। সে আগের মতো শাসকশ্রেণীর মালিকানাধীনই থাকবে - শুধু শাসকশ্রেণী পাল্টে যাবে। তফাৎ ঘটছে অন্যত্র - ব্যক্তি মালিকানার জায়গা নিচ্ছে শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার বিমূর্ত রূপ – রাষ্ট্র।

    প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়াদের থেকে পুঁজি ছিনিয়ে নেবার পর সেটা আর পুঁজি থাকে না। বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

    পুঁজি যখন বুর্জোয়াদের হাতে থাকে তখন তার কাজ কি? শ্রমের সাহায্যে পণ্য উৎপাদন। সেই পণ্য বাজারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন। সেই মুনাফার একটি অংশ দিয়ে পুঁজির বৃদ্ধি। সেই বর্ধিত পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে উৎপাদন, উৎপাদিকা শক্তি এবং পুঁজির ক্রমাগত বৃদ্ধি। এই প্রক্রিয়ায় যেমন শ্রমিকশ্রেণী সংখ্যায় বাড়তে থাকে, তাদের দুর্দশাও বাড়তে থাকে সমান ভাবে। তবু পুঁজির দ্রুত বৃদ্ধিই শ্রমিকশ্রেণীর দিক থেকে সবচেয়ে বেশী কাম্য (১)। ফলে যখন মার্কস বলেন যে বুর্জোয়াদের হাত থেকে পুঁজি ছিনিয়ে নেবার পর সমস্ত উৎপাদনের উপকরণকে রাষ্টের হাতে কেন্দ্রীভুত করে, যথাসম্ভব দ্রুত উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে (২), তখন প্রশ্ন ওঠে পুঁজি যখন বুর্জোয়াদের হাতে থাকে তখনও তো সে এই একই কাজ করে। সেই কাজের (উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ) একটাই পদ্ধতি, পুঁজি-শ্রম-পণ্য-মুনাফা - বর্ধিত পুঁজি-বর্ধিত শ্রম-বর্ধিত পণ্য-বর্ধিত মুনাফা। পুঁজির বিকাশ ছাড়া উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটবে কি ভাবে?

    মার্কস “পুঁজি” শব্দটি খুব ভেবেচিন্তে ব্যবহার করেছেন। বলেছেন যে পুঁজি হলো সঞ্চিত শ্রম - জীবন্ত শ্রম যার সেবা করে। উল্টোটা হলে সেই সম্পদ আর যাই হোক, পুঁজি নয় (৩)। ফলে কোথাও যদি মার্কস পুঁজি শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তা নেহাৎ অন্যমনস্ক শব্দ ব্যবহার নয়। তাই মার্কস যখন সমাজতন্ত্রে অবশ্য করণীয় দশটি কার্যক্রমের মধ্যে বলেন যে, সমস্ত ব্যাঙ্কের সম্পদ (ক্রেডিট) একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কে একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় পুঁজি হিসাবে কেন্দ্রীভূত করতে হবে (৪), তখন কোনো সন্দেহই থাকে না যে সমাজতন্ত্রেও পুঁজি “পুঁজি” হিসাবেই থাকে - ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় হয় মাত্র। (নজরটান আমাদের)

    সেই রাষ্ট্রীয় পুঁজি মুনাফাও অর্জন করে। অর্থাৎ সে সমাজতন্ত্রেও উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করে। ‘কম মজুরীর গোপন চুরি’ সমাজতন্ত্রেও থেকেই যায়। তার থেকেই আসে পরমানু বোমা, মহাকাশ অভিযানের খরচ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য তাই দিয়ে শ্রমিক আবাসনও তৈরী হয় (৫)। বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে মুনাফা ১৯২৪-২৫ এ ৫২১,০০০,০০০ রুবল থেকে বেড়ে ১৯২৬-২৭ এ দাঁড়ায় ৬৮০,০০০,০০০ রুবলে (৬)। সমাজতন্ত্রেও সঞ্চিত শ্রম, জীবন্ত শ্রমের সেবা করে না। বরং জীবন্ত শ্রম সঞ্চিত শ্রমের সেবা করেই যেতে থাকে।

    মার্কস “গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা”-য় শ্রমের ফসল বন্টনের সমস্যা নিয়ে লিখেছেন :
    প্রথম : উৎপাদনের উপকরণের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ
    দ্বিতীয় : উৎপাদন বাড়ানো
    তৃতীয় : দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকে প্রথম ও দ্বিতীয়-কে রক্ষা করা

    এসবের পরেও যা থাকলো তার থেকেও প্রথম : অনুৎপাদক কাজে ব্যয়িত প্রশাসনিক খরচ আলাদা করে রেখে তারপর যা থাকলো, তা সামাজিক পরিকাঠামো, কর্মক্ষম নন এমন মানুষের জন্য ব্যয়িত হবে। (৭)

    এই যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিষয়ের জন্য যে পরিমাণ শ্রমের ফসল সরিয়ে রাখতে হবে তা আসবে কোথা থেকে?

    শ্রমের যে অংশটি সাধারণ তহবিলের জন্য শ্রমিক দিয়েছে - তার থেকে। সাধারণ তহবিলের অর্থ (গুরুত্বের ক্রমবিন্যাস অনুযায়ী) :
    ১) উৎপাদনের উপকরণের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের খরচ
    ২) উৎপাদন বাড়ানোর খরচ
    ৩) দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকে উৎপাদনের উপকরণের কে রক্ষা করার খরচ
    ৪) অনুৎপাদক কাজে ব্যয়িত প্রশাসনিক খরচ
    ৫) সামাজিক পরিকাঠামো ও সুরক্ষার খরচ

    শ্রমিক কি পাচ্ছেন? একটা শংসাপত্র। যাতে লেখা আছে, অমুকে এতো মূল্যের শ্রম (সাধারণ তহবিলের জন্য দেয় শ্রমের মূল্য বাদ দেবার পর) সমাজকে দান করেছেন। ততো মূল্যের ভোগ্যপণ্য তিনি সমাজ থেকে পাবেন। মার্ক্সের মতে, এতে করে তিনি যে শ্রম সমাজকে দিয়েছেন তার পুরোটাই ফিরে পাবেন। (৮)

    মার্ক্স ধরে নিয়েছেন, ব্যক্তি শ্রমিকও সেই সমাজে পুঁজির মালিক। অথচ বলছেন, সমস্ত ব্যাঙ্কের সম্পদ(ক্রেডিট) একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় পুঁজি হিসাবে কেন্দ্রীভুত করতে হবে। ফলে পুঁজি ব্যক্তি শ্রমিকের হাতে নয় বরং সমাজবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্র পার্টি নেতৃত্ব ও সরকারী আমলাদের হাতে। সাধারণ তহবিলের জন্য দেয় শ্রমের মূল্য যাতে ব্যয় হবে তার উপর শ্রমিকের অধিকার আছে কি? উৎপাদনের উপকরণের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের খরচ, উৎপাদন বাড়ানোর খরচ (বর্ধিত পুঁজি?), দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকে উৎপাদনের উপকরণের কে রক্ষা করার খরচ, অনুৎপাদক কাজে ব্যয়িত প্রশাসনিক খরচ – এগুলির একটিও শ্রমিকেরা নির্ণয় করে না, করে সরকারী আমলারা, যারা রাষ্ট্রের অংশ ও সমাজবিচ্ছিন্ন। তাদের হাতেই এই অর্থ খরচ হবে। অর্থাৎ এই মূল্য সমাজে ফেরৎ আসবে না। (নজরটান আমাদের)

    পুঁজি তা সে রাষ্ট্রীয়ই হোক না কেন, তার বিনিয়গের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রন করতে কেন্দ্রীভুত প্রতিষ্ঠান লাগে। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহনে সাধারণ শ্রমিকের কোন ভূমিকা নেই, থাকতে পারে না।
    অর্থাৎ শ্রমিক তার শ্রমের পূর্ণ মূল্য পেলো না।

    কেম্পানি’স অ্যাক্টের ১৯ নং এপেনডিক্স ১৯৭৫ (৯)। এটিতে পরিস্কার বলা হচ্ছে - মুনাফা ঘরে তোলার আগে একটি পুঁজিবাদী কোম্পানিকেও মুনাফার একটা অংশ সাধারণ তহবিলে সরিয়ে রাখতে হয়। যাকে একাউন্টিং পরিভাষায় “জেনারেল রির্জাভ” বলে। এছাড়াও বাধ্যতামূলকভাবে "উৎপাদনের যে উপকরণগুলি ব্যয়িত হয়েছে, তা পূরণের খরচ" যাকে একাউন্টিং পরিভাষায় “ডেপ্রিশিয়েশন” বলে তাও মুনাফা থেকে সরিয়ে রাখতে হয়। (নজরটান আমাদের)

    হ্যাঁ, এরা সামাজিক পরিকাঠামো বা কর্মক্ষম নন এমন মানুষের জন্য কিছু করে না, কারণ সে সব করার জন্য তাদের সেবক - সরকার রয়েছে। সরকারী কোম্পানিগুলির মুনাফার একটা অংশ ওতে ব্যয়িত হয়।

    অর্থাৎ, মার্কস “গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা”-য় যা বলেছেন তাতে একথা প্রমাণ হয় না যে সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুঁজি থাকবে না। সমাজতান্ত্রিক সমাজে যে উৎপাদন ব্যবস্থার কথা বলা হলো বা যে উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক সমাজে চালু হলো, তা আদতে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থারই অন্য এক রূপ।

    তাহলে সমাজতন্ত্রেও রাষ্ট্র থেকে গেলো পীড়নের যন্ত্র হিসাবে। উপরি পাওনা হিসাবে সে এখন পুঁজির মালিকও বটে। কিন্তু রাষ্ট্র আসলে একটা বিমূর্ত চিন্তা - যার মূর্ত রূপ হলো তার পরিচালন সংগঠন - সরকার। সরকার চালায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে কমিউনিষ্ট পার্টি - আর কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে মন্ত্রীমন্ডলী এবং ছোটো বড়ো অজস্র আমলা, পুলিশ, বিচারক, নিয়মিত সৈন্যবাহিনী আর আইনসভার নির্বাচিত সদস্যসমূহের এক বিশাল প্রতিষ্ঠান।

    যেহেতু রাষ্ট্র তার ধর্ম অনুযায়ী নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, ফলে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও তার সমস্ত প্রতিষ্ঠান সমেত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে আরও একটা অদ্ভুত অবস্থা তৈরী হয় – পুঁজিও তার মালিকের সাথে সাথে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সম্পদের সামাজিকরণ জন্ম দিয়েছিলো ধনতন্ত্রের, “সমাজতন্ত্র” তাকে সমাজবিচ্ছিন্ন করে দেয়। (নজরটান আমাদের)

    সামন্ততান্ত্রিক সমাজে অলস সম্পদ সামাজিক উৎপাদনের কাজে লাগিয়ে বুর্জোয়ারা পুঁজির জন্ম দেয়। সেই কারনেই, পুঁজি শুধুই সম্পদের সমাহার নয়, তা একটা সামাজিক শক্তিও বটে, এ কথা মার্কস বার বার বলেছেন (১০)

    পুঁজির এই অস্বাভাবিক অবস্থান (সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া), তার সাথে রাষ্ট্রের একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। পুঁজির স্বাভাবিক ঝোঁক তাকে সামাজিক অবস্থানে নিয়ে যেতে চায়, তার মালিক রাষ্ট্রের পক্ষে তা হতে দেওয়া সম্ভব নয়। পুঁজি তার পথ কেটে নিতে থাকে দুর্নীতি আর ভ্রষ্টাচারের হাত ধরে ব্যক্তি আমলা, ব্যক্তি মন্ত্রী, ব্যক্তি নেতার তোষখানায়। এই অলস পুঁজি ও তার অবৈধ মালিকেরা রাষ্ট্রের ভিতরেই রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে ওঠে এবং আঘাত হানার সুযোগ খোঁজে নিরবিচ্ছিন্নভাবে।

    অন্যদিকে দমনের যন্ত্র হিসাবেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র অদ্ভুত এক অবস্থার মধ্যে পড়ে। এটা পরিষ্কার যে, ক্ষমতায় না থাকা শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহকে দমন করে রাষ্ট্র - এটা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সত্য হলেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা অর্ধ সত্য হয়ে দাঁড়ায়। মুস্কিলটা হয় নানান দিক থেকে। সমাজতন্ত্রে মতপ্রকাশর স্বাধীনতা না থাকায়, বিরোধী কন্ঠস্বর প্রকাশ্যে থাকে না। ফলে শত্রু চিহ্নিতকরণ বেশ কঠিন। তার ওপর শ্রেণী হিসাবে বুর্জোয়ারা যেমন তার স্বাভাবিক শত্রু, তেমনই, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের বিলোপ হওয়ার ফলে, সেও তার শত্রুই বটে।

    যখন রাষ্ট্র বিলোপের প্রশ্ন আসে অর্থাৎ সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যসমাজের উত্তরণের প্রশ্ন আসে তখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিলুপ্তির প্রশ্নই আসে। শ্রমিকশ্রেণীর এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি তার জন্মলগ্ন থেকেই থাকে। শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণীচরিত্রই হলো শোষণ বিরোধী, আর রাষ্ট্র মানেই শোষণের যন্ত্র। ফলে রাষ্ট্রের উচ্ছেদই শ্রমিকশ্রেণীর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। তাই সে যে কোন রাষ্ট্রেরই বিরোধী। রাষ্ট্র পীড়নের যন্ত্র। তার অস্তিত্বের যারা বিরোধী তাদের ওপরে সে দমন নমিয়ে আনবে সেটাই স্বাভাবিক। ফলে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, শ্রমিকশ্রেণী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী নয়।

    এটা শুধু একদলীয় সমাজতন্ত্রের সমস্যা নয়। শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণীচরিত্রই তাকে রাষ্ট্রের বা পুঁজির মালিক হতে বাধা দেয়। শ্রমিকশ্রেণীর কেউ বা কারা যদি সেই অবস্থানে চলে যায়, তবে নিশ্চিত ভাবেই সে বা তারা শ্রমিকশ্রেণী থেকে চ্যুত হয়। আমলাতান্ত্রিকতা, শ্রেণীর নামে দলের একনায়কতন্ত্র, দল ও সরকারের একাকার হয়ে যাওয়া, দুর্নীতির হাত ধরে দল ও সরকারী পদাধিকারীদের প্রচুর সম্পদের মালিক হয়ে ওঠা - এ সবই ঘটে চলে শ্রমিকশ্রেণীর নামেই।

    দুই শ্রেণীর উদ্দেশ্য আলাদা হওয়া সত্ত্বেও, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে দুই শ্রেণীই সমান বিপদের। ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দমন যন্ত্রের লক্ষ্য উভয় শ্রেণীই। এটা একেবারেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিশেষ সমস্যা। বুর্জোয়া রাষ্ট্র, সামন্ত রাষ্ট্রে বা দাস রাষ্ট্রকে কখনোই তার শাসকশ্রেণীকে দমন করতে হয় নি। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই প্রথম রাষ্ট্র যে তার শাসক শ্রেণী বলে চিহ্নিত শ্রেণীর ওপরেও পীড়ন নামিয়ে আনে। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে - রাষ্ট্রের ভিতরে থেকে যারা অবৈধভাবে পুঁজি সঞ্চয় করে চলে, যেহেতু তারাই দমন যন্ত্রের পরিচালক, ফলে তারা রাষ্ট্র বিরোধী হয়েও পীড়নের শিকার হয় না।

    যদিও একটা মত আছে যে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আসলে ঠিক রাষ্ট্র নয়। লেনিন তাঁর “রাষ্ট্র ও বিপ্লব”- এ বলেছেন – “ধনতন্ত্র থেকে কমিউনিষ্ট সমাজে উত্তরণের পর্বেও দমনের প্রয়োজন। কিন্তু এই দমন হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত দ্বারা সংখ্যালঘিষ্ঠ শোষকের দমন। দমনের বিশেষ যন্ত্র রাষ্ট্রের তখনো প্রয়োজন। কিন্তু এই রাষ্ট্র হলো এক পরিবর্তনশীল সময়ের রাষ্ট্র। প্রচলিত অর্থে একে রাষ্ট্র বলা চলে না।” (নজরটান আমাদের)

    এখানে তিনটে ব্যাপার একদম পরিষ্কার নয় -

    প্রথমত: - সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কিভাবে শ্রমিকশ্রেণীকে “সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত” আর বুর্জোয়াদের “সংখ্যালঘিষ্ঠ শোষক” বলা হচ্ছে ! তবে কি লেনিন বলতে চাইছেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বুর্জোয়ারা শোষক হিসাবেই থাকে !! কিন্তু তাহলে “শোষিত”রা কিভাবে “শোষক”দের ওপর দমন নামিয়ে আনে সেটা পরিষ্কার নয়। আর “শোষিত”রা যদি “শোষক”দের ওপর দমন নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়, তবে দমনকারীরা আর “শোষিত” থাকে না শাসক হয়ে যায়। উল্টোদিকে দমিতরাও আর “শোষক” থাকে না - শাসিত হয়ে যায়।
    তবু ধরে নিচ্ছি, লেনিন “শোষক” ও “শোষিত” পুরোনো সমাজের প্রেক্ষিতেই ব্যবহার করেছেন।

    দ্বিতীয়ত: - শোষক-শোষিতের বিতর্কে না গিয়ে লেনিনের মতই যদি মেনে নেই, তাহলেও যে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুর ওপর পীড়ন চালায় তাকে কেনো প্রচলিত অর্থে রাষ্ট্র বলা যাবে না সেটা বোঝা গেলো না। শুধু অর্থনৈতিক সংখ্যালঘুই তো সংখ্যালঘুত্বের একমাত্র মাপকাঠি নয় - ধর্ম, জাতি, ভাষাগোষ্ঠী এসবেরও তো সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু হয় - সে বেলা !!!

    তৃতীয়ত: - এতসব বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় - রাষ্ট্রের প্রধান এবং একমাত্র কাজ যখন দমন করা, তখন সেই কাজ যে রাষ্ট্র করে চলে তাকে প্রচলিত অর্থে রাষ্ট্র না বলার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।

    আর তাছাড়া, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কমিউনিষ্ট সমাজ কায়েম করার জন্য আত্মহুতি দিতে ভয়ানক ব্যাগ্র এমন কথা কেউ কখনো বলে নি।

    দেখা যাক লেনিন কি ভাবে প্রচলিত রাষ্ট্র থেকে এর ফারাক করছেন।

    - “মজুরশ্রেণী রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থান কি দিয়ে পূরণ করবে, সে সম্পর্কে অতীব শিক্ষণীয় তথ্য প্যারী কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া গেছে।“ - রাষ্ট্র ও বিপ্লব, ৩য় অধ্যায়, ১৮৭১ এর প্যারী কমিউনের অভিজ্ঞতা, মার্কসের ব্যাখ্যা।

    সেই অভিজ্ঞতা মার্কসের ভাষায় – “স্থায়ী ফৌজ তুলে দিয়ে তার জায়গায় সশস্ত্র জনসাধারনকে নিয়োগ করা............” এটাই ছিলো কমিউনের প্রথম ফরমান।“ - ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ, মার্ক্স, মে ১৮৭১। (১১)

    আর রাশিয়ায় কি হলো?

    কাউন্সিল অফ পিপলস কমিসারস ১৫ জানুয়ারী, ১৯১৮য় এক ডিক্রি জারি করলেন।

    মজুর ও কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেণী সচেতন ও শ্রেষ্ঠ অংশকে নিয়ে তৈরী হবে লাল ফৌজ।

    আঠেরো বছর বয়সের উপরে যে কোন সোভিয়েৎ রাশিয়ার নাগরিক এতে যোগ দিতে পারে একটি সামরিক বা বেসামরিক কতৃপক্ষ, পার্টি বা ট্রেড ইউনিয়নের সুপারিশ সাপেক্ষে।

    লাল ফৌজের সদস্যদের পরিবারের সমস্ত ভার নেবে রাষ্ট্র। এছাড়াও তারা মাসে ৫০ রুবল করে ভাতা পাবে।

    লাল ফৌজের সদস্যদের পারিবাবের যে সব মানুষ কর্মক্ষম নন, আঞ্চলিক সোভিয়েৎএর সুপারিশে তাদের জীবনধারনের প্রয়োজনীয় সব কিছুর জোগান দেবে রাষ্ট্র।
    লাল ফৌজের সর্বময় কতৃত্ব ন্যস্ত থাকবে কাউন্সিল অফ পিপলস কমিসারসের উপর। (১২)

    প্যারী কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকে, যাতে প্রচলিত রাষ্ট্রের মতো এই রাষ্ট্রও “সমাজের প্রভু” না হয়ে বসে, মার্কস আরও বললেন
    “প্রথমত, প্রশাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ প্রভৃতি সমস্ত পদেই কমিউন সংশ্লিষ্ট সকলের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত লোক নিয়োগ করে ; সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের এই অধিকারও ছিলো যে, তারা যে কোনো সময়ে তাদের প্রতিনিধিদের ফিরিয়ে আনতে পারবে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য মজুরেরা যে পরিমান মজুরী পেত, ঊর্দ্ধতন নিম্নতম সমস্ত কর্মচারীকেই মাত্র সেই পরিমান মজুরী দেওয়া হত।“ - ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ, মার্ক্স ১৮৭১। (৭খ)

    আর রাশিয়ায় কি হলো?

    অন্য আর পাঁচটা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মতোই স্থায়ী ফৌজ গড়া হলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও।
    অন্য আর পাঁচটা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মতোই প্রশাসন, বিচার, শিক্ষা প্রভৃতি সমস্ত পদেই সরকারী আমলারা নিয়োজিত হলেন সরকারী আদেশ বলে - সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও। (১৩)
    অন্য আর পাঁচটা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মতোই না হলেও, মজুরীর ফারাক থেকেই গেলো - সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও।
    অতীব শিক্ষণীয় প্যারী কমিউনের “শিক্ষা” কাজে এলো না।

    অর্থাৎ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও প্রচলিত অর্থে রাষ্ট্রই, যার কিছু বিশেষ সমস্যা আছে।

    রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পুঁজির অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। পুঁজির সামাজিক ভূমিকা লুপ্ত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় যাবার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে কি?

    মোদ্দা কথা, সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা বলে কিছু তৈরী হয়েছিলো কি? যৌথ খামার বা শ্রমিক পরিচালিত শিল্পে পুঁজির ভূমিকা কি? সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ফলে রাষ্ট্রীয় পুঁজির প্রকৃত মালিক হয়ে দাঁড়ায় - বড় বড় পদস্থ আমলা, মন্ত্রী, সেনাপ্রধান, পুলিশকর্তা, বিচারপতি এবং অবশ্যই কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ। কারখানা ব্যবস্থা বজায় থাকে শিল্পে ও কৃষিতেও। পরিচালক হিসাবে শ্রমিকদের প্রতিনিধি হয়ে যারা থাকেন, তারা হয় পার্টির নেতা বা শাসনযন্ত্রের আমলা বা একসাথে দুইই।

    রাষ্ট্রীয় পুঁজিও উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করে। সেই উদ্বৃত্ত মূল্যেই রাষ্ট্রের অনুৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলির খরচ চলে - জেলখানা চালানো থেকে চাঁদে যাওয়া। রাষ্ট্রীয় মালিকানাও পুঁজির “চরিত্রহননে” সক্ষম হয় না। বরং পুঁজি তার স্বাভাবিক অবস্থানে, অর্থাৎ সামাজিক অবস্থানে ফিরে যাবার ঝোঁক বজায় রাখে এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরী করে দুর্নীতিগ্রস্ত নীতিনির্ধারক আর সিদ্ধান্তগ্রহনকারী ব্যক্তি, যাদের কোষাগারে জমা হতে থাকে অবৈধ পুঁজি। ফলে সমাজতন্ত্রের নামে যেটা চলে সেটা আদতে ধনতন্ত্রেরই অন্য এক রূপ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।

    ১৯২১-এ লেনিন বলছেন যে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদই রাশিয়াকে নিশ্চিতভাবে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে দেবে (১৪)। একই কথা লেনিন ১৯১৮-তে (১৫), ১৯১৭-তেও (১৬) বলছেন। লক্ষ্য করার বিষয়, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে দেবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কখনোই সমাজতন্ত্র নয়, সে বিষয়ে লেনিন খুব স্পষ্ট। কিন্ত তিনি এটাও খুব জোরের সঙ্গে বলছেন সমাজতন্ত্র আসবে রাষ্ট্রীয় পুঁজির হাত ধরে। কাজেই ১৯১৭-য় বা ১৯২১-এ যা হল, সেটা সমাজতন্ত্র নয়, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।

    সমাজতন্ত্র বলতে, মার্কস বা লেনিন যা বলেছেন, তা আদৌ সমাজতন্ত্র নয়। কারন সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা বলতে ওনারা যা বলেছেন, যা অনুশীলন করেছেন, তা পুঁজিবাদেরই রকমফের মাত্র। সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের পথে কোনো অস্থায়ী ব্যবস্থা নয়, এটা আজকের বাস্তব। মার্কস বা লেনিন তা মনে করতেন না। লেনিনের কাছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদই ছিলো সমাজতন্ত্রের “গ্যারান্টি”।

    ভাবতে হবে, এমনটা কেন হলো? শুধু তো রাশিয়ায় নয়, চীন-ভিয়েৎনাম-কম্বোডিয়া-লাওস-গোটা পূর্ব ইউরোপ কেন এইভাবে ভেঙে পড়লো? কেন “সমাজতন্ত্রিক” সমাজগুলো ধ্বংস হয়ে গেলো?

    এমন ভাবার কোন কারন নেই যে পুঁজি কখনো কোন সংকটে পড়ে নি। আর সেই সংকটকালে লেনিন বা স্তালিন যে জাতীয় ভুল করেছিলেন তেমন ভুল কি হিটলার/মুসোলিনী/তোজো বা আইসেনহাওয়ার/চার্চিল/দ্য গল বা আর কেউ করেন নি? কেন পুঁজি বার বার একটার পর একটা সংকট কাটিয়ে ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে? আর সমাজতন্ত্র সংকটে পড়লেই, হয় ট্রটস্কি নয় স্তালিন নয় মাও নয় টিটো কেউ না কেউ দায়ী হয়ে যান। আর সমাজতন্ত্রিক সমাজগুলো ফিরে যায় পুঁজিবাদের গাড্ডায়!!!!

    এর থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের চেয়ে ভালো। হ্যাঁ, অবশ্যই পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের চেয়ে সংকটের মোকাবিলায় অনেক বেশী দক্ষ। কিন্তু আজকের পুঁজিবাদ মানবতার শত্রু। সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশী কাম্য।

    সমাজতন্ত্রকে দাঁড়াতে হবে তার নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থার উপর, যে উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার চেয়ে ততটাই আলাদা, যতটা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা আলাদা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার চেয়ে। (নজরটান আমাদের)

    মার্কস তাঁর "ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল''- এ বলেছেন - "পুঁজি তার বিকাশের জন্য নির্ভর করে শ্রমশক্তির ওপর - জন্ম নেয় শ্রমিকশ্রেণী। আবার শ্রমিকশ্রেণীও তার বিকাশের জন্য নির্ভর করে পুঁজির ওপর। অর্থাৎ পুঁজির বিকাশ মানেই শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশ।'' (নজরটান আমাদের)

    এই সিদ্ধান্ত আজ আর প্রযোজ্য নয়। মার্কস যে ভবিষ্যত সমাজের কথা ভেবেছিলেন, যেখানে রাষ্ট্র অবলুপ্ত হয়ে যাবে, যেখানে শ্রমের জায়গা নেবে যন্ত্র। গ্রুন্ডাইজ নোটবুক-এ মার্ক্স নিজেই লিখছেন, মানুষের অবসর বেড়ে যাবে। মানুষ তখন তার সৃষ্টিশীল মননের চর্চায় আরও বেশী সময় ও শ্রম দেবে, যাতে সে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। (১৭) যন্ত্রায়নের ফলে কায়িক শ্রম আর কাজ থকবে না। শ্রমিক হয়ে উঠবে যন্ত্রের সচেতন অংশ মাত্র। তাদের কাজ আর কাজ থাকবে না তা পরিণত হবে “কাজের মতো কিছুতে”। (১৮) কিন্তু বুর্জোয়া সামাজেই যখন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ঐ ধরনের যন্ত্রায়ন ঘটে, তখন ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় ভয়াবহ। পুঁজির বিকাশ আর কোনোভাবেই শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশ ঘটায় না - বরং উল্টোটাই করে। এতে চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী হিসাবে মার্কস এতোটুকু খাটো হন না। মার্কস একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর সেই স্বপ্ন পূরণের একটা বাস্তবসম্মত তাত্ত্বিক ভিত্তিও দিয়ে গেছেন তাঁর সময় থেকে বেশ কিছু এগিয়েই। কিন্তু তিনি তো ভবিষ্যতবক্তা বা জ্যোতিষী নন। স্বপ্নভঙ্গের দায়িত্ব নি:সন্দেহে তাঁর নয় - আমাদের সকলের, আমরা যারা তাঁর স্বপ্নকে আজকের সময়ে রূপায়নের কথা ভাবি।

    উৎপাদন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত যন্ত্রায়নের ফলে শ্রমশক্তির ব্যবহার ক্রমশ: কমতে থাকে। শ্রমশক্তির এই সংকোচনের আওতায় শুধু কায়িক শ্রমই নয়, মানসিক শ্রমও পড়ে যায়। ফলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়তে তাকে ভীষণ ভাবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেটুকু শ্রমের দরকার পড়ে, পুঁজি তা অনায়সে জোগাড় করে নেয় এবং তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী মজুরী দিয়ে তাদের তাঁবেদারে পরিনত করে। পরিসেবা শিল্পে আজ কাজের সময় অলিখিত ভাবে প্রায় দশ থেকে বারো ঘন্টায় এসে দঁড়িয়েছে। বলা হচ্ছে ব্যাঙ্ক (ধীরে ধীরে সব শিল্পই) খোলা রাখতে হবে রাতদিন-সাতদিন। এই প্রেক্ষিতে, ব্যক্তিপিছু কাজের ঘন্টা কমানোর কথা এবং তার সাথে নতুন কর্মী নিয়োগের কথা কোনো শ্রমিক সংগঠনগুলির আশু কর্তব্য।

    একটু বিশদ হওয়া যাক। শিল্পে যন্ত্রায়নের ফলে যে কাজ করতে আগে আট ঘন্টা লাগতো তা আজ চার ঘন্টায় বা তারও কমে হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলি একসময় শিল্পে যন্ত্রায়নের প্রচন্ড বিরোধী ছিলো। পরে যখন তারা মেনে নিতে বাধ্য হলো, তখন এই ‘মেনে নেওয়ার’ দরকষাকশিতে কিছু মজুরী বাড়িয়ে নিলো। কোনো কোনো শ্রমিক সংগঠন (ছোট ছোট শ্রমিক সংগঠন যারা বড় দলগুলির বাইরে) তারাও একসময় হতোদ্যম হয়ে চুপ করে গেলো। অথচ কেউ একবারের জন্যও কাজের সময় কমানোর দাবী তুললো না। বললো না যে চার ঘন্টায় যখন আট ঘন্টার বা তার-ও বেশী কাজ পাওয়া যাচ্ছে, তখন মজুরী না বাড়িয়ে বরং কাজের সময় ব্যক্তি পিছু চার ঘন্টা হোক, আর চার ঘন্টার জন্য নতুন কর্মী নিয়োগ করা হোক।

    ভীষণ জরুরী পুঁজি ও শ্রমের আন্ত:সম্পর্কের নবমূল্যায়ন। পুঁজি যে বিপুল সংখ্যক মানুষকে কর্মচ্যুত করেছে এবং যে শ্রমশক্তিকে স্রেফ কর্মহীন করে রেখে ক্রমাগত তাদের প্রন্তিক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে, সেই কর্মচ্যুত/কর্মহীন শ্রম সম্ভাবনার সাথে পুঁজির সম্পর্ক নির্ধারণ আর একটি জরুরী কাজ। এই সব প্রান্তিক হয়ে যাওয়া মানুষের সাথে পুঁজির সম্পর্ক আর উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেই। বরং এদের সাথে পুঁজির সম্পর্ক সম্পূর্ণ অন্য এক ময়দানে - বাজারে।

    পুঁজির ইতিহাস বলছে, সে তার মুনাফা বাড়ানোর, ফলত: পুঁজি বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় বাজারকে সংকুচিত করছে। অতীতে পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে শ্রমিকশ্রেণীরও বিকাশ ঘটতো। যতো বেশী বেশী মানুষ মজুরী দাসে পরিনত হতো - তত বাজার বাড়তো। এই বাজার বাড়ানোর তাগিদেই পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা, যা আজ এক শীর্ষে এসে পৌঁছেছে বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে।
    সারা দুনিয়া জুড়ে অবাধ এবং এক নিয়মের বাজার চাইছে পুঁজি। অথচ উৎপাদন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত যন্ত্রায়ন ক্রমাগত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে - বাজার সংকুচিত হচ্ছে।

    এই সংকটের মোকাবিলায় পুঁজি নানান কায়দা গ্রহন করছে। ভোগ্য পণ্যের বাজার ছেয়ে যাচ্ছে ব্যবহার করো-ফেলে দাও জাতীয় পণ্যে। কৃত্রিম চাহিদা তৈরী হচ্ছে বিজ্ঞাপন আর ক্রেডিট কার্ডের দৌলতে।

    পুঁজি মুনাফা বাড়ানোর তাগিদে গোটা উৎপাদন প্রক্তিয়াকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো কারে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বময়। পোষাক ও গাড়ি শিল্প দিয়ে শুরু করে অন্যান্য প্রায় সব শিল্পই আজ খন্ডিত হায়ে সস্তা শ্রমবাজার ছেয়ে ফেলেছে। আগেকার বৃহৎ শিল্পে পুঁজির একটা আবর্তন (কাঁচামাল কেনা থেকে উৎপাদলের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধদিয়ে গিয়ে পণ্য তৈরী, এবং তা বিক্রি করে লাভ উঠে আসা) শেষে যে মুনাফা অর্জন করতো পুঁজি, আজ ঐ গোটা প্রক্রিয়াকে ভেঙ্গে অসংখ্য প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সেই একই পরিমান পুঁজি আনেক বেশী আবর্তনের মধ্যদিয়ে গিয়ে বেশী মুনাফা দিচ্ছে, কারন এই খন্ড প্রক্রিয়ায় সে বেছে নিতে পারছে সবচেয়ে সস্তা কাঁচামাল ও শ্রমের বাজার যা আগেকার বৃহৎ শিল্প প্রক্রিয়ায় সম্ভব ছিলো না।

    এই বিষয় একটা অন্য পূর্ণাং আলোচনা দাবী করে। আমরা তা করবও।

    এই লেখায় আমরা দেখানোর চেষ্টা করলাম, সমাজতন্ত্র বলে যে পথে বিপ্লবোত্তর সমাজগুলি এগিয়েছে তা আদৌ সমাজতন্ত্র ছিলো না, বরং তা ছিলো পুঁজিবাদেরই অন্য রূপ রাষ্ট্রীয় পুঁজি চালিত সমাজ।


    কোথায় পেলাম :

    (১) We thus see that if capital grows rapidly, competition among the workers grows with even greater rapidity i.e., the means of employment and subsistence for the working class decrease in proportion even more rapidly; but, this notwithstanding, the rapid growth of capital is the most favorable condition for wage-labor. - Wage Labour & Capital - Effect of Capitalist Competition on the Capitalist Class the Middle Class and the Working Class - Karl Marx
    কার্ল মার্কসের লেখা। ১৮৪৭, ব্রাসেলস, জার্মান শ্রমিক সংঘে বক্তৃতামালা হিসাবে পঠিত। প্রথম প্রকাশ জার্মান ভাষায় ১৮৪৯।

    (২) The proletariate with use its political supremacy to wrest, by degree, all capital from the bourgeoisie, to centralise all instruments of production in the hands of the State, i.e., of the proletariat organised as the ruling class; and to increase the total productive forces as rapidly as possible. Communist Manifesto, Proletarians & Communists - Karl Marx & Friedrich Engels

    কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের লেখা, ১৮৪৭। প্রথম প্রকাশ ১৮৪৮। কমিউনিস্ট লিগ নামে এক গোপন সংগঠন ১৮৪৭ নভেম্বরে তাদের লন্ডন বৈঠকে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসকে দলের তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং কর্মসূচী তৈরীর দায়িত্ব দেয়। তারই ফলশ্রুতি হিসাবে লেখা হয় আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’।

    (৩) Capital does not consist in the fact that accumulated labor serves living labor as a means for new production. It consists in the fact that living labor serves accumulated labor as the means of preserving and multiplying its exchange value. - Wage Labour & Capital - Nature & Growth Of Capital
    ১ নং টিকা দেখুন।

    (৪) Centralisation of credit in the banks of the state, by means of a national bank with State capital and an exclusive monopoly. 5th point of the 10 point agenda of Socialism (where the 1st point was the famous Abolitaion of Property) - Communist Manifesto - Proletarians & Communists

    ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’-এর মহান ঘোষনা, দশ দফা কর্মসূচী। যার প্রথম কর্মসূচীই হলো সম্পত্তির অবসান। উপরের উদ্ধৃতিটি সেই ঘোষনারই পঞ্চম দফা।

    (৫) On the business aspect of life in a Russian textile factory I will not linger, for industry is the subject of another volume in this series. Like all the larger concerns in Russia, this mill has been nationalized. On the productive side it is subject to a big organization known as the Textile Trust; on the commercial side a separately organized "syndicate" disposes of its manufactures. In spite of the use of such words as trust and syndicate, no private capital is involved, and the Russians intend only to convey that the idustries grouped as "trusts" enjoy autonomy in the conduct of their affairs, though their profits go to the State. They are under an obligation, however, to return at least ten percent of their annual surplus to the workers in the form of a welfare fund. Last year the Textile Trust did, in fact, assign as much as twenty-two percent of its profits for the benefit of its employees, and this considerable sum was spent mainly upon housing. - How The Soviet Work - Chapter 2: Democracy in the Factory - Vanguard Press, November 1927 by H N Brailsford

    এইচ এন ব্রেইলসফোর্ড বামপন্থী ইংরেজ সাংবাদিক। ১৯২০ থেকে ১৯৫২৭-এর মধ্যে বহুবার সোভিয়েৎ রাশিয়ায় গিয়েছেন। ১৯২৭-এর নভেম্বরে একটি কাপড় কল দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘হাও দ্য সোভিয়েৎ ওয়ার্কস'-এর দ্বিতীয় অধ্যায়।

    (৬) Finances of large State industries:
    1924-25 Rubles1925-26 Rubles1926-27 Rubles
    Profits521,000,000676,000,000680,000,000
    Losses63,000,00066,000,00080,000,000
    Net Profit458,000,000610,000,000600,000,000
    Depreciation Fund277,000,000360,000,000398,000,000
    Taxes paid to govt169,000,000259,000,000379,000,000
    Financing by govt125,000,000325,000,000536,000,000
    Net receipts from or payments to the govt- 44,000,000+ 66,000,000+ 157,000,000
    Credits564,000,000431,000,000454,000,000
    Total Net Income1,255,000,0001,467,000,0001,609,000,000
    Of this:
    Capital expenditures385,000,000810,000,0001,090,000,000
    Operating Funds870,000,000657,000,000519,000,000
    Total1,255,000,0001,467,000,0001,609,000,000

    The Soviet Union : Fatcs, Descriptions, Statistics 1917 to 1928–Industry Published in 1929 by Soviet Union Information Bureau - 4 Table.
    ১৯২৯-এ সোভিয়েৎ ইউনিয়ান ইনফর্মেশন ব্যুরো প্রকাশিত, সোভিয়েৎ ইউনিয়ান সর্ম্পকিত তথ্যাবলীর শিল্প অধ্যায়ের চতুর্থ সারণী।

    (৭) From this must now be deducted: First, cover for replacement of the means of production used up. Second, additional portion for expansion of production. Third, reserve or insurance funds to provide against accidents, dislocations caused by natural calamities, etc.
    These deductions from the "undiminished" proceeds of labor are an economic necessity, and their magnitude is to be determined according to available means and forces, and partly by computation of probabilities, but they are in no way calculable by equity.
    There remains the other part of the total product, intended to serve as means of consumption.
    Before this is divided among the individuals, there has to be deducted again, from it: First, the general costs of administration not belonging to production. This part will, from the outset, be very considerably restricted in comparison with present-day society, and it diminishes in proportion as the new society develops. Second, that which is intended for the common satisfaction of needs, such as schools, health services, etc. From the outset, this part grows considerably in comparison with present-day society, and it grows in proportion as the new society develops. Third, funds for those unable to work, etc., in short, for what is included under so-called official poor relief today. - Karl Marx, Critique of the Gotha Programme 1875

    (৮) Accordingly, the individual producer receives back from society -- after the deductions have been made -- exactly what he gives to it. What he has given to it is his individual quantum of labor. For example, the social working day consists of the sum of the individual hours of work; the individual labor time of the individual producer is the part of the social working day contributed by him, his share in it. He receives a certificate from society that he has furnished such-and-such an amount of labor (after deducting his labor for the common funds); and with this certificate, he draws from the social stock of means of consumption as much as the same amount of labor cost. The same amount of labor which he has given to society in one form, he receives back in another. Karl Marx, Critique of the Gotha Programme 1875 (নজরটান আমাদের)

    (৯) Companies (Transfer of Profits to Reserves) Rules, 1975https://www.mca.gov.in/Ministry/actsbills/rules/CToPtRR1975.pdf

    (১০) (৭) Thereby, that as an independent social power, i.e. as the power of a part of society - it preserves itself and multiplies by exchange with direct, living labour power. - Wage Labour & Capital - Nature & Growth Of Capital - Karl Marx
    ১ নং টিকা দেখুন।

    (১১) The first decree of the Commune, therefore, was the suppression of the standing army, and the substitution for it of the armed people. - The Third Address, The Paris Commune, The Civil War In France, Karl Marx 1871.
    Also see – What is to Replace the Smashed State Machine, Experience of the Paris Commune of 1871. Marx’s Analysis, State And Revolution, V.I.Lenin, September 1971.

    (১২) Decree issued by the Council of People’s Commissars on January 15, 1918 https://www.marxists.org/history/ussr/government/red-army/1937/wollenberg-red-army/append01.htm

    (১৩) Article Three ORGANIZATION OF THE SOVIET POWERA. ORGAZIZATION OF CENTRAL POWER– CHAPTER EIGHT – THE COUNCILl OF PEOPLE’S COMMISSARS
    Point 44. Every commissar has a collegium (committee) of which he is the president, and the members of which are appointed by the Council of People's Commissars. (নজরটান আমাদের)
    Chapter Nine - AFFAIRS IN THE JURISDICTION OF THE ALL-RUSSIAN CONGRESS AND THE ALL-RUSSIAN CENTRAL EXECUTIVE COMMITTEE – Point 49 Sub section - (o) Appointment and dismissal of the individual People's Commissars or the entire council, also approval of the president of the Council of People's Commissars (নজরটান আমাদের)
    https://www.marxists.org/history/ussr/government/constitution/1918/article3.htm
    মজুরীর প্রশ্নে :
    Re Comrade Shlyapnikov’s inquiry concerning rates of pay for high ranking officials, the C.P.C.
    1) confirms that the decree establishing 500-ruble monthly salaries for members of the Council of People’s Commissars is to be interpreted as an approximate norm for top salaries and contains no prohibition to pay specialists more.
    This motion of Lenin’s was adopted at a meeting of the C.P.C. on January 2 (15), 1918, during the discussion of an inquiry by A. G. Shlyapnikov, People’s Commissar for Labour, concerning the rates of pay for high officials of the factory managements.
    Rates of Pay for High-Ranking Officials, January 2 1918, Lenin Collect Works, Vol 42
    https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1918/jan/02.htm

    (১৪) Tax In Kind - 1921 Vol 32 Lenin Collected Works - "ট্যাক্স ইন কাইন্ড' এই পুস্তিকাটি লেখা হয় ১৯২১-এ দশম পার্টি কংগ্রেসের ঠিক পরেই। এই লেখায় ‘নতুন অর্থনৈতিক নীতি’র প্রয়োজনীয়তা ব্যখ্যা করেন লেনিন। এই লেখায় বহু জায়গায় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ নিয়ে লেনিন তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন।

    (১৫) State capitalism would be a step forward as compared with the present state of affairs in our Soviet Republic. If in approximately six months time state capitalism became established in our Republic, this would be a great success and a sure guarantee that within a year socialism will have gained a permanently firm hold and will have become invincible in this country. - The Present-Day Economy Of Russia- Referred in another writing - Tax In Kind - 1921 Vol 32
    "ট্যাক্স ইন কাইন্ড' এই পুস্তিকাটিতেই এই লেখাটির উল্লখ আছে। ১৯১৮ সালে "দ্য প্রেজেন্ট ডে ইকনমি অফ রাশিয়া' লেনিন-এর এই লেখাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়।

    (১৬) Try to substitute for the Junker-capitalist state, for the landowner-capitalist state, a revolutionary-democratic state, i.e., a state which in a revolutionary way abolishes all privileges and does not fear to introduce the fullest democracy in a revolutionary way. You will find that, given a really revolutionary-democratic state, state-monopoly capitalism inevitably and unavoidably implies a step . . . towards socialism. . . .
    For socialism is merely the next step forward from state-capitalist monopoly. . . .
    State-monopoly capitalism is a complete material preparation for socialism, the threshold of socialism, a rung on the ladder of history between which and the rung called socialism there are no intermediate rungs (pp. 27 and 28). - The Impending Catastrophe and How To Combat It, written in September 1917. Lelin Collected Works Vol 22
    এই লেখাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে অক্টোবরের শেষদিকে। আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় সরকার, দল এবং মানুষ কি করতে পারে সেই প্রসঙ্গে লেনিন-এর এই লেখা।

    (১৭) Grundrisse: Notebook VII – The Chapter on Capital - Real saving – economy – = saving of labour time = development of productive force. Suspension of the contradiction between free time and labour time. – True conception of the process of social production
    The saving of labour time [is] equal to an increase of free time, i.e. time for the full development of the individual, which in turn reacts back upon the productive power of labour as itself the greatest productive power.

    (১৮) Grundrisse: Notebook VI / VII – The Chapter on Capital - Surplus value. Production time. Circulation time. Turnover time. Part of capital in production time, part in circulation time. – Circulation time. – Surplus value and production phase. Number of reproductions of capital = number of turnovers. – Total surplus value etc.
    But, once adopted into the production process of capital, the means of labour passes through different metamorphoses, whose culmination is the machine, or rather, an automatic system of machinery (system of machinery: the automatic one is merely its most complete, most adequate form, and alone transforms machinery into a system), set in motion by an automaton, a moving power that moves itself; this automaton consisting of numerous mechanical and intellectual organs, so that the workers themselves are cast merely as its conscious linkages. In the machine, and even more in machinery as an automatic system, the use value, i.e. the material quality of the means of labour, is transformed into an existence adequate to fixed capital and to capital as such; and the form in which it was adopted into the production process of capital, the direct means of labour, is superseded by a form posited by capital itself and corresponding to it. In no way does the machine appear as the individual worker’s means of labour. Its distinguishing characteristic is not in the least, as with the means of labour, to transmit the worker’s activity to the object; this activity, rather, is posited in such a way that it merely transmits the machine’s work, the machine’s action, on to the raw material – supervises it and guards against interruptions. Not as with the instrument, which the worker animates and makes into his organ with his skill and strength, and whose handling therefore depends on his virtuosity. Rather, it is the machine which possesses skill and strength in place of the worker, is itself the virtuoso, with a soul of its own in the mechanical laws acting through it; and it consumes coal, oil etc. (matières instrumentales), just as the worker consumes food, to keep up its perpetual motion. The worker’s activity, reduced to a mere abstraction of activity, is determined and regulated on all sides by the movement of the machinery, and not the opposite.

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৪ জুন ২০২৩ | ১২৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন