এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বিল্লি

    শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৭ জুলাই ২০২১ | ২২৫৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)

  • বর্ষাকাল হলে কী হবে, গরম লাগছিল প্রচন্ড। কিভাবে এই জ্বালা থেকে মুক্তি পাই, সাজেশন চাওয়ায় বিল্লি তৎক্ষণাৎ বললো, তিব্বত গেলেই পারো।


    আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম, "বলে কী! তিব্বত? যাওয়ার জোগাড় করতে করতেই তো ঘেমে নেয়ে মরে যাব!"


    বিল্লি একটুও না দমে বললো, "সে মরতে পারো, কিন্তু একবার চেষ্টা চরিত্তির করে যদি পৌঁছে যাও তিব্বতে, দেখবে এ জীবনের মতো গরম উধাও হয়ে গেছে! তাপ্পর যতই যাও বীরভূম বা আফ্রিকা, গরম আর লাগবে না। এমনকি বরাত থাকলে পরের জন্মে গ্রিনল্যান্ডেও জন্ম হতে পারে।"


    সকলে একজোটে আব্দার করে বসলো, "বল বল, তিব্বতের গল্প বল ভাই! শুনেই একটু বাতাস লাগাই গতরে।"


    বিল্লি একেবারে এদিক ওদিক প্রচন্ড মাথা নেড়ে বললো, "তা হবে না। তিব্বতে একবার পৌঁছলে যে মজা, সে মুখে বলা যায় না। খুব শখ তো গিয়েই জেনে এসো!"


    সবার মধ্যে বেশ একটা গুনগুন শুরু হলো। গুনগুন ক্রমেই গনগনে হয়ে উঠলো, এবং ব্যাগ গোছানোর আগেই তুমুল তর্ক। রাস্তাও নাকি ছিল সিধে, পথও সোয়া ঘন্টার, কিন্তু আদ্দেক লোক বেঁকে বসে বললো, "ইঃ! তিব্বত যাবে নাকি সোয়া ঘন্টায়! বিল্লির যেমন বুদ্ধি! নিশ্চয়ই চাঁদনির চিনেপট্টি থেকে ইঁদুর পাকড়ে এসে এখন এসব গপ্পো শোনাচ্ছে!" 


    বিল্লি একবার খুব আমতা আমতা করে মিনমিনিয়ে "আজ্ঞে তা হলেও হয়" না ওরকম কী একটা বললো, কিন্তু আমরা ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম বলে শুনতে পাই নি ভালো; আর বাকিরা তো রেগেমেগে এসি কিনতেই চলে গেল।


                                           **


    পথে নেমেই বেশ বুঝলাম, এক এক জনের যাওয়ার সাধ হয়েছে এক এক পথে। কেউ বললো প্লেনে যাবে, কেউ বললো "শিলিগুড়ি অব্দি বাসে যাই আগে, বাকিটা ভেবে দেখব", আরেক পার্টি বললো "ডুলি চেপে যাবো", কেউ বললো পালকি, কেউ ঘোড়া, কেউ গাধার পিঠে, কেউ গাধার পিঠে মাল চাপিয়ে নিজে গাধার পাশে পাশে, কেউ দু দণ্ড পরপর টোটো নেওয়ার কথা বলতে লাগলেন। কেবল আমরা কয়েকজন বললাম, নাহ, পায়ে হেঁটেই যাবো -- সে সোয়া ঘন্টাই হোক, কি তার বেশি লাগে, লাগুক!


                                           **


    শহরের রোজকার বাড়িঘর, বাজার দোকান যখন পাতলা হয়ে এল, তখন বুঝলাম, এ পথটায় আগে তো আসিনি! তেমন চেনা নয়। তবু, মনের ভিতর কে যেন বললো, এই পথেই তিব্বত পাবো। 


    পায়ের বেগে কখন পথ কেটে যায়, জানতে পারি না। হন্যে হয়ে তিব্বত খুঁজে চলি। এমন এক সময় চোখে পড়লো, সাইনবোর্ডে লেখা 'সুলভে তিব্বত এদিকে'। গিয়ে দেখি সে এক এলাহি ব্যাপার। তিব্বতী পানীয়ের ভান্ডারা বসেছে, শয়ে শয়ে লোক পিলপিল করে সেখানে গিয়ে গেলাস হাতে তুলছে আর খাচ্ছে। এদিক সেদিকে লেখা "ঘরের কাছেই তিব্বতী আরাম, হা রাম!"। আমাদের দলের দুজন সেই পানীয় খেয়ে কেবলমাত্র একবার "আঃ" বলে মাটিতে পতাকা পেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ওঠার আর নাম নেই। এগিয়ে চললাম আমরা।


    পা টনটন করে, কিন্তু ফেরার পথ নেই। যে পথ দিয়ে একবার এসেছি, কয়েকবারই ফিরে দেখেছি, সেই পথ কোন ম্যাজিকে যেন মুছে গেছে। এখন যা আছে, শুধু সামনে। আর সামনে ওরা কারা আসছে? কয়েকটা অদ্ভুত দেখতে লোক এসে আচমকাই বলতে শুরু করলো -- "ধমাকা! ধমাকা! ধমাকা! কিছু কমও হবে না, কিছু বেশিও হবে না। ও বড়দা, ও ছোটভাই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? মাত্র ৫০ টাকা দক্ষিণায় আপনার নাবাল পেটে তিব্বতী তোতাপাখির ন্যাজের পালক দিয়ে ১০০ রাউন্ড সুড়সুড়ি! সস্তায় গরম থেকে ছুটকারা পান, এ তো তিব্বতেরই দান।"


    বোধ হয় অনেকেরই মন সুড়সুড়ি-সুড়সুড়ি করছিল; দলে চল্লিশোর্ধ্ব যাদের ভুঁড়ি সবে জমে টাইট হয়েছে, তারা মুখ থেকে কথা না খসতেই জামা তুলে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন ষাট পেরোনো মানুষ খুব দুঃখ করে বললেন, "আমি তো বড়দাও নই, ছোটভাইও নই। কাকাতুল্য। আমিও কি আরাম পাবো?" চিমড়ে লোকগুলো তাকে খুব গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি স্কুলপাশ '৭৭-এর পর তো?" ভদ্রলোক খুব জোর দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, '৮১-র ডিসেম্বরে।" তখন লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কিসব বেশ আলোচনা করে অভয় দিয়ে বললো, "জ্যোতি বসুর আমলে তো। তাহলে হয়ে যাবে।" 


    তারপর বারুইপুর স্টেশন থেকে কেনা রংবেরঙের পালক দিয়ে লোকগুলো বিকট বেসুরে "ধাড়ি ঘুমোলো, বাড়ি জুড়োলো" গাইতে গাইতে ভুঁড়িসেবা করতে লাগল, আর ভুঁড়োরা আরামের "আ"টুকু বলে ঘুমিয়ে পড়লো। আমরা কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলাম।


    হেঁটে হেঁটে পা বলে আর কিছু নেই মনে হচ্ছে, সবে ভাবছি প্রাণপাত না করে প্রাইম ডে-তে এসি কিনে নিলেই কাজের কাজ হতো কিনা; এখন আশপাশটা আদৌ ঠান্ডা না গরম কিস্যু বোধ হচ্ছে না, এমন সময় দেখি, ওই তো দূরে, ওই যে -- তিব্বত! আহা, সাধের তিব্বত! সোয়া ঘন্টা লাগল কি? চুলোয় যাক ঘড়ি, ঘন্টা! আহা, তিব্বতে এসে পৌঁছেছি সবার আগে! কিন্তু ওটা -- ওটা কে -- না ভুল দেখছি না, ওই তো, তিব্বতে দাঁড়িয়ে আছে বিল্লি! আমাদের আগেই এসে গেছে, কাদের সঙ্গে জানি কথা বলছে ... কাছে যেতেই দেখি, ইইইইকস্! এবিপি আনন্দ যে! 


                                          **


    আমাদের দেখে একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এল বিল্লি, "কী হে, কমলো গরম?" এবিপি আনন্দও একই প্রশ্ন করলো বটে, তবে তাদের সময় বেশি লাগল অবশ্য, "কিন্তু আপনারা কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা সাচ্চল্লিশ মিনিটেই এসে গেছেন কিন্তু! কেমন লাগছে?"


    আনন্দকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সোজা বিল্লিকে চেপে ধরলাম, "গরম? গরম? হাত পা খুলে যাচ্ছে, শরীর আছে বলেই বুঝছি না, তার আবার গরম কী রে হারামজাদা? দিব্যি বসেছিলাম বাড়িতে, জ্বালিয়ে মারলো!"


    বিল্লি মিচকি হেসে বললো, "ওইটাই তো! তিব্বত এসে গরম না লাগার চাইতে, বাড়িতে বসে গরম লাগাও যে ভালো, সেটা বাড়িতে বসে কেমন করে বুঝতে, বলো?"


    পাশ থেকে এবিপি আনন্দ নিচু গলায় বিল্লিকে বললো, "কোট-টা একটু শর্টের ওপর দেবেন? এতবড়টা নিউজ ফ্ল্যাশে ধরানো যাবে না আসলে..."


    (ঋণ: সুকুমার রায়)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৭ জুলাই ২০২১ | ২২৫৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর-১ - Ranjan Roy
    আরও পড়ুন
    ইঁদুর-১ - Ranjan Roy
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত | 202.8.***.*** | ২৯ জুলাই ২০২১ ১০:০১496179
  • দারুন লাগল।

  • Ranjan Roy | ২৯ জুলাই ২০২১ ২৩:২৫496195
  • খুদা কী কসম, মজা আ গয়া।

  • Nirmalya Nag | ৩১ জুলাই ২০২১ ১৩:৩৯496246
  • দারুণ 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন