বরানগর নিবাসী, কলিকাতাস্থ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর ভাষাতত্ত্ব বিভাগের জনৈক বিশিষ্ট ভূতপূর্ব অধ্যাপক তাঁহার পিতা মাতার মৃত্যুর পর যথাবিহিত শ্রাদ্ধশান্তি করান নাই। নিজ পল্লীতে তিনি ও তাঁহার পরিবার “নাস্তিক” বলিয়া পরিচিত। ইহাতে উক্ত ভদ্রলোকের ঊর্ধ্ব পিতৃপুরুষের (জেনানাকুলও তাহার অন্তর্ভুক্ত বলিয়া গণ্য করিতে হইবে) দেহত্যাগী আত্মাসমূহের পিণ্ডলাভ ঘটে নাই, তাহারা জল পায় নাই। সুতরাং ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হইয়া তাহারা পুরাতন লোকালয়ে আসিয়া যে কথঞ্চিত দৌরাত্ম্য করিবে, ইহাতে বিস্ময়ের কিছু মাত্র নাই। তথাপি, যাঁহারা ইহাতে সত্যই বিস্মিত হইতেছেন, তাঁহাদিগকে আমি পুরাতন শাস্ত্রসমূচয় পুনর্বার পাঠের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতেছি।
সমস্যা আরও জটিলতর হইয়া উঠিয়াছে, শোনা যাইতেছে, সেই পূর্বাত্মাগণ সংশ্লিষ্ট লোকালয়ে আগমন করিয়া তাহাদিগের নিজস্ব আপন আপন পুরাতন আস্তানা খুঁজিয়া পাইতেছে না। ফলত, তাহারা ক্ষুন্নিবৃত্তির তাড়ণায় এবং তৃষ্ণা নিবারণার্থ যত্র তত্র প্রবেশ করিতেছে, অপরাপর অনাত্মীয়গণকেও নাকি যারপরনাই বিরক্ত করিতেছে। স্বাভাবিক। রাত্রির অন্ধকারে, বিশেষত যে সকল ব্রাহ্ম মুহূর্তে বিজলিও গৃহস্থকে একাকী ফেলিয়া আপন গৃহবন্দিদশায় নিমগ্ন হইয়া থাকে, সেই সকল অন্যলোক গত আত্মা আসিয়া ভূতের আকারে দর্শন দিলে জীবিত দর্শন প্রাপকের মনে যে কত খানি ভয়ভীতি ত্রাসের সঞ্চার হয় তাহা ভুক্তভোগী না হইলে বুঝাইয়া বলিবার মতো নহে।
এই সব বিবিধ প্রকার সংবাদ পাঠপূর্বক ভূতপ্রেত সম্পর্কে নবতর আঙ্গিকে এক দুর্নিবার আগ্রহ জাগিয়া উঠিল আমার মানসলোকে। বিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই অবগত আছেন, আগ্রহের প্রথম প্রকাশ ঘটিয়া থাকে কৌতুহল কিংবা প্রশ্নের আকারে। মদীয় অন্তরেও তাহাই হইল। কতিপয় প্রশ্ন আপনাকে পীড়িত করিতে লাগিল। পাঠকদিগের কৌতুহল নিবারণার্থে নিম্নে তাহা ক্রমান্বয়ে লিপিবদ্ধ করিতেছি:
১। মনুষ্য জাতির প্রাণী সকল মরিয়া গেলে ভূতত্ব প্রাপ্তি হয় কী রূপে? উহার কার্যকারণ কিছু জানা গিয়াছে কিনা।
২। হিন্দু পরিবারস্থ মার্জার সারমেয় অজ গোতম আদি গৃহপালিত প্রাণী সকলের মৃত্যুর পর উহারাও কি ভূত হইতে পারে? হয় কি?? হইলে কী রূপে সম্ভবে? অন্যথায় না হইবার কারণ কী? উহাদের মৃত্যুতে তো শ্রাদ্ধশান্তি আদি করা হয় না!
৩। ইসাই, মহমেডান প্রভৃতি ধর্মে বিশ্বাসী লোকদিগের মধ্যেও ভূত প্রেতাদিতে (জ্বিন) অটল বিশ্বাস রহিয়াছে বলিয়া শোনা যায়। উহারা পিতামাতার মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়াসমূহ যে সকল পদ্ধতিতে করিয়া থাকে, তাহার সহিত বরানগরের পাষণ্ড নাগরিক মহোদয়ের অবলম্বিত পদ্ধতির অন্তর ইতর বিশেষ অপেক্ষা অধিক নহে। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, পিণ্ড দান, জল দান ইত্যাদি উহারাও করে না। তাহা হইলে উহাদের পিতৃপুরুষগণ (নারী সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত) পরলোকে খাদ্য পানি প্রাপ্ত হয় কী প্রকারে? না পাইলে ভূত হইয়া আসিয়া আত্মীয়স্বজনকে অথবা প্রতিবেশীগণকে উত্যক্ত করে কি?
৪। জল বা পিণ্ড দান করা হইল কিনা ভূত প্রেতগণ সন্ধান পায় কী করিয়া? বাক্যান্তরে, ইহলোকে বিশেষ স্থানে মন্ত্রপাঠ সহ প্রদত্ত পিণ্ড ও জল পরলোকে স্ব স্ব আত্মীয় ভূতের কাছে গমন করে কীভাবে? সুইগি যোম্যাটো প্রভৃতির মতন হেভিপোর্ট (heavenly transport) ডেলিভারি ব্যবস্থা কিছু রহিয়াছে কি? অথবা কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট-এর মতো কোনো সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কি ইহার পশ্চাতে সক্রিয়?
প্রাচীন কালের সনাতন জ্ঞানীজনেরা কহিতেন, প্রশ্নটা ঠিক ঠিক উত্থাপন করিলে নাকি অর্ধ-উত্তর আপনি আসিয়া উপস্থিত হয়। এই ক্ষেত্রে যে সেই রূপ কিছু ঘটিল না, তাহা অধমের প্রশ্নগুলিরই ত্রুটি হইবে।
সুতরাং শিরোদেশে ঘর্মোৎপত্তির ব্যবস্থা করিতে হইল। স্বীয় উদ্যোগে।
কিছু শতাব্দ-প্রাচীন পুরাতন পুস্তক আলমারি হইতে নামাইতে হইল। উহারা বিজ্ঞানের যে শাখায় বিভিন্ন প্রাচীন মনুষ্য গোষ্ঠী সম্বন্ধীয় আলোচনা হইয়া থাকে সেই নৃতত্ত্ব বিষয়ক কিতাব বিশেষ। এডওয়ার্ড টাইলর, এডওয়ার্ড ক্লড, জেমস ফ্রেজার, জেন হ্যারিসন, ড্যানিয়েল ব্রেন্টন, পাউল এহরেনরাইখ, ফ্র্যাঙ্ক জেভনস, রবার্ট ম্যারেট, প্রমুখ এক কালের বিদ্বান ও বিদুষীদিগের রচনা। পৃষ্ঠাগুলি বিবর্ণ ও ভগ্নোন্মুখ, সামান্য হস্তাবলেপেই ছিন্ন হইবার সম্ভাবনা।
চমৎকার। এই রূপ ভূতপূর্ব পুস্তকেই ভূতপ্রেতাদি সম্পর্কে সঠিক হদিশ পাইবার সম্ভবনা অধিক বলিয়া বোধ হইল। পুরা কালের পাঠস্মৃতিও অন্ধকারে জোনাকির ক্ষণপ্রভার ন্যায় স্বল্পাকারে জাগিতে লাগিল।
হ্যাঁ, এই তো, ইঁহাদের মতে, ভূতের ধারণা অতি প্রাচীন সময়ে মানব মনে আসিয়াছে আত্মার ধারণা হইতে।
বেশ বেশ।
তা, এই আত্মার ধারণাই বা জন্মাইল কী রূপে?
মৃত্যু ব্যাখ্যা করিতে।
মৃত্যুর ব্যাখ্যা? ইহার পুনরায় ব্যাখ্যার কী আছে? প্রাণ বাহির হইয়া গেল মানেই তো মনুষ্য মৃত হইল।
অহো, প্রাণ কী?
যাহা শরীর হইতে নির্গত হইল, শরীর নিথর নিশ্চল হইয়া গেল, তাহাই প্রাণ। ইহা না বুঝিবার কী আছে?
উহা শরীরের কোথায় অবস্থান করিতেছিল? কোথা দিয়া বাহির হইয়া গেল?
ইহা একটি চিন্তা করিবার মতো প্রশ্ন বটে।
তবেই বুঝিয়া দেখুন। সেই আদ্যিকালের মানবকুল ইহারই ব্যাখ্যা খুঁজিয়াছিল। তাহারা নিষ্ক্রিয় নিশ্চল নিথর লুপ্তচেতন আহত ও মৃত – এই বিবিধ প্রকারের মানবাবস্থার পার্থক্য নিরূপন করিতে সক্ষম হইত না। অজ্ঞান ব্যক্তি যেরূপে কিয়ৎকাল পরে জ্ঞান লাভ করিয়া সক্রিয় হইয়া ওঠে, তাহারা আশা করিত, “মৃত” ব্যক্তিও কিঞ্চিতধিক কাল পরে সক্রিয় হইয়া উঠিবে। সক্রিয় মানবকুলে ফিরিয়া আসিবে। সুতরাং তাহাদের মনে হইত, মানব শরীরে এমন একখানি কিছু রহিয়াছে, যাহা থাকিলে মনুষ্যদেহ সক্রিয় সতেজ থাকে, যাহা বাহির হইয়া গেলে সে নিষ্ক্রিয় নিস্তেজ হইয়া পড়ে।
তাহারা কল্পনা করিয়া লইয়াছিল, সেই উহা একটি সূক্ষ্ম শরীর, দৃশ্যমান শরীরেরই অনুরূপ। কিন্তু তাহা এমন সূক্ষ্ম ও বায়বীয় যে তাহার গমনাগমন সহসা বুঝিয়া উঠা যায় না।
ক যখন খ-এর চক্ষের তারায় আপন ক্ষুদ্রাকৃতি প্রতিবিম্ব দেখিতে পায়, ক মনে করে, উহা খ-এরই সেই সূক্ষ্মশরীর। খ-এর আত্মা আপনাকে দর্শাইতেছে। হাতেনাতে, আব্বুলিশ, চক্ষে চক্ষে প্রমাণ!
প্রাচীন মানবের নিকট এই আত্মাই ছিল কারক কিংবা কর্তা। যে করায়। দেহে থাকিলে সেই দেহ সক্রিয় থাকিবে। দেহ ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেলে সেই দেহ নিষ্কর্মা হইয়া পড়িবে।
অদ্য আমরা আধুনিকেরা যাহাকে মৃত্যু বলিয়া থাকি, প্রাচীনেরা তাহাকে আত্মার দেহত্যাগ বলিয়া বুঝাইত ও বুঝিত। যাহারা আত্মার ধারণা আজি অবধিও পরিত্যাগ করিতে সক্ষম হয় নাই, তাহারা এই যুগেও দেহত্যাগ, দেহান্তরি, পরলোক গমন, ইত্যাদি ব্যবহার করিয়া থাকে। এবং তাহার ভিত্তিতে মৃতের আত্মার শান্তি কামনাও করিয়া ফেলে। এই ধারণার মধ্যে আরও একখানি চিন্তাও লক্ষণীয়। তাহা হইল আত্মার অমরত্ব। ব্যক্তি মরিল, কিন্তু আত্মা মরে নাই, সে দেহান্তরে বা লোকান্তরে গমন করিল। আত্মা অবিনশ্বর। সাধারণত ধর্মে বিশ্বাসীরা আত্মায়ও বিশ্বাসী হয়। ফলে তাহাদিগের মধ্যে এই বাক্যবন্ধ প্রয়োগের উদাহরণ আধিক্য দেখা যায়।
এই আত্মার গতিতত্ত্ব সম্পর্কে প্রাচীন মানবগণ কী ভাবিয়াছিল?
আত্মার দেহে প্রবেশ ও প্রস্থান সম্পর্কে তাহারা অবশ্যই কিছু ধারণার জন্ম প্রদান করিয়াছিল। যেহেতু তাহারা ইহা অতি প্রাচীন কালেই লক্ষ করিতে সক্ষম হয় যে মনুষ্যের নাসিকাপথে অনবরত বায়ু প্রবেশ করিতেছে (প্রশ্বাস) ও নির্গত হইতেছে (নিশ্বাস), তাহাদের মতে এই বায়ুই আত্মা। এই কারণে তাহার বলিয়াছিল, আত্মার দেহত্যাগের অর্থ দেহের শেষ নিশ্বাস।
ইউরোপের সম্ভ্রান্ত লাতিন ভাষা হইতে নিষ্পন্ন inspire expire sprite spirit ইত্যাদি ইংরেজি শব্দগুলির মধ্যেও নিশ্বাস প্রশ্বাসের (spirare) মধ্য দিয়া আত্মার গমনাগমনের বার্তাটি নিহিত রহিয়াছে। জার্মান einatmen শব্দের অর্থ শ্বাস গ্রহণ, যাহার সহিত সংস্কৃত “আত্মন্” শব্দের সাদৃশ্য অতীব দর্শনীয়। আবার ঋগবেদে আত্মন্ শব্দের একটি অর্থও নিশ্বাস।
এই পর্যন্ত পাঠ করিয়া কেহ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিবেন না। ক্লান্ত এবং/অথবা বিরক্ত লাগিলে নিদ্রা যাইতে পারেন।