বুড়াটা হাঁটছিল মাঠের আলপথ ধরে হন হন করে। বেরোনোর সময় পেরেকে খোঁচা লেগে খাটো ধুতিটা ফেঁসে গেছিল, বাদামি চামড়া প্রায় তাই হাঁটুর প্রায় ৪ ইঞ্চি ওপর থেকেই দেখা যাচ্ছে। দূরে লামটিংগা পাহাড়ের নীল ছায়া পড়েছে ফসলি জলে, তির তির করে গমের ডগা কাঁপছে, ছাতারে পাখির চেঁচামমেচিতে বিরক্ত হয়ে তীক্ষ্ণ উড়াল দিচ্ছে মাছরাঙা। বুড়া যদি কবিতা লিখতে পারত বেশ হতো, তবে বুড়া এসব লক্ষ্য করত না অন্য দিন হলে। আজ করলো, কারণ ওর মতই আরেকটা বুড়া গাছের শেকড়ে ধাক্কা লেগে পায়ের আঙুলের চলটা উঠে গেল বলে। এক্ষুনি পাথরকুচি পাতা না বেটে দিলে, ভোগাবে। একটা অস্ফুট খিস্তি করলো বুড়া। এতক্ষণে খিদেটাও পেটে হালচাষ করা শুরু করে দিয়েছে, যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তখন সূর্য সবে উঠেছে, এখন পাহাড়ের ঢালু কাঁধে মাথা রেখে ডুব যায় যায়। সামনে বয়ে যাওয়া ঝোরা থেকে আঁজলা আঁজলা জল মুখে গায়ে দিয়ে একটু পেট ভরানোর চেষ্টা করলো বুড়া। এখনো দুটো গ্রাম পেরোতে হবে তাকে। সামনে একটা প্রাগৈতিহাসিক পাথরের আড়ালে উদোম বুকে চান করছে এক দল মারিয়া মেয়ে। তাদের শুকনো শাড়ি মরা গাছটার ডালে টাঙিয়ে রাখা আছে, উড়ছে অনবরত। দুলছে ডালগুলো, এরম দুলুনি আজ সকালেও কোথায় যেন দেখেছে সে, আবছা আবছা মনে পড়ছে আবার উড়ে যাচ্ছে সামনের কাকগুলোর মত। কিন্তু কেন ঘর থেকে বেরিয়েছে সক্কাল সক্কাল কিছুতেই মনে পড়ে না তার। একটা আধপোড়া চুট্টা ধরালো সে, গাছে হেলান দিয়ে।
সমস্ত ঘটনা যেন এই ফাঁকের অপেক্ষায় ছিল, খালি মাথায় বগবগ করে ঢুকতে শুরু করে দেয় বুড়ার। রুমকি আর ঝুমকিকে সেও তো দোল খাওয়াত নিজের হাঁটুতে। বুড়ি বেঁচে থাকতে ওদের ঘুমপাড়ানি গান শোনাত প্রতিদিন “ও সোনার বিটিয়া লো হামার”! চাঁদ কি বিরক্ত হত প্রতিদিনের একই প্রস্তাবে? তা জানা যায়নি তবে বুড়ি একদিন পাহাড় থেকে নামার পথে একটা ভালুকের মুখোমুখি পড়ে যায়, সঙ্গিনী খুঁজতে ব্যস্ত ভালুক হয়ত একটু অপ্রস্তুত হয়ে আর একটু রসিকতা করে বুড়ির কান আর নাক খিমচে ছেড়ে দেয় । সেই আধঝোলা নাক-কান নিয়ে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে জানা যায় ডাক্তার সাহেব এ সপ্তাহে কলকাতা গেছেন, শুক্রবারের স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে। ৬ ঘন্টায় ২৫ কিমি রাস্তা পেরিয়ে টোউন পৌঁছনোর পথেই জ্বরের তাড়সে বেঁকে যায় বুড়ি, হাসপাতালে আর চোখ খোলে নি। এর কিছুদিন পরেই চাঁদ না হলেও সোনার বিটিদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে সরকারি কন্ট্রাক্টর গাংনারান বাবুর ছেলে ভাগিরথ। সবে মাত্র লায়েক হয়েছে সে, বিছানা গরম রাখার প্রয়োজন তার রোজ-কে-রোজ। গ্রামের ভিতরে ধুলোর মাটিতে তার লাল বুলেট ভটভটিয়ে উড়ে বেড়ায়, নথ ভাঙার চিহ্ন পড়ে থাকে পিছনের খেতে, ঝোরার পাশে জঙ্গলে। বুড়া সেদিনও দুপুরে নারান বাবুর খেতে নিড়ানি দিচ্ছিল, বাড়ির ইঁদারায় চান সারছিল ঝুমকি। হঠাৎ ভটভটির আওয়াজ এসে থামে ওদের বাখারির দরজার বাইরে, ঘরে ঢুকে এসে ভিজে ঝুমকিকে জড়িয়ে ধরে ভাগিরথ। এরপর খানিকটা ঝটপট শব্দ, কুয়োর বালতির ঝনঝন একটা শাসানির শব্দ ক্রমে তীব্র আর্তনাদে মিশে যাওয়া। রক্ত ভেজা মাথায় রুমাল চেপে ‘শালি খানকির চুত’ বলতে বলতে বেরিয়ে যায় ভাগিরথ। ভিতরে তখনও রক্ত, চুল লেগে থাকা, একপাশ তেবড়ে যাওয়া লোহার বালতিটা হাতে নিয়ে রুমকিকে জড়িয়ে কাঁপছে ঝুমকি। পাড়ার ভক্তিপ্রসাদের কাছে খবর পেয়ে বাড়ী ফেরে হাঁপাতে হাঁপাতে। একটু বাদেই থানা থেকে জমাদার মিসিরজি আসে, থানায় তুলে নিয়ে যায় বুড়াকে, জিপের হাতায় দাঁড়িয়ে ভাগিরথ একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে সাপ চোখে পরখ করে গেল বুড়াকে। বছর পনেরোর মেয়ে দুটো শুধু অবলা গরুর মত তাকিয়ে থাকে জিপের দিকে। এতে বুড়া অবাক হয় না, বাবুদের গায়ে হাত পড়লে পুলিস সাহাব তো এসব করবেই। মেয়ে দুটোকে তুলে নিয়ে যায়নি বলে মনে মনে হনুমানজীকে ধন্যবাদ জানায় বুড়া। এই তো গেল বার মাহাতদের ছোট মেয়েটাকে সারা রাত থানায় রেখে দিল গেজেট বাবুর ২০ টাকা চুরির নামে, সকালে যখন নামিয়ে দিয়ে গেল মেয়েটা তখন পাগল হয়ে ভুল বকছে। টোউনের ডাক্তার বাবুরাও কিছু করতে পারেনি। কেউ কিছু না বললেও, সবাইই জানে জমাদার আর সেপাইরা মিলে কিরম খানা তল্লাসি করেছিল ওই একরত্তি মেয়েটার ।
এবছর পুরতে পুরতে না পুরতেই সাদি বানাতে হবে দুটোর, শুধু টাকা যোগাড় করতে হবে হাজার বিশেক। গাংনারান বাবু বলেছে মাসে শটাকায় দশ টাকার হিসেবে ধার দেবে, অত অঙ্ক টঙ্ক মাথায় ঢোকে না বুড়ার। সে এখানের আর পাঁচটা লোকের মতই জানে, যে এই মুলুকে সরকার বা ব্যাঙ্ক যাই হোক না কেন, সবই ওই গাংনারান বাবু ।
থানায় অবশ্য বিশেষ কিছু করেনি ওকে, দুটো রুলের গুঁতো খেয়েই মুখ গুঁজড়ে সেপাইদের পায়ে পড়ে যায় বুড়া। আচ্ছাসে সারারাত দলাই মলাই করিয়ে বাছা বাছা কাঁচা খিস্তি দিয়ে ভোরে এক লাথ মেরে তাকে থানা থেকে বের করে দেয় কনস্টেবল সিং। ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে। বাতাসে এখনো বহত জাড়, ভালো করে গায়ে আলোয়ান টেনে নেয় বুড়া। কুয়াশার মাঠের ওপারেই তার বাড়ি। ধোঁয়া ধোঁয়া ডাইনি বুড়ির মত কুয়াশা উড়ছে মাঠের পিছনে, আকাশে গাছে...আজ এত পাখি উড়ছে কেন বাড়ির সামনে? পায়ের শব্দে ঝোপে ঢুকে যায় একটা লোমড়ি। বাড়ির সামনে হাটুরে ভিড়, বুড়ার বুকে ঢেঁকির পাড়। বাড়িতে দৌড়ে ঢোকার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরল নিবারণ, মোড়ের মনিহারি দোকানি। যাস না রে বুড়া ওদিগে, বিটিয়ারা আর নাই রে তোঁহার। বুড়ার পা টলমল, চোখ পাথর তবুও সা-জোয়ান এর শক্তিতে নিবারণকে ঠেলে ঢুকে আসে দরজার ভিতরে, বেশিদূর যেতেও হয় না। ইঁদারার পাশে রুমকির লাগানো ঝুপসি জাম গাছের দুটো ডালে কে ওরা দুল দুল ঝুলছে? বুড়ার চোখে ইস্টিশনের বড় ঘড়ির পেন্ডুলাম, একবার এদিক একবার ওদিক। রুমকি ঝুমকির দু জোড়া পা, ঝিন ঝিন শব্দ হচ্ছে, পায়ের মল থেকে। পায়ের ওপর থেকে রক্তের দাগ গড়িয়ে এসেছে গোড়ালি হয়ে পায়ের আঙুল বরাবর। আলতার মত। ঠোঁটের কোণেও কি রক্ত?
বুড়া ঠেসান দিয়ে বসে থাকে কুয়োর ধারে। চারদিকে মানুষের কথা বয়ে যাচ্ছে ফিসফিস ফিসফিস, কিছুই ধরতে পারছে না সে! হঠাৎ তার বাপের একটা কথা মনে পড় যায় বিজলিচমকের মত। যখন আঁধার নামে, তাজা লোমড়ির রক্ত খেয়ে জেগে ওঠেন মারী দেবী, তাঁকে খুশি করতে পারলে যা চাই তাই দেন মা । জরুরি কাজ মনে পড়ে যাবার মত করেই ধড়মড় করে উঠে বসে। “আমি যতক্ষণ না ফিরি, নিয়ে যাবি না ওদের” ব’লে খ্যাপা মোষের মত বেরিয়ে যায় বুড়া। জমায়েত একধারে সরে গিয়ে পথ করে দেয়, নিবারণ হাহুতাশ করে, পাগলে গেছে গো বুড়াটা। বুড়া ততক্ষণে পিছনের মাঠ পেরিয়ে সোজা খেত বরাবর নারান বাবুর মাঠে। লোমড়িটা ওদিকেই গেছে নিশ্চই খরগোশ ধরতে, এসময় এগুলো বেশ গায়ে গতরে হয়ে ওঠে।
ওই তো ভাগিরথ বাবু, কপালে একটা ব্যান্ডেজ, মুখে আঁচড়-দাগ সকালের রোদে বিজয়ী নিশানের মত চকচক করছে। সে তখন তারিয়ে তারিয়ে সামনের কালো কামিনটার বুক আর পেটের ভাঁজ সীমানা লক্ষ্য করছিল। বেড়ার কোনে একটা গাঁইতি রাখা, ওটাই হাতে তুলে নিল বুড়া, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লোমড়িটাকে বের করা যাবে গর্ত থেকে। হাতে সময় খুব কম।
মাটিতে পড়ে থাকা লোমড়ির শরীরটা অল্প অল্প মোচড় দিচ্ছে শেষ আক্ষেপে l এর মধ্যেই ধৈর্য্য ধরে ঘিয়ে ফেট্টিটাতে খুব মনোযোগ দিয়ে লোমড়ির রক্ত ভিজিয়ে নিল বুড়া। তারপর দৌড় গুনিন ঝল্লা শাহের গ্রামে।
চুট্টাটা খুব তেতো লাগতে শুরু করলো বুড়ার, ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। গুনিনের গ্রাম সামনেই। বাবার আমলের গুনিন তার সাজানো আসনেই বসেছিল, যেন জানত সে আসবে। সন্ধের মহুয়ায় চোখ আরক্ত। গুনে গুনে ২০০ টাকা নিয়ে, রক্ত ভেজা ফেট্টিটা আগুনে ফেলে দেয় ঝল্লা। লোমড়ির রক্ত আফলা যাবেক নাই। গুনিন বলে, দেখ রে বুড়া, আগুনের রং পুরো সাদা হলেই বেটি খুশ হবে। রুমকি ঝুমকি আবার ঘুম থেকে জেগে উঠবে, নাচবে কুঁদবে, সাদি লাগবে। বলে আরেকটু মহুয়া ছিটিয়ে দেয় আগুনে... হলহলে হয়ে ওঠে আগুন।
বাইরে এমন সময় ঘট ঘট গাড়ির শব্দ, বুট পায়ে অনেকগুলো পা যেন ছুটে আসছে গুনিনের বাড়ির দিকে। পুলিশ সাহেবের কাছে ফেরারি বুড়াকে জিন্দা ধরার সুপারি দিয়েছে গাংনারান বাবু, ছেলের খুনিকে সে ছাড়বে না। একটা বড় গর্ত খুঁড়ে রাখা আছে সাতঝোরার ঠিক পেছনে। একটা ধাড়ি লোমড়ি ধূর্ত চোখে মেপে নিচ্ছে শিকারের গভীরতা ।
আগুনের কুণ্ডে ফেট্টিটা কুঁকড়ে মিশে যেতে থাকে ক্রমশ, সন্ধের রঙে ঠিক ঠাহর হয় না, তবুও বুড়া জ্বলা চোখে চেয়ে থাকে আগুনের দিকে, দুলতে থাকে যেন রুমকি ঝুমকিকে হাঁটুতে বসিয়ে, কই পাল্টাচ্ছে রং? কই?