এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • পরমাণু শক্তি সম্পূর্ণ বর্জন করে শক্তি সমস্যার সুস্থ সমাধান করা সম্ভব

    সুজয় বসু লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ জুন ২০১১ | ৫৭৮ বার পঠিত
  • পরমাণু শক্তি চাই না। অনেকেরই ধারণা শক্তির এই চমকপ্রদ উৎসটি বাদ দিলে মানবজাতির শক্তির প্রয়োজন কিছুতেই মেটানো যাবে না। যদি বলা হয় পরমাণু শক্তি তো পৃথিবীতে ব্যবহৃত শক্তির ৬ শতাংশেরও কম যোগান দেয়, যেখানে জৈবভর অর্থাৎ কাঠ-পাতা, জীব-বর্জ্য, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি থেকে পাওয়া যায় ১০ শতাংশ। কী এমন প্রভাব পড়বে পরমাণুর অংশটা অন্য উৎস থেকে মেটালে? তখনই শোনা যাবে খনিজ জ্বালানির সীমিত ভাণ্ডারের সমস্যা। তেল-গ্যাস-কয়লার ভাণ্ডার সত্যিই সীমিত। যে ক্রমবর্ধমান হারে এগুলি পোড়ানো হচ্ছে তাতে কয়েক দশকের মধ্যেই তেল-কয়লা সরবরাহে টান ধরবে অবধারিত ভাবেই। ইদানীং আবার তেল-কয়লা জ্বালানোর জন্য অন্য এক গভীর সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে --- বিশ্বের উষ্‌ণায়ন ঘটছে এবং তার প্রতিকারে জোর চাপ বাড়ছে কার্বন-ভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার দ্‌রুত কমিয়ে এনে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে একটি সহনীয় মাত্রায় আনতে। সব মিলিয়ে এই শতাব্দীতে শক্তি সরবরাহের প্রধান উৎসগুলোর স্থায়িত্ব ও ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই মনে করছেন শক্তির ক্ষেত্রে সাবেকি পথ ছেড়ে নতুন দিশার সন্ধান করতে হবে।

    শক্তির উৎস নির্বাচনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় ভালোভাবে যাচাই করার দরকার, এগুলির মধ্যে প্রধান হল : (ক) স্থানীয় লভ্যতা, (খ) অর্থনীতি ও (গ) পরিবেশ-অনুকূলতা। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থানের দৃঢ়তা নির্ভর করে তার আবশ্যিক প্রয়োজনাদি মেটানোর ক্ষমতার ওপর। শক্তির ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদনেই প্রয়োজন না মিটলে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করতে গেলে তার দাম মেটানোর মতো অর্থের সংস্থান থাকতে হবে। উৎস সহজ এবং সরবরাহ সুলভে করতে পারলে অর্থনীতি গ্রহণযোগ্য হবে। কোনো শক্তির ব্যবহারে পরিবেশ দূষিত হলে, সে পরিবেশ স্থানীয় বা বৈশ্বিক যাই হোক, তার গ্রহণযোগ্যতা কমল --- দূষণ মারাত্মক হলে সেই উৎস বর্জন করতেই হবে। মোটামুটি এই তিনটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবস্থা থাকলে শক্তির উৎসটি নির্বাচন-গ্রহণে কোনো বাধা থাকবে না।

    পরমাণু শক্তির ক্ষেত্রে এই সীমিত বিচারেই এর গ্রহণযোগ্যতা থাকছে না। পরমাণু জ্বালানি ইউরেনিয়াম এদেশে আছে নামমাত্র। এখন বিদেশ থেকেই সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ দেশে থোরিয়াম আছে যা বিশেষ চুল্লিতে --- প্রজনী চুল্লিতে --- কিছুটা রূপান্তর ঘটিয়ে শোধন করে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু তার প্রযুক্তি যদি বা আয়ত্ত করা যায়, রূপান্তরকাল অতি দীর্ঘ হওয়ায় বাস্তবে এই জ্বালানিকে প্রাথমিক ব্যবহারের স্তরে আনতেই কয়েক দশক পেরিয়ে যাবে। সুতরাং স্থানীয়ভাবে এই শক্তি উৎপাদনের জ্বালানির অভাব এমন প্রকট যে অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে আমেরিকার, অনুগ্রহ ছাড়া এই শক্তি সরবরাহ সম্ভব হবে না। অর্থনীতির প্রশ্নটি সামান্য নয়, পরমাণু শক্তি বর্তমানে যা ব্যবহার করা হচ্ছে তা প্রচলিত শক্তির তুলনায় তো বটেই, এমনকী সৌরশক্তির তুলনায়ও মহার্ঘ। গত বছর আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনার এক গবেষক গোষ্ঠী জানিয়েছে যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েই চলেছে। বিপরীতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন-ব্যয় কমছে এবং একসময় সৌরবিদ্যুতের দাম একক পিছু পরমাণু বিদ্যুতের দামের চেয়ে কম হবেই। এই গোষ্ঠী নানাবিধ তথ্যাদি সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে ২০১০ সালেই এই প্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটেছে। পরমাণু বিদ্যুতের অর্থনীতির বিচারে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও রয়েছে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের নিরাপদ সংরক্ষণ এবং চুল্লির বিস্থাপন (ডিকমিশনিং)-এর ব্যয়ের কোনো স্থির হিসাব এ পর্‌যন্ত কোনো দেশ থেকেই পাওয়া যায়নি। ওয়াকিবহাল মহলের এক অংশের মতে বিস্থাপনের ব্যয় স্থাপনের ব্যয়কেও ছাপিয়ে যেতে পারে। সর্বশেষে পরমাণু কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় দূষণ। অন্যান্য সবরকম দূষণ থেকে এর প্রকৃতি আলাদা। অন্যান্য দূষণ সম্পূর্ণ অপসারণ না করতে পারলেও তার মাত্রাকে কমিয়ে আনা যায়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের নিম্নতম কোনো মাত্রা নেই যা ক্ষতিকর নয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ-তীব্রতা কমে ওই মৌলের জ্ঞঅর্ধজীবনঞ্চ অনুযায়ী। যতটা সময়ে বিকিরণ-তীব্রতা অর্ধেকে নেমে আসে সেই পরিমাণ সময়ই ওই মৌলের অর্ধজীবন এবং এটি একটি ধ্‌রুবক অর্থাৎ কোনো প্রক্রিয়াতেই মৌলটির অর্ধজীবন পরিবর্তন করা যায় না। বিকিরণ মানুষের দেহযন্ত্রাদির বিকলন ঘটায় এবং জীনগত পরিবর্তন এনে পরবর্তী প্রজন্মগুলির মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের বিকলন আনে। আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনাবসান কাল নির্ভর করে বিকিরণমাত্রার ওপর। মাত্রা বেশি হলে কয়েক ঘন্টা, দিন বা সপ্তাহে; কম হলে কয়েক বছরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতি যন্ত্রণাদায়ক কর্কট রোগে। চের্নোবিল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৯৮৬ সালে একটি চুল্লি বিস্ফোরণের ফলে ২০০৪ সাল পর্‌যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৯ লক্ষ ৮৫ হাজার মানুষ। এই হিসাব দিয়েছেন দুঞ্চজন রাশিয়ান পরিবেশ ও পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানী। (এই তথ্যপুস্তকটির প্রকাশক জ্ঞনিউ ইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্সঞ্চ, প্রকাশ সাল ২০০৯।)

    পরমাণু শক্তির কোনো গ্রহণযোগ্যতাই স্থিতবুদ্ধির বিচারে নেই। মহার্ঘ, অতি বিপজ্জনক এই উৎসটি মানবকুল যত শীঘ্র বর্জন করে ততই এই গ্রহের মঙ্গল। একটি সঙ্গত প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা হল পৃথিবীর এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর শক্তির চাহিদা, যা বেড়েই চলেছে ছেদহীন ভাবে, তার যোগান আসবে কোথা থেকে? সঙ্গত প্রশ্ন। কয়লার প্রচলন হয় ষোড়শ শতকে, খনিজ তেল উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। শিল্পযুগের সূচনা এই সময় থেকেই মোটামুটি ধরা হয়। শক্তির লাগামছাড়া ব্যবহারবৃদ্ধি ঘটেছে বিংশ শতকে। এই শতাব্দীর সূচনায় পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১৬০ কোটি এবং বাৎসরিক বাণিজ্যিক শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টন তেল-সম (সম পরিমাণ খনিজ তেলের সম্পূর্ণ দহনে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়)। শতাব্দী শেষে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০ কোটি এবং শক্তি ব্যবহার ১০০০ কোটি টন তেল-সম --- অর্থাৎ চারগুণের কম জনসংখ্যা বাড়ল আর শক্তির ব্যবহার বাড়ল দশগুণ। ধরিত্রী এই চাপ সহ্য করার অবস্থায় নেই। খনিজ তেল ফুরিয়ে আসছে। বিপুল পরিমাণ তেল-কয়লার দহনে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ লক্ষে ৩৯ ভাগে পৌঁছেছে। গত সাড়ে ছঞ্চলক্ষ বছরে এই পরিমাণ লক্ষে ৩০ ভাগ অতিক্রম করেনি। মানুষ এই পৃথিবীর আবহাওয়ায় এমন পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে যাতে জীবকুলের জীবনরক্ষাতেই এক গভীর সংকট দেখা দিচ্ছে। এখনই সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপচয় বন্ধ করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক স্তরে এই আলোচনা গত দুঞ্চদশক ধরেই চলছে। সামান্য সচেতনতা এসেছে, কিন্তু শক্তি ব্যবহারের যে ধারা চলে আসছে তার কোনো পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে না। সরকারি তরফে নিয়মরক্ষায় কিছু নির্দেশ, কিছু কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটছে না।

    শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন কার্বনহীন উৎসকে গুরুত্ব দিয়ে তার ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন তেমনই শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও সংযমের সঙ্গে প্রয়োজন শক্তি সংরক্ষণের। শক্তি উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন রূপে, প্রধান হল তাপশক্তি ও বিদ্যুৎ শক্তি। যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদনই প্রাধান্য পায়, কারণ শক্তিকে এই রূপে স্থানান্তরে প্রেরণ প্রায় অসম্ভব। একমাত্র বিদ্যুৎ শক্তিকেই বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে দূরদূরান্তে পরিচলন সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নাগরিক জীবনযাত্রায় ও কলকারখানায় বিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও বিদ্যুৎ শক্তি প্রায় সব দেশেই মোট ব্যবহৃত শক্তির এক-তৃতীয়াংশের মতো হয়। পরমাণু শক্তি একমাত্র বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করেই ব্যবহার করা হচ্ছে --- জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহী তন্ত্রের সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সংযুক্ত করেই এই শক্তির ব্যবহার হয়। সেদিক থেকে উৎস হিসেবে পরমাণুর একটা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।

    পরমাণু শক্তিকে সম্পূর্ণ বর্জন করার প্রস্তাবে দেখে নেওয়া দরকার পৃথিবীর প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের শক্তির প্রয়োজন কীভাবে মেটে। জ্ঞইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সিঞ্চর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান (২০০৮ সালের) অনুযায়ী এই বছরে শক্তির ব্যবহার হয়েছে ১,২২৭ কোটি টন তেল-সম এবং তা সংগ্রহ হয়েছে শতকরা হিসেবে : তেল ৩৩.২%, কয়লা ২৭.০%, প্রাকৃতিক গ্যাস ২১.১%, জলশক্তি ২.২%, জৈবভর ১০.০%, পরমাণু শক্তি ৫.৮% ও অন্যান্য (নবীকরণযোগ্য) ০.৭%। পরমাণু শক্তি (একমাত্র বিদ্যুৎ রূপেই) দিয়েছে পৃথিবীর মোট উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তির ১৪ শতাংশের কম। ২০১০-এ এই অংশটা আরও কম হয়েছে। এই বছরে বিশ্বে বায়ুবিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন মোট বিদ্যুতের ২.৫%, উৎপাদনক্ষমতা ২ লক্ষ মেগাওয়াট। ২০২০ সালে এটা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ লক্ষ মেগাওয়াট। আগামী দশ বছরে বিদ্যুৎ ব্যবহারমাত্রা বাড়বে। যে হারে বাড়বে সেই হারে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে না। ফলে তার অংশটা ১৪ শতাংশের কমই থাকবে। সুতরাং দায়িত্ব নিয়ে এটা নিশ্চয়ই বলা যায় যে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনমাত্রা বাড়িয়েই পরমাণু বিদ্যুতের অভাব শতাংশে মেটানো যাবে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকদল আমেরিকার জ্ঞন্যাশনাল এরোনেটিক্‌?স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনঞ্চ বা নাসার সহযোগিতায় কৃত্রিম উপগ্রহ ও বেলুনের সাহায্‌যে সারা পৃথিবীর বায়ুপ্রবাহের গতি এবং স্থায়িত্ব সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করে এবং তা বিশ্লেষণ করে সাড়ে সাত হাজার বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনযোগ্য স্থানের সন্ধান পেয়েছেন। এঁদের মতে এই স্থানগুলির (যেমন টাসমানিয়া দ্বীপ) মাত্র ২০ শতাংশে বায়ুখামার (উইন্ডফার্ম) বসিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যাবে।

    সৌরকোষের সাহায্‌যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা, সরকারি অবহেলা সত্ত্বেও, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির গবেষণার ফলে ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাণিজ্যিক স্তরে এই কোষগুলির দক্ষতা ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। সঙ্গে সঙ্গে দামও কমছে। বর্তমানে সৌরকোষ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ১৫,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। আমেরিকার জ্ঞন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরিঞ্চর তিন গবেষক সৌরশক্তি থেকেই ২০৫০ সালে আমেরিকার বিদ্যুৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ মেটানোর পরিকল্পনার নকশা প্রকাশ করেছেন। একথা ঠিক যে সৌরশক্তি সবসময় সমানভাবে পাওয়া যায় না, এর হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। সর্বক্ষণের চাহিদা পূরণ তাৎক্ষণিক উৎপাদনে সম্ভব নয়। প্রয়োজন শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থার, সাধারণভাবে ব্যাটারির সাহায্‌যে যা অহরহই করা হয়ে থাকে। খুব বড়ো মাপে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ব্যাটারির দুর্বলতা রয়েছে। বড়ো মাপের বিদ্যুৎ শক্তি সঞ্চয়ের দুটি পৃথক পদ্ধতি অনেকদিন ধরে ইউরোপ ও আমেরিকায় চলছে। প্রথমটি হল নিচের জলাধার থেকে বিদ্যুতের সাহায্‌যে পাম্প করে জল ওপরের জলাধারে তোলা বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকার কালে এবং প্রয়োজনে ওপরের জলাধার থেকে জল ছেড়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতোই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ঘাটতি মেটানো। দ্বিতীয়টিতে জলের পরিবর্তে বাতাসকে খুব উঁচু চাপে বদ্ধ আধারে, মাটির নিচে কোনো গহ্বরে বা মাটির ওপরে কোনো ধাতব আধারে, রেখে দেওয়া বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত অবস্থায় কমপ্রেসর চালিয়ে আবার ঘাটতির সময় উঁচু চাপের বাতাসের সাহায্‌যে টারবাইন জেনারেটর চালিয়ে ঘাটতি মেটানো। পদ্ধতি দুটিই প্রাচীন এবং পরীক্ষিত, কোনো নতুন উদ্ভাবন প্রয়োজন নেই। এই জাতীয় যন্ত্রপাতি এখনই বাজারে বিক্রি হয়। স্বল্প সঞ্চয় ব্যাটারির সাহায্‌যেই করা যাবে। নতুন উন্নত ধরনের ব্যাটারি পাওয়া যাচ্ছে --- ওজন কম, সঞ্চয়-ক্ষমতাও বেশি। সুতরাং পরমাণু বিদ্যুৎ বর্জন করলে এই আধুনিক সভ্যতা রসাতলে যাবে ধারণাটা সম্পূর্ণ অমূলক। বস্তুত সাম্প্রতিক তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আশংকা বাড়ছে সরবরাহ নিয়ে। উৎপাদন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছতে খুব একটা দেরি নেই। তার পর থেকেই সরবরাহে স্থায়ী টান ধরবে। এ সম্পর্কে এখন থেকেই ব্যবস্থাদি নেওয়া দরকার, জরুরি ভিত্তিতে।

    একথা স্বীকার করতেই হবে, অস্ত্রসম্পর্ক জোরালো থাকার কারণে তৃতীয় বিশ্বের কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে, পরমাণু শক্তির খাতে ব্যয় বরাদ্দ অতি অসঙ্গতভাবে মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। ভারতে পরমাণু শক্তি কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মধ্যেই। এশিয়ায় ভারতই ছিল অগ্রণী। সেই কাল থেকে এক বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দে লালিত হয়েছে পরমাণু শক্তি বিভাগ। ষাট বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরমাণুর অবদান মাত্র ৩ শতাংশ। নবীকরণযোগ্য শক্তি উন্নয়ন এ দেশে পরমাণুর প্রবল প্রতাপে অবহেলিতই থেকে গেছে। সরকারে একটি বিভাগ সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৮২ সালে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে --- জ্ঞঅচিরাচরিত শক্তি বিভাগঞ্চ (ডিপার্টমেন্ট অব ননকনভেনশনাল এনার্জি সোর্সেস)। এই বিভাগের উদ্যোগে ১৯৮৬ সালে গুজরাতে একটি ছোটো বায়ুবিদ্যুৎ যন্ত্র বসিয়ে এ দেশে বায়ুবিদ্যুৎ উন্নয়নের সূচনা হয়। মাত্র দশ বছরে, ১৯৯৬ সালে, বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারত তৃতীয় স্থানের অধিকারী হয়। এখনও অবধি এ দেশ বায়ু শক্তির ক্ষেত্রে গৌরবজনক পঞ্চম স্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বায়ু শক্তি সংস্থা --- জ্ঞইন্টারন্যাশনাল উইন্ড এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনঞ্চ-এর বর্তমান সভাপতি একজন ভারতীয়। নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে গত নব্বইয়ের দশকে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ছিল পরমাণু শক্তি বাদে শক্তি খাতে সাধারণ মোট ব্যয় বরাদ্দের ১.৬ শতাংশ মাত্র। পরমাণুর প্রবল প্রতাপে নবীকরণযোগ্য শক্তির উন্নয়ন এ দেশে পূর্বাপর অবহেলিতই থেকেছে। শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডেনমার্ক একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বায়ুবিদ্যুৎ প্রযুক্তিতে এই দেশ বিশ্বে সেরা। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১০ সালে বায়ু থেকে এসেছে ২৪ শতাংশ। প্রথম থেকেই ডেনমার্ক পরমাণু শক্তিকে বর্জন করে। অধিক গুরুত্ব দেয় শক্তির উৎপাদন-ব্যবহার ব্যবস্থাপনায়, অপচয় রোধে। এই দেশের জাতীয় আয় বেড়েছে শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ না বাড়িয়েই। সরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে একদিকে যেমন নবীকরণযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে বায়ুশক্তির, প্রযুক্তি উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, অন্যদিকে অপচয়কে যথাসম্ভব, প্রয়োজনে আইন করে, কমিয়ে এনেছে।

    ভারতে শক্তিনীতির কোনো দীর্ঘকালীন রূপরেখা রচিত হয়নি। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে, অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। কিন্তু কার্‌যক্ষেত্রে সেগুলি আন্তরিকতা এবং সততার সঙ্গে অনুসৃত হয়নি। দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ সামান্য নয়, অপচয়ের পরিমাণও কম নয়। অপচয় রোধে এক দশকেরও বেশি নানা টালবাহানার পর একটি সরকারি আইন পাশ হয়েছে ২০০২ সালে। আইনভঙ্গকারীদের শাস্তির উল্লেখও আইনে আছে, থাকতেই হবে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আইনটি তেমন কার্‌যকর করা যায়নি। পরমাণু বিদ্যুতে সরকারি আগ্রহ ও আকুলতার বিপরীতে শক্তি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি উদাসীনতাকে ক্ষমার অযোগ্য বলতে দ্বিধা হয় না।

    বিপজ্জনক ও মহার্ঘ পরমাণু শক্তির কোনো প্রয়োজনই এদেশে নেই। নবীকরণযোগ্য শক্তির উন্নয়ন ও বিস্তার এবং সংরক্ষণের সঠিক ও সম্ভাব্য সুফল পেতে এক/দুই দশক লেগে যাবে। ততদিন কয়লাকে আশ্রয় করে শক্তির প্রয়োজন মেটানো যাবে --- কার্বন নি:সরণের পরিমাণ খুব একটা না বাড়িয়েই। সমস্যার গুরুত্ব কেউই অস্বীকার করে না। প্রয়োজন একটা সুস্থ সমাধানের।

    এই সমাধান আসবে পরমাণু শক্তিকে সম্পূর্ণ বর্জন করেই।

    সংবাদ মন্থনে পূর্বপ্রকাশিত

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ জুন ২০১১ | ৫৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন