বর্ষাকাল হলে কী হবে, গরম লাগছিল প্রচন্ড। কিভাবে এই জ্বালা থেকে মুক্তি পাই, সাজেশন চাওয়ায় বিল্লি তৎক্ষণাৎ বললো, তিব্বত গেলেই পারো।
আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম, "বলে কী! তিব্বত? যাওয়ার জোগাড় করতে করতেই তো ঘেমে নেয়ে মরে যাব!"
বিল্লি একটুও না দমে বললো, "সে মরতে পারো, কিন্তু একবার চেষ্টা চরিত্তির করে যদি পৌঁছে যাও তিব্বতে, দেখবে এ জীবনের মতো গরম উধাও হয়ে গেছে! তাপ্পর যতই যাও বীরভূম বা আফ্রিকা, গরম আর লাগবে না। এমনকি বরাত থাকলে পরের জন্মে গ্রিনল্যান্ডেও জন্ম হতে পারে।"
সকলে একজোটে আব্দার করে বসলো, "বল বল, তিব্বতের গল্প বল ভাই! শুনেই একটু বাতাস লাগাই গতরে।"
বিল্লি একেবারে এদিক ওদিক প্রচন্ড মাথা নেড়ে বললো, "তা হবে না। তিব্বতে একবার পৌঁছলে যে মজা, সে মুখে বলা যায় না। খুব শখ তো গিয়েই জেনে এসো!"
সবার মধ্যে বেশ একটা গুনগুন শুরু হলো। গুনগুন ক্রমেই গনগনে হয়ে উঠলো, এবং ব্যাগ গোছানোর আগেই তুমুল তর্ক। রাস্তাও নাকি ছিল সিধে, পথও সোয়া ঘন্টার, কিন্তু আদ্দেক লোক বেঁকে বসে বললো, "ইঃ! তিব্বত যাবে নাকি সোয়া ঘন্টায়! বিল্লির যেমন বুদ্ধি! নিশ্চয়ই চাঁদনির চিনেপট্টি থেকে ইঁদুর পাকড়ে এসে এখন এসব গপ্পো শোনাচ্ছে!"
বিল্লি একবার খুব আমতা আমতা করে মিনমিনিয়ে "আজ্ঞে তা হলেও হয়" না ওরকম কী একটা বললো, কিন্তু আমরা ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম বলে শুনতে পাই নি ভালো; আর বাকিরা তো রেগেমেগে এসি কিনতেই চলে গেল।
**
পথে নেমেই বেশ বুঝলাম, এক এক জনের যাওয়ার সাধ হয়েছে এক এক পথে। কেউ বললো প্লেনে যাবে, কেউ বললো "শিলিগুড়ি অব্দি বাসে যাই আগে, বাকিটা ভেবে দেখব", আরেক পার্টি বললো "ডুলি চেপে যাবো", কেউ বললো পালকি, কেউ ঘোড়া, কেউ গাধার পিঠে, কেউ গাধার পিঠে মাল চাপিয়ে নিজে গাধার পাশে পাশে, কেউ দু দণ্ড পরপর টোটো নেওয়ার কথা বলতে লাগলেন। কেবল আমরা কয়েকজন বললাম, নাহ, পায়ে হেঁটেই যাবো -- সে সোয়া ঘন্টাই হোক, কি তার বেশি লাগে, লাগুক!
**
শহরের রোজকার বাড়িঘর, বাজার দোকান যখন পাতলা হয়ে এল, তখন বুঝলাম, এ পথটায় আগে তো আসিনি! তেমন চেনা নয়। তবু, মনের ভিতর কে যেন বললো, এই পথেই তিব্বত পাবো।
পায়ের বেগে কখন পথ কেটে যায়, জানতে পারি না। হন্যে হয়ে তিব্বত খুঁজে চলি। এমন এক সময় চোখে পড়লো, সাইনবোর্ডে লেখা 'সুলভে তিব্বত এদিকে'। গিয়ে দেখি সে এক এলাহি ব্যাপার। তিব্বতী পানীয়ের ভান্ডারা বসেছে, শয়ে শয়ে লোক পিলপিল করে সেখানে গিয়ে গেলাস হাতে তুলছে আর খাচ্ছে। এদিক সেদিকে লেখা "ঘরের কাছেই তিব্বতী আরাম, হা রাম!"। আমাদের দলের দুজন সেই পানীয় খেয়ে কেবলমাত্র একবার "আঃ" বলে মাটিতে পতাকা পেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ওঠার আর নাম নেই। এগিয়ে চললাম আমরা।
পা টনটন করে, কিন্তু ফেরার পথ নেই। যে পথ দিয়ে একবার এসেছি, কয়েকবারই ফিরে দেখেছি, সেই পথ কোন ম্যাজিকে যেন মুছে গেছে। এখন যা আছে, শুধু সামনে। আর সামনে ওরা কারা আসছে? কয়েকটা অদ্ভুত দেখতে লোক এসে আচমকাই বলতে শুরু করলো -- "ধমাকা! ধমাকা! ধমাকা! কিছু কমও হবে না, কিছু বেশিও হবে না। ও বড়দা, ও ছোটভাই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? মাত্র ৫০ টাকা দক্ষিণায় আপনার নাবাল পেটে তিব্বতী তোতাপাখির ন্যাজের পালক দিয়ে ১০০ রাউন্ড সুড়সুড়ি! সস্তায় গরম থেকে ছুটকারা পান, এ তো তিব্বতেরই দান।"
বোধ হয় অনেকেরই মন সুড়সুড়ি-সুড়সুড়ি করছিল; দলে চল্লিশোর্ধ্ব যাদের ভুঁড়ি সবে জমে টাইট হয়েছে, তারা মুখ থেকে কথা না খসতেই জামা তুলে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন ষাট পেরোনো মানুষ খুব দুঃখ করে বললেন, "আমি তো বড়দাও নই, ছোটভাইও নই। কাকাতুল্য। আমিও কি আরাম পাবো?" চিমড়ে লোকগুলো তাকে খুব গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি স্কুলপাশ '৭৭-এর পর তো?" ভদ্রলোক খুব জোর দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, '৮১-র ডিসেম্বরে।" তখন লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কিসব বেশ আলোচনা করে অভয় দিয়ে বললো, "জ্যোতি বসুর আমলে তো। তাহলে হয়ে যাবে।"
তারপর বারুইপুর স্টেশন থেকে কেনা রংবেরঙের পালক দিয়ে লোকগুলো বিকট বেসুরে "ধাড়ি ঘুমোলো, বাড়ি জুড়োলো" গাইতে গাইতে ভুঁড়িসেবা করতে লাগল, আর ভুঁড়োরা আরামের "আ"টুকু বলে ঘুমিয়ে পড়লো। আমরা কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলাম।
হেঁটে হেঁটে পা বলে আর কিছু নেই মনে হচ্ছে, সবে ভাবছি প্রাণপাত না করে প্রাইম ডে-তে এসি কিনে নিলেই কাজের কাজ হতো কিনা; এখন আশপাশটা আদৌ ঠান্ডা না গরম কিস্যু বোধ হচ্ছে না, এমন সময় দেখি, ওই তো দূরে, ওই যে -- তিব্বত! আহা, সাধের তিব্বত! সোয়া ঘন্টা লাগল কি? চুলোয় যাক ঘড়ি, ঘন্টা! আহা, তিব্বতে এসে পৌঁছেছি সবার আগে! কিন্তু ওটা -- ওটা কে -- না ভুল দেখছি না, ওই তো, তিব্বতে দাঁড়িয়ে আছে বিল্লি! আমাদের আগেই এসে গেছে, কাদের সঙ্গে জানি কথা বলছে ... কাছে যেতেই দেখি, ইইইইকস্! এবিপি আনন্দ যে!
**
আমাদের দেখে একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এল বিল্লি, "কী হে, কমলো গরম?" এবিপি আনন্দও একই প্রশ্ন করলো বটে, তবে তাদের সময় বেশি লাগল অবশ্য, "কিন্তু আপনারা কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা সাচ্চল্লিশ মিনিটেই এসে গেছেন কিন্তু! কেমন লাগছে?"
আনন্দকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সোজা বিল্লিকে চেপে ধরলাম, "গরম? গরম? হাত পা খুলে যাচ্ছে, শরীর আছে বলেই বুঝছি না, তার আবার গরম কী রে হারামজাদা? দিব্যি বসেছিলাম বাড়িতে, জ্বালিয়ে মারলো!"
বিল্লি মিচকি হেসে বললো, "ওইটাই তো! তিব্বত এসে গরম না লাগার চাইতে, বাড়িতে বসে গরম লাগাও যে ভালো, সেটা বাড়িতে বসে কেমন করে বুঝতে, বলো?"
পাশ থেকে এবিপি আনন্দ নিচু গলায় বিল্লিকে বললো, "কোট-টা একটু শর্টের ওপর দেবেন? এতবড়টা নিউজ ফ্ল্যাশে ধরানো যাবে না আসলে..."
(ঋণ: সুকুমার রায়)
দারুন লাগল।
ধন্যবাদ, রমিত বাবু। আপনার মতামত পেয়ে ভাল লাগল। :)
খুদা কী কসম, মজা আ গয়া।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, রঞ্জন বাবু।
দারুণ
ধন্যবাদ, নির্মাল্য বাবু।