বেসরকারী হলে পরিষেবা ভালো হবে আর কর্পোরেটের স্ট্রেসগরিমা ইত্যাদি ভাষ্যের অন্তরালে প্রকৃত ভারতবর্ষের মানব সম্পদের পরিচর্যায় সরকারী ব্যবস্থার অবদানকে ভুলতে থাকার কারন বিবিধ; সরকারের নিজের দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলার ইচ্ছা, সর্বগ্রাসী মুনাফাপিপাসা, জনগণের সঙ্গত ক্ষোভ - এইসব অনেক কিছুই তার মধ্যে থাকা সম্ভব। তার পরেও, যেসব জায়গায় পৌঁছে যাওয়া পুঁজির কাছে লাভজনক নয়, সেসব জায়গায় পৌঁছনোর দায় রাষ্ট্রযন্ত্রের। সেই যন্ত্রকে সচল রাখার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রতিকূল পথে চলতে গেলে শুধু চাকরীর দায়ের বাইরেও, মানুষের প্রতি পারস্পরিক মমতা এক আবশ্যিক উপাদান হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারী বা অলাভজনক সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে রাখা আমাদের অভিপ্রায়। প্রথম পর্বে থাকছে সত্তরের দশকের ত্রিপুরায় কর্মরত সমাজ কল্যাণ দপ্তরের আধিকারিক জয়া বর্মনের অভিজ্ঞ্তা। আপনিও আপনার অভিজ্ঞ্তা নিয়ে লিখুন খেরোর খাতা অথবা হরিদাস পাল বিভাগে, কিংবা সম্পাদকীয় বিবেচনার জন্যে ইমেল করুন guruchandali@gmail.com ঠিকানায়। কর্মরত অবস্থায় অনেক কথা বলা যায় না, সেসবও আসুক এই বিভাগে।
গভীর অরণ্য নয়, কিন্তু ঘন জঙ্গল। পথ বলতে কিছু নেই, তাই সঙ্গী, পথপ্রদর্শক কুড়ি বাইশ বছরের এক স্থানীয় যুবক। হাতে তার টাক্কল - প্রয়োজনে দু'ধারের জঙ্গল সাফ করছে।
১৯৭৫/৭৬-এর ত্রিপুরা। যাব শাখানটাং পাহাড়ের পাদদেশে জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামে। তখন সবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মসূচি শুরু হয়েছে। মাছলির অনীতা আচার্য ঐ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কাজ করে, ওখানেই থাকে। যাব বলছি, কিন্তু যাওয়া তো অত সহজ নয়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকটি ছড়া পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যেতে হবে। কত কিলোমিটার হাঁটতে হবে সে আমি ভুলে গেছি, তবে ঘণ্টা তিনেকের হাঁটা পথ। আর ঐ পথ ধরে একা যাওয়া সম্ভব নয়, স্থানীয় সাথী খুঁজতে হয়। নতুন কোন জায়গায় যেতে হলে কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিতে হতো। আজ যেমন নিয়েছি। এ বাবদ তাকে পাঁচ টাকা দিতে হবে, ওর সারা দিনের রোজগার।
গতকাল এসে লাল ছড়া এম টি কলোনিতে ঝর্ণার ওখানে ছিলাম। আজ ভোর ভোর রওনা দিয়েছি। নির্জন পথ, পাখির কলকাকলি আর বুনো ফুলের সৌরভ বিভোর করে দেয়, বাইরের বিশ্ব চরাচর কিচ্ছু মনে থাকে না। মনে হয় এই নিবিড় অরণ্য, এই পাখির ডাক এসবই যুগযুগান্ত ধরে ঘিরে আছে এই ধরণীকে, আর কোথাও কিছু নেই, অনন্ত শূন্য।
'আর যাইত না' হঠাৎ এই নিশ্ছিদ্র নীরবতা ভঙ্গ করে আমার সঙ্গী বল ওঠে। যাইত না মানে, আমি অবাক হয়ে বলি। সে আবার বলে আর যাইত না, এবার সে ফিরতে উদ্যত। খুব রাগ হয় আমার। যাইত না কেন, গতকাল তো চৌধুরীর সামনে কথা হলো, তিনিই তো ঠিক করে দিলেন, এখন এতটা পথ এসে তুমি বলছো যাবে না। এ কেমন কথা! এবার সে খুব রেগে গিয়ে আমাকে বললো, 'তুমি যাও'। আমি তো যাবই, কিন্তু কি করে, আমি তো রাস্তা চিনি না।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা, বচসার পর যেটা বোঝা গেল, তা হলো এই যে রাস্তায় বন্য হাতি নেমেছে, এই রাস্তায় এখন আর যাওয়া যাবে না। ততক্ষণে আমিও গাছপালা ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাই সে দিন ফিরে আসতে হলো। ফিরে এসে ঝর্ণার ওখানে বসে চা খেতে খেতে ওর হাতে যখন পাঁচটা টাকা দিলাম, সে তো অবাক। কাজ না করেই টাকা, সে নেবে না। ঝর্ণা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাল, তুমি আজ নিয়ে যেতে পারনি এটা যেমন ঠিক, তেমনি এই বেলায় তোমার আর কোন কাজ জুটবে না তাও তো ঠিক। তখন ত্রিপুরার গ্রাম পাহাড়ে কী প্রচণ্ড খাদ্যাভাব তা যারা চাক্ষুষ করেনি তাদের পক্ষে বোঝা কঠিন। আর এমনই ছিলো আমাদের গ্রাম ত্রিপুরার পাহাড়ি বাঙালি সব মানুষেরা, সহজ সরল আর ইমানদার। কাজ সম্পূর্ণ না করে সে পারিশ্রমিক নেয় কী করে!
যাই হোক, পরদিন আবার যাবার পালা। ছোটো ছোটো চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পথ চলেছি। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট ছড়া, তির তির করে বয়ে চলেছে। এত ফুটফুটে পরিষ্কার জল, নীচের বালি চিক চিক করছে, এই টুকুন টুকুন মাছগুলি খেলা করছে। বেলে, পুঁটি আরো কত কী, বৈচা মাছকে ভালো কথায় কি বলে জানি না, তবে সেটি যখন তুড়ুক তুড়ুক নাচছিল রামধনুর সাত রঙ ঝিলিক দিয়ে উঠছিল।
তখন আমাদের একটা সমস্যা ছিলো, বেশ কিছুদিন জমিয়ে ইস্কুল করার পর একদিন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এসে কাঁদো কাঁদো মুখে বলতো, দিদিমনি আমার এখানে বাচ্চা কমে গেছে। কেন, বাচ্চা আবার কমে কী করে? ও বলে দিদিমণি, এখান থেকে ছয়টা পরিবার ফুরুং করেছে। ওরা ফুরুং করেছে তো তোমার কী। অঙ্গনওয়াড়ি তখন বুঝিয়ে বলে, ফুরুং করেছে মানে চলে গেছে। কেন? হয়তো এখানে ওরা আর জুম করতে পারছে না বা আয় রোজগারের কোন পথ করতে পারছে না, তাই ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়ে ঐ দূরের টিলায় নতুন ঘর বানিয়েছে।
এমন তখন প্রায়ই হতো। আর ওরা এতদূর থেকে সেন্টারে আসতে পারতো না। কখনো বা মায়েরা চলে আসতো, বৃষ্টি বাদলার দিনে বা চৈত্র মাসে প্রচণ্ড খরার সময়, পাহাড়ে জলেরও খুব অভাব হতো। হেল্পার বোনেরা মাথায় কলসি পিঠে খারাংয়ের মধ্যেও কলসি বা অন্য কিছু বসিয়ে হাতে লোহার বালতি করে জল আনতো। দুটো মাটির কলসি আর লোহার বালতি নিয়ে কত দূর দূর থেকে ওরা জল এনে সেন্টারের বাচ্চাদের জন্য রান্না করতো, বেতন ছিল পঞ্চাশ টাকা। তো সেন্টারের দিদিমনি বলতো, পাহাড়ে ভীষণ অভাব চলছে দুদিন তিনদিন উপোস চলছে। তাই বেশি করে রান্না করে ওদেরও দিয়ে দিয়েছি, ওদেরই তো প্রাপ্য ছিল। মাঝে মাঝে তখন ব্লক অফিসে ধর্না হত। মায়েরাও আসতেন পিঠে নিজের শিশুটিকে বেঁধে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে হয়তো বা খরা ত্রাণ মিলতো একটু, কখনো মিলতো না আবার হেঁটে হেঁটে অতটা পথ পাড়ি দেওয়া। এই ত্রিপুরাকে কতজন দেখেছি? মনে আছে দল বেঁধে নেমে আসছে পাহাড় থেকে, কালো ফুটকির মত, ধীরে ধীরে ওদের জীর্ণ শীর্ণ অবয়ব স্পষ্ট হচ্ছে।
তারপর দু'টি স্বল্প মেয়াদের সরকার শেষে বামফ্রন্ট সরকার এসে ফুড ফর ওয়ার্ক, কাজের বিনিময়ে খাদ্য চালু করার পর গ্রাম পাহাড়ে একটু হাসি ফুটলো ।
অনীতার ওখানে অবশ্য সমস্যা ফুরুং হওয়ার নয়। যা হোক আমি আর সেই পাহাড়ি ছেলেটি আটটার মধ্যে ওখানে পৌঁছে গেছি। অনীতা হাসি মুখে বেরিয়ে এল সেন্টার থেকে। একটু একটু ককবরক শিখে গেছে সে, বাচ্চাদের কী বললো, বাচ্চারা উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললো খুলুমকা, তার পর আধো আধো বুলিতে ছড়া বলার পালা। বলতে তো চায় না খুব লজ্জা, দিদিমনি বারবার বলার পর কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে। পরে জানলাম দিদিমনি বেতন আনতে ছৈলেংটা গেলে লেবেনচুস এনে দেবার কড়ারে আমার ছড়া শোনার সৌভাগ্য হলো।
এক ফাঁকে অনীতা চা-টা খাইয়ে অতিথি সত্কার সারলো। কিন্তু যার জন্য আসা, তাঁর সঙ্গে তো দেখা হলো না এখনো। গ্রামের যিনি মূল মানুষটি, চৌধুরী, তিনি এলেন বেশ পরে। গ্রামের কল্যাণে সবাই মিলে পূজা হচ্ছে, পাঁঠাবলি হয়েছে, সবাইকে বলির মাংস ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়ে তবে তিনি আসতে পেরেছেন। তার প্রথম কথা, ভাইজার তুমার খাইয়া যাওন লাগব। খিদেও চনমন করে উঠেছে সুতরাং আপত্তির কোন কারণ নেই।
অনেক সময় ধরে কথা বলতে হলো। এখানে সেন্টারের জন্য অফিস থেকে যেসব খাবার দাবার দেওয়া হয় তা সেন্টারে পৌঁছায় না। প্রথমেই যারা এসব বয়ে এনেছে তাদের নিয়ে, গ্রামের সব পরিবারের মধ্যে বিলি করে দেন চৌধুরী । এটা যে শিশু ও মায়েদের খাবার একথা তিনি মানতে নারাজ। শেষে এগিয়ে আসে অনীতা। ও জানায় কিছুদিন আগে গ্রামের একজন সন্তানসম্ভবা মা মারা গেছেন, ডাক্তার বাবু বলেছেন তার শরীরে রক্ত খুব কম ছিল। তখন অনেক করে আই সি ডি এস প্রকল্প, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু কথা বললাম। শুনে চৌধুরী খুব আফসোস করতে লাগলেন, ভুল হয়ে গেছে তার, আর হবে না। ধরা পড়ে গেলে শিশুর যেমন হয় এমনই সরল হাসিমাখা মুখে বারবার বলছিলেন ভাইজার, (সুপারভাইজারকে ওরা বলতো ভাইজার) তুমি আগে কইছনা কেরে।
মিটিং সেরে অনীতা রান্না করতে গেল, ভালো মন্দ কিছু হলে এখন অনীতাকেই রান্না করতে হয়, বাড়ির সবার পছন্দ। খাওয়া দাওয়া করতে করতে বেশ দেরি হলো, আর তখনই চার দিক অন্ধকার করে ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি। কী বৃষ্টি বাবা! চৌধুরীর বাড়ির ওপরের পাহাড় থেকে মুষলধারায় নেমে আসছিল। পাশের ছড়াটি ঘোলাজলে ফুলেফেঁপে উঠেছে, গর্জন শোনা যাচ্ছে। বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল কোন দূর গ্রহে চলে গেছি। চৌধুরী বলছিলেন, ভাইজার আজকে ঘুমাইয়া যাও, ছড়া সব জলে ভরে গেছে, জল না কমলে পার হওয়া মুশকিল। হঠাৎ আমার মনে হলো অনীতা কোথায় থাকে তা তো জানলাম না। জিজ্ঞেস করতে অনীতা ওর বিছানাখানা দেখিয়ে দিল। ওমা একী, এটাতো চৌধুরীর বাড়ি। দেখো এই মাইয়াটার লাইগ্যা ঐ ঘরটা তুলছিলাম। কিন্তু আমার মেয়েকে একা ওখানে শুতে পাঠাই কী করে। তাই এই মাচাতে আমরা দুজন থাকি, ওপাশে মাচায় আমার ছেলে ছেলের বৌ, মাঝখানের মাচায় মেয়ে---বলছিলেন চৌধুরী। না চৌধুরী নয়, পাহাড়ে খোদাই করা গামছা পরা এক স্নেহময় পিতা। অনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, আহ্লাদে ডগমগ, বাড়ির ছোটো মেয়েটি রাত হলে ঘুমিয়ে পড়ে বাবা মায়ের কোল ঘেঁষে। অনীতা যেদিন প্রথম গিয়েছিল ওখানে, সঙ্গে ওর বাবা আরো কেউ। ওর বাবা বলছিলেন বনবাসে দিয়ে এসেছি মেয়েকে, কী করে থাকবে একজনও বাঙালির মুখ না দেখে। ভাবছিলাম কী করে আছে। এখন অনীতা মাসে একবার বাড়ি যায় বেতন পেয়ে, ফেরার দিন ওরাই এসে নিয়ে যায় ছৈলেংটা থেকে।
সেদিন ফিরতে বেলা শেষ হয়ে গেল, ঐ জনপদের বেশ কয়েকজন অনেক দূর অবধি এলেন এগিয়ে দিতে, রাস্তায় বিপদের সম্ভাবনা আছে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসা বৃষ্টি ভেজা জঙ্গলে।
কোন কিছু ঘটেনি, আমি তো ছিলাম ঘোরের মাঝে, বর্মনটিলার বাড়ি থেকে কোথাও যাবার সময়ে যেমন হয়, মা জেঠিমা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, গলার কাছে কেমন জমাট বাঁধা কান্না।
নতুন অভিজ্ঞতা ... নতুন দেশের কথা !!ভালো লাগছে আবার দুঃখ হচ্ছে এই জেনে যে এমন একটা জায়গা আমাদের তথাকথিত এই গণতান্ত্রিক দেশে আছে ??১৯৭৫ - ৭৬ তো ? নতুন ভারতের নাবালকত্ব শেষ , ইন্দিরা গান্ধী ছড়ি ঘোরাচ্ছেন উন্নয়নের সবুজ বিপ্লবের ।...কিন্তু ওই প্রান্তিক লোক গুলোর কথা কেউ ভাবে নি !!রাজনীতি তে মত্ত ছিলেন সচিন সুখময় , প্রফুল্ল রা ।..নৃপেন বাবু দশরথ বাবু রা কি বা করলেন তাদের কমরেড দের জন্য ??কেউ কিচ্ছু করেনি !!!ভালো লাগছে পড়তে !!ধন্যবাদ !!
জয়া বর্মন এর মতো সরকারি কর্মচারিদের দেখা শুধু ত্রিপুরা নয় দেশের প্রত্যন্তে প্রত্যন্তে আছেন।সবজান্তা কিছু এলিট জয়াবর্মনদের খবর ও রাখেন না বন পাহাড়ের সরল সেই মানুষদের ও চেনেন না। এরকম একটা সিরিজের তাই প্রয়োজন আছে