ধর্ষণ হল ক্ষমতার আস্ফালন। ঘরে বাইরে সর্বত্র পুরুষ যখন নারীর ওপর ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়, যখন নারীকে জানাতে চায় তুই আমার পায়ের নীচের মানুষ, তখন সে নানাভাবে মেয়েদের নির্যাতন করে, ধর্ষণ তেমনই এক নির্যাতন। সমাজে ধর্ষণকে মেয়েদের ওপর ঘৃণ্যতম অপরাধ হিসেবে দেখা হয় কারণ মনে করা হয় ধর্ষণের ফলে মেয়েদের চরম অসম্মান সম্ভব। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজ আজও মনে করে, মেয়েদের যোনিতেই তাদের এবং তাদের সম্প্রদায়ের সম্মান লুকানো আছে। অতএব মেয়ের অথবা তার পরিজনদের সম্মানহানির উপায় হল মেয়েকে ধর্ষণ করা। ধর্ষণের সঙ্গে কামনার লেশমাত্র সম্পর্ক নেই।
এখন কথা হল, নারী কোন একমাত্রিক পরিচিতি নিয়ে চলে না। যোনিগত পরিচিতি ছাড়াও মেয়েদের বংশ, জাত, ধর্ম, শ্রেণী ইত্যাদি নানা পরিচয় থাকে। যত জীবন চলতে থাকে ততই মৌলিক পরিচয়গুলির সঙ্গে যুক্ত হয় তার প্রথাগত শিক্ষার তকমা, পেশার পরিচয়, তার রাজনৈতিক অথবা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কজনিত পরিচয়। আর এই যে লিঙ্গ, জাতপাত, ধর্মীয়, শ্রেণীগত, যৌনতা অথবা শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বিষয়ে মেয়েদের পরিচিতি, এর মধ্যে কোন পরিস্থিতিতে কোন পরিচয়ের কারণে তাকে ধর্ষিত, নির্যাতিত হ’তে হবে, তা নির্ভর করে তার পরিচিতিগত অবস্থানের প্রান্তিকতার ওপর। অনেকসময় একাধিক প্রান্তিক পরিচিতির কারণেও মেয়েদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। জম্মুর কাঠুয়ায় মুসলিম উপজাতি বাখেরওয়াল সম্প্রদায়ের আট বছরের যে মেয়েটি ধর্ষিত এবং খুন হল, তার ধর্ষণের পিছনের মূল কারণ কিন্তু তার ধর্মীয় এবং জাতিসত্ত্বাগত পরিচিতি। অবশ্যই যোনি নিয়ে জন্মেছে বলেই তাকে ধর্ষণ করা সম্ভব হল, কিন্তু এক্ষেত্রে শুধুমাত্র লিঙ্গ পরিচিতির কারণে মেয়েটি ধর্ষণ হয়নি, মেয়েটি যদি ‘জয় শ্রীরাম’-এর ধর্মের মেয়ে হত, যদি তার জাতি এবং ধর্মীয় পরিচিতির গায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ছাপ্পা থাকত, তাহলে তাকে ধর্ষণ করা হত না। কাকা-ভাইপো থেকে শুরু ক’রে উর্দিধারী পুলিস, মীরাট থেকে ‘কামনা চরিতার্থ’ করতে আসা বন্ধু, গুষ্টিশুদ্ধ মানুষ মিলে জঙ্গলে ঘোড়া চড়াতে নিয়ে যাওয়া বাচ্চা মেয়েটিকে যে দেবীমূর্তির পাদদেশে এক সপ্তাহ জুড়ে গণধর্ষণ এবং খুন করল, তার কারণ মেয়েটির সম্প্রদায় সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠের দল আট বছরের শিশুর ওপর তাদের পেশীবলের দাপট দেখিয়ে বোঝাতে চাইল, এ দেশ শুধুই সংখ্যাগুরুর। একথা আরও প্রমাণিত হয় কারণ, মেয়েটিকে ধর্ষণ ক’রেই সংখ্যাগুরুর দল ক্ষান্ত হল না, ধর্ষকদের সমর্থনে তারা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে মিছিল বার করল,এমনকি উকিলরা পর্যন্ত রামের নামে ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা আনতে অস্বীকার করল।
দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে আজও সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী যখন সংখ্যালঘিষ্ঠকে ভয় দেখাতে চায়, ভিটেছাড়া করতে চায়, তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী শরীর তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের বধ্যভূমি হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়ায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকেদের দ্বারা খ্রীষ্টান সন্ন্যাসিনীদের ধর্ষণের ঘটনাটি মনে পড়ে। অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়েছে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের পেশীবল লাগামছাড়া হয়েছে। তারা নির্দ্বিধায় প্রান্তিক মেয়েদের নির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, খুন করছে। এই নির্যাতনের উদ্দেশ্য শুধু মেয়েদের শরীরে আঘাত হানা নয়, মেয়েরা যে জাত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীর পরিচিতি বহন করেন, সেই গোষ্ঠীকে পর্যূদস্ত করা, তাদের ভয় দেখানো। মেয়েদের শরীরের ওপর মেয়েদের নিজেদের অধিকারের ধারণাটিকে সম্পূর্ণ নস্যাত করছে ভারতবর্ষের বর্তমান শাসক দলের অনুগামীরা। সরকার থেকে সারাক্ষণ নারীর ক্ষমতায়নের বিজ্ঞাপণ দিলেও, আসলে তারা মেয়েদের কোনো গোষ্ঠীর সম্পত্তি ভাবে। সেইজন্যই অপছন্দের ধর্মীয় সম্প্রদায় অথবা জাতের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা সেই গোষ্ঠীর নারী শরীর বেছে নেয়।বাচ্চা মেয়েকেও তারা এব্যাপারে রেওয়াত করে না। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ আসলে এক প্রহসন মাত্র!
আজকের ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের সংগঠনগুলি শুধু মেয়েদের ওপর অত্যাচারই করে না, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তারা তাদের অত্যাচারকে ন্যায্য প্রমাণ করতেও উদ্যোগী। নিজেদের অপরাধের মান্যতা দেওয়ার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা তুখোরভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যাবহার করছে। হিন্দুত্বের পূজারীরা এখন মেয়েদের ধর্ষণ অথবা খুন ক’রে ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ একটি উল্টো গল্প প্রচার করছে। যেমন কাঠুয়ার ঘটনায় সারা দেশ প্রতিবাদে সরব হওয়া মাত্র হিন্দুত্ববাদীরা কলকাতার একটি ঘটনাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এল। সেখানে বলা হল যে, কলকাতার একটি মুসলমান অধ্যূষিত অঞ্চলে একটি হিন্দু নাবালিকাকে দুজন মুসলমান পুরুষ নাকি কয়েদ ক’রে রেখে ধর্ষণ করছে এবং সেই অঞ্চলে পুলিস নাকি প্রবেশ করতে পারছে না। অথচ সে পাড়ায় একটি জ্বলজ্যান্ত থানা আছে এবং অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে যে, এই প্রচার বহুলাংশে ভিত্তিহীন এবং অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু এই পালটা অপপ্রচারের ফলে অনেক মানুষ খতিয়ে দেখার আগেই মুসলমান দ্বারা হিন্দু বাচ্চা মেয়ের ধর্ষণের ঘটনা বিশ্বাস করবেন এবং কাঠুয়ার ঘটনায় যে সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে, তাকে লঘু ক’রে দেখবেন। এইভাবেই ধর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার, লঘু করে দেওয়ার এক সুপরিকল্পিত চেষ্টা চলছে।
আরও একটি সুপরিকল্পিত প্রচার চলছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু ক’রে তার তাঁবেদারের দল বলছেন, ধর্ষণ হল নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের অত্যাচার, এর মধ্যে কোন রাজনীতি নেই। তাদের মতে, যে কোনো ধর্ষণই একমাত্র মেয়েদের লিঙ্গ পরিচিতির কারণেই হয়। কিন্তু কাশ্মীর থেকে মনিপুর সর্বত্র আমরা বহুবার দেখেছি যে, মানুষের প্রতিরোধের আন্দোলন দমনের, মানুষকে ভয় দেখানোর অন্যতম রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে ব্যাবহার করা হয়েছে। আর কাঠুয়ার ধর্ষণ যদি শুধুমাত্র ‘কচি নারী মাংসের স্বাদের’ জন্যই হবে তাহলে বাচ্চাটিকে খুন করার কি প্রয়োজন ছিল?যদি এই ধর্ষণ নিতান্ত ‘অরাজনৈতিক’ হবে, তাহলে ধর্ষককে বাঁচাতে আপনার দলের মন্ত্রী, বিধায়করা মিছিল করলেন কেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
কাঠুয়ার ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা সংখ্যালঘু ধর্ম এবং জাতি্র বাচ্চা মেয়ের ওপর সংখ্যাগুরু হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা্র প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। এদেশের শাসক দল এবং তাদের অনুগামীরা সন্তর্পণে আমাদের দৃষ্টি অরাজনৈতিক পথে চালিত করতে চাইছে।আমাদের চিন্তায় সতর্ক প্রহরা জারি রাখতে হবে। নারীর প্রতি যেকোন নির্যাতনের ক্ষেত্রেই নারী বহুমাত্রিক পরিচিতিকে মাথায় রেখে তার বিশ্লেষণ করা জরুরী। নচেৎ এই সংগঠিত হিন্দুত্ববাদী শক্তির মোকাবিলায় শুভবুদ্ধির জয় কঠিনতর হয়ে দাঁড়াবে।
২০.৪.২০১৮