একটি জানা গল্প আবার বলতে ইচ্ছে করছে। গল্পটা আফ্রিকা মহাদেশের। বান্টু অঞ্চলের। একজন নৃতত্ববিদ একটা মজার খেলা আমদানী করলেন ৷ একটা গাছের ডালে একঝুড়ি আপেল ঝুলিয়ে দিলেন ৷ দূরে একটা দাগ দিলেন। দাগ ধরে সাতটি বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে দৌড়বে বলে। শর্ত হল, যে আগে পৌঁছতে পারবে সব কটা আপেল তার। সাহেবের যে দেশে জন্ম সেখানে বাচ্চাদের এরকম খেলা দিলে তারা হয়ত হৈ হৈ করে দৌড়াত এবং একজন প্রথমে ছুঁতো। সবকটা ফল সেই পেত। এটা-ই তো খেলার শর্ত। কিন্তু এই বাচ্চারা যে দেশে জন্মেছে তাদের উচিৎ অনুচিত বোধ একেবারেই আলাদা। বাচ্চাগুলি সকলে মিলে হাত ধরাধরি করে একই সাথে ঝুড়ির কাছে হাজির হলো। সাহেব তো অবাক - শুনি নাই কভু, দেখি নাই কভু অবস্থা। জানতে চাইলেন এরকম তারা কেন করতে গেল। উবন্তু। উত্তর দিল সবাই মিলে ৷ বুঝিয়ে দিল সাহেবকে উবন্তু কথাটির মানে, উবন্তু বলতে কী বোঝায় ৷ তাদের কথা এই যে যদি আর সকলে দুঃখ পায় তবে একজন কি করে আনন্দ পাবে। সবাই একসাথে ভোগ করতে না পারলে সেটা আনন্দ নয়। সবাই আছে তাই আমি আছি - এই হল ওই বাচ্চাগুলির শিক্ষা। এত অল্প বয়সে ওরা এটা জানে না আজকের এগিয়ে থাকা, স্মার্ট, বিজ্ঞানমনস্ক সভ্যতায় আতিপাতি করে খুঁজলেও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না বাচ্চাদের সহজাত সদ্ভাবনায়। এই শিক্ষার অস্তিত্ব আধুনিকতায় আর মোবাইল অ্যাপে হারিয়ে গেছে। একেবারে গোড়া ধরে নাড়া দেয় আজকের মূল্যবোধে, জীবনচরিতে, জোটবদ্ধ হওয়ার ফাঁকা আওয়াজে আর মৌলিক ভাল-মন্দ বোধে।
আবার ভাবি - এই বাচ্চাগুলি যদি পারে তবে আমাদের ও একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? প্রথমে শুরু করি প্রকৃতি তথা প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে অধ্যয়নের বিজ্ঞান ৷ খুবই জরুরী বিষয় বস্তু। এটাও ঠিক যে কাজটা সহজ হবে না। এর অনেকটা জ্ঞানই সাধারণ মানুষ, চাষি, জেলে আর বনবাসীদের সহজাত। আমাদের চিনতে অসুবিধা হয় কারণ মানুষ মাত্রই নানান ছুঁৎমার্গের শিকার হয়ে থাকেন ৷ অনেকেই সারাজীবন কাটিয়ে দেন তাই নিয়ে। কোনও প্রয়োজন বোধ করেন না তাকে যাচাই করার বা তা থেকে মুক্ত হবার। সবচেয়ে প্রচলিত ছুঁৎমার্গ হল গায়ের রঙ নিয়ে৷ সাদারা এগিয়ে, কালোরা পিছিয়ে, বিভিন্ন স্তরের তীব্রতা। এই বর্ণবৈষম্য মানুষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং লজ্জাজনক পরিচালক ৷ তার মানে এই নয় যে প্রত্যেক সাদা চামড়ার মানুষ কালো দেখলে নাক সিঁটকোতে থাকেন তবুও বহু দেশে বহু মানুষের অন্তরে আজও বর্ণবৈষম্যের বসবাস বজায় আছে৷
আমার ভাবনা বর্ণবৈষম্য ঘটিত ছুৎমার্গ নিয়ে নয়৷ আমার বোঝার চেষ্টা মানুষের চৈতন্যর বিকাশ নিয়ে ৷ চেতনার জগতে এক অচর্চিত ঘাটতি নিয়ে ৷ চেতনার জগতে এক অদ্ভুত ছুঁৎমার্গ নিয়ে আছে তথাকথিত সমাজের এগিয়ে থাকা অংশ। সুবিধাভোগী অংশ। ভোগসুখের উপর নিশ্চিন্ত দখলদারি উপভোগ করা অংশ ৷ এই নির্লজ্জ এবং নির্মম বৈষম্য বোধ সযত্নে সঞ্চিত রেখেছেন আধুনিক ইতিহাসের এক কলঙ্কের বোঝা হয়ে।
চেতনার জগতের এই ছুঁৎমার্গ কিছুতেই প্রকৃতিকে যাঁরা জীবনবোধ দিয়ে চলেন, বাঁচার তাগিদে সরাসরি আদানপ্রদান করেন প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে মিলেমিশে জীবনীশক্তি খোঁজেন, যেমন জেলে, চাষি, বা যাঁরা বনে বাদারে খুঁটে খেয়ে বেঁচে থাকেন, যাঁরা তাদেরই স্বার্থে প্রকৃতির নানান গঠনকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁরাই হলেন মানুষের মাঝে জ্ঞানের বৃহত্তম খনি। আমরা কোনোদিনও সেই স্বীকৃতি বা উপযুক্ত মাত্রায় বৈজ্ঞানিকের সন্মান দিতে পারলাম না। অথচ যাঁদের ওই বিজ্ঞান এর উপর একটি জলজ্যান্ত বিভাগ আছে তার নাম ইকলজি। এর বাংলা যা আছে তাতে মন ভরে না৷ তাই ইকলজিকে বাংলায় আপন করে নিলে আপদ চোকে। অসুবিধাই বা কিসে! ফলিডলের বাংলা হয় না৷ পুলিশের বাংলা হয় না। ওগুলোই বাংলা। তেমনি ইকলজিকে বাংলা বলে ধরে নিলে কোনও ব্যাকরণগত মর্যাদা খোয়া যায় না৷
প্রায় বছর দশেক আগে- কোলাম্বিয়া দেশে একটি জঙ্গল দেখতে গিয়েছিলাম নানান খ্যাতনামা ইকলজি তথা পরিবেশ বা বনজঙ্গল বিশেষজ্ঞদের সাথে। বিশাল জঙ্গল। অসামান্য তার জীববৈচিত্রের আধার। একজন প্রৌঢ় একমনে আমাদের সব বুঝিয়ে দিলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। সহকারি বা সহকর্মী। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমরা শুনছিলাম। একজন সাহেব প্রশ্ন করলে যে প্রৌঢ় ইকলজি কাকে বলে জানেন কিনা? প্রৌঢ় উত্তর দিলেন যে তিনি জানেন না। আবার প্রশ্ন। ইকোসিস্টেম ম্যানেজমেন্ট বলতে উনি কী বোঝেন। একটু বিরক্ত হয়ে প্রৌঢ় উত্তর দিয়েছিলেন যে ওঁদের ওসব না জানলেও চলে তবে প্রশ্নকর্তা মনে হয় সেমিনারে যান সেখানে এসব জানতে লাগে। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার মগজের কাজকর্ম। যাঁরা জানেন, তারা জানেন না, জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না যে আমরা তা তাদের জ্ঞানটিকে কী নাম দিয়েছি। শুধু নাম দিয়েছি তাই না, শুধু নাম দিয়েছি বলেই পিতৃত্বের অধিকার রাখাও। কী বিকৃত প্রচেষ্টা ৷
এখানেই গোলমাল বা এখান থেকেই আবার শুরু। নতুন করে পরিবেশ চর্চার বুনিয়াদ গড়ার প্রয়োজন আছে। কাজটা কার আমার জানা নেই কিন্তু কয়েকজন মিলে শুরু করলে কোনও কৌলীন্য হারাবে বলে মনে হয় না।
এই পর্যায়ে আমরা কয়েকটা সূত্র একত্র করতে পারি। ছড়ানো ছেটানো বোধগুলি এক জায়গায় করতে পারলে এগোতে সুবিধা হবে। এই সূত্রগুলি কোনও মতেই কোন তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে পরিবেশিত হচ্ছে না। এখানকার ইচ্ছে এইটুকুই যে আসুন সবাই মিলে ভাবি। ভেবে একটা সূত্র-সমগ্র খাড়া করি; তাই নিয়ে ছড়িয়ে পড়ি। এইটুকু মাথায় নিয়ে নিম্নে লিখিত সূত্রগুলি জড়ো করা হয়েছে। মানা-না মানা, ঠিক ভুল এ সমস্ত বিতর্ক যদি শুরু হয় তবেই লেখাটা কাজে দিয়েছে মনে হবে।
প্রথম সূত্রঃ প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে ৷ মানুষ জীবজন্তু বা জলা জঙ্গল বাঁচলো কি শেয হয়ে গেল, এনিয়ে প্রকৃতির সামান্যতম কোন ও আঁচড় পড়েনা।
দ্বিতীয় সূত্রঃ পৃথিবীতে যত ঘটে বা ঘটবে তার কোন ও কিছুই নিশ্চিত নয়৷ বিজ্ঞান এখন একথাই বলে।
তৃতীয় সূত্রঃ অধিকাংশ মানুষকে সহ্য শক্তি বাড়াতে বা কষ্টসহিষ্ণু হতে বলে উষ্ণায়নের সমস্যার যে প্রতিবিধান দেওয়া হচ্ছে সেটা অচল। বিত্তবানেদের জীবনধারা না পাল্টালে আবহাওয়ার দুর্যোগ বেড়েই যাবে। পৃথিবী মানুষের জন্য আর বাসযোগ্য থাকবে না।
চতুর্থ সূত্রঃ উষ্ণায়ন নয়, আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল ক্রমশ আরো কম মানুষের কাছে আর ও বেশি পরিমাণে সম্পদের মালিকানা কেন্দ্রীভূত হওয়া।
পঞ্চম সূত্রঃ কি করে সুস্থ ভাবে, অনেক ক্ষতি না করে শান্তিতে বেঁচে থাকতে হয় তা মানুষের অজানা নয়। কিছু লোকের সীমাহীন লোভের তাড়নায় বাকি সকলের জীবন আজ অন্তিমযাত্রায়। তাই আজকের জয় জয়কার হল তিনটি শাণিত অস্ত্রেরঃ
ক) মিথ্যা কথা , মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।
খ) ন্যায্য অধিকার চাইলে ভয় দেখানো।
গ) অলীক জীবনের লোভ দেখিয়ে বিপথগামী করা।
মাঝে মাঝে অবাক লাগে যে পরিবেশ চর্চার কোন ও রকম মৌলিক সূত্র আমাদের দেশের যার কোন অভাব নেই তার কখনো বিদ্বজ্জন খুঁজে পেলেন না। অথচ নিঃসন্দেহে অসামান্য জ্ঞানী গুণী লোকে ঠাসা আমাদের গ্রাম, আমাদের আদিবাসী সমাজ, তাঁদের কাছে আমরা হাজির হতে পারি নি, তাঁদের জ্ঞানের বিস্তারের খোঁজে ৷ কেবল সাহেবদের লেখা বই আর তাদের দেওয়া সূত্র দুলে দুলে মুখস্থ করেছি। বড় চাকরি বা উপদেষ্টা হতে এই আত্মসম্মানহীন মনোভাব কোন বাধার কারণ হয়নি।
আমাদের ব্যাপার আমরাই বোঝার চেষ্টা করতে শুরু করি। প্রয়োজনীয় সূত্র আগে নিজেরা লিখি তারপর কার সাথে মিললো বা না মিললো দেখা যাবে। মিললো ভালো না মিললেও কোন ক্ষতি নেই। ওনারা আমাদের থেকে প্রয়োজনে লিখে নেবেন।
পৃথিবীর বুকের উপর ৭০০ কোটি মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলাবাহুল্য এই অসংখ্য মানুষের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে চলেছে৷ এই অবস্থায় একজন ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় তা সহজে বলা যায় না। রাইন নদীর ধারে দুর্গের মালিকরা বা পাহাড়ের গুহায় বৈরাগ্যের খোঁজে বসে থাকা সন্ন্যাসী – এঁরা কেউই তেমন ভাবে জীবনের লক্ষ্য আর স্পষ্ট করেন না। বরঞ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে একে ওপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা।
এহেন অবস্থায় এই সামান্য লেখা পড়ে দলে দলে মানুষ দুনিয়া পালটানে৷র কাজে নেমে পড়বেন, এ রকম কোনও সম্ভাবনার সামান্যতম -আশাতে এই লেখা হয়নি ৷ তবু যদি হাতে গোণা ক’জনে একত্র হওয়া যায়, তাই বা খারাপ কী? আর সেই ক’জনের মনে রাখার বা মেনে চলার জন্য দুটো কথা বলে শেষ করা যায়।
প্রথমতঃ উবন্তু - সবাই আছে বলে আমি আছি
দ্বিতীয়তঃ - মনে মুখে এক হতে সচেষ্ট থাকা।
আশা করতে দোষ কী৷