
শরৎ সাহিত্যের কী সব ‘দোষ’ সে আমার জানা নেই। কিন্তু বুঝতে পারি অনেক ‘দোষ’ আছে। এই যে আমার ‘দোষ-বোধ’ সে অন্যদের অভিমত থেকে পাওয়া বা শেখা যা আমাকে শেখানো হয়েছে। নিজে তা বুঝে উঠতে পারিনা কীভাবে কী কী কারণে শরৎ সাহিত্য দোষের হয়েছে! ধারণা করি হুমায়ূন সাহিত্যেও সেই রকম ‘কথ্য-কলঙ্ক’ লেপ্টেছে যেটাও কম বেশী দোষেরই। এই দোষটাও যে আমি খুব বুঝি তা নয়। এই সব অভিমতের বিচারকদের সম্পর্কে বরং আমার সব সময় ভিন্নমত থাকে। তা এ রকমঃ তাঁরা কারা? যাঁরা বলেন অমুকে আছে, অথবা নাই, থাকবে অথবা থাকবে না ইত্যাদি ধরনের জ্যোতিষ বিদ্যা চর্চা। জরিপের বাইরে এ ধরনের অভিমতের মূল্য নেই। অর্থাৎ থাকা উচিৎ নয়, থাকলেও তা ‘তর্ক সাপেক্ষিক’। শরৎ নেই বলে যে চিৎকার সেভাবেও শরৎ দশকের পর দশক বেশ দাপটেই থেকেছে এবং থাকছে। এখানে পরিসংখ্যান হতে পারে প্রকৃত কী পরিমাণ শরৎ-বই লোকজন/পাঠক কিনছে। সেই সংখ্যায় হয়তো ওই অভিমতটি উল্টে যাবে। তখন তর্কটা অন্য খাতে দিতে হবে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ শিরোনামে, ভারবাহী একটা কিছু। সেখানেও ঝুঁকি থাকে জাজমেন্টাল হওয়ার যে, কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কী কী শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠির ‘মাতব্বরি-সনদ’ এদের থাকে এসব রায় দেওয়ার। আয়রনিটা এখানেঃ শরৎ থাকলো না চিৎকারটির বয়স কী পঞ্চাশ বছর হয়নি? এতো দীর্ঘ সময় পরেও যখন একই চিৎকার পাড়তে হচ্ছে তখন নেই বা থাকবে না জ্যোতিষী চর্চার অস্তিত্বই তো প্রশ্ন বোধক। এক্ষেত্রে হতে পারে তাঁরা হয়তো ইংগিত দেন যে, তাদের কাছে ঐক্যমতও মনে হয়, অমুক ও অমুক থাকবেন না বা খুব করে থাকবেন। হতেই পারে, কিন্তু এরও একটা নাম আছে- এটা এক ধরনের ডিনায়াল ও অন্যকিছুর প্রতি এক প্রকারের তাৎক্ষণিক অশ্রদ্ধা সহ অস্বীকার মনোভাব। তারা হয়তো উপলব্ধিই করেন না যে এদের প্রায় সকলকেই ওই ‘জিনিষ’ (যে জিনিষের জ্যোতির্বিদ্যায় তাদের নামতে হয়) ভাল করে পড়ে নিতে হয় এমনটি চর্চা করবার আগে। কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক তাহলে তাঁরা কেন পড়েছেন? অন্যেরা তা পড়তে বলেছেন বলে? না কী অন্যেরা অমুককে অনেক বেশী পড়ে ফেলেছেন বলে? তাতেই তিনি বা তাঁরা পড়বেন কেন? পড়ছেন কী এ কারণে যে ওর মধ্যে এমন কিছু থাকে যা অবদমন করা কঠিন। অথবা ওই জিনিষ এমন একটা হৈচৈ তুলেছে যে তিনি ওই আলোচনার বাইরে থাকবার লোভ সামলাতে পারেন না। অতএব তিনি ও তাঁরা পড়লেন, কিন্তু ওই পাঠোত্তর একটা বিচারকের মুখোশে একখানা ধারালো বল্লম নিয়ে গুঁতা কর্মে নামেন। এটা কী লক্ষণ জানা নেই। সেটা যে সৃষ্টিশীল লেখক-স্বভাব নয়- তা স্পষ্ট, সেটা যেচে শালিসি করতে যাওয়া’র মত ঘটনা। তার দরকার পড়ে না। এর সবই একটা নিজ নিয়মে চলে। যেমন শরৎকে নেই-নেই বলেও আজতক ‘নেই’ করা যায়নি। বরং একদল পাঠকদের কাছে জেনে কী না জেনে তিনিই মডেল হয়ে থাকেন; একদল লেখকদের কাছেও তাই, এই যে নিন্দা বা হারিয়ে যাবে বলে ভবি-বাণী করা হয়, তারও নিজস্ব নিয়ম আছে। নিয়মের নিয়ম। একদল ওইভাবে ‘লিখতে না পারা’ ব্যর্থ লেখক সমালোচকের পরিচিতি খানা গলায় ঝুলিয়ে স্বেচ্ছা শালিসিতে নেমে রায় দিয়ে যেতে থাকেন বিষয়ের প্রকৃত মূল্যায়ন’কে অস্বীকার করে।
তাঁর ক্ষেত্রে যে ঢালাও সমালোচনা যে তিনি ‘সিরিয়াস’ সাহিত্য করেননি, ধারণা করি সেটাই একটি ভুল অভিযোগ তার সম্পর্কে। সন্দেহ নেই সেটাকে ঘিরেই তাঁকে শরৎ অপবাদ দেয়া হয়, যদিও ওই শরৎ অপবাদও একটি যুক্তিহীন অভিযোগ! সেই যুক্তিতে কিন্তু ‘সিরিয়াস সমালোচকও’ নেই। সিরিয়াস সাহিত্য না করবার অভিযোগের প্রভাব জ্যোতিষ বাণী যদি হয় যে ‘টিঁকবে না” আখেরে তবে যে বাণীতে ওই কথা বলা হয় তা যদি আবার সিরিয়াস সমালোচকদের কাছ থেকে না আসে তবে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে ওই কথাটারই কোনও ভিত্তি তৈরি হয় কিনা। সাহিত্য জগতের সবাই-ই সিরিয়াস সাহিত্যই করেন। সাহিত্যের সিরিয়াসনেস প্রমাণে কোনও সূত্র-উপসর্গ নেই যা মেনে চলে প্রমাণ করা যেতে পারে এইটা এইভাবে সিরিয়াস অথবা ওইভাবে সিরিয়াস নয় বলে চিহ্নিত হলো। আসলে এই অর্থে এইখানে সাহিত্য সিরিয়াসনেস একধরনের লেখক বা ‘লেখা-সৃষ্টিকর্তার’ ক্ষমতা যা তার সাধারণ সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যেই প্রতিফলিত হওয়ার কথা। যা কিনা কোনও কোনও সমালোচকের কাছে সিরিয়াস বলে গণ্য হতে পারে। যে সব উপসর্গকে উদাহরণ ধরে শরৎ বা হুমায়ূন সাহিত্যের অবজ্ঞার রাস্তাটি খোলা হয় সেই উপসর্গ রবীন্দ্রনাথের অজস্র লেখায়ও রয়েছে। তাকে আমরা শরতীয় বলছি না কেন? রবীন্দ্রনাথ তাহলে কোন আভিজাত্যে সে অপবাদ থেকে মুক্ত থাকেন? তা কি এমন যে তার অন্যান্য লেখা আবার সেইগুলোকে ওইসব সমালোচকদের আক্রমণাত্মকতাকে কভার দিতে পারে; সে জন্য? যদি এটা মেনে নেই তবে কী আমরা আরও সৎ হতে পারিনা এইভাবে বলে যে রবীন্দ্রনাথের ‘শরতীয়-হুমায়ুনীয়’ ঘরানা’র রচনা সমগ্র ও তার অন্যান্য সিরিয়াস রচনা সমগ্র! আসলে একে আমরা ‘ঘরানা-কেন্দ্রিকতা’ বলতে পারি। তাঁর কোনও ঘরানা বা স্টাইল পছন্দ করি বা করিনা এই হতে পারে আলোচনার একমাত্র নির্বাচন পদ্ধতি। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্টিফেন কিং বা জন গ্রিশাম পড়ি না। আসলে পড়তে আমার ভাল লাগে না তার অর্থ কী এই দাঁড়াল যে ওরা এমন কোন বড় লেখক না? তার চেয়ে ঝুম্পা সাহিত্য পড়ি, এতে কী ঝুম্পা ওদের চেয়ে বড় হয়ে গেল? একই ভাবে ছোট হবারও কারণ থাকে না কারো। পদ্ধতিটি আসলে আমাদের জানরা তল্লাশি। কারো কোনও জানরা (ঘরানা) ভাল লাগলে অন্য জানরা’র প্রতি অ-শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণ দেখি না। হরোর সাহিত্য, ইয়াং এ্যাডাল্ট সাহিত্য, ওয়েস্টার্ন সাহিত্যও আমি পড়িনা, তবে কী কোনোও-না-কোনভাবে ওইসব লেখকরা সিরিয়াস লেখক নয়? কেবল মাত্র আমার রুচিতে তা গ্রহণ করেনি বলে? আমার বাইরে যে মিলিয়ন পাঠকরা যা তাদের পড়ছে তার কোনও মূল্যই নেই? যেহেতু আমার (বা নির্ধারিত কোনও সমালোচকের কাছে) তিনি পছন্দ হননি? আমার ঘরানা বিচারের বাইরে আর কোনও কিছুর কথাই হয়তো বলছি না, কেবল আমাদের প্রকাশে গুলিয়ে ফেলে শরৎ, হুমায়ূন, মহাশ্বেতা, শীর্ষেন্দু , নিমাই, সুনীল, সেলিনা, সমরেশ , কমলকুমার , জ্যোতিপ্রকাশ, বিভূতি, মানিকদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছি? এখানে অনেকেরই নাম নেয়া হলোও ওই গর-হর দোষারোপের ভয়াবহতা ও পরিণতি সম্পর্কে একটা ইংগিত করতে। অতএব, সব ও সবার সাহিত্যই সিরিয়াস, সেটা বটতলার কী খেজুর তলার বা চটি কী ঘটি সাহিত্য, যাই বলা হোক না কেন।
বাংলা সাহিত্যের মুসলমান অংশ (এইভাবে চিহ্নিতকরণ হয়তো ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ নয়, কিন্তু এটাই সত্য) অর্থাৎ পূর্বাংশ বা পূর্বাংশের মুসলমান অংশ, বর্তমান বাংলাদেশ জেনে কী না জেনে স্বতন্ত্র হতে চায়, সেটাই বাস্তবতা। তার সঠিক বেঠিক হিসাব অপ্রয়োজনীয়। পরিকল্পিত কী অপরিকল্পিত ভাবে এই আলাদা-করন যে চায় তার যৌক্তিকতা বা উত্তর থাকুক না থাকুক এটুকু আমরা এখন জানি- সেই-ই সত্য। নজরুল, গোলাম মোস্তাফা, ফররুখ আহমদ বা আবুল মনসুর আহমদরা যা করতে পারেননি, তা অনেক বেশী করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। কোন নির্ধারিত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তিনি ‘পুব’এর কোলকাতা কেন্দ্রিক কাহিনী (গল্প বা উপন্যাস)পড়বার যে নির্ভরতা তা সম্পূর্ণই বিলুপ্ত করতে পেরেছেন। এই বিলুপ্তি পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল, খুবই ‘বাংলাদেশী’ ঘরানার মানুষদের জন্য কাংখিত ঘটনা। কিন্তু উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে তিনি অবশ্য বিলোপ কর্মিটি সম্পূর্ণভাবে সফল করতে পারেননি। কোনো না কোনো ভাবে পশ্চিম বঙ্গ প্রবল ভাবেই তাদের মধ্যে টিঁকে আছে। এর কারণ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা এই সাহিত্য রুচি চর্চার মধ্য দিয়েই নিম্নবিত্তদের থেকে নিজেদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ফেলে। নিজেদের আভিজাত্য বজায় রাখে। তাতে হুমায়ুনের কোনও ক্ষতি হয়নি। তিনি সব তরফেই পঠিত হচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি যা চেয়েছেন তাই তিনি অর্জন করেছেন, সবার কাছেই গৃহীত হয়েছেন। এর কারণ তিনি দুই দেশেরই শক্তিশালী লেখকদের মধ্যে অগ্রগণ্য হিসাবে নিজেকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাকে এড়ানো যায়না। তিনি কোনো না কোনো ভাবে পঠিত হবেনই। তার লেখা নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে কিন্তু তার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা সত্যকে এড়ানোর মনোভাব হবে। যদিও পূর্ববর্তীদের সঙ্গে তার তফাৎ, তিনি এই কাজটি করেছেন নিভৃতে, কোনও প্রতিশ্রুতি ছাড়া তার স্বভাব ক্ষমতা দিয়ে। অন্যেরা সেটা করতে চেয়েছেন বা করেছেন বাংলায় ‘মুসলমানিত্বকে’ অগ্রাধিকার দিয়ে।
আমার মতে তার জনপ্রিয়তার প্রধানতম কারণগুলো হলো প্রচলিত সাহিত্য ধারার ভিন্নতায় অবস্থান নেওয়া। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও উপন্যাস বা গল্প বলবার যে প্রচলিত ‘এথিকস’গুলো আছে- তিনি তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। ধরা যাক বাংলা ও বাংলাদেশ জীবনে প্রেম-ভালবাসা ছাড়া অন্য কিছুই নেই, ছিল না। হুমায়ূন সে প্রথার বাইরে মৃদু (সফট) মেজাজের সংসার জীবনের মনোজাগতিক বিষয়গুলোর উপর জোরারোপ করতে থাকলেন। ভালবাসা ও ্পিরিতি ক্লান্ত পাঠক দল এর মধ্যে জীবনের সংস্পর্শ পেতে থাকলেন। এটা খুবই জরুরী আলোচনা যে সমগ্র বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলার পুবে সাহিত্য মানে একটি নীতির অন্তর্নিহিত ‘মেসেজ/বার্তা’ সর্বস্ব নির্ভরতায় নিপতিত, সেখানে তিনি এর বাইরে দাঁড়ালেন। লেখক হিসাবে এই সাহসী উদ্যোগই আমার মতে তার আস্থা’র পরিমাপের একক হতে পারে। তিনি ওই সময় থেকে সাক্ষাতকারগুলোতে বললেনও যে, তিনি বার্তা-অনুপস্থিত গল্প করছেন। তিনি তাঁর (তাঁর করা টেলিভিশন নাটকগুলোওকেও আমি লেখা হিসাবে দেখছি এই আলোচনায়) লেখায় একটি বিশেষ মধ্যবিত্তকে বেছে নিলেন। যাদের টেলিভিশন কেনবার বা দেখবার সামর্থ্য আছে বা যাদের তাঁর বই কিনবার সামর্থ্য আছে। তিনি তাঁর গল্প ও গল্পের চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও বেশী কৌশল ও চতুরতার আশ্রয়ী হলেন। অর্থাৎ ওই তাঁর প্রধান টার্গেট এরিয়া’র জনগোষ্ঠীর জীবনে আবার নিম্ন ও উচ্চবিত্তের যে মানুষ গুলোর সঙ্গে ‘ইন্টার এ্যাকশন’, তাদেরকেও রাখলেন। ফলে আমরা হয়তো দেখলাম তাঁর গল্পের প্লট-প্রধান উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার’এ একাধিক কাজের লোক থাকলো এবং তাদের মাধ্যমে নিম্নবিত্ত বা সর্বস্বান্তদের (সর্বহারা বলা হলো না রাজনৈতিক ফ্লেভার এড়ানোর জন্য) প্রাত্যাহিক জীবনের সত্য গল্প তিনি নির্মাণ করলেন। লেখক হিসাবে এই সাধারণ সমন্বয়ও তাঁর মত আর কেউ করতে যেমন ব্যর্থ হলেন একই ভাবে মেধায়’ও হয়তো সেরকম হয়ে উঠলো না। খেয়াল রাখতে হবে তিনি অফিসিয়ালি একজন মেধাবী লোক তা সৃষ্টিশীল লেখার বাইরে ‘এ্যাকাডেমিক’ পর্যায়ে। ফলে তাঁর গল্পে যাবতীয় সামাজিক ইন্টার-একশনে কোনও রকম ‘স্টুপিড’ মুভ থাকল না। অন্যেরা আর কেউ তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও টিঁকলেন না। এই হচ্ছে তার প্রথমদিকের অবস্থা। কিন্তু এর পর ক্রমান্বয়ে তিনি ওই বলয়ের অংশ হলেন। ওই বলয় তার অংশ হলেন। এরপর স্বেচ্ছায় কি অনিচ্ছায় হোক তিনি যে চক্র নির্মাণ করলেন তিনি তারই ভিকটিম (এটা জাজমেন্টাল হয়ে গেল তবুও একটি মূল্যায়ন অর্থে বলা হলো) হলেন আর, চক্রের টার্গেট গোষ্ঠীও ওই চক্রের ভিক্টিম হলেন। তারা একে অপরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এর বাইরে আর তিনি কোনদিন’ই বের হননি। বৃত্ত-বন্দী পাঠকরা তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলেন। তিনিও তাদের প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক হলেন।
অন্যদিকটি হলো তার রসবোধ মিশ্রণ। তাও আবার নির্মল রসবোধের সঙ্গে উপহাস সংযোগে। আমার ধারণা এই শক্তিই প্রাধানত তার জনপ্রিয় হবার সবচেয়ে শক্তিশালী ‘সিক্রেট’। না শুধু রসবোধের উপহাস নয় তার সঙ্গে আছে অপূর্ব সাইকো-এনালিটিক্যাল চরিত্র নির্মাণ। ফলে তাঁর নাটকে মামার সঙ্গী, সৈয়দ বংশের আভিজাত্যে ও মান মর্যাদার প্রশ্নে চশমা লাগিয়ে ঘোষণা দেয় যে রিক্সা চালনার মত মানহানিকর কাজ সে করতে পারবে না ইজ্জত রক্ষার্থে। একথা বলে সে চোখে চশমা আরও একটু কষিয়ে বসায়। কিন্তু এরপরই সে ঘোষণা দেয় যে ইজ্জত হরণকারী রিক্সা না চালাতে চাইলেও সে চুরি করতে পারবে। অথবা খেয়ালী বড়লোক শখ করে একদিন তার কাজের লোকদের টেবিল চেয়ারে খাবার অধিকার দিয়ে নিজে ভৃত্যের ভূমিকায় নামলে দর্শকরা দেখতে পায় কাজের লোকদের আদেশে তিনি পাগল প্রায়; এবং তারা হাত না লাগিয়ে কাটা চামচ দিয়ে খাবে দাবী করে। এইভাবে তার মনোজাগোতিক বিশ্লেষণ গুলোও সহজভাবে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে। তিনি মানুষের আনন্দ ও বেদনা অনুভূতি গুলোকে যত সার্থক ভাবে ধরতে পেরেছেন বাংলা সাহিত্যেই সে রকম উদাহরণ হবে বিরল।ধরা যাক সঙ্গীতের ব্যবহার প্রসঙ্গে। এমন সব গান এমনভাবে ব্যবহার করলেন, তা পেল জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্বীকৃতি। এটা তার ক্ষমতার অংশ। অর্থাৎ এই সব অর্জন গুলো তাঁর মেধাবী দিকেরই ফসল।
তাঁর ক্ষমতার ধরন সম্পর্কে দুয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ঢাকায় আজকাল যে পরিমাণ ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ...’র চলন তা আশে পাশের দুই-চার-দশটি দেশ মিলিয়েও সমান করা সম্ভব নয়। এটা দেখলে এখন মনে হবে বাঙ্গালী সংস্কৃতির (ঢাকা অংশে) এ যেন অবধারিত একটি বিষয়। এই অবদান সম্পুর্ণ হুমায়ূন আহমেদের। তিনিই একক ও ব্যাক্তিগত ভাবে আমদানি করেছেন যা এখন বাঙ্গালী (ঢাকা) সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে উঠেছে। বছর খানেক আগে আমি গুলশানে গিয়েছি আমার বিমানের টিকেটের ব্যাপারে। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা পেয়েছে খুব, সঙ্গী বলল নিকটস্থ বেকারীতে যেতে পারি। বেকারীতে ঢুকতে বাইরে দু’জন, ভেতরে একজন, তারপর দাঁড়িয়ে থাকা একজন, তারপর এগিয়ে আসা একজন; এরা সবাই আমাকে শুভেচ্ছা (গ্রিটিংস) জানাল এই বলে ‘আসালামুয়ালাইকুম’। আমি প্রথমজনকে সাড়া দিয়ে আর কাউকে সাড়া না দিয়ে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে (সেখানে সব শেষ সালামটা পেলাম) বলালাম আমি আপনাদের মালিক বা ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে পারি কিনা। তিনি বললেন, আমাকেই বলুন। বললাম আপনার কর্মীদের বলেন সালাম নিয়মে একব্যক্তিকে এক জায়গায় একজন দিলেই হয়। আমাকে যে পরিমাণ যন্ত্রণা দেওয়া হলো তাতে এখন আর আমার তৃষ্ণা বা ক্ষুধা নেই। তিনি বললেন আমি বলবো ওদের এবং ভাই বোঝেন তো এরা সব হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখে এ সব শিখেছে! আমি তখন হুমায়ূন সংস্কৃতির ক্ষমতা উপলব্ধি করি। এটাও তিনি খুব সার্থক ভাবে করেছেন। নিজে করতে না চাইলেও রাজনৈতিক রাষ্ট্র যেভাবে চেয়েছে, পাশাপাশি জনগণও যেভাবে চেয়েছে, তিনি তাদের কাউকেই আশাহত করেননি। ওই সূত্র, তিনি তাদের, তারা তাঁর। তাঁকেই বা কত দায়ী করা যায়। গত মার্চে আমি ঢাকায় পাকিস্তান-বাংলাদেশ খেলা দেখছি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ (সেকুলার বলে মেনিফেস্টো আছে তাদের), সন্ধ্যায় খেলা বন্ধ রেখে জাতীয় টেলিভিশনে আজান প্রচার করা হলো। তবে হুমায়ূন আর কী করেছেন? জনগণের সঙ্গে থেকেছেন। তার লাভ-ক্ষতি হিসাব আর করতে হয়না তেমন।
সবাই (এইখানে সবাই বলতে ঢাকার ‘উচ্চমান’ বলে খ্যাত ও দাবীদার লেখক-ক্রিটিকদের বলা হলো) যখন এই অভিযোগের জেকের’এর হল্লা অব্যাহত রাখলেন তখন তিনি (হুমায়ূন) ঘোষণা দিয়েই ওই অর্থে ‘সিরিয়াস’ রচনা অর্থাৎ উপন্যাস লিখলেন। কিন্তু তাও সিরিয়াস হলো কিনা প্রশ্ন থেকে গেল। অর্থাৎ তার ‘সিরিয়াস’কেও হয়তো সিরিয়াস গণ্য করা হোলও না। কিন্তু আসলে ধরে নিতে হবে তার সিরিয়াস সাহিত্যের ধরনই ওইরকম। যা কিছু বের করতে হবে তা এর মধ্য থেকেই নিতে হবে। অতএব সিরিয়াস সাহিত্যের যে ‘ক্রাইটেরিয়া সমূহ’ পূর্ব নির্ধারিত রয়েছে তার সঙ্গে হুমায়ুনের ধরণগুলোকে যোগ করে নিতে হবে।
হুমায়ুনের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের বাইরে যায়নি। এ কথার অর্থ এই নয় যে তার লেখা পাঠ পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়বার কথা বলা হচ্ছে। কোলকাতা কেন্দ্রিক পাঠকের কথাই বলা হচ্ছে। আমার হিসাবে সেটা একটি বাস্তব কারণেই ঘটেনি। কোলকাতার পাঠকদের পুরনো একটি ধারাবাহিকতার পাঠাভ্যাস রয়েছে। যে পদ্ধতিতে তিনি ঢাকা কেন্দ্রিক পাঠকদের জয় করেছেন, অনুরূপ কোলকাতার ক্ষেত্রে ঘটানো সম্ভব হয়নি। দেশ তাকে ছেপেছে, কিন্তু পাঠক প্রিয়তা ঘটেনি। তার কারণ ওই ধরনের পাঠাভ্যাস সেখানে নেই। তার অর্থ আবার এইও ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে সেটা উন্নত, হুমায়ুনেরটা নয়। ওই রকম হিসাব করলে এর উল্টা দিকটাও বিবেচনায় আনতে হবে। আমার ধারণা হুমায়ূন নিজেও তা চাননি। চাইলে পারতেন। আর্থ-সামাজিক যে অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে অভ্যস্ত সেই গোষ্ঠী কোলকাতা কেন্দ্রিকও আছে। সহসা সেই পাঠক পাওয়া তার জন্য কঠিন হওয়ার কথা নয়। আর একটা কারণ, তিনি ছিলেন ‘প্রফেশনাল’ লেখক। যার অর্থ ‘অর্থ’ বা টাকা প্রধান, কোলকাতার স্পন্সর’রা যদি ঢাকা’র মত তাকে সেই জায়গাটা পূরণ করতে পারত নিশ্চয়ই তিনি সেখানের জন্য লিখতে পারতেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য সেখানকার পাবলিশার/পত্রিকা/বা টিভিগুলো বলবে- তারা যদি আবার তাকে বিক্রি করে সে টাকা না তুলতে পারে তাহলে হুমায়ূনকে তারা দেবেন কোত্থেকে বা কেন। তাহলে সেই কথাটাই থাকে যে, মূল জনপ্রিয়তার ঘাটতিই তার ক্ষেত্রে কোলকাতায় সত্য। তারপরও আমার ধারণা কোনও চতুর পাবলিশার উপলব্ধি করতে পারলে নিশ্চয়ই তাকে ‘বাজার’ করবার ব্যবস্থা করতেন। এবং সে উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কথা ছিল না। সেখানে কোনও ‘পলিটিক্স’ থাকতে পারে। তা আমার জানবার বা বুঝবার কথা নয়। এখনো যদি তার বই কোলকাতায় ‘বাজারজাতকরণ’ উদ্যোগ নেয়া হয় আমার ধারণা একটা বাজার-ফল পাওয়া যাবে।
অতএব তাঁর মৃত্যু নিয়ে কোলকাতায় যে হৈচৈ হলোনা তাও ওই ‘নিউজ-ভ্যালু’ টার্মে পরবে। এতে মান অভিমান, দুঃখ-কষ্টের জায়গাটা অর্থহীন। নিউজ কেন ও কী কারণে থাকবে তা সব সময় প্রত্যাশা থেকে হতে পারেন। হুমায়ুনের জীবন-মৃত্যু কোলকাতায় কোন ‘সংবাদ-মূল্য’ নেই। বাংলার লেখকরা কেন কোলকাতা মুখাপেক্ষী তার কারণ ঐতিহাসিক। সেটা খুব দোষের নয় বলেই আমার মনে হয়। কোলকাতাও একইভাবে থাকবে সেটা ‘আত্মীয়তার’ দাবীর মতন। সত্য আত্মীয়তা মানে না। আমরা তোমাদের মুখাপেক্ষী বলে আমাদের (পূর্বাংশের) এই দাবী ও প্রত্যাশা আসলে আবেগ থেকে আসা একটি অভিব্যাক্তি। কেউ কাউকে সাংস্কৃতিক ভাবে কারো দিকে কেবলামুখি হতে জোর করেনা। কিছুদিন আগে আমেরিকান সাইন্স ফিকশন লেখক (ফ্যারেনহাইট ৪৫১ খ্যাত) রে ব্র্যাডবেরি’র মৃত্যু সংবাদ আমি ঢাকায়ও দেখেছি। এখন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ আমেরিকায় নেই কেন প্রশ্নটা যে কারণে উঠবে না সেই কারণ কোলকাতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এইভাবে- হুমায়ূন ‘থাকবেন না’ বলে জেকের ও জাকেরান যতদিন থাকবে অন্তত ততদিন সূত্র অনুযায়ীই ওই ‘না-বলি’য়েদের জ্যোতিষ বাণী উপেক্ষা করে সেটাও ‘ব্যালেন্সড’ হতে গিয়ে দশকের পর দশক পার হয়ে যাবে শরৎ’এর মতন।
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ০২:০৩90351
কুলদা রায় | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ০২:৩৫90352
সুশান্ত কর | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ০৫:২২90353
কুলদা রায় | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ০৫:৫২90354
কুলদা রায় | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ০৫:৫২90355
কুলদা রায় | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ০৫:৫৩90356
আবুল খায়ের | unkwn.***.*** | ০১ আগস্ট ২০১২ ১২:৪২90350
রূপঙ্কর সরকার | unkwn.***.*** | ০২ আগস্ট ২০১২ ০৪:৩৩90357
কল্লোল | unkwn.***.*** | ০২ আগস্ট ২০১২ ০৪:৩৯90358
কথা | unkwn.***.*** | ০২ আগস্ট ২০১২ ০৬:১৩90359
চৈতালি | unkwn.***.*** | ০৪ আগস্ট ২০১২ ০৩:০১90360
শঙ্খ | unkwn.***.*** | ০৫ আগস্ট ২০১২ ০৪:৫৫90361
চৈতালি | unkwn.***.*** | ০৫ আগস্ট ২০১২ ০৬:৪২90365
maximin | unkwn.***.*** | ০৫ আগস্ট ২০১২ ০৭:০২90362
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০৫ আগস্ট ২০১২ ০৯:১৪90363
শুদ্ধ | unkwn.***.*** | ০৫ আগস্ট ২০১২ ১২:১৬90364
ফৈরা দার্শনিক | unkwn.***.*** | ০৬ আগস্ট ২০১২ ০৫:২৪90366
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ১২:৫৬90367
শুদ্ধ | unkwn.***.*** | ১৭ আগস্ট ২০১২ ০১:১৮90368