এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ভ্রমণ

  • অচিনপুরের বালাই 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ভ্রমণ | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৯৪৪ বার পঠিত
  • আমি দাওয়াতে বসতে – লাজবন্তী আর বালাই আমার মুখের দিকে উৎসুক আগ্রহে এমন তাকিয়ে রইল, মনে হল আমি যেন কোন সঙ্গীত শিল্পী, গলা খুললেই ঝরে পড়বে সুরের মূর্ছনা!
     
    একটু সময় নিলাম মনটাকে স্থির করতে, তারপর বললাম, “এই গানটি আমার খুবই প্রিয়, রবি ঠাকুরের গান – বলা চলে আমার অন্তরের গান। আমি তো গাইয়ে নই, মুগ্ধ শ্রোতা মাত্র। কাজেই ঠিকঠাক সুরে তালে গাইতে না পারলেও ক্ষতি নেই, আশা করি আমার মনের ভাবটুকু বুঝে রবি ঠাকুর আমাকে ক্ষমা করবেন, ক্ষমা করবে তোমরাও”। তারপর একটু ধীর লয়ে শুরু করলাম,   

    “অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া,
    সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া।।

    দিনের পরে দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা,
    বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা।
    কখন আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা,
    সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া।। সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া...

    হারিয়ে যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে
    রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে।
    সেই-যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা
    সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা -
    এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা,
    একতারাতে আধখানা গান গাওয়া।। সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া...”।

    চোখ বন্ধ করে গাইছিলাম, গান শেষ হতে চোখ মেলে তাকালাম লাজবন্তী আর বালাইয়ের মুখের দিকে। দুজনের চোখেই অশ্রুর বন্যা। বালাই তো মাথা নিচু করে রীতিমতো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আজ সকাল থেকে আমি আর বালাই একই সঙ্গে সারাক্ষণ রয়েছি, স্বভাবতঃ হাসিমুখ বালাই এতটা ভেঙে পড়বে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের এই গানটি প্রেম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং শততম গান। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুললিত কণ্ঠে বহুবার শুনেও আমার মন কখনই কারো প্রতি প্রেমে ব্যাকুল হয়নি। বরং সর্বদাই আকুল হয়েছি অপার্থিব এক স্বর্গীয় অনুভবের আবেশে। আমি কোন কথা না বলে, আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ।
     
    কতক্ষণ পরে বালাই মুখ তুলে বলল, “এমন গান যিনি রচনা করতে পারেন, তাঁর অন্তরে যাঁর অধিষ্ঠান তাঁর প্রকাশটুকু বুঝতে আর বাকি থাকে না, বাবু, তাই না?” একটু থেমে গভীর শ্বাস নিয়ে আবার বলল, “সারা জীবনে তাঁর কতো সহস্র কৃপা-কণা প্রতি পলে আমাদের ওপর ঝরে পড়ে বাবু, তার কতটুকুই বা টের পাই। প্রায় সবটুকুই অবহেলায় আমরা হারিয়ে ফেলি”। বিগলিত চোখ-নাক মুছে একটু বিরতি দিয়ে বালাই আবার বলল, “ধুলোয় ঝরে পড়া, সামান্য যেটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি, তাই দিয়েও এতদিন কোন মালা তো গাঁথতে পারিনি, বাবু! সেই সামান্য মালাটুকু সম্বল করতে পারলেও তো আমরা তাঁর দুয়ারে পৌঁছে যেতে পারতাম, তাই না, বাবু”? এই বলে সে গান ধরল গভীর আবেগে,
     
    “মতামতের কট্‌কেনাতে, ভ্রমি ভ্রমের সাধনাতে,
    তোমার মিলনপথের সন্ধানেতে, সব যে গোঁজামিল। সে হায় গোড়ায় গরমিল।

    ভাবের ঘরে আপনি বসে, জপি মালা হিসেব কষে,
    ভুলেই গেলাম ব্যাপ্ত তুমি এ বিশ্ব নিখিল, সে হায় গোড়ায় গরমিল...

    জ্বলেনি দীপ আমার মনে, আঁধার ঘরের অন্ধ কোণে,
    তবু তোমার মিলবে পরশ, ভাবতেছিলাম ক্ষণে ক্ষণে।

    আনলে টেনে বাহির পানে, গাইলে কী সুর কানে কানে।
    তোমার কনক-প্রভা-কণায় দেখি জগৎ করতেছে ঝিলমিল,  
    এবার বুঝি হবেই হবে তোমায় আমার মিল, মিটবে সকল গোঁজামিল...”।       
      
    ঝটিতি এমন গান শুনিয়ে বালাই আমাকে আবার অবাক করে দিল। মুগ্ধ চোখে আমি তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। কিন্তু বালাইয়ের কোন হেলদোল নেই, আগের কথার জের টেনে সে বলল, “বড়ো ভীষণ গান শোনালেন বাবু। আমাদের হাজার কথার সার ওই গানের কয়টি পদেই বাঁধা হয়ে আছে। বদ্ধ ঘরের কবাট ভেঙে, পেলাম ঝোড়ো মুক্তির বাতাস। তবু এই দুঃখ আমার চিরটাকাল রইবে, বাবু,  সারা জীবনে আমার একতারাতে আধখানা গানও যে, তাঁর উদ্দেশ্যে গেয়ে ওঠা হল না…”।

    কথাগুলো বলার পরেই বালাই আবার ফুঁপিয়ে উঠল নতুন করে, আমি কোন কথা বললাম না। মনে মনে ভাবলাম, আমরা শহুরে বুদ্ধিজীবিরা রবীন্দ্রনাথকে মনে করি আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তাঁকে ভাঙিয়ে, তাঁকে ভেঙে-চুরে আমরা কত না বৈদগ্ধ্য ফলাই! অথচ নিষ্ঠুর ভাগ্যের হাতে আহত, অনপড় এই মানুষটা কত অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারল রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির কাছাকাছি! শিক্ষার প্রয়োজন সর্বস্তরে, কিন্তু তার থেকেও প্রয়োজন সে শিক্ষাকে অনুভবের। কিন্তু আমাদের কাছে শিক্ষা শুধু পরীক্ষা পাস এবং চাকরি লাভের অনুপান মাত্র। যে অনুভবে আমাদের তথাকথিত অশিক্ষিতা ঠাকুমা-দিদিমারা মহাভারত, রামায়ণ অথবা পৌরাণিক কথকতা শুনে অনায়াসে বুঝে ফেলতেন ভারতীয় মননের সারাৎসার, বালাই তার ধমনীতে সেই ট্রাডিশনই বহন করে চলেছে! কিন্তু আমরা নিজেদের হাতে উপড়ে ফেলছি আমাদেরই শিকড়!

    দাওয়া থেকে মাটিতে নেমে আমি বালাইয়ের কাছে গেলাম। তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, “এবার আমায় বিদায় দাও, বন্ধু। এই মূহুর্তে আমাদের মনে যে আনন্দের আবেশ রয়েছে, সাংসারিক কথায় তার রেশ যাবে কেটে। আমাদের বিদায়ের সুরটি এমন তারেই বাঁধা থাক। সে সুর অন্তরে বাজবে, যখনই মনে পড়বে বিশেষ এই দিনটির কথা”।
    বালাই আমার হাত দুটো ধরে বলল, “তবে তাই হোক, বাবু, তাই হোক”।
    লাজবন্তী আঁচলে চোখ মুছে, বললেন, “যাবেন বাবু? তা যেতে তো হবেই। কিন্তু আপনারে ছাড়তে যে মন চায় না”। তারপর ভিক্ষে চাওয়ার মতো করুণ আগ্রহে বললেন, “আপনার ফোনের নম্বরটা লিখে দেন না, বাবু। আমাদের আবার তো দেখা হতে পারে। এখানে না হোক, অন্য কোথাও। আপনাকে খপর দেবো, অবসর করে  যদি আসতে পারেন... সে কিন্তু বেশ হবে”।
    বালাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও উৎসুক চোখে আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার জামার পকেটে কাগজ বলতে ছিল আসার সময়ে কাটা ট্রেনের টিকিটটা। আমার নাম আর ফোন নম্বর লিখে, সেটা লাজবন্তীর হাতে দিলাম। লাজবন্তী সেটি হাতে নিয়ে যত্ন করে আঁচলে বাঁধলেন। আমি এবার পার্স থেকে পাঁচটা একশ টাকার নোট বের করে বালাইয়ের সামনে ধরে বললাম, “বালাই, তোমাকে এ আমার সামান্য দক্ষিণা...”

    লাজবন্তী দুচোখ ঝলসে রাগে ফোঁস করে উঠলেন, “আপনি আমাদের এত ছোট করে ধুলোয় মেশাতে পারলেন, বাবু? গান গেয়ে আমরা ভিখ মেগে খাই, একথা সত্যি। কিন্তু আপনারে আমরা বড়ো আপনার ভেবেছিলাম। এক থাল ভাতের দাম দিচ্ছেন বুঝি? কিন্তু তার দাম তো অত হতে পারে না!”  
    আমি কিছু বললাম না, চুপ করে লাজবন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর রাগটা থিতিয়ে যেতে ধৈর্য ধরলাম। বালাইও আহত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। আমি কিছুক্ষণ পরে বললাম, “পথে ঘাটে ভিক্ষে যাকে দিই, তাকে বুঝি আমার নাম ঠিকানা দিই, দিদি? দিই না তো! তাদেরও কেউ কোনদিন চায় না! সেখানে দাতা কিংবা দানগ্রহীতা কেউই কাউকে মনে রাখার দায় তো বহন করে না”।  

    ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে আবার বললাম, “মানছি টাকাপয়সা অনেক সম্পর্ককেই ছোট করে দেয়। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে তেমন ঠুনকো সম্পর্ক তো করিনি। সারাদিনে যাদের হাত ধরে এই বয়সে আমি জীবনের নতুন পাঠ পেলাম, তার দক্ষিণা না দিলে আমার শিক্ষা যে অপূর্ণ থাকবে, দিদি। এ কটা টাকা মনে করুন না, আমার আন্তরিক উপহার”। আমি মাথা নিচু করে নিজের আবেগকে একটু সংযত হতে সময় দিয়ে আবার বললাম, “আমাদের সমাজে কতশত নির্লজ্জ ধনী দেখেছি, যাদের অভাব কোনদিনই ঘোঁচে না। তারা সকলেই ভিখারি, তারা প্রত্যেকেই দস্যু। আপনাদের অনুভবে যে ঐশ্বর্য রয়েছে, সেখানে কোন অভাবের ছায়াটুকুও থাকতে পারে না। আমি আপনাদের অভাব ঘোঁচানোর চেষ্টা মাত্র করছি না”।  শেষ কথাটা বলতে আমার গলা কেঁপে উঠল আবেগে।
     
    বালাই হাত বাড়িয়ে আমার হাতদুটো ধরল, তারপর একটা মাত্র নোট নিয়ে বলল, “একটা টাকা আরো দেবেন বাবু?” আমি কথা বাড়ালাম না। চারটে নোট পার্সে ঢুকিয়ে, এক টাকার একটা কয়েন তুলে দিলাম বালাইয়ের হাতে। বালাই টাকা আর কয়েন মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “আপনার উপহার ফিরিয়ে আপনাকে বিমুখ করবো না, বাবু”। লাজবন্তীকে টাকাটা দিতে – লাজবন্তী এটাও আঁচলে বেঁধে রাখল। বালাই আবার বলল, “চলেন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি”।
     
    এবার আমার রাগার পালা, বললাম, “পাগলামি করো না, বালাই। বাঁধের পথ চিনে আমি ঠিক চলে যাবো। তুমি অকারণ ব্যস্ত হয়ো না”।
    লাজবন্তী বললেন, “তার চে আপনি রিকশতে চলে যান না। গ্রামের ভেতর সিয়ে সিমেণ্ট বাঁধানো পাকা রাস্তা।  দাঁড়ান, এস্ট্যাণ্ড থেকে আমি একটা রিকশ ধরে আনি”। বালাইও সে কথার সমর্থনে বলল, “সেই ভালো, চট করে এস্টেসনে পৌঁছেও যাবেন”।
    লাজবন্তীর প্রস্তাব আমার ভালই লাগল। দিনের শেষ প্রহরে বাঁধের পথে সমস্ত রাস্তাটা হেঁটে পার হওয়ার থেকে রিকশ করে স্টেসন পৌঁছানো অনেকটাই আরামদায়ক।  আমি বললাম, “রিকশ আপনাকে ডেকে আনতে হবে কেন? আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে, ওখান থেকেই বেরিয়ে যাবো রিকশ ঠিক করে?”

    লাজবন্তী বললেন, “যতটা পারেন থাকুন না, বালাইয়ের সঙ্গে। এত বছর আমি বালাইয়ের ঘর করছি, আমার সঙ্গেও বালাইয়ের এমন মনের মিল গড়ে ওঠেনি, বাবু”। লাজবন্তী হাসলেন, কিন্তু সে হাসিতে সামান্য হলেও কী বিষাদের ছোঁয়া দেখতে পেলাম? নাকি সেটা আমার দেখার ভুল?

    আমি মৃদু হেসে বললাম, “ওটা আপনার ভালোবাসারই লক্ষণ, দিদি। যে ভালোবাসায় আপনি সারাজীবন ওকে বুকে করে আগলে রেখেছেন, তার থেকে এতটুকু অধিকারও আপনি খোয়াতে চান না। আমাকে অতি নিরাপদ উপলক্ষ জেনেও!”

    লাজবন্তী চমকে উঠলেন আমার কথায়, একবার বালাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা দুজনেই একই রকম। নির্মম ছলে যেমন পথের ধুলো থেকে বুকে তুলে নিতে পারেন। মধুর হাসিমুখে তেমনই হেলায় ফেলেও যেতে পারেন পথের ধুলোয়”। আমার চোখে চোখ রেখে তীব্র কটাক্ষ হেনে আবার বললেন, “আমি রিকশ নিয়ে এখনই আসছি, মোহনকালা”।

    বালাইয়ের চোখে এখন আগের মতোই মিচকে হাসি, বলল, “লাজের কথায় রাগ করলেন নাকি, বাবু। তবে নামটা দিয়েছে মোক্ষম, মোহনকালা। বেশ নাম”। তারপর গুনগুন সুরে গাইল,
    “বাঁশী হাতে মোহন কালা, ও রাই, ওরাই যে তোর কণ্ঠ মালা,
    নয়ন মণিরে নয়নে হারিয়ে, ও সই, সইতে হবে যে দহন জ্বালা”।

    আমি হেসে ফেললাম, কিন্তু কিছু বললাম না। বলার কিছু ছিলও না। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম, ভাবের রাজ্যে বাস করা অদ্ভূত এই দুই চরিত্রের কথা – অভাব ওদের স্বভাবে কোন দাগ ফেলেনি। ওদের মনবসনে জীবনের কোন দুঃখ-শোকের কালিই ধোপে টেকেনি। কোন ভক্তির আবেশে ওরা এমন নির্দ্বন্দ্ব থাকতে পারলো – চারিদিকে আজকের এই নগ্ন-নির্লজ্জ জীবন যাত্রার মধ্যেও? শ্রদ্ধায় মাথা নত করে বসে রইলাম চুপচাপ।
     
    ঝরঝর শব্দে একটা রিকশা এসে ঢুকল সামনের প্রাঙ্গণে। দুর্বিনীত স্বরে রিকশওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, “ওই মেয়েছেলেটা আমাকে পাঠাল। কে যাবেন এস্টেসনে?”

    এতক্ষণ যে আনন্দ অনুভবে মজে ছিলাম, ‘মেয়েছেলে’ কথাটা আমাকে টেনে নামাল চরম বিরক্তিতে। লাজবন্তীই নিশ্চয়ই সেই ‘মেয়েছেলে’! ‘ছেলেমেয়ে’ এবং ‘মেয়েছেলে’ – এই শব্দদুটিতে গুণগত তফাৎ থাকার কথা নয়। কিন্তু ভয়ানক তফাৎটা আছে অর্থের দিক থেকে। “আপনার কটি ছেলেমেয়ে?” বা “আপনার ছেলেমেয়েরা কী করে?” একথা আমরা পরিচিত জনকে জিজ্ঞাসা করলে, সন্তানগর্বে সকলেই উত্তর দিতে দেরি করেন না। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করি, “আপনার কটি মেয়েছেলে?” বা “আপনার মেয়েছেলেরা কী করে?”, সে ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তার প্রাণ সংশয় হওয়াও বিচিত্র নয়!
    তবে এই গ্রাম্য পরিবেশে, রিকশওয়ালার জিজ্ঞাসায়, ‘মেয়েছেলে’ কথাটা যদি ‘ব্যাটাছেলে’-র বিপরীত লিঙ্গ হিসেবে স্বাভাবিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমার অতটা বিরক্ত না হলেও হয়তো চলতে পারে। তবু মনে খটকা একটা রয়েই গেল। আমি উত্তর দিলাম, “আমিই যাবো, ভাই। রিকশ ঘুরিয়ে রাখুন, এখনই যাবো”।
     
    আমি বালাইয়ের কাঁধে হাত রাখলাম, বললাম, “চললাম, ভাই, মনের বালাই। তোমার মতো এমন “মনের বালাই” মিত্র এখন পর্যন্ত কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। ফোন নাম্বার দিলাম, বাইরে গেলে আমাকে খবর দিও, সুযোগ সময় পেলে নিশ্চয়ই যাবো”।

    বালাই বিষণ্ণ মুখ তুলে, আমার হাতদুটো ধরে বলল, “সে কী আর বলার কথা বাবু, নিশ্চয়ই জানাবো। আর কালার ইচ্ছে হলে, আমাদের ডাকে মোহনকালা কী আর কালা সেজে ঘরে থাকতে পারবেন? আসুন বাবু। আজকের দিনটা আমাদের জীবনে আলোক-কণায় স্থির উজ্জ্বল করে দিয়ে গেলেন, বাবু”।

    রিকশওয়ালা পেছন থেকে তাড়া দিল, “ওঠেন বাবু, দেরি করবেন না”।
      
    বালাইয়ের কথায় আমি হাসলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “লাজবন্তী এখনও ফিরল না কেন? যাবার সময় ওর সঙ্গে দেখা হবে না?” বালাই হাসল, “বলল, আপনি রওনা হন বাবু, দেখা হবে, ঠিক জায়গাতেই সে আপনার অপেক্ষায় থাকবে”।

    বালাইয়ের কথাটা আমার কাছে কেমন যেন রহস্য বলে মনে হল। আমার অপেক্ষায় সে কোথায় থাকবে, কোন জায়গায়? আমি রিকশয় উঠলাম। প্যাডেলে চাপ দিয়ে রিকশওয়ালা বলল, “স্টেসন যেতে তিরিশটাকা লাগবে, বাবু। এমনিতে ভাড়া কুড়িটাকা, তবে আপনাকে তুলতে এতটা উজিয়ে এলাম, এতক্ষণ দাঁড়ালাম…সে সব নিয়ে”। মৌন থাকাই সম্মতির লক্ষণ চিন্তা করে, আমি কোন উত্তর না দিয়ে গুছিয়ে বসলাম রিকশয়।

    মিনিট চারপাঁচ গড়ানোর পরেই পৌঁছলাম, চার রাস্তার এক মোড়ে। মনে হল, সেখান থেকে বাঁদিকে স্টেসনের রাস্তা, ডানদিকে বাঁধের দিকে যাওয়ার রাস্তা। আর সামনেরটা হয়তো চলে গেছে অন্য পাড়ার দিকে। এই মোড়ের ঠিক বাঁহাতেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক অশ্বত্থ গাছ, শাখাপ্রশাখার বিপুল বিস্তার নিয়ে। তার ডালে ডালে ঘরে ফেরা পাখিদের উচ্ছ্বল কাকলিতে কানপাতা দায়। বিকেলের মরা আলোয় অনুজ্জ্বল কিন্তু অদ্ভূত স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। যেন অনেক ঝড়ঝাপটা সয়ে, কতকালের কত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে, প্রপিতামহের মতো, গাছটা উদাসীন দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে।

    দেখলাম সেই গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে আছে লাজবন্তী। আমি রিকশওয়ালাকে থামতে বলে নিচেয় নামলাম। লাজবন্তীর সামনে গিয়ে বললাম, “আপনি এখানে, দিদি? বাড়ি ফিরলেন না?”
    আমার চোখে চোখ রেখে লাজবন্তী বললেন, “আমি আপনার সঙ্গে এই গাছতলাতেই দেখা করতে চেয়েছিলাম, মোহনকালা। এই পরিবেশেই আপনার বিদায় পর্ব শেষ হোক। সাক্ষী থাকুক এই বুড়ো অশথ গাছ, আর এই দিনান্তের আবছা আলো”।
    আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর বললাম, “চলি”।
    লাজবন্তী চোখ নামিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, “আপনাকে খপর দেব, আর আশায় থাকব আপনার দর্শনের। চলি নয় বলুন আসি। আসুন”।
     
    আমি কোন উত্তর দিলাম না। একটু হাসলাম। তারপর পিছন ফিরে রিকশয় চড়ার সময়, রিকশওয়ালার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, সে কুটিল চোখে তাকিয়ে আছে লাজবন্তীর দিকে। সে আমাদের সব কথাই হয়তো শুনেছে। রিকশওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে রিকশ চালু করল। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম লাজবন্তীর দিকে। সে একই ভাবে  দাঁড়িয়ে আছে আবছা আলোয় ঘেরা গাছতলায়। তাকিয়ে আছে এই রিকশটার দিকে…ওর থেকে আমার দূরত্ব বেড়ে চলেছে প্রতিটি মূহুর্তে…।
     
    (চলবে)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৯৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন