আলো ফুটতে না ফুটতেই ইমাম বক্স থানাদার লেনের তিনতলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পড়ল নন্দ ঢালি। বাবু রামলাল শীল, মেজাজ ভালো থাকলে ইয়ার বকশীদের বলেন, - এ শালা চেহারায় হাতি, স্বভাবে খরগোশ। বাবুই নন্দর মা বাপ। মা বা বাপ কাউকেই মনে পড়ে না নন্দর। কুড়ি টাকা নিয়ে ওরা তাকে কচি বয়সে বেচে দিয়েছিল বাবুর কাছে। বাবু তাকে খাইয়েছেন, পরিয়েছেন। কুস্তি, লাঠিখেলা শিখিয়েছেন। বলতে নেই, বাবু তাকে খুব কষ্ট দেন না। সে একাধারে তাঁর বান্দা আর দেহরক্ষী কিনা! রাগ হলে ঘুষি, লাথি চালান ঠিকই, তবে ওসব গায়ে লাগে না নন্দর। তবু, আর থাকা যাবে না। পালিয়ে ধরা পড়লে কী হবে ভাবতেও চায় না সে। শুধু জানে, এখানে থাকলে সে মরে যাবে। এক বছর হলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে সে। আর না! বাবুকে বলেও কিছু লাভ নেই। এই বাড়িতে রামলালবাবুর বিধবা বোন দিগম্বরীর কথাই আইন।
নন্দর পরিষ্কার মনে আছে সেই রাত। সে দিদিঠাকরুনের ঘরে দাঁড়ানো। সেজের বাতি জ্বলছে। দিগম্বরী স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ঠোঁট চাটছেন।
- এমন গতর কখন বানালি? বুজতেই পাল্লুমনি! খাসা ডাগরটি হইচিস! পালঙের সামনে এসে ডাঁড়া!
সেই শুরু। তারপর থেকে সপ্তাহের বেশ কিছু সকালে নন্দর চোখ ভারী হয়ে থাকে। শরীর চলতে চায় না। সারা গায়ের আঁচড় কামড়ের দাগ দেখে সবাই মুখ টিপে হাসে। কিন্তু, কারো টুঁ শব্দ করার জো নেই। ঐ সামনে সোনাগাজীর পাড়া। সেখানকার দশটা ঘরের মালিকানা ছিল রামলালের পিতাঠাকুর কৈলাসপতির। সেই ঘরগুলো তিনি বালবিধবা মেয়েকে লিখে পড়ে দিয়ে গেছেন। যথেষ্ট আয় হয় দিগম্বরীর। ঐ তল্লাটের ত্রাস রাখাল গুণ্ডা দিগম্বরীর বাবার সময় থেকে তাঁদের অনুগত। দিদিরাণীর এক কথায় সে একশটা লাশ গায়েব করতে পারে। গতরাত্রে সীমা ছাড়ালো। মনে পড়তেই কুঁকড়ে উঠল নন্দ। তাকে উপুড় করে ফেলে, তার ওপর চাবুক চালাচ্ছেন দিদিঠাকরুণ। ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছে সে। রক্ত বেরোচ্ছে। জ্ঞান হারানোর আগে পর্যন্ত সে শুনেছে দিগম্বরীর শীৎকার, - আহ্, আহ্, আআআআআআহ্! জোরে পা চালাল নন্দ। কলকেতা জেগে উঠছে। ভিস্তিওয়ালা পিঠে মশক নিয়ে চলেছে। একটা বাবু টলতে টলতে আসছে। চোখের নীচে ঘন কালি। ঢেউ খেলানো বাবড়ি চুল, দাঁতে মিশি। পরনে ফিনফিনে কালোপেড়ে ধুতি। গায়ে মসলিনের বেনিয়ান, চুনোট করা উড়নি গলায়, পায়ে চীনেবাড়ির জুতো। খিদেয় পেটে আগুন জ্বলছে নন্দর। সে লুব্ধ চোখে খাবারের দোকানগুলো দেখতে লাগল। বিক্রী হচ্ছে জিভে গজা, ছাতুর শুটকে গজা, কচুরি, জিলিপি। দেখাই সার। ছোঁয়ার উপায় নেই। ওড়িয়াদের দোকানে এক পয়সায় এত মুড়ি-মুড়কি আর নারকেল নাড়ু দেয় যে একজনে খেয়ে শেষ করতে পারে না। তাই, সবাই আধ পয়সার মুড়ি-মুড়কি কেনে। কিন্তু, নন্দর কাছে ফুটো পয়সাও নেই। কেনা গোলামের পয়সা থাকে না। রাস্তার ওপর একটা পাহারাওয়ালা! গরানহাটা ছাড়িয়ে এসেছে নন্দ। একটা বাড়ির আড়ালে সরে গেল সে। তারপর, পাহারাওয়ালা দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে না যেতেই, পড়ি কি মরি করে ছুটতে লাগল যেদিকে দুচোখ যায়।
মৌলা আলির দরগার কয়েক গজ দক্ষিণে সারকুলার রোডের ওপর একটা বাড়ি থেকে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক বেরিয়ে এলেন। অতি অল্প বয়স। মুখে যেন এখনও কৈশোরের লাবণ্য লেগে আছে। এলোমেলো চুল। অন্যমনস্ক চাহনি। একবার দক্ষিণদিকে চাইলেন। ওদিকে রয়েছে পার্কস্ট্রিট গোরস্থান। আরএকবার চাইলেন উত্তর পশ্চিমে। ঐ দিকে গোলদীঘি। একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি ধর্মতলার দিকে পা বাড়ালেন। ভারী ক্লান্ত পদক্ষেপ। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই ছুটে আসা একটা লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। লোকটাও সচাপ্টে পড়েছে। নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালেন সাহেব। লোকটাও উঠে বসেছে। লোক নয়। একটা ছেলে। বছর উনিশ হবে। পালোয়ানের মতো শরীরের ওপর একটা শিশুর মতো মিষ্টি মুখ। তাঁর খুঁটিনাটি দেখতে অভ্যস্থ চোখ দেখে নিল, ছেলেটার পরনে শুধু একটা ধুতি। সারা গায়ে ক্ষতচিহ্ন। যদি তাঁর ভুল না হয় তবে এ হলো আরেকজন পালানো গোলাম। ১৭৯৩ তে কম্পানির ডাইরেক্টররা মানুষ কেনাবেচা আটকাতে আদেশ জারি করেন। ক্যালকাটা গেজেট আর সমাচার দর্পণ ক্রমাগত লিখে যাচ্ছে দাসপ্রথার বিরূদ্ধে। তবু, লুকিয়ে চুরিয়ে গোলামির বীভৎসতা চলছেই। একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপর পরিস্কার বাংলায় বললেন,
- সোজা বাড়ির ভেতর চলে যাও। আমার বোনকে ডেকে দিচ্ছি। বিশ্রাম নাও। তবে, পেটভরা খাবার বোধহয় জুটবে না। যা আছে ভাগ করে খেতে আপত্তি নেই তো?
ছেলেটা হতবুদ্ধির মতো মাথা নাড়ল। তিনি গলা তুলে ডাকলেন,
- আমেলিয়া।
এক মেমসাহেব বেরিয়ে এলেন। গাউন পরা লক্ষ্মীঠাকরুনের মতো দেখতে।
- রান অ্যাওয়ে স্লেভ বুঝলি? ফুড আর শেল্টার দরকার। দ্যাখ না একটু, প্লিজ।
প্রীতিভরা চোখে দাদার পানে চেয়ে অল্প হাসলেন আমেলিয়া। তারপর গোলামটিকে বললেন,
- এসো। ভেতরে এসো।
সাহেব এগিয়ে চললেন। মাথায় গুনগুন করছে নিজের লেখা কবিতা। এই তো চারবছর আগে লেখা। তিনি তখন প্রায় ঐ ছেলেটারই বয়সী।
কী ভাবিল যবে তাহে কহে ডাকি সবে ক্রীতদাস
আর নহ এই নরলোকে গরবে পূরিল হিয়া শুনি,
এই ভবে রহিবে স্বাধীন সুখে, দুঃখে ও শোকে!
সত্যি! যদি, ঐ ছোকরা স্বাধীন হওয়ার খবর পায়, তাহলে কী হবে? সামনের বড়িটায় কিছু একটা হয়েছে। তিনি এগিয়ে গেলেন। বারান্দায় পাতা চেয়ারে এক দারোগা বসা। ইতস্তত জটলা করছে কিছু পুলিশম্যান। লনের ওপর একটা ল্যাংটো বাচ্চা ছেলে উবু হয়ে বসা। মাথায় একটা গামছা জড়ানো। তেল চুকচুকে বাবড়িচুলো, রুদ্রাক্ষের মালা গলায় একটা লোক হেঁকে বলছে,
- হেই লাগ লাগ লাগ লাগ! ইরুন্তি ভুরুন্তি কাসুন্দি দ্রুম। কার আজ্ঞে? ভানুমতীর আজ্ঞে! মেমসাহেবের রূপোর থালা বাসন নোওয়া চোর, যদি একেনে থাক তো কবুল করো! নইলে এক মন্তর ঝাড়ব, আর এই ল্যাংটা খোকা তেজী ঘোড়ার মতো নাপিয়ে নাপিয়ে যাবে, বাটি টেনে নে যাবে ওরে! এক্কেরে মাল যেকেনে আচে সেইকেনে। হঁ হঁ হঁ!
উত্তুরে বাতাসে বাটি ধরা ছেলেটা ঠকঠক করে কাঁপছে। সাতদিন পরে বড়দিন। এক ইংরেজ ভদ্রমহিলা - নিশ্চিত তিনি এদেশে বেশিদিন আসেননি- দারোগাকে ইংরিজিতে প্রশ্ন করছেন,
- বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় আপনারা এইভাবে চোর ধরেন নাকি?
আর না দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করলেন তিনি। আজও একটা ঠিকঠাক পুলিশ বাহিনী গড়তে পারল না সরকার। পুলিশ এখনও নির্ভর করে বাটি চালানো, চটা চালানো, চাল পড়ার ওপর। পরের এডিটোরিয়ালে এই নিয়ে লিখতে হবে। সামনের মাঠের পাশে তাঁর পুরনো স্কুল। ঐ তো একটু ঝুঁকে পরে ডিডি স্যার দাঁড়িয়ে।
- গুড মর্নিং সার।
- ভেরি গুড মর্নিং। কেমন আছ?
- খুব ভালো সার।
- না। খুব ভালো নেই। আমরা কেউই নেই। তবু লড়াই তো চলবেই। তোমার কলেজ ডেকেছে তোমায়?
- না সার। মাস্টারি ছেড়ে এখন ইস্ট ইন্ডিয়ান কাগজ চালাই।
- জানি। খবর রাখি। সেদিন জন বুল কাগজ থেকে কে একটা এসে তোমাকে বেত মেরেছিল না? কিন্তু, তুমি একটুও দমে যাওনি! সাবাশ! অহংকার হয়েছিল আমার! তবে, ছেড়ে আসা ক্লাসরুমে তুমি ফিরবেই!
- আশা কম স্যার।
- ইয়াং ম্যান, আমি স্কটল্যান্ডের মানুষ। একজন খাঁটি স্কটিশ মরে যাবে, তবু আশা ছাড়বে না।
রুটি আর জল খেয়েছে নন্দ। মাথাটা এতই ভোঁভোঁ করছে যে খিদে আছে না নেই কিছুই বুঝছে না সে। সে মরে গিয়ে স্বর্গে চলে আসেনি তো? এঁরা সব দেব দেবী নিশ্চয়ই। কোনও মানুষ গোলামের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে পারে না! হলঘরের এক কোণায়, মাটিতে বসেছিল নন্দ। হঠাৎ, সামনের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। একটা সাহেব। ভাঁটার মতো লাল চোখ ঘুরছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল সে। গাঁক গাঁক করে কী যেন বলল। উঁহ্! কী বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে!
- ফ্র্যাঙ্ক!
ডাকটা এল পেছন থেকে। মেমসাহেব বেরিয়ে এসেছেন। সাহেবটা হাউ হাউ করে কী সব বলতে লাগল। হঠাৎ, মেমসাহেব সপাটে এক চড় কষিয়ে দিলেন তার গালে। লোকটা গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে রইল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল। মেমসাহেব নন্দর দিকে চেয়ে বললেন,
- ক্ষমা কোরো। ও আমাদের সবার বড় দাদা। মদ খেয়ে অসভ্যতা করে, কিন্তু, আমায় ভালোবাসে খুব। আমি ছাড়া কেউ ওকে সামলাতে পারে না।
এরা কারা? তার কাছে ক্ষমা চাইছে! মাটির মধ্যে ঢুকে যাওয়া যায় কী করে, এই কথা ভাবতে ভাবতেই বাইরে থেকে একটা বিরাট চিৎকার শোনা গেল। দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখা গেল একদল লেঠেলের আগে আগে ছুটছে এক তরুণ। সাহেবি পোশাক পরনে। সোজা দৌড়ে এসে সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন সাহেব। নন্দ নিজেও বুঝল না কেন সে সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। লেঠেলরা এসে পড়ল। একজন সাহেবকে একটা ধাক্কা দিল। ডানহাতে বুকের মাঝখানটা চেপে মাটিতে বসে পড়লেন সাহেব। ক্রুদ্ধ বাঘের গজরানির মতো একটা শব্দ শোনা গেল। নন্দ অবাক হয়ে শুনল আওয়াজটা তার গলা থেকেই বেরোচ্ছে। একটানে একটা লাঠি কেড়ে নিল সে। তারপর, তার লাঠি চলতে লাগল বিদ্যুতের মতো। একটু পরেই রণে ভঙ্গ দিয়ে দৌড় দিল লেঠেলরা। ভেতরে এসে নন্দ দেখল, সাহেব কৌচে বসা আর সাহেবি পোশাক পরা বাবুটা তাঁর নাড়ি দেখছে। সাহেব হাসছেন,
- আই নিউ য়ু আর আ ম্যান অভ মেনি পার্টস দক্ষিণা! হোয়াট আই ডিডন্ট নো ওয়জ দ্যাট য়ু আর ভার্সড ইন মেডিকেল সায়েন্স টু!
বাবুটা লজ্জা পেয়ে ঘাড় চুলকোচ্ছে। বেশ মজা লাগছে নন্দর! সাহেব উঠে বসলেন।
- লেঠেল কেন?
- বাবার পাঠানো। বাড়ি ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়ি থেকে চলে এসে একটা ঘর নিয়ে আছি তো!
- সেকি! আমাকে বলনি কেন?
- বললে আপনি বারণ করতেন। থাকা যাচ্ছিল না, বিশ্বাস করুন। শাসন, প্রহার, উৎপীড়ন - এর পর কড়া মাদক খাইয়ে বশীকরণের চেষ্টা! যত বলি, আমি ক্রীশ্চান হবো না, শোনেন না!
- ধর্ম নাই বদলালে, হিন্দু ধর্মের কোনও প্রথাও তো তুমি মানো না।
- সেটাই মুশকিল। প্রথাগুলো সম্পর্কে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে ওরকম হিংস্র হয়ে উঠেছেন বাবা।
সাহেব খানিক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন বাবুটার দিকে। তারপর বললেন,
- আমার সবচেয়ে বেশি কোনটা ভালো লেগেছে জানো? মাত্র সতের বছর বয়সে তুমি বুঝেছ, মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা না করলে জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছনো যায় না। তোমার জ্ঞানান্বেষণ কাগজের আদর্শ প্রচারকারী সেই শ্লোকটা যেন কী?
- এহি জ্ঞান মনুষ্যানামজ্ঞান তিমিরংহর।
দয়া সত্যঞ্চ সংস্থাপ্য শঠতামপি সংহর।।
অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে, দয়া ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে, শঠতাকে সংহার করে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোই আমাদের আদর্শ।
বারে! বাবুটা কী সুন্দর অং বং করে মন্তর পড়ছে! ধুতি, নামাবলী পরিয়ে দিলেই তো পুরো পুরুতঠাকুর! সাহেবের চোখ দিয়ে আশিস ঝরছে। এবার ঠোঁট নড়ল তাঁর,
ফুলদল সম বিকশিত হতে দেখি কোমল চিত্ত মুক্ত স্বাধীন সবে
- শক্তি হারায় মন্ত্রবাঁধন, বন্দী ছিল কবে
চেতনা, মনন, মেধাবল যায় লেখি...
কী সুন্দর সংস্কৃত উচ্চারণ তোমার!
- এ দেশের জ্ঞানকে খুঁজতে গেলে তো সো কলড্ দেবভাষার সাহায্য চাইই স্যার! আর মুখুটি হেরিটেজ বোধহয় রক্তে আছে! উচ্চারণ আমি ছোটবেলা থেকেই শুদ্ধ করি!
সাহেব হাসিমুখে চেয়ে আছেন। তেমনি হাসি হাসি মুখেই কৌচ থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়লেন। চোখ বোজা।
পাঁচদিন কেটে গেছে। চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। ঘরে দানাপানি নেই। একটা ফুটো পয়সাও নেই। নন্দ দাঁতে কুটোটি কাটেনি। কারণ, সাহেব কিছু খেতে পারছেন না। তাঁর ছাত্ররা বাইরে থেকে খাবার এনে, নিজেরা খেয়েছেন, আমেলিয়াকে খাইয়েছেন। ওইটুকু সামর্থ্যই তাঁদের আছে। ডাক্তারের ফী-এর ব্যবস্থা তাঁরা করতে পারেননি। আজ সকাল থেকে সাহেব চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। বন্য আক্রোশে ফুলে দুনো হয়ে উঠেছে নন্দ। সারা পৃথিবীকে ফালা ফালা করে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, কোনও প্রতিপক্ষ সামনে নেই। একটা বিরাট জুড়িগাড়ি বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। নেমে এলেন এক চোগা, চাপকান, লপেটা পরা এক ব্যক্তি। মাথায় একটা সাদা বেরে টুপি। প্রতি পদক্ষেপে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে। দেখেই বোঝা যায় মানুষটি আদেশ করতেই অভ্যস্থ। ঘরময় ফিসফিস
- মহারাজ এসেছেন।
সাহেব হাসলেন,
- সুপ্রভাত মহারাজ। বসুন।
মহারাজ বসলেন না। অন্যমনস্ক ভাবে বলতে লাগলেন,
- বাবার বানানো একটা গ্যালাক্সির মডেল ছিল। এখন কাজ করচে না। সারাতে হবে। নতুন একটা টেলিস্কোপ এনিচি। মঙ্গলের দুই চাঁদ - ফোবস আর ডিমস। অপরূপ! আর জান, আমার মনে হয় মানবদেহের ভেতরটা মহাকাশের চেয়ে কম রহস্যময় নয়। গত বচর মেডিকেল কালেজের ডাক্তারদের বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিইচি তাই। যাক! মড়া কেটে দেকে আসুক! এখেনে তো বামনাগুলো কাঁইমাই করবে!
- মহারাজ কী বলছেন ঠিক বুঝছি না!
- বোজা শক্ত! তুমি আমাদের অবস্থানটা, হিন্দু সমাজকে না বুজলে, বুজবে না! আমি, রাধাকান্ত দেব, সতীদাহ প্রথা রদের ব্যাপারে প্রাণপণে বাদা দিইচি। কিন্তু, আমার ঘরের একটি মেয়ে সতী হয়নি। আমার বাড়ির সব মেয়ে লেকাপড়া শেখে! তবু, সমাজপতি হিসেবে আমাকে স্রোতের সঙ্গে চলতে হয়। বোজার চেষ্টা করো। হট করে বদল আসে না। ধীরে ধীরে ভেতর থেকে আনতে হয়। হিন্দু কালেজ আমরা বানিয়েচি যাতে উচ্চবর্ণের হিন্দু ছেলেরা লোকাচারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো পায়, তার জন্যে। মাত্তর একুশ, বাইশ বচর বয়সে তুমি তাদের, সব কিচুকে প্রশ্ন করো, বলে নাচাবে, তারাও তিন ধা নাচন নাচবে : এসব সমাজ মেনে নেবে মনে কর? মানুষ আমি তোমার সব কটি লেকা পড়িচি। বাহবা জানিইচি। কিন্তু, সমাজমুখ্য হিসেবে আই কান্ট অ্যালাও অল দিস। আমার ঠাকুরদা, মহারাজাবাহাদুর নবকৃষ্ণ শেইমলেস স্কীমার ছিলেন। সেই তিনিও সমঝে চলতেন সমাজকে। জাতিমালা কাছারিতে জাতের সমস্যা মেটানোর সময় ত্রস্ত হয়ে থাকতেন।
- আমি কিন্তু এখনও কিছু বুঝিনি।
- বেশ। খুলেই বলি। আমি ক্ষমা চাইতে এসিচি। তোমার প্রতিভার কদর আমার চেয়ে বেশি এদেশে কেউ করে না। তবু তোমায় বরখাস্ত করতে হলো। কেন যে একটা অসম লড়াইয়ে নামলে!
- অসম?
- বাংলার একটা গ্রামের নাম করো, যেখেনে লোকে আমার নয়, তোমার কতা শুনবে! গ্রাম ছাড়ো! এই কলকেতায়, কুমোরটুলি, শাঁখারিটোলা, নেবুতলা, বেলগেছে - একটা জায়গা দেখাও যেখেনে তোমার মতের কোনও দাম আচে! আরও একটা কথা বলে দিচ্চি। তোমার এই বিদ্রোহী ছাত্রের দল কালক্রমে হিন্দু সমাজের মূলস্রোতে মিশে যাবে।
- আর সেখানেই আমি জিতব! আপনি দেখছেন না কত অল্প বয়সে ওরা কাগজ বার করছে, ডিবেট করছে, প্রশ্ন করছে? পুব আর পশ্চিমের জ্ঞানকে মিশিয়ে নিচ্ছে? ওরা মূলস্রোতে মিশলে, ওদের শিক্ষাটাও মিশবে। তারপর ছড়িয়ে পড়বে। আপনারই ভাষায়, ভেতর থেকে বদল আরম্ভ হয়ে গেছে মহারাজ! হা হা হা হা!
একজন পাদ্রী এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়। এক ছাত্র প্রশ্ন করলেন,
- কিছু বলবেন রেভারেন্ড?
- একজন ক্রীশ্চান হিসেবে আরেক ক্রীশ্চানকে ঈশ্বরের পুণ্যকথা শোনাতে চাই।
সাহেব নিজের মুখের ওপর হাত বোলালেন।
- সারাজীবনে, একবারের জন্যেও, নিজেকে ক্রীশ্চান বলিনি! ঈশ্বর আছেন এমন কোনও প্রমাণ সঙ্গে এনেছেন রেভারেন্ড?
পাদ্রী বুকে, বাতাসে ক্রস আঁকলেন। তারপর চলে গেলেন। সাহেব এবার হাসলেন,
- আপনি আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি মহারাজ। য়ু আর অ্যান অনারেবল ম্যান! একটা উপকার করবেন?
- করব। বলো।
- এই ঘরে একজন পালানো গোলাম আছে। তাকে স্বাধীন করে দিন অনুগ্রহ করে।
রাধাকান্তর চোখ নির্ভুল ভাবে নন্দকে খুঁজে নিল।
- মুনিব কে রে?
- রামলাল শীল। ইমাম বক্স লেন।
- বুঝেছি। তুই আর গোলাম নোস। রামলালকে আমি বলে দেব।
নন্দ এসে পা জড়িয়ে ধরল।
- আরে, দূর ব্যাটা! শিকে নে। শ্রদ্ধার যুগ্যি কিনা না জেনে কারও কাচে মাতা নোয়াবিনি।
সাহেব দু'টো হাত বাড়িয়ে দিলেন। একটু নাটুকে স্বরে বললেন,
- থ্যাঙ্ক্যু মহারাজ। য়ু আর আ নোবল্ এনিমি।
হাত দুটো ধরলেন রাধাকান্ত। মুখটা কেমন বদলে গেছে তাঁর। তেতো গলায় বললেন, -
তুমি ইংরেজ সাহেব হলে তোমার কিচুই হতো না। ওরাই মালিক। আর জাতভাইদের বাঁচাতে এককাট্টা হয়। ফিরিঙ্গি বলেই সব্বোনাশটা হলো।
হঠাৎ সাহেবের মুখটা কেমন স্থির হয়ে গেল। দেখলে ভয় করে। কীরকম ঘড়ঘড়ে গলায় তিনি বললেন,
- কে ফিরিঙ্গি? আমি? আমি ভারতীয়। এই মাটিতে জন্মেছি। এটা আমার দেশ। ছেলেরা...কেউ একজন, কেউ একজন আমার লেখা স্বদেশ আমার কবিতাটা আবৃত্তি করবে? অনেকগুলি তরুণকন্ঠ একস্বরে বলে উঠল,
স্বদেশ আমার, কিবা জ্যোতির্মণ্ডলী
ভূষিত ললাট তব, অস্তে গেছে চলি
সেদিন তোমার...
সাহেবের মুখে হাসি ফুটল। তিনি চোখ বুজলেন।
ঘুমোবেন এবার। ঘুমিয়ে পড়বেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। এক ভারতবাসী। তাঁর কবিতা আবৃত্তি করছেন, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ি...। তাঁদের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নন্দকুমার ঢালি। এক স্বাধীন মানুষ।
[স্বদেশ আমার - এর অনুবাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাকী দুটির অনুবাদপ্রয়াস এই অক্ষম কলমচির।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।