এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  সমাজ

  • প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিবন্ধকতা আসলে কোথায়?

    Dr. Bubai Bag লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সমাজ | ০২ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৩১৯ বার পঠিত
  • কন্ডাকটর দুটি ক্রাচকে লক্ষ করে সাবলীল প্রশ্ন “কোথায় যাবি?”
    আমি: যাদবপুর! কিছুক্ষণ পরে বললাম, দাদা ভাড়াটা নেবেন,
    কন্ডাকটর : কেন তোর কার্ড (প্রতিবন্ধী পরিচয় পত্র) নেই?
    আমি: (বেশ গর্বের সঙ্গে), ‘আছে তো’! হাজার হলেও আরও একটি পরিচয়ে’র (identity) প্রকাশ করে তো। তবে দাদা, আমি ভাড়া দিয়েই যাতায়াত করি’।
    কন্ডাকটর: (কিছুটা করুণাবশত), নানা তোর ভাড়া লাগবে না।
    আমি: (নাছোড়বান্দা হয়ে) হয় ভাড়া নিন, না হলে নামিয়ে দিন।
    কন্ডাকটর: (কিছুটা ইতস্তত হয়ে) ভাড়া নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কি করা হয়?
    আমি: ‘পড়ায়’।
    কন্ডাকটর: কোথায়???
    আমি: কলেজে।

    আপনি কলেজে পড়ান? - কথাগুলি শোনার মিনিট দু’য়েকের মধ্যে লোকটির মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখলাম, যা সাময়িকভাবে নিজেকে স্বস্তি দিল, এই ভেবে যে, ‘আর হয়ত! লোকটি আমাকে তুই সম্বোধন করে কথা বলবে না!’ - এই ধরনের অভিজ্ঞতা তথাকথিত শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের কাছে একেবারেই অচেনা বা অজানা নয়। যে উত্তরগুলো আজও জানি না তা হল প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতি এই ধরণের আচরণ বা মনোভঙ্গি আর কতদিন চলতে পারে বা থাকবে? ঠিক কবে থেকে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা প্রাত্যহিক জীবনে নূন্যতম সম্মান বা মর্যাদা লাভ করতে পারবে? কর্মক্ষমতার পরিবর্তে শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিচ্ছবি বা নির্দিষ্ট কিছু চিহ্নই দিয়েই কী প্রতিবন্ধকতার পরিচয় নির্মাণ করা হবে? প্রশ্নগুলি যতটা সহজ উত্তরগুলি ঠিক ততটাই কঠিন বলেই মনে হয়।

    সাধারণভাবে আপাত দৃশ্যত প্রতিবন্ধকতাহীন মানুষদের বলতে শোনা যায়, ‘দেখ ভাই, আমরা সবাই প্রতিবন্ধী, আমাদের সবার মধ্যে কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে’। এই ধরণের কথা শুনলে দৃশ্যত প্রতিবন্ধী মানুষদের যে রাগ হতে পারে সেই চেতনা বোধহয় এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় না। হয়ত অনেকে মুখের ওপরে সবসময় কিছু সাহস করে বলতে পারে না। কারণ এই ধরণের বক্তব্যের সারবত্তা এখনও অন্তত খুঁজে পাওয়া যায় না। বাস্তবে যারা দৃশ্যত প্রতিবন্ধদশার অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে তারাই বোঝে প্রতিবন্ধকতার জগতের স্বরূপ। ছোটবেলা থেকে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রায় শুনতে হয়, ‘ভগবান একটা দিক নিয়েছে, আর অন্য দিকগুলি উজার করে দিয়েছে’। সত্যি বলতে, ভগবান কেনই বা দিল, আর কেনই বা নিল আবার কোনদিক দিয়েছে আর কোনদিক নিয়েছে, সেই হিসেব বোধহয় বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী মানুষদের পক্ষে করে ওঠা সম্ভব হয় নি।

    যদিও মূল সমস্যাটি লুকিয়ে রয়েছে অনেক গভীরে। ঐতিহ্যগতভাবে সাধারণ জনমানসে (শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে) প্রতিবন্ধীদের মানুষদের অধিকার বিষয়ে তেমন কোন ধারণা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বিপরীতে কিছু দান করার মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধকতার প্রতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়িত্ব শেষ করা হয়। ফলে কোন কোন বিষয়ে তাদের যে বক্তব্য থাকতে পারে –সেই চেতনা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় না। ফলে অপ্রতিবন্ধী মানুষদের তরফে প্রতিবন্ধী মানুষদের বক্তব্য শোনার ধৈর্য্য তেমন দেখা যায় না। একথা সত্যি যে গত কয়েক দশকে দলিত সাহিত্যের মত প্রতিবন্ধকতা সাহিত্যও এখনও সেই অর্থে জনপ্রিয়তা পায় না। ফলে প্রতিবন্ধকতার কথা শোনার থেকে দানধ্যান করা অধিক শ্রেয়। শতাধিক বছর পূর্বেই অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘রজনী’ উপন্যাসে রজনী’র সহজ ও সরল আত্মবিবৃতির মধ্য দিয়ে তা হয়ত স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন; ‘তোমাদের সুখ দুঃখে আমার সুখ দুঃখ পরিমিত হতে পারে না। তোমরা আর আমি ভিন্ন প্রকৃতি। আমার সুখে তোমরা সুখী হইতে পারিবে না -আমার দুঃখ তোমরা বুঝিবে না...... আমার উপ্যাখান কি তোমরা মন দিয়া শুনিবে? আমি জন্মান্ধ! কি প্রকারে বুঝিবে? তোমাদের জীবন দৃষ্টিময় –আমার জীবন অন্ধকার’। তাই তাত্ত্বিক চর্চাতে প্রতিবন্ধকতার অবস্থাগত উন্নয়নে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসণ, ক্ষমতায়ান ও অধিকার চেতনা বিষয়ে বরাবর নিস্পৃহতা দেখা গেছে।

    ফলে সামাজিক বৃহত্তম সংখ্যালঘু প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে অপ্রতিবন্ধকতার নিস্পৃহতার প্রধান কারণ হয়ত স্বাধীনতা পরবর্তী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। সংবিধান প্রণেতাগণ জাতি উপজাতিগত প্রান্তিকতা বিবেচনা করে তাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই কাঠামোতে লিঙ্গগত উপাদান যুক্ত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন ধরণের প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মতামতের ভিত্তিতে ভারতীয় গণতন্ত্রকে দৃঢ় ও মজবুত হবে। অপরদিকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে সেই ধরণের কোন সংযোজন বা সংযুক্তিকরণ দেখা যায় না। এমনকি মৌলিক অধিকারের মধ্যে ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ’ নির্বিশেষে সাম্যের কথা বলা হলেও সেখানে প্রতিবন্ধকতার কোন সংস্থান বা উল্লেখ দেখা যায় না। আবার ভারতীয় সংসদের ৭৮৮টি আসনে প্রতিবন্ধী মানুষদের একটিও প্রতিনিধিত্ব দেখা যায় না। এমনকি রাষ্ট্রপতি মনোনীত বারোটি আসনেও অন্যভাবে সক্ষম বা আপাত প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিনিধি নেই। একই রকমভাবে রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের একটিতেও প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিনিধি নেই। তাই একথা সত্যি যে আইনসভার প্রতিনিধিত্ব ব্যাতীত তাদের জন্য বারেবারে নতুন নতুন আইন রচিত হলেও তাদের অবস্থা সেই তিমিরে থেকে যাবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০২ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৩১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন