বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা মানে আমাদের প্রজন্মের কাছে একপ্রকার বিড়ম্বনা। আমাদের জন্মই হয়েছে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর। “শেখ মুজিব- হ্যাঁ এই নামেই উনাকে সম্বোধন করেন আমার বাবা। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে আমরা দেখি নি। কিন্তু বাবা কাকাদের কাছ থেকে শোনা কথাগুলোতে যেন আমরা আজো বেঁচে আছি নস্টালজিয়া নিয়ে। আমি আগরতলায় থাকি। জন্ম-কর্ম সব এখানেই। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো আমাদের কাছে বিদেশ নয়, জাস্ট ওপার। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নয়, আমার দেশের ওপারের।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ত্রিপুরা ভৌগলিকভাবে ছিল খুব গুরুত্বপুর্ন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বৃহত্তর স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ৬০ ভাগ অংশ চলে যায় পুর্ব পাকিস্তানে। এরপর ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী ত্রিপুরাকে ভারতভুক্তি করেন। ফলে ভৌগলিকভাবে ত্রিপুরার তিনদিকে বাংলাদেশ ও একদিকে আসাম-মিজোরাম সহ অভিবক্ত ভারত। ফলে ত্রিপুরার আত্মকিতা ও আন্তরিকতা বাংলাদেশের সাথেই গড়ে ওঠে। দুই দেশ হলেও ভাষা ও সংস্কৃতি এক হওয়ায় কোনও অসুবিধা হয় নি যদিও দেশভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে হাজার হাজার উদ্বাস্তু ছোট্ট এই ত্রিপুরায় প্রবেশ করে। কিন্তু তাদের শেকড় থেকে যায় সেই বাংলাদেশ বা অধুনা পুর্ব পাকিস্তনে। ১৯৭১ সালে ত্রিপুরায় মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে পনের লক্ষ। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল তখন বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তের লক্ষ। স্থায়ী জনসংখ্যার প্রায় সমান। এই সংখ্যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আরও বেড়েছে, স্বভাবতই রাজ্যের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় এর একটা চাপ সৃষ্টি হয়। তবু ত্রিপুরাবাসী সমাদরেই এদেরকে গ্রণ করে তাদের আপন করে নেয়। নেপথ্যে কিন্তু সেই ধানমান্ডি ৩২ নম্বরের বাসিন্দা, আমাদের শেখ মুজিব।
শুধু ভাষা নয়, যখনই বাংলাদেশের প্রয়োজন হয়েছে, ভাইয়ের মত ঝাপিয়ে পড়েছে ত্রিপুরা। অভিবক্ত বাংলার রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন সাঁই থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত কিছুই ধারন করছে ত্রিপুরা। উপজাতি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় এই বিশাল সংখ্যক শরনার্থীকে নিজের ভাইয়ের মত আগলে নিজের ঘরে রেখেছে। লাখো মুক্তিযোদ্ধার ভরসার আশ্রয়স্থল ছিল এই ত্রিপুরা। ইতিহাসের সোনালি পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে বাংলাদেশ-ত্রিপুরার মৈত্রী, বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্ক। আর এই সুসম্পর্কের প্রধান কান্ডারী শেখ মুজিব। যার দিকে তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশের সাথে সারা ত্রিপুরা। অনাহারে অর্ধাহারে থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে লড়েছিল ত্রিপুরা, ওই একজন লোকের দিকেই তাকিয়ে। দাঁতে দাঁত নিয়ে লড়ে ২ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সরকার গঠনের অনেক আগেই পাকিস্তানী বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার প্রতিবাদে ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার দাবিতে সারা ত্রিপুরায় স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ পালিত হয়। ত্রিপুরায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল ত্রিপুরা, যা ভারতের ইতিহাসেও আরেক গৌরবের অধ্যায়। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের “হিস্ট্রি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া”য় তিনি লিখেছেন, “ত্রিপুরার রাজাদের অনুগত প্রজা বা সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ি এলাকা বিলোনিয়া ও উদয়পুরে দুটো খামার ছিল। সেগুলো দৃশ্যত কৃষি খামার হলেও মূলত তা ছিল প্রশিক্ষণ শিবির। দিনের বেলায় সমিতির সদস্যরা মাঠে কাজ করতো; কিন্তু রাতের বেলা তাঁদের বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এবং নিকটবর্তী পাহাড়ে গিয়ে তারা গোলাগুলির মহড়া দিত।” অনেক বিপ্লবী ও সংগ্রামী পশ্চিম পাকিস্তানের মৃত্যু হুলিয়া মাথায় নিয়ে নিরাপদে ত্রিপুরায় আশ্রয় লাভ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের প্রানের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করার সংকল্প নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে মোট ১১ টি যুদ্ধ সেক্টরের মধ্যে ৫ টি যুদ্ধ সেক্টর গড়ে ওঠে এই ত্রিপুরার সীমান্ত বরাবর।
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মানো শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিবকে নিয়ে ত্রিপুরায় আগ্রহের অন্ত নেই। ব্রিটিশ ভারতে তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছিল উল্লেখযোগ্য।ছাত্রজীবন থেকেই তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা চোখে পড়ে। সে ১৯৩৯ সালে মিশনারী স্কুলে পড়ার সময় তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর কাছে স্কুলের সংস্কারের দাবীই হোক বা ১৯৪০ সালে নিখিল ভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেওয়া- রাজনীতির হাতেখড়ি হয়ে যায় ছাত্রজীবনেই। ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগদান করে মূলধারার রাজনীতিতে নেমে পড়েন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় শেখ মুজিব কোলকাতা (অধুনা কলকাতা) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময়ে কোলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় শেখ মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন এবং তাদের রক্ষায় তৎপর হন। দেশভাগের পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা চলতেই থাকে। এরপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসের ৪ তারিখ প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। এই লীগের মাধ্যমে শেখ মুজিব পুর্ব পাকিস্তানের অন্যতম এক ছাত্রনেতায় পরিনত হন। কিন্তু এর পর তার রাজনৈতিক মনোভাবে একপ্রকার পরিবর্তন আসে। তৎকালীন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তার রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ব্যপক পরিবর্তন আনে। এক সময় তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান ও নিম্নমানের জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য সমাজতন্ত্রকে বিকল্প সমাধান হিসেবে মানতে শুরু করেন।
ফিরে আসি বর্তমানে। আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজও অমলিন শেখ মুজিবের মনোভাব। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে তার কঠোর ও অনমনীয় পদক্ষেপ ভূভারত সহ সারা বিশ্বে সমাদৃত। তার কার্যশৈলী, কর্মদক্ষতা এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা সারা বিশ্বে এক বিশেষ স্থান ধারন করেছে। তাইতো বাংলাদেশ গেলে ধানমান্ডির সেই বাড়িটির দিকে নিস্পলক ভাবে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি এই সেই বাড়ী যেখানে এক ব্যাঘ্রহৃদয় বাঙ্গালী বসবাস করতেন। আর আগরতলা আমার অফিসে যাওয়ার সময় প্রনাম করে যাই পুর্বতন আগরতলা কেন্দ্রীয় কারাগারকে যেখানে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী ছিলেন বাঙ্গালীর সেরা সন্তান; আমাদের আপন “শেখ মুজিব”।
"১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বৃহত্তর স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ৬০ ভাগ অংশ চলে যায় পুর্ব পাকিস্তানে। এরপর ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী ত্রিপুরাকে ভারতভুক্তি করেন। "
এখানে একটু ব্যাখ্যা করবেন? হতে পারে আমার জ্ঞান কম। রিটিশ আমলের টিপেরা বা ত্রিপুরা জেলা আজকের বাংলাদেশের কুমিল্লা নয়? আর যাকে ভারতের ত্রিপুরা বলে জানি, তাকে পার্বত্য ত্রিপুরা (হিল টিপেরা ) বলা হত, না কি? স্বাধীনতার আগের ত্রিপুরা রাজ্য কি এই দুটো নিয়েই গঠিত ছিলো?
আপনার কথা ঠিক, স্বাধীনতার আগে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাকলা রোশনাবাদ, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালীর কিছু অংশ৷ নিয়েই ছিল বৃহত্তর ত্রিপুরা। আজকের অংশ ছিল পার্বত্য ত্রিপুরা।