পুড়ছে, শুধু কাগজ নয়…
আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে গ্যারাজের দিকে একদৃষ্টিতে পথ চেয়ে অনন্ত অপেক্ষায় উড্রো উইলসন ব্লেডসো। কার কথা ভাবছিলেন? হয়তো এমন কারও কথা যার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল ওই মাস কয়েক আগে, বা প্রতি রবিবার মর্মন চার্চে যাঁর অভিবাদনে তিনি অভ্যস্ত, আবার হয়তো বা সারা শহরেই তাঁর শ্যেন দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে কারও খোঁজে। অন্তত তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই। এত দিনে তাঁর স্বাস্থ্যবান শরীরের ফোলা ফোলা গাল-চিবুক নুয়ে পড়েছে। ৭৪ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। এএলএস রোগ তাঁর শরীরকে করেছে বিধ্বস্ত। কেড়ে নিয়েছে কথা বলার, হেঁটে চলে বেড়ানোর ক্ষমতাটুকুও। শুধু সাদা বোর্ডে টুকরো কতগুলো সংকেত, আদেশ লিখে দিতে পারছিলেন। এত কিছুর পরেও মস্তিষ্ক কিন্তু তাঁর সতেজ। যখন অস্টিনে তাঁর ছেলে ল্যান্স ফিরে এল ১৯৯৫ সালের এক সকালে তিনি ওই সাদা বোর্ডে লিখে ছেলেকে হুকুম দিলেন ব্যাক ইয়ার্ড থেকে একটা অদরকারি কাগজপত্র ঠাসা বাক্স নিয়ে আসতে। ল্যান্স নিতান্ত বাধ্য ছেলের মতো সেটা হাজির করল এবং বাবার আদেশে আবার লাইটার, পেট্রল এনে আগুন জ্বালাল। উডি চেয়ারে বসেই অগ্নিকুণ্ডে ছুড়ে দিল দুটো ফাইল সমেত বাক্সটিকে। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল কাগজপত্র। এই ভাবে একে একে সমস্ত ফাইলগুলো ছাইতে পরিণত হল।
কী পোড়াল ল্যান্স? সে কি নিজেই জানে? অন্ধকারে হাতড়ানো আর আন্দাজে ঢিল ছোড়াই তাঁর একমাত্র উপায়। বিগত তিন দশক ধরে তাঁর বাবা টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ল্যান্স জানত তাঁর বাবা প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং আশাবাদী। সেই ১৯৫০ সালের শেষের দিকে উড্রো শুরু করেছিলেন গবেষণা। স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা রোবটের যা মানুষের সঙ্গে কথা বলবে, মানুষের মতো করে ভাববে, এমনকি তাঁর সঙ্গে পিং পং খেলবে।
একটা ভয়াবহ ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলেন তাঁর রোবটকে। মুখ দেখে শনাক্তকরণের ক্ষমতা। এই গবেষণা অচিরেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল মার্কিন সরকারের, বিশেষত মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-এর। এর পর থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে উৎসাহ জুগিয়েছে সিআইএ, ঢেলেছে অফুরন্ত টাকা। তাদেরও স্বপ্নের প্রজেক্ট এই শনাক্তকরণ। এই ক্ষমতা তাদের হাতে এনে দেবে সারা পৃথিবীকে নজরবন্দি করার চাবিকাঠি। ওয়াশিংটনের নজরদারির এই অভিনব পদ্ধতির (face recognition) প্রথম প্রচেষ্টার প্রমাণ স্বরূপ নথি-ই কি পুড়িয়েছিলেন ল্যান্স?
“যন্ত্রের বুদ্ধিটা ক্যামেরার চোখ দিয়ে খুঁজে নেয় মুখখানা তোর
রক্ত না চামড়ার রঙে নাকি লেখা আছে—অপরাধ ভীষণ কঠোর!
তুই সেই অপরাধী, যার মুখে চোখ রেখে যন্ত্রের ঘুম চুরি হয়
ভীষণ শাস্তি তার, কখনও বা কারাগার, বারুদের গন্ধে সময়…”
ঘিলু কত থকথকে, খুলি টিপে দেখি আয়…
অনেকটা সময় গেল পেরিয়ে। আমার খোঁজ নেবার তালিকায় তোমার নাম কাটা গিয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে অবসন্ন আজ তুমি ইউটিউব হাতড়ে কী গান শুনবে, কোন্ সিনেমা দেখতে চাইবে তা বোধহয় আর বলতে পারব না। তোমার পছন্দের তালিকায় থাকা জিনিসগুলো বহুদিন হল আমার থেকে মুখ ফিরিয়েছে। নাহ! বহু বছরের সম্পর্কে ইতি হওয়ায় মন ভেঙে যাওয়া প্রেমিকের বিরহ কিংবা বিষাদ মাখা স্বগতোক্তি নয়; এ এক রোবোটের স্বগতোক্তি যে আপনার সুখদুঃখের মুহূর্ত, পছন্দ-অপছন্দের তালিকা থেকে শুরু করে আপনার মুখ, চোখ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবকিছুর ওপরেই শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে রেখেছিল নিঃশব্দে, আপনার অজ্ঞাতেই। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, গুগল, টুইটার সহ সমস্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে একটা অদৃশ্য ছায়া অনুসরণ করত আপনাকে। বছরখানেক হতে চলল কোনো বিশেষ কারণে হয়তো আপনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এই সমস্ত জায়গা থেকে। আর তাই এই হা-হুতাশ।
আমাদের জীবনকে কৃত্রিম মস্তিষ্ক এমনভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, আমাদের মুখের আদল, দু-চোখের তারার মাঝের ফাঁক, গায়ের রং—সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য প্রতিদিন চুরি যায়। শুনছি এইসব নিতান্ত ব্যক্তিগত তথ্য আজ মহার্ঘ; বিক্রি হয় লক্ষ লক্ষ টাকায়। মুখ নিয়ে চলছে আজ নানান পরীক্ষা-নিরিক্ষা; আর মুখ আর মুখোশের ভিড়ে জটিল গোলোকধাঁধায় হারিয়ে যাচ্ছি আমরা, ঘুরপাক খাচ্ছি—নানা জাতের কুয়াশার মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করতেও ভুলে যাচ্ছি। গতকাল পর্যন্ত যে আমি টিকটক, ফোটো ল্যাব সহ বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের খেলায় মেতে নিজের মনের কোণের নার্সিসিজমকে চরিতার্থ করতাম—সেই আমি-ই হয়তো বা আজ ভাবছি, কয়েকটা চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে দিলেই বোধহয় আমার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ভীষণ সুরক্ষিত।
মাথার খুলি নিয়ে প্রথম ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের ভিয়েনাতে। হাজার হাজার মানুষের এবং অন্যান্য জন্তুর মাথার খুলি ছুঁয়ে দেখতে লাগলেন সোয়াবিয়ান ডাক্তার গল। ছেলেবেলায় গল লক্ষ করেছিলেন, তাঁর যে সহপাঠীরা গড়গড় করে মুখস্ত বলে যেতে পারত, তাদের চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসত সামনের দিকে—এতটাই বড়ো বড়ো তাদের চোখ। সেই থেকে তাঁর মাথা কুরে খাচ্ছে এই বিষয়টা।
রীতিমত টিপে টিপে দেখতে লাগলেন খুলি এবং মুখের অবয়ব। কী যেন খুঁজছেন তিনি নিতান্ত বেপরোয়া হয়েই। গল ধরেই নিয়েছিলেন মস্তিষ্কের গঠন আর খুলির গঠন হবে সাযুজ্যপূর্ণ। শুধু তাই নয়, তিনি এও ধরে নিয়েছিলেন যে নির্দিষ্ট অংশের ঘিলুর আয়তন নির্ধারণ করে দেবে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা এবং সেই অবস্থানে থাকবে নির্দিষ্ট ক্রিয়ার চাবিকাঠি। এতগুলো ধরে নেওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে চিত্তবৃত্তি বা ফেনোলজি।
সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে বেশ দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে লাগল এই চিত্তবৃত্তি বিষয়ক তত্ত্ব। স্পুরঝেম নামে ডাক্তার গলের এক শিষ্যের হাত ধরে দ্রুত দাবানলের মতো ছড়ায় এই তত্ত্ব। ক্রমাগত বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য হারিয়ে তা চেহারা নিল ধর্মীয় ভাবাবেগের। চার্লস ক্যাডয়েল, হোরেস মান-রা ততদিনে এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন অপরাধবিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। টোমিলসন নামে এক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অবশ্য সেই সময় দাঁড়িয়েই সোচ্চারে বলেছিলেন, এই ধরনের তত্ত্ব সমাজে মুক্তি বয়ে আনে না বরং এতে আরও গেড়ে বসে—পোক্ত হয় সামাজিক স্তরবিন্যাস, বর্ণবাদ আর পুরুষতন্ত্রের ভিত।
তোমার মুখেও অ্যালগোরিদম ঘুরছে…
যতই প্রযুক্তিকে সমাজনিরপেক্ষ এবং মহান হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা থাকুক না কেন; কয়েকটা প্রশ্ন কিন্তু আমাদের তাড়া করে বেড়াবেই।
প্রথমত, দেহতত্ত্ব বা ফিজিওজেনি এই শব্দবন্ধকে ঘিরে রয়েছে এমন কিছু প্রশ্ন যা গভীরে গিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। ফিজিওজেনির সাম্প্রতিক বিবর্তন আমাদের ঠেলে দেবে না তো বৈজ্ঞানিক স্বজাতিতত্ত্বের দিকে? স্বজাতিতত্ত্ব, বর্ণবাদ, সামাজিক স্তরবিন্যাস, জাত-পাত ইত্যাদিতে বিজ্ঞানের শিলমোহর পড়ে গেলে কিন্তু ওই বিষাক্ত বীজের চাষ হু-হু করে বাড়বে, বাড়তেই থাকবে।
দ্বিতীয় কথা হল, অপরাধতত্ত্বের সংজ্ঞা ঠিক কী? বিচারাধীন বন্দিকে কি অপরাধী বলা চলে? আমাদের বিচারব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থার ওপর ঠিক কতটা আস্থা রেখে দাবি যায় যে অপরাধী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক স্তরবিন্যাস, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ প্রভাব ফেলবে না? জেলে পোরার সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সমাজে পিছিয়ে থাকা বা কোণঠাসা হওয়া জাত বা বর্ণের মানুষেরাই কি সহজলভ্য হয়ে দাঁড়ায় না? তাঁরাই কি কারণে-অকারণে বলির বখরা হয় না? সামাজিক সিঁড়ির ওপরের দিকে থাকা মানুষেরা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তির স্বাদ পেয়ে যাওয়া মানুষেরা অপরাধী হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে—এমন ঘটনা জীবনে কবার দেখেছেন বলুন তো? হাতে গুনে বলা যায়—তাই নয় কি? এবার হয়তো প্রশ্ন করে বসবেন, আরে এসবের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মুখ শনাক্তকরণ ব্যবস্থার সম্পর্কটাই বা কী?
আসুন তাহলে আর-একটু ডুব দিয়ে দেখি বিষয়টাকে। এবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মেশিন লার্নিং-এর সঙ্গে আর একটু পরিচিত হই আমরা। যারা একটু-আধটু ওয়াকিবহাল তাঁরা অবশ্যই জানবেন এদের বুদ্ধি কিন্তু মোটেই জন্মগত নয়। তাহলে কীভাবে শেখে এই যন্ত্র? ভাবুন, একটি শিশু ঠিক কীভাবে শেখে। জন্ম থেকেই সে সব শিখে আসে কি? নাহ! বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম ঘটনা, পড়াশোনা, পরিশ্রম, ভুলভ্রান্তি ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই কিন্তু সে জ্ঞান অর্জন করে। ঠিক সেরকমভাবেই মেশিন লার্নিং-এর ক্ষেত্রে প্রচুর তথ্য ফিড করিয়ে যন্ত্রকে শেখানো হয়। এর মধ্যে থেকে অর্থবহুল একটা প্যাটার্ন সে বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তী ধাপে সে সিদ্ধান্ত নেয়। এবার ঘটনা হল, জেলবন্দিদের ছবি, মাগ শট ইত্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ফিড করানোর জন্য। যেখানে আমাদের পুলিশি ব্যবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থা ভীষণরকম একপেশে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষাতেও গভীরভাবেই থেকে যাবে সামাজিক বৈষম্যের ছাপ। এবার মুখ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া (face recognition) যদি ক্লাসিফিকেশনের মাধ্যমে সেই ফিডব্যাক লুপ অর্থাৎ সেই তথ্যভাণ্ডার অনুসারে চলে তাহলে তার দ্বারা যে ফল আমরা পেতে থাকব তাতে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ছাপ আরও দৃঢ়তর হয়ে দাঁড়াবে।
এই অ্যালগোরিদমে নিশ্চয়তা কতটুকু? এর ফলাফলে গলদ থাকার সম্ভাবনা ভুল ব্যক্তিকে শনাক্ত করার দিকে ঠেলে দিতেই পারে। ১০০ শতাংশ সঠিক ফলাফল তো কোনো যন্ত্রই দিতে পারে না। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের বুকে ছাঁকনির মতো বসে অপরাধী এবং নিরপরাধ, মানুষকে এই দুটি স্তরে ছেঁকে নিতে ব্যবহৃত হলে তা সমাজের পক্ষে ঠিক কতটা ভয়াবহ? প্রযুক্তি যার হাতে সে সহজেই তাঁর নিজস্ব সংজ্ঞা অনুযায়ী তথ্য ফিড করিয়ে অর্থাৎ নিজের মনের মতো করে ওই যন্ত্রকে শিখিয়ে পড়িয়ে অপছন্দের মানুষকে অপরাধী হিসেবে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করবে না তো?
এ ছাড়াও এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে নাগরিকদের প্রাইভেসিকে ঘিরে। দেশের নাগরিকদের গোপনীয়তার সুরক্ষা থাকবে না? গোপনীয়তার মালিকানা থাকবে কর্পোরেটদের হাতে? ন্যূনতম সাংবিধানিক অধিকার কি যখন তখন চুপিসারে কেড়ে নিতে দেওয়া যায়?
পরের পর্বে বরং দেখি আমাদের এই দেশের হাল।
গণতন্ত্র সেলফি তুলছে …
নজরদারির এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হাতে আসার পর সন্দেহের বশবর্তী হয়েই কেবল কারও ওপর নজর রাখা হয় না; বরং তথ্যভাণ্ডারের বিশ্লেষণের ফলশ্রুতিতে উৎপাদিত হয় সন্দেহ। ফলে আপনি যে-কোনো মুহূর্তে আপনার অজ্ঞাতেই উঠে আসতে পারেন রাষ্ট্রের সন্দেহের তালিকায়।
নির্বাচনের প্রাক্কালে বিগত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মোদীর সভায় উপস্থিত মানুষজনের ওপর দিল্লি পুলিশ চালিয়েছিল এই স্বয়ংক্রিয় নজরদারি। রামলীলা ময়দানের গেটে যেখানে ছিল মেটাল ডিটেক্টর, সেখানেই বসানো হয়েছিল এই যন্ত্র। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত পর পর বিভিন্ন প্রতিবাদ মিছিল থেকে সংগৃহীত ছবির নিরিখে ওই নির্বাচনি সভায় চলেছিল খোঁজ।
সামাজিক বিচ্যুতির নতুন সংজ্ঞা তৈরি হল; যেখানে কেউ চিহ্নিত হল স্বভাবসিদ্ধ প্রতিবাদী হিসেবে আবার কেউবা সমাজের অভদ্র উপাদান হিসেবে।
নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারকে সরাসরি লঙ্ঘন করছে এই মুখ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া। শুধু তাই নয় মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অজানা ভয়। সন্দেহ তালিকায় না থাকার আপ্রাণ চেষ্টা স্বরূপ সে ক্রমশ গুটিয়ে নেবে তার স্বাভাবিক অভিব্যাক্তিটুকুও। ভুলতে বসবে সংবিধান তাঁকে দিয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমবেত হবার অধিকার, মিছিল-মিটিং করার অধিকার। শিরদাঁড়া বেয়ে এক অজানা ভয় নেমে আসবে, নিয়ন্ত্রণ করবে তাঁর সমস্ত গতিবিধি, ঘুম ভেঙে ওঠা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত। সামগ্রিক এই ভয়ের চর্চায় কি গণতন্ত্রের মূল ভিতটাই প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে না?
যেহেতু এই নজরদারি এক ধরনের সামাজিক স্তরবিভাজন তৈরি করছে, ফলে ইতিমধ্যেই প্রান্তিক হয়ে যাওয়া সম্প্রদায়, জাতি বা জনগোষ্ঠী আরও কোণঠাসা হবার মুখে পড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরও খাদে পড়তে চলেছে। এতে আরও জোরদার হবে আইডেন্টিটির রাজনীতি। সেই রাজনীতি কিন্তু আবার সামাজিক বিভাজনকেই সুদৃঢ় করবে, হাত শক্ত হবে সমগ্রকে আড়াল করার আর বিভাজনের রাজনীতির। এ এক জটিল আবর্ত।
নাগরিক সুরক্ষার প্রশ্নটিকে রক্ষাকবচ বানিয়ে ভারতে আমদানি হয়েছে এই মুখ শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া। তাই দেখি ‘নির্ভয়া’ ফান্ড থেকে ২৫০ কোটি টাকা ধার্য হয় ৯৮৩ টি রেল স্টেশনে এই মুখ শনাক্তকরণ (facial recognition) ক্যামেরা বসানোর জন্য। এর আগে নিখোঁজ বাচ্চাদের খুঁজে বের করার জন্য যে মুখ শনাক্তকরণ সফটওয়ার কাজে লাগানো হয়েছিল পরে সেগুলিই ব্যবহার করা হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে। নজরদারির এ হেন আপাত অহিংস বাণিজ্যিক হাতিয়ার হাতে আসার পর মনে হচ্ছে অরওয়েলের ডায়াস্টোপিয়াও আজ হার মানবে। যথেষ্ট আইনি বিধিনিষেধ যদি চাপানোও হয়, যন্ত্র যদি নির্ভুল হবার জায়গায় পৌঁছেও যায়, তবু বলব এই ধরনের যন্ত্রের প্রয়োগে যে প্রভূত সামাজিক ক্ষতির সম্ভাবনা তা লাভের ভাগকে বহুগুণে ছাপিয়ে যায়। তাই এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পক্ষেই সওয়াল করা দরকার। এএফআরএস (Automated Facial Recognition System)-এর পরেই আসবে ‘ইমোশান অ্যান্ড গেইট’ প্রযুক্তি, যা ধরতে পারবে আমাদের আবেগকেও, আমাদের মনের ভাবনাকেও পড়তে পারবে। তখন কোথায় যাব আমরা? ভাববার স্বাধীনতাটুকুও কি হারাতে বসব অবশেষে?