এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • র‌্যানডম অ্যাক্টস অফ ক্রুয়েলটি অ্যান্ড কাইন্ডনেস

    শিবব্রত রায়
    আলোচনা | বিবিধ | ১৮ মে ২০০৮ | ১১৯০ বার পঠিত
  • যে শহরে আমি চাকরি করি সেখানে খুব বাস্তুহারাদের ভীড়। সমুদ্রের ধারে গরম আবহাওয়ায় ঘর ছাড়া থাকতে সুবিধা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা অভ্যেস করে ফেলেছে এই সহবাস। আমার বউ একদিন ট্রেনিং নিতে এসেছিল ওদের হেড অফিসে। ভোরবেলা ও আর ওর সহকর্মী এসে দেখে দুই বাস্তুহারা পার্কিং লটে ঘুমুচ্ছে। সহকর্মী পুলিস ডেকে ওদের তাড়িয়ে দিল। সেদিন বিকেলে ম্যানেজার ডেকে পাঠায় ওদের দু'জনকে। কথা হল ওরা ভোরবেলা কেউ বিছানা থেকে তুলে দিলে সেটা পছন্দ করে কি না।

    গাড়ী পার্ক করে চার ব্লক হেঁটে আমি অফিসে আসি। এই রাস্তাটুকুতে জনা ছয়েক নিয়মিত ঘুমোয়। প্রথম সিনেমা হলটার পাশে একজন, বাঁদিকে ছোট পার্কে একজন। তারপর ব্যাংকের সিঁড়িতে তিনজন। তিনজনে ঘেঁষাঘেষি করে ঐখানে ঘুমোয় কেন? সিনেমা হলের সামনে যে মেয়েটা ঘুমোয় সে বলেছিল বড় বাড়ির দেওয়ালের পাশ রাস্তার থেকে গরম হয়। সত্যি-সত্যি খেয়াল করে দেখেছি দেয়াল ধরে লাগানো জেরেনিয়ামরা শীতেও দু'চাট্টি ফুল বেশী ফোটায়। পার্কের পাগলটাকে আর কেউ কাছে শুতে দেয় না, কথা বললে বড্ড থুতু ছেটায় বলে। কিন্তু এই তিনজনের কোন কারন নেই পরপর তিন ধাপ সিঁড়ি ভাগ করে নেবার। অন্তত: তেমন কোন কারণ তাদের জিজ্ঞেস করে পাওয়া যায়না। দেখলে মনে হয় পরিবার, মা আর দুই ছেলে। কিন্তু তেমন কিছু আসলে নয়। মেয়েটা কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে আছে দেখে বড়টা জুটে গিয়েছিল।

    এই ফেব্রুয়ারী মাসেও আরো দু'জন ঘুমোত উল্টোদিকের চার্চের সামনে। তারা দুই বুড়োবুড়ি। প্রথমে শুধু বুড়ি ছিল, র‌্যালফের বাজার করার ট্রলিতে ঘর-সংসার বোঝাই করে। আমি সিগারেট খেতে বেরোলে খুব চ্যাঁচাত - এই একটা মেক্সিকান এসে আমাদের চাকরি নিয়ে নিচ্ছে। ডেকে একটা সিগারেট দেওয়াতে বুড়ির মন ঘুরে যায়। সেই থেকে বুড়ি মাঝে মাঝে পরমর্শ করতে আসত। একদিন এসে জানাল এক বুড়ো থাকতে চাইছে ওর জায়গা ভাগ করে। ঐ ছোট্ট জায়গায় দু'জনের হবে কি? তবে বুড়ো নাকি খুব ভাল। ভিয়েতনামে লড়েছিল খুব। তারপর খোঁড়া হয়ে দেশে ফেরে। দেখা গেল বুড়ী লজ্জা পেয়েছে। ক'দিনেই উপলব্ধি হল সিগারেটের সংগে প্রনয়কলহ ভারী উপাদেয় অনুপান। ফেব্রুয়ারীর পনের তারিখ সকালে বুড়োকে দেখলামনা। উদাস ভাবে বুড়ী জানাল বমি করে গেট নোংরা করেছিল বলে চার্চের লোকেরা বুড়োকে শেলটারে দিয়ে এসেছে। দেখি বুড়ী দুই বুকের মাঝখানে ডেইজির উল্কিতে আঙুল বোলাচ্ছে। দু'দিন বাদে বুড়ী র‌্যালফের ঠেলাগাড়ী গুছিয়ে, আমার কাছ থেকে একটা মার্লবরো চেয়ে নিয়ে শেলটারে বুড়োর খোঁজ করতে চলে গেল।

    আর সেই যে লোকটা অফিসের পেছনে ভেরাইজনের পার্কিং লটে ঘুমোত। একদিন আমাকে ডেকেছিল ওর সাথে কফি ভাগ করে খেতে। সেই লোকটা কত্ত কিছু জানত। ক্রেডিট ব্যুরোর জানালায় বাসা বাঁধা পায়রাগুলোর একটার কেন গোঁফ আছে থেকে ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার পর্যন্ত। দাঁড়ি-গোঁফ একদিন জিজ্ঞেস করেছিল লিনাক্স প্রসেসের মেমোরিতে সাইজ কি করে জানা যাবে। সিগারেটের প্যাকেট ফেলে এসেছি বলে পালিয়ে এসে ন্যাড়ার কাছে জেনে গিয়েছিলুম, কিন্তু প্রেস্টিজ বাঁচে নি। হলুদ দাঁতে হেসে লোকটা জানতে চেয়েছিল এতটা সময় নিলুম এই কথা বলতে, কি করে আমার চাকরি বজায় আছে! তো সেই লোকটাও আর নেই। এখন আমাকে একা একা সিগারেট খেতে হয়।

    মিড-ওয়েস্টের একটা চোটা সহরে আমি বছর পাঁচেক চার্ত হয়ে ছিলুম। সেখানে শীতকালে খুব বরফ পড়ে, আর তখন পাড়ার চার্চের বেসমেন্টে সন্ধেবেলা যে যায় তাকেই স্যুপ আর রুটি খেতে দেয়। মাসের শেষে পয়সা ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে রুমমেটের পাউরুটি চুরি করে খেয়েছিলাম। 'ট' ছিল আমার সেই রুমমেটের শ্বেতাঙ্গিনী বান্ধবী। সেই মেয়েটি একশ মাইল দূরের একটি গ্রামের মেয়ে। পড়াশুনোতে খুব খারাপ বলে স্কলারশিপ কেটে গিয়েছিল। 'ট' কি সব করে টিউশন দিত আর একটা বুইক গাড়ীতে ঘুমোত। শীতকালে মাঝে মাঝে গরম ঘরে শুতে পারকে 'ট' বলত গার্লফ্রেন্ডের চাকরির ফিঞ্জ বেনিফিট। তা সেই পাউরুটি চুরি করা আমার রুমমেট বুঝতে পেরেছিল। সেই নিয়ে আমার আর 'ট'-এর সামনে অনেকক্ষন গজগজ করেছিল, কিন্তু আমাকে সোজাসুজি কিছু বলে নি। পরে 'ট' আমাকে ডেকে ঐ চার্চের বেসমেন্টের খোঁজ দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাউরুটির কথা কিছু বলে নি। আমি তখন দেশে থাকা আমার বউ আর তিন মাসের ছোট মেয়ের প্লেনের টিকিট কাটার টাকা জমাচ্ছি। ঝগড়া করে আমার রুমমেট 'ট'-কে রাত্তিরে তাড়িয়ে দিলে ওকে ডেকে ঘরে শুতে বলার সাহস আমার ছিল না।

    তারপর সেই বছর পুরো শীতকাল আমি ঐ চার্চে রোজ সন্ধেবেলা যেতাম। চার্চের মেম্বারেরা পালা করে স্যুপ রান্না করত। খাওয়া কেমন হবে সেটা নির্ভর করত রান্নার হাত আর রাঁধুনীর ক'টি পোষ্য, তার ওপরে। আমার মত রোজকার জনতা কয়েকজন ছিল। বাকীরা যারা অন্য অনেক রকম খোঁজ খবর রাখত তারা বেছে বেছে ভাল রান্নার দিনে যেত। ওদের নিয়ম ছিল যে রান্না করবে তাকেই পরিবেষণ করতে হবে। তা এক বুড়ী মাঝে মাঝে রান্না করত। একদিন আমাকে দেখে বুড়ীর কি মনে হয়েছিল, স্যুপের নীচে থেকে অনেকগুলো বড় মাংসের টুকরো তুলে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর আমার পাশে বসা লোকটা ছুরি দেখিয়ে আমার সাথে বাটি বদলে নিল। এঁটো খাব কিনা ঠিক করতে অনেক ভাবতে হয়েছিল আমাকে। কিন্তু তারপর থেকে আমি বাটিতে ভাল কিছু পড়লে বেসমেন্ট থেকে স্যাংচুয়ারীতে যাবার সিঁড়িতে বসে খেতাম। সেই দেখে প্রিস্ট একটু বকুনি দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেই বুড়ী ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলায় আমার সিঁড়িতে বসে খাবার ট্যাসিট অ্যাপ্রুভাল জুটে যায়। স্প্রিংএ বউ আর মেয়ে দেশ থেকে চলে এল। তারপর আর চার্চে ফিরে যাবার দরকার হয় নি।

    এই সব আর কি।

    মে ১৮, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৮ মে ২০০৮ | ১১৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন