গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভের মধ্যে যেটির সাথে সবচেয়ে বেশি ইন্টার্যাকশন হয়ে থাকে আমনাগরিকের, তা হল গণমাধ্যম। আমাদের ছোটবেলায়, মানে নব্বইয়ের শেষ বা শূন্য দশকের শুরুর দিকে কোন তথ্যের ধ্রুবসত্যতা যাচাইয়ের কষ্ঠিপাথর ছিল তা “কাগজে বেরিয়েছে” কিনা। পরে এর সাথে যোগ দেয় “টিভিতে দেখিয়েছে” কিনা। তখনো ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ আসেনি। পোস্ট ট্রুথ শব্দটা অজানা ছিল, তাই মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আস্থা অটল ছিল অনেকটাই। এখন সেসব গতজন্মের কথা। এখন সবাই জেনে গেছি কোন কোন খবরের চ্যানেল আইডিওলজিক্যালি সরকার বিরোধী, আর কারা কারা সরকারপক্ষের। আইডিওলজিক্যালি শব্দটার উপর জোর দিলাম এখানে।
কোবরাপোস্টের ব্যাপারে আগে তাই দু’এক কথা বলে নেওয়া দরকার। ২০০৩ সালে তেহেলকার প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক অনিরুদ্ধ বহাল কোবরা পোস্ট নামক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অনিরুদ্ধ ও তাঁর টিমের বিভিন্ন স্টিং অপারেশন পরবর্তী কালে প্রকাশ্যে আসে। এর মধ্যে ২০০৫ সালের “অপারেশন দুর্যোধন”, ২০১৩ এর “রেড স্পাইডার”, “অপারেশন ব্লু ভাইরাস” উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ তে যখন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়, মার্ক জুকারবার্গকে অন ক্যামেরা রোস্ট করছেন আমেরিকান সেনেটররা, কোবরাপস্টের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে তাদের সাংবাদিক তখন সঙ্গোপনে কোবরাপোস্টের সাংবাদিক পুষ্প শর্মা একটি স্টিং অভিযানে নেমেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ, এই পুষ্প শর্মাই ২০১৬ সালে একটি লেখায় দাবি করেছিলেন আয়ুশ মন্ত্রকে সংখ্যালঘু কর্মীদের নিয়োগ করা হয় না। পরে অবশ্য মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এই দাবিকে নস্যাৎ করা হয় এবং স্বল্প সময়ের জন্য পুষ্প শর্মা গ্রেপ্তার হন।
কোবরাপোস্টের দাবী অনুযায়ী তাদের সাংবাদিক পুষ্প শর্মা কাল্পনিক একটি সংস্থা শ্রীমদ্ভগবতগীতা প্রচার সমিতির কর্মকর্তা জনৈক আচার্য সেজে দেশের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ সংস্থার (যার মধ্যে খবরে চ্যানেল, নিউজ পেপার এবং ওয়েব পোর্টাল সবই আছে) কর্তাব্যাক্তিদের অ্যাপ্রোচ করেন টাকার বিনিময়ে একটি বিশেষ আইডিওলজিকে প্রোমোট করতে। এটি তিনটি ফেজে বিভক্ত। প্রথম ফেজে গীতার বাণী প্রচারের মাধ্যমে, দ্বিতীয় ফেজে বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ব্যংগ করার মাধ্যমে এবং তৃতীয় ফেজে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি রাজনৈতিক দলের সুবিধামতো অ্যাগ্রেসিভ প্রোমোটিং করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
যেহেতু বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন, তাই যথাসম্ভব নাম না লিখে বিষয়টি লেখার চেষ্টা করছি। তিন ফেজে বিভক্ত এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল “অপারেশন ১৩৬” (প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্সে ভারতের র্যাংক ১৩৬ তম স্থানে)। এখন কোবরাপোস্টের দাবী সত্য হলে তাঁরা সারা দেশের ২৫-৩০টি মিডিয়া হাউসকে অ্যাপ্রোচ করেছিলেন তাদের মধ্যে একমাত্র বাংলার বর্তমান এবং দৈনিক সংবাদ পত্রিকাগষ্ঠী এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি।কোবরাপোস্টের দাবি অনুযায়ী, অন্যান্য মিডিয়া হাউসগুলি তাদের প্রস্তাব মেনে বিশেষ টিম গঠন করার কথা বলেছিল যে টিম একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সুবিধাজনক আদর্শ এবং পরোক্ষভাবে তাদের সুবিধাজনক আদর্শ প্রচার করবে।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দেশের অন্যতম প্রধান মিডিয়া হাউস, যারা একাধিক ভাষার সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মালিক তাঁরা পুষ্প শর্মার প্রস্তাব মতো “খবর” প্রচারের জন্য ১০০০ কটি টাকা চেয়েছেন। পরে অবশ্য সেটা দরাদরি করে ৫০০ কোটি টাকাতে নেমে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কিভাবে অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থার মাধ্যমে সেই টাকা নেওয়া হবে, যদিও প্রথমে চেকে পেমেন্ট নেওয়ার কথা ভাবছিলেন সেই মিডিয়া গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় কর্তা। ওই একই গ্রুপের একটি রেডিও চ্যানেলের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যাক্তি অবশ্য ভিডিওতে স্বীকার করেছেন তাঁরা ঐ রাজনৈতিক দলের সুবিধামতো ক্যাম্পেন আগেও করেছেন।
অন্য একটি সর্বভারতীয় খবরের কাগজের অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট পুষ্প শর্মাকে আশ্বস্ত করেছেন তাঁদের সিইও বর্তমানে দেশের প্রধান বিরোধী দলের সমর্থক হলেও, তারা দেখবেন যাতে সম্পাদকীয়তে “deep negative” কোন সমালোচনা না বেরোয়। এই গ্রুপের রেডিও চ্যানেলের জনৈক ম্যানেজার ভিডিওতে বলেছেন তিনি সঙ্ঘের মতাদর্শের অনুগামী এবং গুজরাট কান্ডের (২০০২?) সমর্থক।
আরেকটি মিডিয়া গ্রুপ যাদের পাক্ষিক ম্যাগাজিন এবং খবরের চ্যানেলের দেশজোড়া খ্যাতি, তার একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন তাঁঁর কেওমাত্র উদ্দেশ্য যাতে কেন্দ্রের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আবার ক্ষমতায় আসে।প্রসঙ্গত , এই গ্রুপের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টকে একমাত্র প্রেসের স্বাধীনতা নিয়ে দু এক কথা বলতে দেখা গেছে। তিনি দাবি করেছেন কোন অ্যাক্টিভিটির সাথে এই মিডিয়া গ্রুপ একমত না হলে, তাঁঁরা সম্পাদকীয়তে সমালোচনা করবেন। অন্ধকারের মধ্যেও ক্ষীণ আশার আলো পাওয়া যায় এই মন্তব্যে। টানেলের শেষে আলোর রেখা দেখা যায় বাংলার দুই সংবাদপত্রের আচরণেও, যাঁঁরা টাকার টোপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। প্রায় ২৫-৩০টি সংস্থার মধ্যে থেকে মাত্র তিন চারটির উদাহরণ দিলাম। মোর অর লেস, একই সুর শোনা গেছে সবার কথায়।
এছাড়াও ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অনলাইন পেমেন্ট ও ডিজিটাল ওয়ালেট কোম্পানিকেও কোবরাপোস্টের তরফ থেকে অ্যপ্রোচ করা হয়। সেই ভিডিওতে চমকে ওঠার অনেক উপাদান পাবেন, যা নিয়ে পরের পর্বে লিখবো।
হাই কোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করার ফলে অচিরেই আমরা ভুলে যাবো। এমনিতেই বীভৎস মজার চক্করে যে কোন সেনসেশন বা খবরের আয়ু মাত্র দেড় দিন।তারপর কোন না কোন বৃহত্তর সেনসেশন এসে ঢেকে দেবে। ইতিমধ্যে প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্সে আরো দুই ধাপ নেমে গেছে ভারতের র্যাঙ্কিং। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ রীতিমতো নড়বড় করছে। এক স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানের সাথে আলাপচারিতায় সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলার জন্য এক প্রবীণ সাংবাদিক হুমকি পেয়েছেন গত সপ্তাহেই। যক্ষপুরীতে রাজ্যপাট চালাচ্ছেন মহারাজ, বাইরে পড়ে রয়েছে রঞ্জনের মৃতদেহ।
(-ক্রমশ )