এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মধ্যপ্রদেশ - ৯ম পর্ব থেকে

    Rupankar Sarkar লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৮ মার্চ ২০১৪ | ২৫৪৪ বার পঠিত


  • ডাক বাংলো ও মকবুল খান

    স্টেশনে নেমেই জগ্‌দীশজিকে ফোন লাগালাম, ম্যাঁয় আ গয়া। উনি বললেন, আরে আরে, আপকো তো তিন বজে পহুঁচনা থা। স্টেশনকে বাহার গাড়ি খড়ি হ্যায়, ব্যায়ঠ যাইয়ে। গিয়ে দেখি সদাহাস্যময় শাহিদ সেই পরিচিত বীকন লাগানো এস ইউ ভি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল, সালাম সাব। জগ্‌দীশ জটিয়াজির গাড়ির বীকন অবশ্য লাল নয়, অ্যাম্বার। আর সেটা দিবস বা রজনীতে কখনই জ্বলেনা, আওয়াজও করেনা। আইন থাকলেই ফাঁক থাকে। কিন্তু দূর থেকে ওই গাড়ি দেখেই আম জনতা প্রণত হয় (লিটারালি)। বীকন না থাকলে এসব হ’ত? অ্যাডমিন্‌সট্রেশন চালানো বড় শক্ত কাজ, বিশেষতঃ এদেশে।

    ওমা, ভেবেছিলাম কোনও ফরেস্ট বাংলো টাংলোয় উঠব, গাড়ি দেখি স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামান্য একটু গিয়েই একটা খোলামেলা চত্বরে ঢুকল। সেখানে একটা সাহেবি আমলের বাংলো। ঢুকতে গেটের ধারে লেখা ‘দামোহ্‌ ডাক বাংলো’। ডাক বাংলো মানেই সাহেবি আমলের। অভিধানে ‘ডাক বাংলো’ শব্দের অর্থ খুঁজলে দেখা যাবে, ‘ডাক’ রুটে অবস্থিত, সরকারি আধিকারিকদের থাকার বা বিশ্রাম নেবার অতিথিশালাগুলিই ‘ডাক বাংলো’। স্বভাবতই সেগুলো অনেকখানি জমির ওপরে, বাগান টাগান সমেত। ভারতের বেশিরভাগ শহরেই সে বাগানের পরিচর্যা আর হয়না। আমাদের বাংলায় তো রীতিমত বাংলোর পাঁচিল ভেঙে মোটর সারাইয়ের গ্যারাজ বা চায়ের দোকান টোকানও ঢুকে যায়। তা যাকগে, এখানে যদিও বাংলোটি শহরের মধ্যে তবু বেশ খোলামেলা জায়গায়। যাক, রাত কাটানো নিয়ে কথা।

    গাড়ির আওয়াজ শুনেই একজন দৌড়ে এল, সালাম সাব। আমাদের দেশে এদের কেয়ারটেকার বলে, ওখানে বলে খানসামা। যে এল তার নাম মকবুল খান। শাহিদ তার জিম্মায় আমাকে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মকবুল খুব যত্ন করে ঘর টর খুলে দিল, জলের পাত্র ভরে দিয়ে চা বানাতে চলে গেল। বলে গেল দেয়ালে, সুইচবোর্ডের তলায় দুটো মোবাইল নাম্বার আছে, যে কোনওটা বাজালেই আমায় পাবেন।

    আমি ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখতে লাগলাম। যদিও শহরের মধ্যে, কিন্তু বাংলোর হাতায় বেশ গাছপালা আছে। সকালে পাখি টাখি পাওয়া যাবে নিশ্চয়। ঘরে ঢুকে কিন্তু কেমন কেমন লাগছিল। আদ্দিকালের বাড়ি। বিশাল উঁচু ছাদ, ছাদের বেশ ওপর দিকে স্কাইলাইট, আগেকার বাংলোয় থাকত, বাড়িতেও থাকত। খাটের ওপর মশারি খাটানো আছে। আদ্দিকালের বাংলোতে এই প্র্যাকটিস এখনও। আমি মাইসোরে একবার পেয়েছিলাম। মশারিতে প্রায়শই প্রচূর ফুটো থাকে, এখানে অবশ্য ফুটো টুটো দেখলাম না। তবে কেমন যেন সিনিস্টার, বিষন্ন বিষন্ন ভাব। আইডিয়ালি ভূতেদের এখানেই থাকা উচিত। মানে তাদের থাকার জন্য একেবারে অনুকূল পরিবেশ আর কি।



    কেমন যেন মনমরা, বিষন্ন আবহমন্ডল। ঘরে টিমটিমে টিউবলাইট, যেহেতু ছাদও অনেক ওপরে, দেয়ালগুলোও অনেক দূরে দূরে, তাই বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে আলো দিচ্ছে নামমাত্র। যাই বাইরেই ঘুরি গিয়ে, বিকেল গড়াচ্ছে, সন্ধে নামো নামো। আমাকে দেখেই মকবুল দূর থেকে দৌড়ে এল, কুছ চাহিয়ে সাব? আমি বললাম, না অ্যায়সেহি ঘুম রহা হুঁ। আচ্ছা মকবুল ভাইয়া, রাত কো কেয়া খিলাওগে?। সে বলল, কী খাবেন বলুন সার, আমি সব বানাতে পারি। খুব সঙ্কোচ করে বললাম, এখানে নন-ভেজ পাওয়া যাবে? খুব অপরাধীর মত মুখ করে বললাম, কারণ আমার হোস্টরা কেউ খান না। মকবুল বলল, হ্যাঁ সার, ফিশ, চিকেন, মাটন, যা বলবেন, আনিয়ে রেঁধে দেব।

    এর পরই প্রসঙ্গ পালটে বললাম, এখানে তো গাছপালা প্রচূর, সকালে পাখি টাখি আসে? সে বলল, হ্যাঁ সার ভোর বেলা উঠলে আপনার দিল খুশ হয়ে যাবে। অনেক পাখি এসে ডাকাডাকি করে। আমি বললাম, আসল মে মুঝে তো সার্কিট হাউসমে ঠহরনা থা। সুনা কি ওয়াহাঁ ভূত হ্যায়, ইস লিয়ে তো মেরেকো ইয়াহাঁ লায়া গয়া।

    মকবুল একগাল হেসে বলল, তো ইয়াহাঁ কেয়া কমী হ্যায় সার? ভূত তো ইয়াহাঁ ভি হ্যায়। রাত হোনেসে আপ কো মিল যায়েগা, কোই ফিকর নহী।

    আমি বললাম, অ্যাঁঃ ? কোই ফিকর নহী ?

    (দুটো ছবিই সেই বাংলোর)
    (চলবে)




    উভয় সংকট

    সব্বোনাশ, লোকটা বলে কী? কোই ফিকর নহী, মিল যায়েগা ? মানে কোনও চিন্তা করবেন না, ঠিক পেয়ে যাবেন। আমি বললাম, দেখ ভাই ভূতে আমি বিরাট কিছু ভয় পাই তা নয়, কিন্তু তা বলে খাটের পাশে ভূত এসে হামাগুড়ি দেবে আর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোব, এমনও তো নয়। তা তোমার এই ভূত বাবাজীরা ভায়োলেন্ট না নন ভায়োলেন্ট?
    মকবুল বলল, না সার ওয়ো লোগ কোই নুক্‌সান নহী পহুঁচতে হ্যাঁয়, সির্ফ আতে হ্যাঁয় অওর ঘুমতে হ্যাঁয় ইধর উধর।
    আমি বললাম, তা বাবা, তেনারা আসেন ঘোরাফেরা করেন, কিন্তু ক্ষতি করেন না, সবই বুঝলাম। আমি জানি ভূত কারো ক্ষতি করেনা। অনাথবাবুর হার্ট দুর্বল ছিল। কিন্তু তাঁরা যে নিত্য যাওয়া আসা করেন, তুমি জানলে কোত্থেকে, তুমি তেনাদের দেখেছ?
    মকবুল বলল, দেখিয়ে সার, অ্যায়সা হ্যায়, কি উও লোগ অ্যায়সে আম আদমী জ্যায়সে সাফ দিখাই নহী দেঙ্গে। মগর আপকো ম্যাহ্‌সুস হোগা যো কোই নজদীক আয়া হ্যায় অওর ঘুমফির রহা হ্যায়।
    আমি বললাম, হুম্‌, তার মানে আর কিছু না হলেও রাতের ঘুমটা গেল। তা বাবা, এই বাড়িটাকে ভূতদের এত পছন্দ কেন? এটা তো সাহেবি আমলের। তা এনারা সাহেব ভূত নাকি?
    মকবুল বলল, দেখিয়ে হম যো সুনে হ্যাঁয় ওয়ো হি বতা সকতে। হম সুনে হ্যাঁয় কি আজ সে করীব বিস পচ্চিস সাল পেহলে এক ভারি দঙ্গা ফাসাদ হুয়া থা। তো উস ওয়ক্ত ইস বাংলা মে যো লোগ ঠহরে থে সব কা কত্‌ল কর দে গয়া থা। উওহি লোগ ভূত বনকে ভটকতে হ্যাঁয় –

    আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম। বিশ পঁচিশের ভেতরে মানে নাইনটি টু। দাঙ্গা হবার একমাত্র সম্ভাবনা তখনই। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম মকবুল। তার উল্টোদিকে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম রূপঙ্কর। সিচুয়েশনটা ডাইসি। কারা মরেছিল বা কারা মেরেছিল জিজ্ঞেস করা একেবারেই অনুচিত।

    ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন
    কান্ডারী বল’ – দ্যাট ইজ ইম্‌মেটিরিয়াল, মানুষ মরেছে মানুষ।

    যাক গে, সে কথা ভুলে থাকাই ভাল, কিন্তু এনারা ঘুরেফিরে বেড়াবেন, আর আমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোব, তাও তো মোটামুটি শোভন না। জোর আলো পড়ল কম্পাউন্ডে, হেড লাইটের আলো। শাহিদের এস ইউ ভি ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল। লাফিয়ে নামলেন জগ্‌দীশজি। আরে আরে দাদা, ইতনী দিনোঁ কে বাদ,‌ ক্যায়সে হ্যাঁয়? সব খ্যইরিয়তমে তো? ক্যায়সা লগা হমারা মেহমান নওয়াজী? ইয়ে জগহ ঠিক লগা আপকো? আরে মকবুল, বেটা সাহাব কো চায় ওয়ে পিলায়া কি নহী?

    আমি বললাম, জায়গা? তা জায়গা তো ভালই, বেশ গাছপালা আছে। মকবুল বলেছে ভোর বেলা বেশ পাখি টাখিও আসে এই গাছ গুলোতে। আর এও বলেছে, ভোরে যেমন বেশ কিছু পাখি দেখা যায়, রাতে আবার বেশ কিছু ভূতও দেখা যায়। মানে, দেখা যাক না যাক ‘ম্যাহ্‌সুস’ করা যায়, মানে উপলব্ধি করা যায়।

    জগদীশজির ভুরু কুঁচকে গেল। মকবুল বলেছে? এই কথা মকবুল বলেছে? কোথায় মকবুল, অ্যাই কে আছিস, মকবুল কে ডেকে আন যেখানে পাস। লোকজন ছোটাছুটি করতে আরম্ভ করল। মকবুলকে ধারে কাছে পাওয়া গেলনা ঠিকই, কিন্তু জগ্‌দীশজি বললেন, এক্ষুণি এঁর কামরা বদল করতে বল ওকে। এই ঘরে ভূত থাকলে অন্য কামরা খোলাও। আমি বললাম, আরে আপনি শান্ত হোন। ভূত তো বায়বীয়, সে তো বিশেষ একটি কামরায় কনফাইন্ড থাকবেনা, এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যেতে তার বিশেষ অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

    জগ্‌দীশজি বললেন, দেখুন দাদা, আপনাকে আগেই বলেছিলাম সার্কিট হাউসে ওঠার কথা। তো আপনি বললেন, ভূত না কীসব আছে। হ্যাঁ টাইমস অফ ইন্ডিয়ার আর্টিকলটা আমিও পড়েছি। তবে ওখানে তো সব ভিআইপি-রা ওঠেন। তাঁদের কারো কাছে তো তেমন কিছু শুনিনি। আমি বললাম, ঐ যে, তাঁরা একা থোড়াই আসেন। টাইমস তো লিখেছে, একা না থাকলে কোনও চিন্তা নেই।

    জগ্‌দীশজি বললেন, দাদা, ইয়ে দোনো অ্যাকোমোডেশন হম আপকে লিয়ে বুক করকে রখ্‌খে হ্যাঁয়। মান লিজিয়ে ভূত ইয়াহাঁ ভি হ্যায় অওর ওয়াহাঁ ভি হ্যায়। তো কিঁউ না হম ওয়াহিঁ চলে যাতে? অগর ভূত ইজ প্রেজেন্ট ইন বোথ দা প্লেসেস, উই শুড গো ফর দা বেটার অ্যাকোমোডেশন। উস জগহ তো ক্লাস ওয়ান ফেসিলিটি হ্যায়। অ্যায় কোই হ্যায়? সাহাব কা লাগেজ প্যাক করো, হম সার্কিট হাউস হি যায়েঙ্গে।

    (চলবে)





    সেই সার্কিট হাউস

    পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি উঠছে ঘুরে ঘুরে। ওঠার মুখে জটাশঙ্করের মন্দির। এটা অবশ্য নকল জটাশঙ্কর। আসলটায় গেছিলাম গতবছর। সেখানে এই জায়গা থেকেও যাওয়া যায়, তবে দূরত্ব ভালই। সামনেই রাণী অবন্তিবাইয়ের মূর্তি। ছবি তোলবার ইচ্ছে ছিল, এর মধ্যে যতবারই সে ইচ্ছে প্রকাশ করেছি, ওঁরা বলেছেন, আচ্ছা হবেখন, আপনি আছেন তো। শেষমেষ সে সুযোগ আর পাইনি। আমি অবশ্য প্রথমে এঁকে রাণী দূর্গাবতী ভেবেছিলাম। শ্রীমতি নির্মলা জটিয়া বললেন, না না, রাণী দূর্গাবতীর মূর্তি আছে স্যাংচুয়ারীর ভেতরে। ওখানে তো যাব আমরা, তখন তুলবেন। তা সেখানেও জানলা দিয়ে ক্যামেরার নল বাড়িয়ে একটা পাশ ফেরা ছবি কোনওমতে তুলতে পেরেছি। সে কাহিনীতে আসব পরে।

    জগ্‌দীশজি বললেন, কী, মনে হচ্ছেনা সিমলায় উঠছেন? এটা আমাদের সিমলা। ওপরে ঠান্ডাও একটু বেশি। গাড়ি এসে দাঁড়াল পাহাড়ের মাথায় একটা সমতল জায়গায়। সাহেবদের একটা ব্যাপারে তারিফ করতেই হয়, আমাদের দেশে যত ভাল ভাল শৈলাবাস আছে, সব তাদেরই আবিষ্কার। এর পর অতিরিক্ত লোভে এবং আমাদের সরকারি ঔদাসীন্যে তাদের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে, সেটা তো তাদের দোষ নয়। ভাগ্যিস কিছুদিন আগে জন্মেছিলাম, তাই প্রাকৃতিক পরিবেশেই শৈল শহরগুলো দেখে ফেলেছি। আমি যখন পহেলগাঁও গেছিলাম, সেখানে একটা কাঠের ছোট্ট কুঁড়েঘরও ছিলনা। আর এখন? ছিঃ, ভাবলেও গা ঘিন ঘিন করে। তবে হ্যাঁ দামোহ্‌ এর সার্কিট হাউস পহেলগাঁও নয়, ঊটাকামন্ড নয়, দার্জিলিং-ও নয়, তেমন কিছু উঁচুও নয়, তবে নিঃসন্দেহে থাকার জন্য এখানে সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা।

    এখানে দুটো বাড়ি, একটা উনিশশো তিন না কবে যেন বানানো হয়েছিল, আর একটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক। তবে দুটোর স্থাপত্য একই রকম, যমজ কুটির। জগদীশজি পুরোটা ঘুরিয়ে দেখালেন, প্রথমে নিয়ে গেলেন। সেই পুরোনটায়। সেখানে নাকি কেবল মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর অনুমোদিত লোকজন এলে থাকেন। ঘরগুলোর বাইরে থেকে ফ্যাশাডটা আদ্দিকালের কিন্তু ভেতরে একেবারে ফাইভ স্টার। সেখানকার ছবি একটাও তুলিনি বলে আফশোষ হচ্ছে এখন, একেবারে চোখ ধাঁধানো। এবার পাশেরটায় আমার জন্য ঘর খুলে দেয়া হয়েছে। এটা ফাইভ স্টার না হলেও সাড়ে চার। দারুণ সাজানো, বিশাল ঘর, ঘরের পাশে অ্যান্টিচেম্বার, বাথরুমও ঝাঁ চকচকে। ঘরে ফ্যান, স্প্লিট এ সি, রুম হীটার সব আছে। গরমে ঠান্ডা হও বা ঠান্ডায় গরম। দেয়ালে লার্জ স্ক্রীন টিভি ঝুলছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের টিভি তো প্রায় পুরো দেয়াল জোড়া বিশাল স্ক্রীনওয়ালা। অমন টিভি স্ক্রীন কেবল এয়ারপোর্টে দেখেছিলাম। রবি ঘোষের মত মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল – ‘ব্যবস্থা ভালই’।

    তেসরা সেপ্টেম্বর দু হাজার বারো

    আমরা এখন একটু পিছিয়ে যাব, প্রায় মাস ছয়েক। টাইমস অফ ইডিয়া কাগজে সেদিন একটা আর্টিকল বেরিয়েছিল। লিখেছেন একজন নিউ ইয়র্কবাসিনী ভারতীয়া। তাঁর নাম দামিনী রত্নম।

    তিনি অবশ্য প্রতিবেদনটি লিখছিলেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ‘ডাক বাংলো’ নিয়ে। সেখানে অন্যান্য ডাক বাংলোর সঙ্গে দামোহ্‌ সার্কিট হাউসের উল্লেখ আছে। আমার প্রথমে একটু সংশয় ছিল, উনি আবার দামোহ্‌-এর ডাকবাংলোটার কথাই লেখেন নি তো? সংশয় মোচন হ’ল সঙ্গের ছবিটা দেখে। নাঃ। সেটা সার্কিট হাউসেরই ছবি ছিল। তাছাড়া ‘সার্কিট হাউস’ শব্দদুটো বিশেষ করে উল্লেখও করেছেন তিনি। আমি লিখেছি উনিশশো তিন কিন্তু তিনি লিখছেন এটা আঠারশো নিরানব্বই সালে তৈরী। তিনি লিখছেন, এখানে একটা বিষন্নতা যেন গ্রাস করতে আসে অতিথিদের। বাংলোটি নাকি এখনও ( মানে ওঁর লেখার কালে তখনও) ‘আত্মা’ দের দখলে। একথা উনি জেনেছিলেন, এ এস কুরেশি নামে একজনের থেকে, যাঁর পিতা আবদুল সালিম খান ঐ বাংলোর খানসামা ছিলেন।

    অবশ্য আমি যখন গেছি, তখনকার খানসামার নাম সুখলাল। সে লাল তো নয়ই, কোনও সুখের সন্ধানও দিতে সে অসমর্থ। ঈশ্বরের অথবা ভারত সরকারের কাছে আবেদন, দেশ থেকে ফাঁসি-র শাস্তি বা মৃত্যুদন্ড তুলে দিয়ে দিল্লীর ধর্ষণকারী সমেত অন্যান্য জঘন্য আসামীদের আজীবন ( মানে যতদিন বাঁচবে, বেশিদিন বাঁচবে না, হলফ করে বলা যায়) সুখলালের হাতের রান্না খাওয়ার শাস্তি দেওয়া হোক। জগদীশজি সঙ্গের লোকদের বললেন, আজ তো মকবুলকে বলা হয়েই গেছে, এঁর ডিনারটা নাহয় মকবুলই রেঁধে পৌঁছে দেবেখন। কাল থেকে সুখলাল রাঁধবে। আমি ভাবলাম, এই তো সবে খাবারের অর্ডার দিলাম। ও তো বাজারও করেনি। তাহলে ওকে বলার দরকার কী। মকবুল আবার কষ্ট করে খাবারটা পৌঁছতে পাহাড়ে উঠবে? ওর তো আর গাড়ি নেই। আসলে তখন বুঝিনি জগ্‌দীশজি কত বিচক্ষণ মানুষ। এমনি কি আর অত উচ্চপদে আসীন। উনি চট করে ভেবে নিলেন, অন্তত আজ রাতের মত এঁর প্রাণটা তো বাঁচুক, কাল থেকে তো সুখলালের কবলে পড়তেই হবে।

    (ক্রমশঃ)





    শ্রীমতী দামিনী রত্নম

    শ্রীমতী রত্নমের লেখা থেকে একটা কথা পরিষ্কার, সোনার যেমন পাথরবাটি হয়না, সুখলাল নামে তেমনি কোনও খানসামা হতে পারেনা। খানসামা মানেই ব্যক্তিটি ধর্মে মুসলমান হবেন। আসলে খানসামারা তাদের বাপ দাদা দের জায়গাতেই নিয়োযিত হতেন, এক সময়ে সব সরকারি দপ্তরের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীরা চাকরিটা পারিবারিক সূত্রেই পেয়ে যেত। তারপর দিনকাল বদলালো, এখন চাকরি অত সস্তায় হয়না। এই কিছুদিন আগেই কাগজে পড়েছি, রেলের গ্রুপ ডি পরীক্ষার জন্য মাস্টার্স ডিগ্রী শুধু না, কয়েকজন পি এচ ডিও বসেছেন। দিনকাল ভাল নয়। আমার পরিচিত একটি ছেলে একটি প্যান ন্যাশনাল কর্পোরেটে একাধারে এচ আর ডি এবং অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার। তার মাসিক বেতন আমাদের পাড়ার মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারের মাইনের অর্ধেকের সামান্য বেশি। সরকারি চাকরি ব্যাপারটা এখন সত্যি রাজকীয়। শ্রীমতী দামিনী দামোহ্‌ থেকে একটু দূরে, সাগর নামক স্থানের সার্কিট হাউসের খানসামা মুহাম্মদ সঈদের কাছ থেকে ফিশ কাটলেটের যে রেসিপি জোগাড় করেছেন, তা নাকি বংশ পরম্পরায় পাঁচ পুরুষ ধরে তারা জেনে আসছে। তবে সে দিন আর নেই, ভারতে ‘ডাক বাংলো কুইজিন’ বলে যে এক অসাধারণ অ্যাংলো-মুসলিম ফিউশন খাদ্য প্রণালী চলে আসছিল, তার কবরে মাটি পড়ে গেছে, এটাই মোদ্দা কথা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, কোনটা বেশি ভয়াবহ, বাংলোর ভূত, না সুখলালের রান্না, তারও মূল্যায়ন হয়নি। শ্রীমতী দামিনী রত্নমের সময়ে সুখলাল ছিলনা। সবচেয়ে বড় কথা, এখন ‘ডেভিল’ এবং ‘ডীপ সী’ জাতীয় কোনও অপশনও নেই। ভূতের দেখা কেউ পাক বা না পাক, তাকে সুখলালের রান্না খেতেই হবে।

    সার্কিট হাউসের ভূতের ব্যাপারে শ্রীমতী দামিনী যা শুনেছেন, তা হ’ল, এক প্রেত দম্পতি, মানে এক পুরুষ ও এক নারী ভূত, এই এলাকায় নাকি এই বাংলোটি তৈরী হওয়ার আগে থেকেই বসবাস করত। বাড়িটি তৈরী হওয়ার পর, ভিন্ন ধর্মের বৃটিশ অতিথিদের তারা সহ্য করতে পারতনা, এবং তাই নানা ভাবে ভয় দেখাত। বাসন কোসন উড়ে যেত, ফার্নিচার চলে ফিরে বেড়াত, ইত্যাদি। কিন্তু তাতেও যারা ভয় না পেয়ে প্রতিরোধের মতলবে যেত, তাদের কপাল ছিল সত্যিই খারাপ। জেনারাল ডগলাস পাঁয়তাড়া মারতে গেছিলেন, পরের দিন তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গুলি করে মারেন। অথচ তাঁদের পরিবারে কোনই অশান্তি ছিলনা।

    শ্রীমতী দামিনী আরো লিখছেন, সেসব ঘটনা আজও ঘটে, তবে বেশি ঘটে এক নম্বর ঘরে। এখনও নাকি প্রায়ই অতিথিদের বাংলো পার্শ্বস্থ জঙ্গল এলাকার গাছ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করতে দেখা গেছে। আমি ভাবলাম, এক নম্বর ঘর তো মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি ভূতদের তাড়ায় আত্মহত্যা না করলেও সুখলালের রান্না খেয়ে করে ফেলতেই পারেন। ভাগ্যিস তাঁর নামে ঘর বরাদ্দ করা থাকলেও তিনি সচরাচর আসেননা।

    কিন্তু সমস্যা হ’ল, প্রতিবেদনটিতে প্রধাণতঃ এক নম্বর ঘর লেখা আছে। তার মানে অন্য ঘরগুলো যে একেবারেই বিপদমুক্ত, তা কিন্তু শ্রীমতী দামিনী বলছেন না। পত্রিকার তরফ থেকে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, - আচ্ছা আপনার নিজের কোনও আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে এখানে? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছেন, একেবারে সরাসরি ভূতের মুখে না পড়লেও কেমন যেন থমথমে, দম আটকানো আতঙ্কময় পরিবেশ। ভারি পাথরের তৈরী স্থাপত্যকলার জন্যই কি? জানিনা, তবে এটুকু বলতে পারি, ভারতের অগণিত ডাক বাংলোগুলোর মধ্যে অন্ততঃ এটাতে আমি আর কোনওদিন থাকতে আসব না।



    বোঝো। আমি এখন কী করি? এখন তো জগদীশজি সঙ্গে আছেন, আমরা সোফায় বসে গল্পগাছা করছি। কালকের ফোটো সেশনের প্ল্যান ট্যানও ঠিক করছি। কিন্তু একটু পরেই তো তিনি চলে যাবেন। তারপর সারা রাত ? একথা সেকথায় দেয়ালে একটা ছবির দিকে চোখ চলে গেল। একটা ফোটোগ্রাফ, দুটি শিশুর। তারা কিছু বই পড়ছে বা পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আলোর বিপরীতে তোলা। জগদীশজি বললেন, এই ফোটোগ্রাফারের নাম মনোহর কাজল। ইয়াহাঁকে জানে মানে ফোটোগ্রাগার হ্যাঁয়। পুরা এম পি মে সব উনকো জানতে হ্যাঁয়। কাল আপসে মুলাকাত করোয়া দেঙ্গে। ছবিটা দেখেই ধাঁ করে আমি সেই উমেরিয়ার মিষ্টির দোকানের সামনে চলে গেলাম।

    (চলবে)




    আচ্ছা, শ্রীমতী দামিনী রত্নম ভারি পাথরের স্থাপত্য বলে ওই বাড়িটিকে ভুতুড়ে পরিবেশের বাড়ি বললেন কেন? পাথর আবার হালকা হয় কবে। আসলে উনি ঠিকই ধরেছেন। পাথর দিয়ে তৈরী বাড়ি তো অনেকই আছে। এমন বাড়ি একসময়ে ওড়িষাতেও অনেক দেখেছি। একটু উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো, যাকে ইংরিজিতে ‘আনডুলেটিং’বলে, তেমন অঞ্চলে একটু উঁচু জমিই বাছা হয়। এবার সেই জমি থেকে কেটে কেটে আয়তাকারের ব্লক তুলে এনে তাই দিয়েই দেয়াল, থাম ইত্যাদি হয়ে যায়। ইঁট ব্যবহার প্রায় হয়ই না, সিমেন্ট বা মর্টারও লাগে খুব কম। কিন্তু সেই বাড়িগুলোর একটাকেও এমন দেখতে নয়। এ বাড়িটা যেন ভৌতিক কোনও পরিবেশ তৈরী করার জন্যই বানানো। এখানে এখন রাতে আলোয় মুড়ে দেয়া হয়, সূর্য লজ্জা পাবে এত আলো। কিন্তু তবু সেই এক নম্বরের বারান্দায় অন্ধকার যেন গিলতে আসে। পাথরের, মানে, এই রকম পাথরেরই বাড়ি আমি অনেক দেখেছি, কোনওটার স্থাপত্য এই রকম দমচাপা নয়। শ্রীমতী দামিনী কি একা ছিলেন রাতে? আমি তো একা।



    যাক সেই মনোহর কাজলের ছবির কথায় আসি এবার। ভদ্রলোকের নামটাও বড় সুন্দর। মনোহর কাজল। মধ্যপ্রদেশের একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন মানুষ এই রকম নাম করে নিয়েছেন নিজের। বাংলাদেশে এমন নজির ঝুড়ি ঝুড়ি দেখা যায়। আমাদের দেশের কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিও এমন দৃষ্টান্ত রেখেছেন, যেমন অমিতাভ বচ্চন। বাঙালি বলতে একমাত্র উদয়শঙ্কর বা তাঁর পরিবারের আর সবাই। কিন্তু আমরা এখনও সেই মুখুজ্জ্যে, চৌধুরী, মন্ডল বা দাশগুপ্তর বাইরে যেতে পারলামনা, যতই প্রগতির কথা বলিনা কেন।
    (পাশে শ্রী মনোহর কাজলের ছবি)

    আসল কথায় আসি। সেই মনোহর কাজলের তোলা ছবিতে পেছন থেকে আলো পড়ে। ওটাই ওঁর বিশেষত্ব। এখন বলা হয়, এগেনস্ট লাইট, আমাদের কালে আমরা বলতাম ব্যাক লাইট। তেমন ছবি আমিও তুলতে গেছিলাম এই মধ্যপ্রদেশেই। সে কাজ করতে গিয়ে প্রাণটাই খোয়াতে বসেছিলাম আর একটু হলে। সেই গল্প বলতে তিন দশক পিছিয়ে চলে যেতে হবে সেই উমেরিয়া। সেই মিষ্টিওয়ালা, যিনি নিজের মিষ্টি বিক্রী করার চেয়ে কোথায় আরও সস্তায় উৎকৃষ্ট মিষ্টি পাওয়া যায়, খদ্দেরকে সেই সন্ধান দেন, তাঁর দোকানের সামনে।

    ওখানে দোকানগুলো মিষ্টি কাম চায়ের দোকান। আমাদের যখন ওখান থেকে মিষ্টি না কেনার উপদেশই দেয়া হ’ল, আমরা বললাম, তাহলে এখানে বসেই কিছু মিষ্টি খাই, আর চা-ও দিন সবাইকে। দোকানের পাশে রাখা বিশাল বেঞ্চিগুলোতে বসেছি আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ধীরে ধীরে বহু দেহাতি মানুষ চলে এলেন আমাদের দেখতে। সে সময়ে বানিজ্যিক সভ্যতা এত গ্রাস করেনি সেই সব অঞ্চল। প্রায় সব মানুষেরই হাঁটুর ওপরে তোলা ধুতি, মাথায় বিশাল পাগড়ি, কানে একটা করে মাকড়ি আর হাতে প্রায় সাত ফিট উঁচু একটা করে লাঠি। তাঁরা সবাই আমাদের ঘিরে, কেউ উবু হয়ে বসে পড়লেন, কেউ দাঁড়িয়ে। বেঞ্চিতে অনেক জায়গা থাকলেও কেউ বসছেন না। সবাই হাঁ করে আমাদের দেখছেন। নিজেদের কেমন যেন ‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং’ মনে হচ্ছিল।

    সবাই আমাদের দেখছেন, নীরবে দেখছেন, কোনও কথা নেই। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল খাবারগুলো মুখে তুলতে। সলিল আবার একজন কে হেঁ হেঁ করে বলল, চায় পিয়েঙ্গে আপলোগ ? তিনি হ্যাঁ বললে সমস্যা ছিল, ওঁরা সংখ্যায় ভারি তো বটেই, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাটা উত্তোরোত্তর বাড়ছে। তাঁরা অবশ্য এবারেও কোনও উত্তর দিলেন না, শুধু দেখে যাচ্ছেন, এই অদ্ভুত মানুষগুলোকে।

    হঠাৎ কোত্থেকে একটা স্কুটার চলে এল। তাতে আসীন এক যৌবন এক্সপায়ার্ড মানুষ। খুব সাধারণ চেহারা, ভীরেন্দ্র সেহ্‌বাগের হাসিটুকু মুছে দিলে যেমন দেখতে হবার কথা, সেই রকম। তাঁকে দেখেই উপস্থিত সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। যাঁরা উবু হয়ে বসেছিলেন, তাঁরা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালেন। অনেক বুকের কাছে হাত জড়ো করে হাফ-নমষ্কারের ভঙ্গিতে, সবারই মুখ কেমন কাতর কাতর। বোঝা গেল লোকটিকে এরা সবাই বেশ ভয় পায়। আমরা কিন্তু ভয় পাইনি, বরং এদের এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলাম। বেশ তো সাদা বুশ শার্ট আর ছাই রঙের ট্রাউসার্স পরা আমদেরই মত একজন লোক, রাইটার্স(এখন নবান্ন) বিল্ডিঙের যে কোনও কেরানি এমনই দেখতে। তাকে দেখে ঘাবড়ানোর কী আছে?

    সমবেত জনতা, যাদের এতক্ষণ বোবা মনে হচ্ছিল, এবার দেখা গেল, তাঁরা কথা বলতে পারেন , সবাই সমস্বরে আগন্তুককে জানালেন, ইয়ে লোগ বঙ্গালকে হ্যাঁয়, অওর বান্ধবগঢ় যায়েঙ্গে।

    ভীরেন্দ্র সেহবাগ এখনও স্কুটারে বসে, এক পা মাটিতে। এবার তিনি অনু পরিমান হাসি বের করলেন। দু হাত জোড় করে বললেন, মুঝে মিশ্র কহতে হ্যাঁয়।

    (চলবে)





    সাতমার পালোয়ান

    মুঝকো খুদ যানা পড়েগা, নহী তো কুছ নহী হোগা। আমাকেই যেতে হবে। ঠিক হ্যায়, এক কাম কিয়া যায়ে। আপলোগোঁমেসে এক দাদা মেরে সাথ আইয়ে। বাকি সব লোগ বাস পে সওয়ার হো যাইয়ে। ইয়ে বাস পহুঁচনেসে পহ্‌লে ম্যায় পহুঁচ যাউঙ্গা। মিশ্রজী বললেন, একজন আমার সঙ্গে আসুন। ওঁর কেন জানিনা সলিলকে পছন্দ হয়েছে, ওকে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে উনি ধাঁ হয়ে গেলেন।

    দেবুদা বুকে একটা ক্রস এঁকে ( দেবুদা ক্রিশ্চান নয়, পাতি হিন্দু) বলল, ওনার নামে সাতখানা মার্ডার কেস, এবার সলিল হ’ল আট নম্বর। এস আমরা ওর আত্মার সদ্গতির জন্য এক মিনিট নীর – আমি বললাম না না ইয়ার্কি না, সত্যি, লোকটা সলিলকে নিয়ে চলে গেল আর আপনারা সিনিয়ররা চুপচাপ দাঁড়িয়ে – দেবুদা বলল, আপনিও তো সিনিয়র দাদা, আপনি কী কচ্চিলেন? আমি বললাম, তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আমি রিঅ্যাক্ট করার সুযোগই পেলাম না। সলিলও দিব্যি উঠে বসল পেছনে। ব্যাপারটা কী বলুন তো? উনি যদি যাবেনই, তো বাসেই যেতে পারতেন আমাদের সঙ্গে। আর যদি স্কুটারেই যাবেন, সলিলকে সঙ্গে নেবার প্রয়োজন কী? র‍্যানসম ফ্যানসম চাইবে না তো? গায়ে পড়ে এমন উপকার, তাও আবার সাত খুন মাফ-ওয়ালা লোক, বিদেশ বিভুঁইয়ে, নাঃ ভাল ঠেকছেনা মোটেই।

    কী আর করা, আমরা গুটি গুটি বাসে উঠে বসলাম। মিষ্টির দোকানী লোকটা রিলায়েব্‌ল বলেই তো ধারণা হয়েছিল। তার কথায় খানিক আশ্বস্ত হওয়া গেল। আপলোগ চিন্তা মত করিয়ে, মিশ্রজী যব আব সবকা জিম্মা লে লিয়া তো সমঝিয়ে কাম বন গয়া। ওখানে আবার বাস ছাড়ে অনেক দেরীতে। এ বাসটা ছাড়ল ঘন্টা খানেক পর। বান্ধবগঢ় পৌঁছে দেখি, জঙ্গলের বাইরে একমাত্র পিডাব্লুডি বাংলো বুক হয়ে গেছে ( তখন একটাও হোটেল মোটেল ছিলনা, এখন অগুন্তি) সেখানে রান্নার তোড়জোড় চলছে মাটিতে পোঁতা বিশাল উনুনে কাঠ ফাঠ জ্বেলে। মিশ্রজী সলিলকে নিয়ে নিজের বাড়ি গেছিলেন। এখানকার আম জনতা শাকাহারি হলেও, আর মিশ্রজীরা বামুন হওয়া সত্বেও, আমিষাশী। সলিল আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, পঞ্চব্যঞ্জন সমেত মাছের ঝোল ভাত খেয়েছে। মিশ্রগিন্নী এমন যত্ন করে খাইয়েছেন সলিলের মা-ও লজ্জা পাবেন। সেখান থেকে স্কুটারে আমরা যাওয়ার অনেক আগেই ওঁরা পৌঁছে গেছেন। মাঝরাস্তায় তেল ভরার সময়ে সলিল পয়সা দিতে চাওয়ায় আট নম্বর মার্ডারটা প্রায় হয়েই যাচ্ছিল। সলিল অনুনয় বিনয় করাতে উনি একটু নরম হয়ে বলেছেন, তাহলে দু বোতল হুইস্কি কিনুন, একটা দিয়ে মুর্গি রান্না করব, অন্যটা আমি খাব, আপনারাও আমায় সঙ্গ দিতে পারেন।

    হুইস্কি দিয়ে মাংস রান্নার ব্যাপারটা আগে জানা ছিলনা, ওখানেই দেখলাম। মিশ্রজী বাংলোর চৌকিদারকে রান্নায় হাত লাগাতেই দিচ্ছেন না। সে বেচারা পেঁয়াজ টেয়াজ কুটে দিচ্ছে খালি। উনি নিজেই রাঁধবেন, সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মিশ্রজীর হুইস্কি-চিকেন রন্ধন প্রণালী শিখছে। আমি ভাবলাম, আমি যে কাজে এসেছি সেই কাজে যাই, জঙ্গলে ঢুকলে ছবি তোলার মত কিছু পাওয়া যাবেই। ক্যামেরা কাঁধে জঙ্গলের দিকে এগোলাম। জঙ্গলের ধার ঘেঁসে পিচের রাস্তা চলে গেছে, তার এপাশেও জঙ্গল, তবে এটা রিসার্ভ ফরেস্টের এলাকার বাইরে। ঘুরতে ঘুরতে দেখি চারিদিকে জঙ্গলের মধ্যে সামান্য একটু জায়গা পরিষ্কার করা, সেখানে একটা অস্থায়ী দোকানমত। দোকান বলতে চারটে বাঁশের খুঁটি, আর তার ওপরে পাতা টাতা দিয়ে ছাউনি। মাঝখানে একটা নড়বড়ে কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপরে একটুখানি জায়গা কাঠের ফ্রেমে ময়লা কাঁচ লাগানো বাক্সমতন করা, পাশে উনুন জ্বলছে, তাতে দুধ জ্বাল দেয়া হচ্ছে। আমি গিয়ে বললাম, ভাইয়া, চায় মিলেগা ইয়াহাঁ?

    লোকটা বলল, বিলকুল মিলেগা। - কিতনা ভাইয়া? -সাঠ পইসা (ষাট পয়সা) এই বলে একটা প্রমাণ সাইজের কাঁচের গ্লাসে, যেটায় প্রায় লিটারখানেক তরল ধরে, সে দুধ ঢেলে দিল। এবার তার মধ্যে খানিক চায়ের লিকার, চিনি আর একটু এলাচ থেঁতো করে মিশিয়ে দিয়ে বলল, আইয়ে -। আমি লিটারালি থ হয়ে গেলাম। তখন কোলকাতাতে হোমিওপ্যাথিক সাইজের ভাঁড়ে, দুধের জেরক্স কপি দিয়ে, এক গজ ( মানে তিন ফুট) চা পঞ্চাশ পয়সা। এই দৈত্যাকার গ্লাসে পুরো ঘন দুধের মধ্যে এক চামচ লিকার ঢেলে ষাট পয়সা? কোথায় এলাম রে ভাই?

    (চলবে)



    ১৪ নম্বরের আগে ১৫ পোস্ট হয়ে গেল। এবার ১৪




    গোলাপকে যে নামেই ডাকো

    আশিক হুঁ ম্যয় মেহ্‌জবীন কা
    লোগ কহেঁ মুঝে পগ্‌লা কহীঁ কা

    আমার শাম্মী কাপূরের ঠোঁটে মুহাম্মদ রফির একটা গান মনে পড়ে গেল। উত্তর ভারতের মানুষরা ঊর্দুভাষীদের থেকে এই ভদ্রতা টা শিখেছে। আমার নাম অমুক, একথা তাঁরা বলবেন না, বলবেন, আমাকে অমুক বলে ডাকা হয়। মুঝে মিশ্র কহ্‌তে হ্যাঁয়। দিল্লী ও গুড়গাঁওয়া ( যাকে অনেকে ‘গুরগাঁও’ বলেন)-র মাঝামাঝি, ‘কপসহেড়া’ নামক স্থানে আমাদের সংস্থার একটি সাময়িক আবাস ছিল। একরাত্রে, ফ্লাইট লেট ছিল বলে বেশ ভাল রাত্তিরেই পৌঁছলাম। বার তিরিশেক বেল বাজাতে একটি ছেলে চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে দোর খুলল। বল, সার আপকা লাগেজ লে আউঁ ?

    (হ্যাঁ অনেকে অধৈর্য হয়ে পড়ছেন হয়ত, আরে মশাই ভূতের কী হল? আসলে আমার এক বদ দোষ হচ্ছে, এক গল্প থেকে আর এক গল্প, সেটা বলতে বলতে কোনও সূত্র পেয়ে আর এক গল্প – এমনি ভাবে ভেসে যাওয়া। তবে তীরে আমি ফিরবই, চিন্তা করবেন না। ভূত আছে ভূতের জায়গাতেই। একবার তার স্বরূপ উদ্ঘাটন হয়ে গেলে তো গল্প পড়ার মজাই চলে যাবে।)

    তো ছেলেটা বলল, লাগেজ লে আউঁ? আমি পরিষ্কার বাংলায় বললাম, লাগেজ ফাগেজ কিছু নেই, কাঁধের এই ব্যাগটা ছাড়া। তা বাবা ঘর খুলে দাও। এসি, শাওয়ার, সিস্টার্ন, প্লাগ পয়েন্ট, সব কটা কাজ করে এমন ঘর দিও কেমন? ছেলেটা বলল, নমস্তে সার, মুঝে পান্ডে কহতে হ্যাঁয়। আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, শোনো ভাইডি, পৃথিবীর যে কোনও পান্ডে, যতই কালো হোক আর যতই বেঁটে হোক, তোমার মত দেখতে কোনওদিন হবেনা। তুমি নিশ্চয় মেদিনীপুরের ‘পন্ডা’। তা কেন বাওয়া বাঙালির সঙ্গে হিন্দী বলছ? আমি যে বাঙালি, তাতো গোড়াতেই বলে দিলাম। সে দন্তরুচিকৌমুদী উন্মুক্ত করে বলল, আসলে সার এদেশে কেউ পন্ডা বললে বোঝেনাতো, তাই –

    স্কুটারের সেহ্‌বাগ বলল, মুঝে মিশ্র কহতে হ্যাঁয়। কহিয়ে আপলোগোঁকা কেয়া সেওয়া কর সকুঁ? আমি বললাম, ইয়ে মানে, ঠিক আছে, আমরা তো এখানে বেড়াতে এসেছি, তাই – তিনি বললেন, আরে বাবুজী, আমি তো আমার নাম বললাম, আপনারা নাম টাম বলেন, কোথা থেকে আসা হচ্ছে – আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, নাম না হয় বলছি কিন্তু কোথা থেকে মানে কোলকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চল। একজন হাওড়ারও আছে। কোলকাতা তো বিরাট জায়গা, মানে – তিনি বললেন, আহা শুনিই না, কোলকাতার কোন জায়গা, আমাদের জানতে ইচ্ছে করে না? একজন বলল, টালিগঞ্জ।
    টালিগঞ্জের কোথায়?
    আপনি টালিগঞ্জও চেনেন? ( কথাটা হচ্ছে উমেরিয়া বলে একটা জায়গায়, যে জায়গার নাম, আমি অন্তত, গত পরশুও জানতামনা।)
    তিনি বললেন, -বলুন-ই না।
    ঐ তো, চারু মার্কেট –
    রাস্তার নাম?
    -বলা হ’ল
    ও, ওই তো বাজারের পাশ দিয়ে বাঁদিকে বেঁকে লাল বাড়িটা –
    আমাদের হাঁ বড় হচ্ছে। ভাবলাম ব্যাটাচ্ছেলে বোধহয় কোনও কালে টালিগঞ্জে একবার গেছিল, তাই –
    আচ্ছা বাবুজী, আপনি –
    সে বলল, হাওড়ায়। বলেই ভাবল রাস্তার নাম টামও বলে দিই বাবা –
    দেখা গেল সে রাস্তাও উনি চেনেন।
    একে একে নম্বর আসছে। সবার রাস্তা উনি চেনেন। অনেকের বাড়িও চেনেন দেখা গেল। আমি একেবারে শেষে।
    বললাম, বেদিয়াডাঙা। -কারাম্‌বা – এই নামটা উনি শোনেননি, জায়গাটা কোথায় তাও জানেন না। হুঁ হুঁ বাওয়া।

    যাকগে, উমেরিয়া নামক পান্ডব-কৌরব উভয়পক্ষ বর্জিত একটা জায়গায়, ভীরেন্দ্র সেহ্‌বাগের লুক-অ্যালাইক ( তখন অবশ্য সেহ্‌বাগ জন্মায়নি, জন্মালেও কাঁথায় ইয়ে করছে) রাইটার্সের কেরানি মার্কা একটা লোক সুদূর ওয়েস্ট বেঙ্গলের সব বাসিন্দার ঠিকুজি কুষ্ঠি বলে দিচ্ছে, লোকটা জ্যোতিষী না জ্যোতি বসু? আমি বললাম, ইয়ে, মানে আপনাকে সবাই খুব সম্ভ্রম করছে দেখলাম, তা আপনি মশাই নেতা টেতা নাকি? তিনি হাত দেড়েক লম্বা জিভ কেটে বললেন, কী যে বলেন বাবুজী, নেতা? আমাদের এখানে নেতা অত চট করে হওয়া যায়না। আমার যিনি নেতা, তিনি উনিশটা মার্ডার করেছেন, তবে না তিনি নেতা। আপনাদের আশীর্বাদে আমার নামে এখনও পর্যন্ত মোটে সাতটা খুনের কেস। আমার নেতা হতে অনেক দেরি। তবে হ্যাঁ, আপনারা আজ থেকে আমার মেহ্‌মান। কোলকাতায় ফিরে গিয়েও, কোই কিসিমকা কোই পরেশানি – মুঝে সির্ফ এক পোস্টকার্ড ড্রপ কর দিজিয়ে। তব দেখিয়ে ইস নাচীজ মিশ্রকা খেল। (‘নাচীজ’ শব্দটাও ঊর্দু বিনয়, মানে অনেকটা ‘গুড ফর নাথিং’ টাইপ।)

    আমদের গলা শুকিয়ে গেছে। আমরা এ ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ইয়ে তাহলে আমাদের অনুমতি দেন, আমরা গিয়ে বাস ধরি? তিনি বললেন, দাঁড়ান মশাই। আপনারা আমাদের দেশের সম্মানিত অতিথি। কী তাই কিনা? প্রশ্নটা সমবেত ওরাং ওটাং দেখতে আসা জনতাকে। তারা সমস্বরে, হাঁ হাঁ সহি বাত। এখন সমস্যা হ’ল, জঙ্গল তো এখন বন্ধ। আপনারা খবর না নিয়েই এসে পড়েছেন। জঙ্গল খুলবে নভেম্বরে। তাও ব্যবস্থা একটা করে দেয়া যেত, কিন্তু সালা রেঞ্জার খুব ডেঞ্জারাস। জঙ্গলে চোরি ছিপে ঢুকলে সালা গোলি চালিয়ে দেয়। জঙ্গলে মানুষ মারলে কেস ফেস হয়না নিশ্চয় জানেন। আপনাদের সঙ্গে কাউকে পাঠালেও কাজ হবেনা। আমায় নিজে যেতে হবে।

    (চলবে)





    গুলাবজামুন ও বনবালা

    চা তো খাওয়া হ’ল। এবার মনে হ’ল বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। বাংলোয় ফিরে গেলে বারোয়ারি ব্রেকফাস্ট কিছু পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার ফেরার ইচ্ছে নেই, আমার কাজটা আগে। দোকানির সেই নড়বড়ে টেবিলের ওপরে অস্বচ্ছ কাঁচের ওধারে কিছু রাখা আছে, খাবারদাবার হতে পারে। আবার টেবিলের তলায় দুটো বিশাল মাটির গামলা, অনেকটা গরুদের জাবনা দেয়ার ডাবার মত। কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ভইয়া, খানেকো কুছ মিলেগা? সে বল, হাঁ হাঁ কিঁউ নহী, সন্দেশ হ্যায়, রসগুল্লা হ্যায়, গুলাবজামুন হ্যায় – তখন খেয়াল করলাম, নীচে ঐ মাটির গামলাগুলোয় চিনির শিরার মধ্যে কিছু ভাসছে, একটায় লাল, একটায় সাদা। যাক মিষ্টিই হচ্ছে বাঙালির(মানে অন্ততঃ আমার) প্রিয়তম খাদ্য। গোলি মারো ব্রেকফাস্টকো, মিষ্টি খাওয়া যাক। বললাম ক্যায়সা হ্যায়? দোকানদার বলল, বহত আচ্ছা, খা কে দেখিয়ে না। আমি বললাম, না না, ক্যায়সা হ্যায় মতলব, ক্যায়সে দিয়া? সে বলল, এক রুপাইয়া পিস। আমি ভাবলাম এ আর এমন কি, আমাদের কোলকাতাতেও তো এক টাকাতেই (তখন) রসগোল্লা পান্তুয়া বিকোয়। বললাম, এক কাম কিজিয়ে, মুঝে চার গুলাবজামুন দিজিয়ে।

    বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, সে তো দিচ্ছেনা? মুখ তুলে তার মুখের পানে তাকিয়ে দেখি, লোকটা হাঁ করে দেখছে আমাকে, আক্ষরিকভাবেই হাঁ করে। সেই ওরাংওটাং দেখা লোকগুলোর চেয়েও অবাক হয়ে, যেন এইমাত্র মঙ্গলগ্রহ থেকে ল্যান্ড করলাম। বললাম, আরে কেয়া হুয়া, দিজিয়ে?
    সে বলল, চারটে গুলাবজামুন?
    আমি বললাম, হ্যাঁ, চারটে, বললাম তো –
    সে বলল, কী করবেন ওগুলো নিয়ে?
    আমি বললাম, শোনো কথা, খাব, আবার কী করব।
    সে বলল, একলা?
    - মানে?
    - মানে একাই খাবেন?
    - এখানে তো চার দিকে জঙ্গল। আমার ধারে কাছে আর কাউকে দেখছেন?
    - দেখছিনা বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম।
    - হ্যাঁ একলাই খাব, চারটে মিষ্টি খাওয়া আবার বড় কথা কী। আমাদের দেশে তো দশ বারোটা যখনতখন খাই।
    - হুম্‌। আচ্ছা বাবুজী, একটা কাজ করুন না, প্রথমে একটা খান। আমি তো আর পালাচ্ছিনা। লাগলে আরও নেবেন না হয়।

    আমি ভাবলাম কী বিপদ রে বাবা। আসলে এরা গরীব মানুষ তো, ভেবেছে একসঙ্গে চারটাকার মিষ্টি খাবে? তা যে কেউ খেতে পারে, তা মাথাতেই নেই। হুঁঃ।
    লোকটা এবার একটা প্লেট বের করল। চিনেমাটির প্লেটই, কিন্তু ধারের দিকে চলটা ওঠা, মেজে মেজে বিবর্ণ। বাড়িতে অমন প্লেট দিলে এক কিকে বেদিয়াডাঙা পেরিয়ে যেত। যাক, কী আর করা যাবে। এবার সে একটা জিনিষ বের করল, একটা লম্বা ডান্ডা, সম্ভবতঃ কোনও শক্ত গাছের ডাল, তার একেবারে মাথায় একটা হাফ নারকোলের মালা ফিট করা আছে। ওটা আসলে হাতা। কিন্তু একটা গুলাবজামুন তুলতে মশা মারতে কামানের ইন্ডেন্ট? সে এবার ওটা এগিয়ে নিয়ে গেল, যে গামলাটায় সাদা মিষ্টি ভাসছে, সেদিকে। আমি বললাম, উহুঁ উহুঁ, আমি তো গুলাবজামুন চাইলাম। সে বলল, এটাই তো গুলাবজামুন, লালটাতো রস্‌গুল্লা। আমি বললাম, যাস্‌সালা, এতো উল্টো্রাজার দেশ দেখছি। বললাম, আরে ভাই মুঝে উওহ লালওয়ালা দো, নাম যো ভি হো। এবার নারকোলের মালা যাচ্ছে গামলার দিকে। আসলে জলে বা অন্য কোনও তরলে সলিড কিছু ভাসলে তার ওয়ান এইটথ ওপরে থাকে বোধহয়। ওপর থেকে বোঝা সম্ভব নয় সাইজটা। মালটা যখন সেই ইম্প্রোভাইজড হাতায় উঠল, তখন মালুম পেলাম, দোকানদার কেন জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা একা খাব কিনা, আর কেনই বা বলেছিল, আগে একটা খান তারপর লাগলে নেবেন, আমি কি পালাচ্ছি?

    উনিশশো ছিয়াশি সালে একবার আমাদের সদর দপ্তরে গেছি ওখানকার মেডিক্যাল অফিসারের কাছে একটা টাই-আপ সই করাতে। অনেক টাকার ধাক্কা, কিন্তু টাই আপে পয়সা লাগেনা। গরমকাল, গিয়ে দেখি ডাক্তারবাবু জামা গেঞ্জি সব খুলে খালি গায়ে তাঁর টেবিলের ওপর বসে। ভাগ্যিস শুধু জামাটাই খুলেছেন। তাঁর বিশাল চেহারায় ভীতিপ্রদ রকমের বড় বড় লোম, প্রায় মহুয়াবনে ভাল্লুকের মত। তাঁকে পরিবেষ্টিত হয়ে কিছু করণিক কাজে ফাঁকি দিয়ে মোসাহেবিতে রত। তিনি গল্প বলছেন, এঁরা শুনছেন কিংবা শোনার ভান করছেন। কেউ ডেকে পাঠালে বললেই হবে ‘স্যারের’ চেম্বারে ছিলুম।
    ডাক্তারবাবুর কাছাকাছি পৌছবার যো নেই, কিন্তু আমায় আজকেই আবার বর্ধমান লোকাল ধরতে হবে, ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।

    ডাক্তার বলছেন, বুঝলেন মশয়, তা সেই দোকানদার তো নারকেলের হাতায় করে একটা জাইগান্টিক সাইজের মিষ্টি তুলল প্লেটে। কী বলব মশয়, সাইজ দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবেন। একটা ক্রিকেট বলের চেয়েও বড়। দাম কত জানেন? মাত্র এক টাকা। অবশ্য জায়গাটা বান্ধবগঢ় আর সেটা বছর কুড়ি আগের কথা।
    আমি দেখলাম এই সুযোগ, বললাম, ডাক্তারবাবু, ওটা এখনও এক টাকাই আছে। উনি অ্যাঁ – বলে চমকে উঠতেই বললাম, এই টাই–আপটা যদি একটু ইয়ে –

    তা সেই ‘জাইগান্টিক’ মিষ্টি তো উঠল প্লেটে। এবার দোকানের মালিক একটা ছোট্ট ছুরি বের করল। আমরা ছোটবেলায় লেক মার্কেটে যেতাম অস্ট্রেলিয়ান আপেল কিনতে। খুব গাঢ় মেরুন রঙের, প্রায় কালচে অসাধারণ মিষ্টি আপেল। একটাই কেনা হত, ওজন যা হয়। দোকানদার এমনি একটা ছুরি দিয়ে ওটার খানিকটা অংশ সারি সারি ফালি করে কেটে পদ্মফুলের মত করে বানিয়ে দিত। ইনিও দেখলাম সেই রকম পদ্মফুল বানাচ্ছেন গুলাবজামুন, থুড়ি, এখানে তো আবার ‘রস্‌গুল্লা’ বলতে হবে, সেইটাকে। গুলাব-মানে ইয়ে রস্‌গুল্লার ভেতরটা একটা গোলাপি আভা, সাজিয়ে পদ্মফুল হয়ে সে এখন আরও মনলোভা। হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিতে যাচ্ছি, দোকানদার বলল, উহঁ উহুঁ –

    কীরে বাবা, এরা খালি সাজিয়ে রাখে নাকি, খেতে দেবেনা? আবার নারকোলের মালা চলল নীচে। এবার একটা দুরূহ জায়গায়, যেটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছেনা। তাতে উঠে এল ঘন থকথকে রাবড়ি, কম করে দুশো গ্রাম। সেটা ঢেলে দেয়া হ’ল সেই ‘পদ্মফুলের’ পাপড়ির মাঝখানে। পুরো ব্যাপারটার দাম এক টাকা এবং অ্যাজ পার ডাক্তারবাবুস স্টেটমেন্ট, গত কুড়ি বছর ধরে তাই আছে।

    আমি সেদিন ফিরে গিয়ে লাঞ্চ খাইনি। শুধু ছোট্ট দু পিস মুরগির মাংস একটু চেখে দেখেছিলাম। ওই খাওয়ার পর সারাদিন না খেলেও চলত। সারাদিন খালি এই ভেবেই কেটে গেল, যে জঙ্গলের মধ্যে কারা খায় এই গুলাবজামুন- থুড়ি রস্‌গুল্লা? বাঘেরা ?

    উমেরিয়ার মিষ্টির দোকানি কেন ওখানকার মিষ্টি নিয়ে আসতে বারণ করেছিলেন এতক্ষণে বোঝা গেল।

    খেয়ে দেয়ে, আমি হাঁটা দিলাম জঙ্গলের ভেতরে। বাঘের ভয় ছিলনা, কেননা মিশ্রজী বলেই দিয়েছেন, ইয়াহাঁকা এক ভি শের আদমখোর (মানুষখেকো) নহী হ্যায়। যখন বললাম, আমাদের দেশের(মানে বাংলার) সব বাঘই আদমখোর, তখন তিনি এমন অবাক হলেন, যে বলার নয়। যাক জঙ্গলের মধ্যে হাঁটছি কাঁটা, ঝোপ এই সব বাঁচিয়ে। খানিক এগোতেই দেখি খানিকটা জায়গা একটু পরিষ্কার মত, আর সেখানে দাঁড়িয়ে এক বনবালা।

    (চলবে)




    ব্যাকলাইট, বনবালা ও বিপদ

    শ্রী মনোহর কাজল ছবি তোলেন। তিনি খুব নামী ফোটোগ্রাফার। তাঁর একটি বইও আছে, চার হাজার ভারতীয় টাকা দাম সে বইয়ের। বইটায় আগাগোড়া সব ছবিই হয় বালক বালিকা অথবা দেহাতি সুন্দরীদের। কেউ গয়নাগাঁটি পরা, কেউ কম জামাকাপড় পরা, তবে সবই ব্যাকলাইটে। সমস্যা হল, তাঁর বই কেমন কাটছে জানিনা, কারণ ছাপার মান খুব একটা ভাল নয়। অধিকাংশ ছবিই সে আমলের, অর্থাৎ অ্যানালগ আমলে তোলা। ব্যাকলাইট মানেই হাই স্পীড। তাতে গ্রেন আসবেই। ছাপার আগে পোস্ট প্রোডাকশনে ডি-নয়েজ করে নেয়া উচিত ছিল। আমার ছবিও ব্যাকলাইটে, সে ছবিতেও নয়েজ আছে, থাকবেই। তবে এ ছবিই আমার ভাল লাগে, একটা অসাধারণ মুহূর্ত। সেদিনের কথা ভাবলেও শিউরে উঠি মাঝে মাঝে।

    জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ বনবালা কেন? কী আশ্চর্য, বনবালা তো বনেই থাকে। তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আমি ঠিক এরকম আশা করিনি। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ফোটগ্রাফার, মানে সত্যি যারা ফোটোগ্রাফার, তাদের সামনে কায়দামত মডেল পড়ে গেলে তারা আর সব ভুলে যায়। কিন্তু একে পোজ দেয়াই কী করে? নাকি ক্যান্ডিড তুলব? না জানিয়ে তুলব, নাকি জানিয়ে? বনবালার হাতে একটা কাস্তে। সে জঙ্গলের শুকনো ডাল, পাতা এইসব কেটে বান্ডিল বাঁধছে, নিশ্চয় মাটির উনুনে জ্বালাবার জন্য। কিন্তু কী বলে ডাকি ওকে? ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের অ্যাড্রেস করার নানা নিয়মকানুন। এক জায়গায় যেটা খুব স্বাভাবিক অন্য জায়গায় সেটাই অফেন্সিভ। বয়স্কা মহিলা হলে, এ মাঈ – বলে এগোন যেত। একে কী বলি?


    কিন্তু হাত নিশপিশ, মানে, শাটার নিশপিশ করছে। বনবালা তো বন্য হরিণীর মত, এক জায়গায় দাঁড়াচ্ছেনা, ঘাসে কাস্তের কোপ মারছে, আবার তুলে নিয়ে ত্রস্তপদে এগিয়ে যাচ্ছে। শেষে বলেই ফেললাম, “এ, – সুনো”- চকিতে ফিরে তাকাল সে। খানিক ভয়, খানিক সন্দেহ। বললাম, ডরো মত, হম সির্ফ তুমহারা ফোটো খিঁচেঙ্গে। ফোটো জানতি হো না? ফোটো? সে খানিক বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই পড়ল-
    ডরো মত, ফোটো খিঁচুঙ্গা, ফোটো – ইয়ে দেখো ক্যাম্‌রা –
    সে দাঁড়িয়েছে। মাথার পেছনে আলো। অসাধারণ ব্যাকলাইট। কোলকাতায় ফিরে গিয়ে জয়দেবদাকে দেখালে পিঠে এত জোরে চাপড়ে দেবে,যে তিনিদিন ব্যথা থাকবে।
    - জরা হঁসো তো – খ্যাচাক্‌ খ্যাচাক্‌
    আচ্ছা এক কাম করো, জরা পিছে চলি আও-
    যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছে, তার পেছনে নীচের দিকে খুব জোর রোদ পড়েছে, প্রিন্টটা জ্বলে যাবে একেবারে। মুখ তো তোলা হল, এবার ফুল ফিগারটা নিতে ওকে একটু অন্ধকার ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে যেতে হবে। এদিকে মাথার পেছনে ব্যাকলাইটও চাই। কিন্তু যেতে হবে বললেই তো হয়না, জঙ্গলতো পার্ক স্ট্রীট নয়, এখানে কাঁটা, ওখানে ঝোপ, অন্ধকার পেলেও সেখানে দাঁড়াবার জায়গা নেই – হঠাৎ এক প্রচন্ড হুঙ্কার –
    না, বাঘের নয়, মানুষের।
    জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে এক মানুষ। দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ, সাদা দাড়ি দুদিকে ভাঁজ করে গোটানো, মাথায় বিশাল পাগড়ি, গায়ে বিচিত্র রঙীন পোষাক, আর...আর হাতে উন্মুক্ত তরবারি।

    সত্যিকারের তলওয়ার। সে আবার বিশাল। লোকটার চোখে আগুন জ্বলছে। মুখে তার জাপানি কিংবা গ্রীক ভাষা- একবর্ণ বুঝছিনা। বললাম আপ কৃপয়া হিন্দী মে বাত করেঁ তো ম্যাঁয় সমঝ সকুঁ। আপকি জুবান মেরি সমঝমে নহী আতি।
    লোকটার হিন্দী আমার থেকেও খারাপ। মোটামুটি যা বোঝা গেল, তা হল –
    এই মেয়েটি আমার নাতনি। তুমি তোমার ঐ বিদ্ঘুটে যন্ত্রের মধ্যে ওর আত্মাকে বন্ধ করেছ। আমি জানি তোমরা জঙ্গলে এসে মাঝে মাঝে জীবজন্তুর আত্মা বন্দী করে নিয়ে যাও, কিন্তু এখন তুমি মানুষের আত্মায় হাত দিয়েছ। আমার নাতনি কুমারী। তার আত্মা তোমার যন্ত্রে গিয়ে কলুষিত হয়েছে। একমাত্র উপায় ছিল তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়া। কিন্তু তুমি একে পরদেসি, তায় বেজাত। বিয়ে সম্ভব নয়, তাই তোমাকে মরতে হবে। তলওয়ার ওঠাচ্ছি, তুমি মরদের মত দাঁড়াও। পালিওনা, আমার সঙ্গে দৌড়ে পারবেনা।

    (চলবে)




    ‘মুন্ডু গেলে খাবোটা কি
    মুন্ডু ছাড়া বাঁচব নাকি’
    – গুপি গায়েন

    - আরে আরে, করেন কী, সিরিয়াসলি আমায় মারবেন নাকি, ও দাদাজী
    সুনিয়ে না, ইয়ে কোই অ্যায়সা ওয়্যাসা যন্তর নহী হ্যায়, ইয়ে তো ক্যাম্‌রা হ্যায়, ক্যাম্‌রা –ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ - দেখিয়ে না আপকা ভি ফোটো নিকালতা হুঁ। আপ জরা সিধা খড়া হো যাইয়ে, তলওয়ার অ্যায়সে পকড়িয়ে – ম্যায় ফোটো নিকালতা হুঁ-
    দাদাজী বললেন, চুপ করো। তোমাদের আমার চেনা আছে। তোমরা আত্মা চুরি করে নিয়ে যাও। কিন্তু এবার শক্ত হাতে পড়েছ। আজ তোমার নিস্তার নেই।
    আমি বললাম, আরে দাদাজী, এটা ফোটো তোলার যন্ত্র, আত্মা ফাত্মা কিছু ধরা যায়না এতে। ফোটো মানে তসবীর। যেমন শিল্পীরা তসবীর আঁকেনা, সেই রকম। শুধু এটায় তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।
    - চুপ করো, বাহানাবাজি বন্ধ করো। তসবীর? কোথায় তোমার তসবীর, দেখাও আমাকে -
    ( এই ঘটনা বিশ্বব্যাপি চাউর হওয়াতেই প্রথমে পোলারয়েড ও পরে ডিজিটাল ক্যামেরা আবিষ্কার করার দিকে নজর দেন বিজ্ঞানীরা, যাতে সঙ্গে সঙ্গে ছবি দেখা যায়, না হলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা কোথাও কোথাও।)

    আমি বললাম, সে তো ফিল্মে আছে, বাড়ি গিয়ে প্রথমে সেটা ওয়াশ করব, তারপর প্রিন্ট –
    দাদাজী বললেন সব বক্‌ওয়াস। আমি জানি তুমি এই কুমারীর আত্মা চুরি করেছ। এবার শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও।
    আমি ভাবলাম, এটা সত্যি, না স্বপ্ন দেখছি? লোকটা সত্যি সত্যি তলওয়ার দিয়ে মারবে নাকি আমাকে?
    নানা রকম চিন্তা মাথায় চলে এল। প্রথম কথা, এই জঙ্গলের মধ্যে, মানে এদিকটা রিসার্ভ ফরেস্টের মধ্যে, এবং যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা টাইগার হ্যাভেন, মানে বাঘদের থাকা এবং ঘোরাফেরার এলাকা। তো এখানে বুড়ো তলওয়ার হাতে কী করছিল। লোকটা পাগল টাগল নয়তো? সত্যি এই মেয়েটার ঠাকুদ্দা তো? এদিকে আমার নায়িকা, হিন্দী ফিল্মে যেমন হয়, -দাদাজী, মত মারিয়ে ইনকো, ইয়ে মেরা জানে জিগর। ম্যায় ইনসে পেয়ার করতি হুঁ – এই সব বলে পা জড়িয়ে ধরবে, না কোথায় কী, সে আবার আপন মনে ঘাস কাটতে লেগেছে। এতবড় একটা কান্ড ঘটে যাচ্ছে, তাতে তার কোনও হেলদোল নেই। এবার নায়ক কী করে?

    এন্টার নায়িকা নাম্বার টু , মানে দু নম্বর বনবালা।
    এ মেয়েটি অন্য রকম সুন্দরী। ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, সম্ভবতঃ গোন্ড উপজাতির। এও ঘেসুড়ে, এবং আগের বনবালার পূর্ব পরিচিতা। এদের মধ্যে হাসি মশকরাও শুরু হয়ে গেল। এদিকে আমি আর দাদাজী মুখোমুখি। আমি বললাম, দেখিয়ে ম্যায় ইসকা ফোটো নিকালতা হুঁ – খ্যাচাক্‌ - দেখিয়ে যদি আত্‌মা হি ইসকে অন্দর বন্ধ রহতি, তো এক যন্তরকে অন্দর দো আত্‌মায়েঁ ক্যায়সে রহ সকতি? বতাইয়ে ?
    দাদাজী কিঞ্চিৎ বিচলিত এবং চিন্তিত। কিন্তু এই ট্রিক বেশিক্ষণ স্থায়ী হলনা।
    তিনি বললেন, কেয়া মালুম, তুমহারা ইয়ন্ত্র (যন্ত্র) কিতনি আত্‌মায়েঁ ভর সকতা। বেশি কথা বলে আমাকে ভোলাবার চেষ্টা কোরনা শহরবাসী, এবার মরার জন্য প্রস্তুত হও।

    একটা পুরুষ কণ্ঠ কানে এল। পেছন থেকে কে যেন বলছে, কোই কোই আদমী কো সহি ওয়ক্ত পর সহি জগহ পহুঁচনেকা আদত হ্যায়। কেয়া নাটক চল রহা হ্যায় ইয়াহাঁ? মুঝে ভি এক রোল দে দো কোই। পেছনে তাকিয়ে দেখি মিশ্রজী। আরে বাবুজী, ব্রেকফাস্ট টেবিলে আপনার দেখা না পেয়ে চিন্তিত হলাম, সবাই বলল, আপনি নাকি ছবি তোলার নেশায় জঙ্গলে টঙ্গলে ঢুকে পড়েন প্রায়ই। তা একা এখানে ঘোরাঘুরি তো ঠিক নয়, এটা টাইগার হ্যাভেন। অবশ্য এখানকার বাঘ আদমখোর নয়, কিন্তু তাকে দেখে ভয় পেলে বা ছুটোছুটি করলে সে অ্যাটাক করে। তাই ভাবলাম একটু খুঁজে দেখি আপনাকে পাওয়া যায় কিনা।

    আমি বললাম, বাঘের দেখা পাইনি বটে, তবে এঁকে পেয়েছি। ইনি এক্ষুণি আমার মুন্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করবেন, খালি আপনি এসে খানিক ব্যাগড়া দিলেন। মিশ্রজী বললেন, তাই? তারপর দাদাজীকে বললেন, শুনুন মশায়, ইনি হলেন আমার সম্মানীয় মেহ্‌মান। এঁর গায়ে আঁচড়টিও পড়লে, আমি কিন্তু জিন্দা দফনা দেঙ্গে পুরা খানদানকো। সমঝে?

    দাদাজী খুব একটা ভয় পেয়েছেন বলে মনে হলনা। তিনি বললেন, কিন্তু তাই বলে যার গায়ে রাজপুত রক্ত আছে, সে কখনও তাদের বংশের কুমারী মেয়ের আত্মা চুরি সহ্য করেনা। সে তুমি আমায় মেরে ফেললেও আমি শেষ দেখে ছাড়ব। তখন মিশ্রজী সেই গ্রীক ভাষায় কী সব বলতে লাগলেন। দুজনে খুব উত্তপ্ত বাদানুবাদ হ’ল কিছুক্ষণ। তারপর মিশ্রজী বললেন, আচ্ছা এটা যে ছবি তা দেখলে আপনি শান্ত হবেন তো? ঠিক আছে, আমি জিম্মা থাকলাম, বাবুজী বাড়ি গিয়ে ফোটো প্রিন্ট করে আপনাকে পাঠাবেন। তাইনা বাবুজী? আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ সিওর সিওর। তাহলে মুন্ডুশুদ্ধু ফিরে যাই?
    দাদাজী বললেন, যান।

    ফিরে এসে অবশ্য মিশ্রজীর জন্য আমাদের দল অনেক কিছু পাঠালেও, দাদাজীর সেই ছবি আমি পাঠাইনি। ভাল ছবি তুলতেই দিলনা, - ধুস্‌ - মডেলটা কিন্তু ক্লাস ওয়ান ছিল।

    (চলবে)




    অমলতাস, কচনার ও গুলমোহর

    ‘কচ্চি কলি কচনারকি
    রীত জানেনা হায় ইয়ে পেয়ার কি’ –
    মান্না দে’র গান। কচনারের নতুন কুঁড়িগুলি হায় পিরীতির নিয়মকানুন জানেনা। মুশকিল হচ্ছে, আমিও জানতামনা, মানে কাঁচা বয়সে। তাই কত যে অভিশাপ কুড়িয়েছি, তার হিসেব নেই। এই মধ্যপ্রদেশেই তো কম শাপ শাপান্ত জোটেনি কায়দা কানুন বুঝতামনা বলে। তার ফল ভুগছি এখন। যাকগে, সেই কচনারই জুটে গেল কপালে।

    দামোহ্‌ সার্কিট হাউসের দু নম্বর বাংলোটার তিনটে ঘর, অমলতাস, কচনার ও গুলমোহর। ভারতে যত ফরেস্ট বাংলো আছে, তাদের ঘর বা টেন্টগুলোর পশু, পাখি বা গাছের নাম ধরে নামকরণ শুরু হয়েছিল সেই সত্তরের দশকেই। তবে সার্কিট হাউসের এমন নামকরণ আগে দেখিনি। আসলে জটিয়াজীর মত প্রকৃতিপ্রেমিক কেউ এর পেছনে থেকে থাকবেন। অমলতাস, কচনার ও গুলমোহর তিনটি গাছের নাম। বাংলায় যথাক্রমে, সোনাঝুরি, কাঞ্চন ও কৃষ্ণচূড়া। অমলতাস নামটি বড় কাব্যিক, বাংলা সাহিত্যে কয়েক জায়গায় উল্লেখও পেয়েছি। তবে আমার যেন সোনাঝুরি নামটাই বেশি পছন্দ। কিন্তু আমায় দেয়া হ’ল কচনার। দুপাশের ঘরে কারা থাকবেন? জানা গেল সেগুলো ফাঁকা। আসলে এক নম্বর ও দু নম্বর বাংলোর কোনও ঘরেই আর কোনও অতিথি নেই। বেশ প্রশস্ত বারান্দা ঘরগুলোর সামনে। এবার ঘরগুলোকে বেড় দিয়ে অমলতাস ও গুলমোহরের দুপাশ দিয়েও সে বারান্দা ঘুরে গেছে, শুধু কচনারের সামনেটাই ফাঁকা। দুপাশে দুটো ঘর দিয়ে কচনার আটকানো। কেন এই ঘর আমায় দেয়া হল, জাতীয় প্রশ্নের উত্তর পরিচারকদের জানা নেই। কোনও প্রশ্নের উত্তরই জানা নেই, তারা ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকে। ঘরে কোথায় কোন সুইচ আছে, রুম হীটার চালু করার প্লাগ কোথায়, এইসব প্রশ্নের জবাবে যান্ত্রিক পুতুলের মত গিয়ে হাত তুলে দেখিয়ে দেয়। এক সময়ে তারা সব চলে গেল। পাহাড়ের মাথায় অনেকটা জায়গা জুড়ে এক বিশাল চত্বরে জোড়া বাংলো। তাতে একজন বাঙালি আজ রাত কাটাবে।

    পাঞ্জাবি পাজামার ওপর শাল চাপিয়ে বসে আছি। ঘরে বড় স্ক্রীনের টিভি। দেখতে গিয়ে দেখি, যা-ই দেখতে যাই, বলে সরি, ইউ আর নট সাবস্ক্রাইবড টু দিস চ্যানেল, প্লীজ কনট্যাক্ট অমুক তমুক । গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেই গাড়িই, তবে চালক অন্য। শাহিদের ডিউটির সময় শেষ বোধহয়। লাফিয়ে নামলেন এক ভদ্রলোক। নমস্তে সার, আমার নাম গোস্‌ওয়ামী (গোস্বামী)। ইনি অবশ্য মুঝে গোস্‌ওয়ামী কহতে হ্যাঁয় বলেন নি। ইনি কেন এসেছেন? বললেন, সার কোনও অসুবিধে হচ্ছেনাতো? বললাম, এই তো সবে এলাম, সুবিধে অসুবিধে বোঝার তো সময় হয়নি। তা আপনি – তিনি বললেন, না একটু খোঁজ নিয়ে গেলাম, সারকে দয়া করে বলবেন যে গোস্বামী এসে খবর নিয়ে গেছে। চলি সার কোনও অসুবিধে হলেই সুখলালকে ডাকবেন।

    সুখলাল এল। বললাম ভাই তোমাদের টিভিতে কয়েকটা মাত্র হিন্দী খবরের চ্যানেল আর অল্প কটা হিন্দী এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেল ছাড়া কিছু নেই কেন? সে বলল, সার এখানকার সরকারি অফিসাররা তো ইংলিশ চ্যানেল ট্যানেল দেখেননা, তাই- আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। খুব কম দামি হোটেলগুলোতেও আমি এবিপি আনন্দের খবর শুনেছি, ডিসকভারি চ্যানেল দেখেছি, তার মানে এরা একটা মিনিমাম রিজিওনাল প্যাকেজ কিনেছে। কিন্তু কেন? সুখলাল বলল খরচ বাঁচানোর জন্য বোধহয়। কিন্তু তাই যদি হবে, গোটা এলাকা যে ভাবে আলো দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে, তাতে তো বিরাট এবং অস্বাভাবিক খরচ পড়ার কথা। চারদিকে এত আলো, যে কোনও ছবি তুলতে ফ্ল্যাশ লাগেনা। এর কারণ কী? ভারতের কোথাও কোনও বাংলোয় তো এত আলোর বন্দোবস্ত নেই।

    এক নম্বর ও দু নম্বরের সব ঘরে আলো জ্বলছে এবং প্রচন্ড জোরালো আলো। আমি বললাম রাত্রে তোমায় দরকার হলে পাব কী করে? এই রিমোট কল সিস্টেমে তো কেউ আসেনা। সে বলল, দেয়ালে আমার মোবাইল নম্বর টাঙানো আছে, কল করবেন। তবে মকবুল খাবার দিয়ে গেলেই আমরা সার্ভ করে নেমে যাব। কী কী দরকার দেখে নিয়ে একটু আগেভাগেই বলে দিন সার।

    তার মানে রাতে মোটামুটি একা?

    (চলবে)





    অবশেষে রাত্রি

    একা একা বিচ্ছিরি লাগছিল। কেউ কোত্থাও নেই, কিছু করারও নেই। হিন্দী চ্যানেলগুলো বার কয়েক খুলে মিনিট দুয়েক পরেই বন্ধ করে দিচ্ছিলাম। এই ভাষাটা খানিক বলতে এবং লিখতে পারলেও আমার পছন্দের ভাষাগুলোর মধ্যে পড়েনা। আমাদের সময়ে স্কুলে কম্‌পালসরি ছিল, আমি বরাবর হাইয়েস্ট মার্কস পেতাম কিন্তু মোটেই ভাল লাগতনা তখন থেকেই। অদ্ভুত জায়গা তো, একটাও ইংরিজি চ্যানেল নেই? কোনও খবরের চ্যানেলও না। বাংলা টাংলার কোনও প্রশ্নই নেই। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া যাক। কিন্তু খাবার কই? বেশ কয়েকবার সেলফোনের বোতাম টেপার পর সুখলালের গলা। তাকে বললাম, আরে ভাই খাবার কোথায়? সে বলল, মকবুল দিয়ে যায়নি? আমি বললাম সে তো তুমি আমার থেকে ভাল জানবে, তাকে ফোন লাগাও। সুখলাল বলল, মগর সার মেরে পাস উসকা ফোন নাম্বার নহী হ্যায়। ব্যাস, তার মানে উপোস? কী আর করি, ঘরে দম বন্ধ লাগছে। যাই বারান্দা বা উঠোনটায় একটু ঘুরে আসি।

    বাইরে বেরোলাম, কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল। আকাশটা ঘন কালো, তারাগুলো হাত বাড়ালেই ধরা যাবে মনে হচ্ছে, কিন্তু জোড়াবাংলোর চৌহদ্দিতে আলোর বন্যা। এত আলো, যে রীতিমত অস্বস্তি হচ্ছে। কত হাজার বা লাখ ওয়াটের শ্রাদ্ধ হয় প্রতিরাতে? নাকি কেবল আজকের জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা? শ্রীমতি দামিনীর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, এখানে অন্ততঃ আর কোনওদিন আসবনা।

    অবশেষে ভূতের দেখা পাওয়া গেল। সে অন্ধকার চিরে আলোর বৃত্তে ঢুকে পড়ল। হেঁটে আসছে আমার দিকেই। খুব অনিচ্ছাসহকারেই আসছে মনে হ’ল। কিন্তু ভূত কি হেঁটে আসে? কাছাকাছি এলে দেখা গেল, সে ভূত নয়, মানুষ, তার হাতে একটা স্টীলের টিফিন ক্যারিয়ার, সম্ভবতঃ মকবুলের দূত। তবে তাকে ভূতের মত লাগছিল কেন? আসলে এখন শীতকাল হলেও ঘরের মধ্যে শীতের কোনই প্রকোপ নেই। শালটা ফেলে দিয়েছি অনেক আগেই। এখন এই বাঙালি বুড়োর গায়ে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর একটা পাজামা। বাইরে সামান্য ঠান্ডা আছে বটে, কিন্তু তা বেশ উপভোগ্য। ওদিকে বেশ বলিষ্ঠ, অল্প বয়্সী, স্থানীয় মানুষটি খুব মোটা ফুল সোয়েটার, মাঙ্কি টুপি ও বেশ মোটা একটা গরম চাদরে মোড়া। সবই সাদা রঙের। তাকে ভূত মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে। লোকটা ভুষুন্ডির কাকের মত কালো, তার ওপরে বিশাল একজোড়া কালো গোঁফ ঝুলতে ঝুলতে প্রায় চিবুকের কাছে। সে বলল, খেয়ে নিন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

    মকবুল খাবার দিয়েছে ভালই। ধনেপাতা দিয়ে চিকেন, একটু তৈলাক্ত। একটা হালকা সবজি, একটা বেশ ব্যালান্সড স্যালাড আর হাতে গড়া রুটি। ওখানকার রুটি দেখতে কোলকাতার বিউটি পার্লারের সুন্দরীদের মত ফর্সা নয়, বরং বন্য আদিবাসীদের মত কালচে। কিন্তু এই আটাই খুব সাস্থ্যকর ও উপাদেয়। খেতেও ভাল যথেষ্ঠই। বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেলাম। খিদে পেয়েওছিল ভালই। শিপ্রা এক্সপ্রেসে প্যান্ট্রি নেই আর এসি কোচ এমন জায়গায় দাঁড় করায়, তার চৌহদ্দিতে খাবার দোকান থাকেনা। মোটামুটি উপোসীই ছিলাম তাই বাড়িতে যা খাই তার দ্বিগুণ খেয়ে ফেললাম। হাত ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে লোকটাকে ডাকলাম, ভাই নিয়ে যাও।

    লোকটা কাছে আসতেই একটা কথা মনে হল –
    - ভাই ইয়ে অমলতাস অওর গুলমোহর মে কওন হ্যায়?
    - কোই নহী সার।
    - তো ঘরকে অন্দর বত্তি কিঁউ জ্বল রহা হ্যায়?
    - অ্যাইসাহি হুক্‌ম হ্যায়।
    - আচ্ছা, মেরে খয়ালসে এক নম্বর মে ভি তো কোই নহী হ্যায়? তো কেয়া ওয়াহাঁ ভি হর কমরেমে বত্তি জ্বলায়ে রখনেকা হুকুম হ্যায়?
    - জী সার।
    - আচ্ছা মান লিয়া কি বত্তি জ্বলেগা। তো ম্যায়নে দেখা এক এক কমরেমে পচ্চিস লাইটস হ্যায়। তো এক কাম করো, এক দো জ্বলাকে বাকি সব বুতা দো। কিঁউ ইতনা ইলেক্ট্রিসিটি বরবাদ কর রহে হো?
    - মাফ কিজিয়ে সার। সারে কে সারে জ্বলায়ে রখনেকা হুকুম হ্যায় সার।

    বাইরের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, এক এক ঘরে পঁচিশটা করে শর্ট টিউব। টোটাল ওয়াটেজ কত ঈশ্বরই জানেন। ওই জন্যই শুধু পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েও ঠান্ডা লাগছেনা। তাহলে সারা কমপ্লেক্সে ভেতর বাহির মিলিয়ে কত ওয়াটের ইলেক্ট্রিসিটি নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেন? যেখানে একটা সাধারণ ডিশ অ্যান্টেনার প্যাকেজ কেনার পয়সা নেই এদের?

    ( চলবে)





    তাঁরা আঁধারে আছেন, আলোতেও...

    ‘ বড় একা লাগে এই আঁধারে...’ মান্না দের গানটা গাইতে গিয়ে থমকে গেলাম। একা ঠিক আছে কিন্তু আঁধার কোথায়? রবিঠাকুরের আলো আমার আলো গাইতে হবে তো। সাদা কম্বল, সোয়েটার, টুপী ইত্যাদি পরা ভূতের মত চেহারার লোকটা আস্তে আস্তে আলোর বৃত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারপরও কিছুক্ষণ তার অবয়বটা দেখা গেল, তারপর একসময়ে মিলিয়ে গেল, সব শান্ত। যখন এখানে এসেছিলাম, জগ্‌দীশজী সঙ্গে ছিলেন। বললেন, আর বলবেন না, বেশ শান্তির পরিবেশ ছিল, এখন পাহাড়ের ওদিকে একটা মন্দির হয়েছে, গাঁক গাঁক করে লাউডস্পীকার বাজায়। ধম্মের ব্যাপার, আমাদের কিছু করতে যাওয়াও বিপদ। দেখবেন না, সারা রাত জ্বালিয়ে খাবে।

    আমি ভেবেছিলাম, ‘হা হা, আফনে মশয় আমারে লাউড ইস্পীকার দেখাইয়েন না। আমার বারির সিধাসিধি একখান মন্দির আসিলো। খানিক দূরে আর একখান হইসে। কান বইল্যা অহন আর কিছু নাই। আফনের ঘুরার ডিমের মন্দিরের আওয়াজ তো ইয়াদের কাসে হাইস্যকর’। তা সেই মন্দিরের মোটেই-লাউড-নয়-স্পীকারের আওয়াজটাও খুব হালকা ভাবে যতক্ষণ আসছিল ততক্ষণ মনে হচ্ছিল, যাক উইদিন হিয়ারিং ডিস্ট্যান্স জীবিত কেউ আছে, মানে যে লোকটা সিডিগুলো বাজাচ্ছে, তা সে যতদূরেই হোক। ও হরি, সে আওয়াজও থেমে গেছে কখন, এখন একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। এমনিতে একটু ফাঁকা জায়গাতে, রাতে নানারকম আওয়াজ আসে। ঝিঁঝির ডাক তো মাস্ট, আর যেখানে এত বড় বড় গাছ চারিদিকে। নানা রকম রাতচরা পাখির ডাকও শোনা যাওয়ার কথা। আমাদের কম বয়সে পেঁচা ও শেয়ালের ডাক তো আকছার শোনা যেত। এই ধরণের বাংলোতে কম রাত কাটাইনি। খুব রোমান্টিক লাগত রাতের আবহ। এখানে কিন্তু শ্মশানের শান্তি। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই।

    সার্কিট হাউসের চাতালটা একটা ইনভার্টেড কমার মত। বাংলো দুটোকে ঘিরে বেশ বড় গোলাকার একটা এলাকা একেবারে সমান করে পেভার ব্লক গিয়ে মুড়ে দেয়া। এমনকি গাছগুলোর গোড়াতেও টালি বসিয়ে বেদীর মত করা হয়েছে। কমার লেজটা হচ্ছে এখান থেকে নেমে যাবার পিচ রাস্তা, সেটা দিয়ে খানিক নামলে একটা বিশাল লোহার ফটক। সেখানে সন্ধে পর্যন্ত সেন্ট্রি থাকে, রাতে কী হয় জানিনা। জগদীশজি বলছিলেন, ফটকটা হালে বসানো হয়েছে। নইলে সকালে শহর থেকে মর্ণিক ওয়াকাররা দলে দলে চলে এসে বিচিত্র রকম ব্যায়াম ট্যায়াম শুরু করে দিত, তারপর ছিল, লাফিং ক্লাবের মেম্বারদের সমবেত অট্টহাস্য। বোঝেনই তো মন্ত্রী টন্ত্রীরা এখানে থাকতে আসেন, প্রাইভেসি চৌপট হচ্ছিল। আমি ভাবলাম, মন্ত্রীরা তো সান্ত্রী সঙ্গে নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রাইভেসির চোটে আমি বেচারা একলা মানুষ –

    একটা অন্ধকার পাহাড়ের মাথায় হাজার হাজার ওয়াটের আলো জ্বলছে, আর একটা লোক একা ভূতের মত বাংলোর চাতালে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো ব্যাপারটাই অস্বস্তিকর। পেছন ফিরে ঘরে যেতে গিয়ে দেখলাম, একটা কুকুর। বেচারার গায়ে গতরে খুব বেশি কিছু নেই। এখানেই থাকে মনে হয়। কোনও গেস্ট, তাও আবার আমিশাষী, এলে কিছু প্রসাদ পায়। এখানে আবার বেশির ভাগ মানুষই শাকাহারি। ইস, মুর্গির হাড়গোড়গুলো ওই লোকটা আসার আগে যদি একে দিতে পারতাম, কুকুরটা রাত্তিরে বারান্দায় থেকে যেত নির্ঘাত। তাও একটা প্রাণী তো থাকত কাছাকাছি। ঘরে ফিরে এলাম। এখন নটাও বাজেনি, কোলকাতায় সবে সন্ধে হয়েছে। রাত বারোটায় ওখানে পাড়া গমগম করে। এখানে এখনই ঝুম রাত্তির। টিভির অখাদ্য হিন্দী প্রোগ্রাম দেখবনা, যাই ঘুমোই।

    আগে আগে কোথাও গেলে সঙ্গে একটা ডায়ারি রাখতাম। কী দেখলাম, কোথায় কোথায় গেলাম, সব লিখে রাখতাম। তখন জানুয়ারিতে ডায়ারির পাহাড় জমত বাড়িতে। লোককে দিয়ে পারতামনা। এখন কে আর আমায় ডায়ারি দেবে, তাই কয়েকটা কাগজ সঙ্গে এনেছি, তাতেই লিখলাম এরপর যা যা হ’ল –

    রাত ৯-৩৫
    হঠাৎ নানা রকম আওয়াজ শুরু হয়ে গেল। খটাখট দুমদাম, যেন ছুতোর মিস্তিরিরা কাঠের ফার্নিচার বানাচ্ছে। জানলা খুলে বাইরে দেখে নিলাম, কোথাও জনমনিষ্যি নেই, অথচ খুব কাছ থেকে আওয়াজ আসছে। বেশ কিছুক্ষণ চলল আওয়াজ। যাকগে হচ্ছে হোক, আমার কী, ঘুমোনোর চেষ্টা করি।

    রাত ১০-৪৪
    এবার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, বুন্দেলখন্ডি ভাষায়, কিছুই বুঝছিনা, তবে কথাবার্তা তো হচ্ছে। এবারও কাউকে দেখা গেলনা। কিছুক্ষণ পরে কুকুরটা খু্ব ডাকতে আরম্ভ করল। যাক কথা হচ্ছিল যখন, মানুষ নিশ্চয় আছে ধারে কাছে, দেখতে পাই আর না পাই। তাছাড়া কুকুরটা তো আছে। যাক নিশ্চিন্ত। ঘুমিয়ে পড়ি।

    রাত ১১-৩২
    ঘুম ভেঙে গেল। তিনটে কারণ আছে, প্রথমতঃ ঘরে অত জোর আলো জ্বললে ঘুমোন যায়? সেই পঁচিশটা টিউবের মধ্যে ঘরের চারিদিকের সুইচ বোর্ডে খুঁজে খুঁজে দুটোর সুইচ কিছুতেই পেলাম না। তেইশটা নিভল বাকি দুজনই কামাল করে দিচ্ছে, তারা আবার ঠিক মাথার ওপর। দ্বিতীয় কারণটা হল, মকবুলের রান্না চিকেনটা যথেষ্ঠ গুরুপাক ছিল, সঙ্গে মোটাদানা আটার রুটি অতগুলো, তৃতীয়তঃ এখানকার কম্বলগুলো হোটেলের মত নয়, খুব মোটা আর খুব গরম। একবার ভাবলাম, এসি টা চালিয়ে দেব নাকি? যাই হোক,আবার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, এইবার অমলতাসের ভেতর থেকে, অথচ সে ঘর বাইরে থেকে তালা বন্ধ। চোখ মেলেই শুয়ে থাকি চিত হয়ে। রাতটা কাটলে বাঁচি।

    রাত ১২-২২
    সাহেবরা হলে বলত সকাল ১২-২২। কিন্তু এখানে নিশুতি রাত। নাঃ এনাফ ইজ এনাফ। দেখতে হবে ব্যাপারটা কী। কাগজে লিখেছে দামোহ্‌ সার্কিট হাউসে ভূত আছে, তবে ভূত কাউকে গলা টিপে মেরেছে তা তো লেখেনি। তার ওপর ডাঃ জগ্‌দীশ জটিয়া আমায় খুব পছন্দ করেন, তিনি জেনেশুনে আমায় বিপদের মুখে ফেলবেন? আবার অন্য দিকে হচ্ছে, শুনেছি এখানে একা কেউ থাকেনা। মন্ত্রীমশাই ষড়যন্ত্রী মশাইরা তো সঙ্গে চামচা পরিবৃত হয়ে আসেন। আমি তো এই জোড়াবাংলোর একমাত্র জীবিত প্রাণী। অপর জীবিত প্রাণী, মানে কুকুরটার কোনও সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু চুপ করে তো বসে(শুয়ে) থাকা যায়না, সরেজমিনে তো দেখতেই হবে ব্যাপারটা কী। দরজার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। তারপর ধাঁ করে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম –

    (চলবে)





    দা লিসনার

    ধাঁ করে বেরিয়ে পড়েছি বাইরে। ধুস, এতক্ষণ বেকার চিন্তা করছিলাম। সব বুঝে গেছি। বাংলোর চাতালের গা বেয়েই তো পাহাড়ের ঢাল নেমেছে। ওধারে জঙ্গল। আসলে চোরা শিকারিরা কাঠ কাটছিল, তারই আওয়াজ। বুন্দেলখন্ডি ভাষায় তারাই কথা বলছিল। রাতে তিনতলা বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তায় যারা কথা বলতে বলতে যায়, মনে হয় যেন কানের পাশে বলছে। কুকুরটাও ওদের উপস্থিতি টের পেয়েই চ্যাঁচাচ্ছিল। কিন্তু শুধু কি তাই?

    মনে হল বেরিয়ে কাজটা ভাল করিনি। এক নম্বর, এখন সত্যিই বেশ ঠান্ডা, খদ্দরের পাঞ্জাবির কম্মো নয়। দুই, কেন জানিনা শ্রীমতী দামিনী রত্নমের মত উপলব্ধি হচ্ছে, কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ, কেমন একটা দমচাপা আবহাওয়া, সব কিছু কেমন ভারি ভারি। ভাল লাগছেনা, একদম ভাল লাগছেনা এখানে দাঁড়াতে। আগের বার যখন বাইরে এলাম তখন তো এমন লাগেনি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ঘরে এলাম। শুতে যাব, হঠাৎ মনে হল বারান্দায় কে যেন হাঁটছে।

    রাত ১২-২৮

    বারান্দায় কে যেন হাঁটছে। জানলার কাঁচ স্বচ্ছ নয়, তার ওপর ভারি পর্দা টাঙানো। পর্দা সরিয়ে দেখলাম, কাঁচে কারও ছায়া পড়ছেনা, অথচ আলোর বিপরীতে হাঁটলে ছায়া পড়া উচিত। কিন্তু কেউ হাঁটছে, পরিষ্কার ছায়া না পড়লেও কিছু একটা সরে যাচ্ছে, তা দেখা যাচ্ছে কাঁচের এপাশ থেকে। তার পায়ের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। গুলমোহরের দিক থেকে অমলতাসের দিকে গেল, এবার ফিরছে। ফিরে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক আমার মুখোমুখি। মাঝখানে জানলা, তার ওপারে কেউ দাঁড়িয়ে, যার ছায়া পড়ছেনা। মনে পড়ল মকবুল বলেছিল, এক আদমি জ্যায়সা সাফ দিখাই নহী দেগা মগর আপকো ম্যহসূস হোগা, যো কোই চল ফির রহা হ্যায়।

    ওয়াল্টার ডে লা মেয়ারের বিখ্যাত কবিতা, দা লিসনার্স। একজন ঘোড়ায় চেপে এসে একটা ম্যানসনের দরজায় খটখট করছে, কেউ আছ? কেউ কি আছ? ভেতরে যারা আছে, তারা জানলার ওপার থেকে শুনছে, কিন্তু জবাব দিতে পারছেনা। তারা শুনেই যাচ্ছে। এখানে বাইরে একজন, ভেতরের লোক বলছে, কওন হ্যায়? কওন হ্যায় ভাই? কেউ কিছু বলছেনা শুধু শুনছে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মাঝখানে একটা জানলা।

    রাত ১২-৫৬

    জানলাটা কেউ খোলার চেষ্টা করছে। স্কেপটিকদের মতে, ধুর মশাই, হাওয়া দিচ্ছিল, হাওয়া – তাই জানলা ঢকঢক করছিল। গল্প বানাবেন না প্লীজ। কিন্তু ঘটনা হল, জানলা মোটা রাবারের প্যাড দিয়ে ইন্টারলক করা। টাইফুন এলে কাঁচ হয়ত ভেঙে টুকরো হবে, কিন্তু ঢক ঢক করবেনা, কোনও চান্স নেই। আমি আঙুল দিয়ে ঠেলে দেখেছি, নড়েনা। কিন্তু নড়ছে, লক যেদিকটা থাকে, সেইখানটাই। আমি পিছিয়ে এসে সোফায় বসে আছি, হাতে ক্যামেরা অন করা। জানলাটা যদি খোলে অন্ততঃ একটা ছবি তুলব, যা হয় হবে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে বেজায় হাসি পেয়ে গেল। পরান বন্দ্যোপাধ্যায় ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত যুগলবন্দী। পরান বলছেন, আমি তো হাওয়া। শাস্বত বলছে, আপনি তো হাওয়া, কিন্তু আমি তো ভয় পেয়েছি। বব বিশ্বাস, হাতকাটা কাত্তিক, মেঘে ঢাকা তারা, সবাইকে পেছনে ফেলে ঐ জায়গাটা, অনবদ্য। আমিও জানি ওদিকে হাওয়া, কিন্তু আমিও ভয় পেয়েছি। ভয় পেয়েও শাশ্বতর অভিনয়ের কথা মনে পড়েছে, মানুষ কোন পরিস্থিতিতে কী যে ভাবে –

    আচ্ছা হাওয়াই যদি হবে, তবে তো জানলা দিয়ে বা যে কোনও জায়গা দিয়ে ঢুকেই আসতে পারত। জানলা খোলার চেষ্টা করবে কেন? যে ওপাশে ছিল, সে জানলা থেকে সরে যাচ্ছে, আবার হাঁটছে, গুলমোহরের দিক থেকে অমলতাসের দিকে।

    দু রকম বিটকেল আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। সোফায় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি, ক্যামেরাটা পাশেই। দুটো মোবাইলেই অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। সাড়ে পাঁচটা বাজে, ছটার মধ্যে জটিয়াজী এসে পড়বেন। বেড টী-র জন্য সুখলালকে অন্ততঃ পনেরো বার ফোন করতে হ’ল।

    (চলবে)





    পাহাড়ের নীচে

    ছটা এখনও বাজেনি, আমি রেডি হয়েই আছি, জগ্‌দীশজী আসার আগে চারপাশটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখি। গুলমোহরের ওপাশের বারান্দাটায় যেতেই চোখের সামনে অসাধারণ নিসর্গ ভেসে উঠল। পাহাড়ের গা বেয়ে অরণ্য গড়িয়ে গিয়ে থেমেছে একটা বিশাল জলাধারের কাছে। ওপর থেকে স্বর্গীয় দৃশ্য। আমাকে অমলতাস বা গুলমোহর দেয়া হয়নি কারণ দুটি ঘরেরই দুপাশে বারান্দা। কচনারের শুধু সামনে। হাঁটাহাঁটি যা হবার তা একদিকেই হোক। তবে যদি কেউ এখানে থেকে আরাম করতে আসেন, তবে গুলমোহর হচ্ছে আদর্শ থাকার জায়গা। মুগ্ধ হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। শাহিদের গাড়ির ঘড়ঘড় শব্দে ফিরে দেখি জগদীশজী এসেছেন, সঙ্গে নির্মলাজীও আছেন। আমাকে দেখেই জোড়হস্তে বললেন, নমস্তে ভাইসাহাব । আমি বললাম, একটু চা হয়ে যাক। জগদীশজী বললেন, হোক। তবে এখন আমরা চা খেয়ে নীচে নামব পায়ে হেঁটে। এই পাশের জঙ্গলটাতেই প্রচূর পাখির আস্তানা।

    নীচের দিকে নামতে গিয়েই জগদীশজী বললেন, আরে! করেছে কী। এখানে ফেন্সিং কে দিল, কবেই বা দিল। আমরা তো এদিক দিয়েই নামতাম, এখন তো অনেকটা ঘুরে নামতে হবে। শাহিদকে বললেন, খবর নাও তো হে, ফেন্সিং টা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট দিয়েছে না আমরা? আমরা যদি দিয়ে থাকি, আমায় তো জানানো উচিত ছিল। ব্যাজার মুখে তিনি আমাকে পথ দেখিয়ে ওপাশের ঢাল দিয়ে নামতে লাগলেন, বললেন, চলুন কোথাও না কোথাও তো শেষ হবে এই বেড়া। মর্ণিং ওয়াকার, ব্যায়ামকারী ও অট্টহাস্য ক্লাবের লোকেরা সার্কিট হাউস চত্বর থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন এই দিকে যান রোজ সকালে। তাঁদের মধ্যে অনেক সরকারি আমলাও আছেন। তাঁরা কেউ কেউ উঠে আসছেন তখন। জগদীশজীর সঙ্গে কুশল বিনিময় হল তাঁদের। তাঁদেরও জিজ্ঞেস করলেন উনি, বেড়া কে দিয়েছে এবং কতদূর গেছে।

    প্রথম প্রশ্নের উত্তর কারোরই জানা নেই দেখা গেল, তবে তাঁরা বললেন, মাঝখান দিয়ে ঢোকার কোনও উপায় নেই, সেই মন্দিরের কাছ দিয়েই একমাত্র রাস্তা। জগদীশজী আবার আলাপ করিয়ে দিলেন, এই যে রূপঙ্করজী, কোলকাতা থেকে এসেছেন। ওঁরা বললেন, আরে নীচে আপনি আর একজন ফোটোগ্রাফার পেয়ে যাবেন, শ্রী মনোহর কাজল। উনি এখনও নীচেই আছেন।


    গেলাম মন্দির চত্বরে। পূজারী জগদীশজীকে বললেন, এসে দর্শন করে যান। সরকারি উঁচুশ্রেনীর আমলাদের জন্য ধর্মও মুখিয়ে থাকে। জগদীশজী বললেন, না না, আমার মানত আছে, এক বছর কোনও মন্দিরে ঢুকতে পারবনা। শ্রীমতী নির্মলাও বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ মানত তো আছেই। এই সব বলে কাটানো গেল। মন্দিরের চাতালেই বসে ছিলেন শ্রী মনোহর কাজল। এম পি তে উনি প্রায় রঘু রাই। আলাপ ও কুশল বিনিময় হ’ল। জগদীশজী বললেন, ওঁকেও সঙ্গে আসতে বললাম কিন্তু উনি পাখির ছবি তোলেন না, উনি তো ব্যাকলাইট পোর্ট্রেট স্পেশালিস্ট তবে কোনও ক্যানডিড বা এই জাতীয় ছবির ফ্রেমিং এর জন্য প্রয়োজন হলে দু একটা পাখিও নিয়ে নেন। এদিকে পোর্ট্রেটের কথা শুনেই আমার মন চলে গেছে অন্য দিকে। এই মধ্যপ্রদেশেই পোর্ট্রেট তুলতে গিয়ে সে কি কান্ড

    (চলবে)




    কালো মেয়ের পায়ের তলায়
    দেখে যা আলোর নাচন -

    সেই পোর্ট্রেট, সেটাও মধ্যপ্রদেশে। সে অনেক বছর আগের কথা, জায়গাটা খাজুরাহো। আগে একবার বলেছি হয়ত, যে খাজুরাহো আমি বার বার যাই, বহুবার গেছি সেখানে। কেন যাই, তা নাহয় বলা যাবে সময়মত। সে সময়ে ছবি তোলার ঝোঁকে যেখানে সুযোগ পেতাম, ছুটি পেলেই চলে যেতাম। সেবার খাজুরাহো গেছি এক বিশেষ কারণে।

    একদিন রবিনদা এসে বললেন, লো স্পীড ফিল্মে ছবি তুলেছেন কখনও? সে সময়ে রঙীন ফিল্ম থাকলেও আমাদের ফোটোগ্রাফার মহলে তার কৌলীন্য ছিলনা। তা ছাড়া রঙীন ফিল্ম প্রোসেস করারও অনেক হ্যাপা, বাতানুকুল ঘর চাই, আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে সে সময়ে এয়ার কন্ডিশনার বসানোর কথা কেউ ভাবতেও পারতনা, এখনকার মত জলভাত ছিলনা জিনিষটা। আমরা সাদা কালোতেই অভ্যস্ত। সেখানে কম স্পীড বলতে একশ এএসএ। দু একটা ম্যানুফ্যাকচারার পঞ্চাশও করত, কিন্তু তার তলায়? আমি বললাম, মেরে কেটে পঞ্চাশ, কিন্তু আমি একশ’র নীচে তুলিনি কখনও। রবিনদা বললেন, এক জায়গায় একুশ, সতের, এইসব এএসএ পাবেন, যাবেন? সাধারণ সাইজে কিচ্ছু বুঝবেন না, ষোল বাই কুড়ি একখানা প্রিন্ট নামালেই তফাতটা বুঝে যাবেন।

    আমাদের ফোটগ্রাফির যে কজন উৎসাহী একসঙ্গে দল পাকিয়েছিলাম, রবিনদা ছিলেন সে দলের গুরু। তবে আমরা একলব্য টাইপ, উনি নিজে হাতে কাউকে শেখাতেন না। শেখাতে গিয়ে একবার দারুন বিপর্যয় নেমেছিল তাঁর সংসারে। সে কথা এখানে আলোচ্য নয়। তাই আমরা তাঁর বাড়ি গেলেও খানিক সাংকেতিক কথাবার্তার বাইরে কিছুই বলতেন না। তৎকালীন উজ্জ্বলা সিনেমার(এখন আর নেই) পাশের গলিতে ছিল তাঁর বাড়ি। রবিনদা বডিবিল্ডার ছিলেন। এককালে ভারতশ্রী হয়েছিলেন। বিশ্বশ্রীর জন্যও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, হয়ে ওঠেনি। আমরা ‘মে অ্যান্ড বেকার’ কোম্পানির ব্র্যান্ডেড ‘প্রমিক্রল’ দিয়ে ছবি প্রোসেস করতাম কিন্তু উনি কী দিয়ে করতেন, তা ঘুণাক্ষরেও বলতেন না। খালি বলতেন, একটা জার্মান রেসিপি।

    সেই রবিনদা বললেন, করবেন নাকি লো স্পীড ছবি? কোনও ক্যামেরা বা ফিল্মের দোকানে কিন্তু এই ফিল্ম পাবেন না। ওগুলো পাওয়া যাবে ডালহাউসিতে স্টীফেন হাউসের তলায় একটা সায়েন্টিফিক ইন্সট্রুমেন্টের দোকানে। ডাক্তাররা ওটা ও টিতে ব্যবহার করেন। ইওগোস্লাভিয়ায় ( এখন সে দেশ নেই) তৈরী হয় সেই ফিল্ম। আমি বললাম, কী তুলব সেই ফিল্ম দিয়ে? রবিনদা বললেন, পোর্ট্রেট। আমি হাঁ হয়ে গেলাম, পোর্ট্রেট? আমরা তো জানি পোর্ট্রেট যত পারা যায় হাইস্পীড ফিল্ম দিয়ে তুলতে হয়, কারণ লো স্পীড মানে আলো আর ছায়ার মাঝখানের ব্যবধান বলে কিছু থাকেনা আর হাই স্পীড মানে আলোরও হরেক রকম শেড, ছায়ারও তাই। পোর্ট্রেট, বিশেষতঃ বাচ্চা বা মেয়েদের তো নরম আলোয় না তুললে গালের কোমল ভাবটাই থাকবেনা। ( এখনকার ডিএসএলআর এর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য)

    রবিনদা বললেন, আমার বলার কথা বলে দিলুম, এবার আপনার যা করার আপনি করবেন। এই বলে হেলে দুলে চলে গেলেন। রবিনদা একটু দুলে হাঁটতেন। বড় ব্যায়ামবীররা অত বড় শরীর নিয়ে দুলে দুলেই হাঁটতেন তখন। আমি পড়লাম ফাঁপরে। গুণী লোক, মাস্টার ফোটোগ্রাফার, তাঁর কথা তো অমান্য করা যায়না, কিন্তু কার পোর্ট্রেট তুলব সেই ফিল্ম দিয়ে? মনে পড়ল, মধ্যপ্রদেশে দেহাতি মেয়েরা তখন রূপোর টাকা দিয়ে গয়না বানিয়ে তাই দিয়ে সাজত বিশেষ উৎসবে। একটা কালো মেয়ে উইথ সাদা গয়না যোগাড় করতে হবে। চলো মধ্যপ্রদেশ।

    (চলবে)




    ইউগোস্লাভিয়ার ফিল্ম - কেবি টোয়েন্টি ওয়ান

    চলে গেলাম স্টিফেন হাউস। দোকানটায় ঢুকে দেখি, নানারকম ডাক্তারি যন্ত্রপাতি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, একজন চশমা পরা মাঝবয়সী এগিয়ে এলেন, - ইয়েস?

    এইসব সাহেবি নামের দোকানগুলো মধ্য কোলকাতায় তখনও বেশ কয়েকটা টিকে ছিল, তবে আগাপাশতলা সব্বাই বাঙলি হলেও ইংরিজি বলবেনই। বললাম, একটা ফিল্ম খুঁজছিলাম। ভদ্রলোক খুব পরিমিত ভাবে ভুরু কোঁচকালেন,

    - বাট দিস ইজ নট আ ক্যামেরা স্টোর, উই সেল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টস।

    আমি বললাম, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ডাক্তারদেরও ছবি তুলতে বিশেষ রকমের ফিল্ম লাগে তো –

    ভদ্রলোক প্যান্টের মধ্যে সাদা শার্ট গুঁজে, কালো চশমায় আর ব্যাকব্রাশ করা চুলে যতই ইংরিজি কপচান, হলফ করে বলতে পারি আজ সকালেই সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি খেয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, - বাট দোজ আর স্ট্রিক্টলি ফর মেডিক্যাল ইউজ, হোয়াট ডু ইয়ু ডু উইথ –

    আমি থামিয়ে দিলাম, আর ইংরিজি বলতে দেয়া উচিত নয়। আমার জন্মের ঠিক একবছর আগেই সাহেবরা চলে গেছে। এখন মজা হচ্ছে, ইংরিজি তো আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান, সবাই বলে কিন্তু ওটা তো আদপে সাহেবদের ভাষা। তা তারা আবার কোনও কথা সোজাসুজি বলেনা। একটু ঘুরিয়ে না বললে ওদের কেমন বদহজম হয়। ধরা যাক একজন সুন্দরী মহিলা, তাকে সরাসরি, ‘ইউ আর আ প্রিটি উওম্যান’ কখনওই বলা যাবেনা। তারা বলবে,- ‘আই সে, নো সোল অন আর্থ ক্যান ক্লেম দ্যাট ইট হ্যাজ সীন আ প্রিটিয়ার ফেস দ্যান ইওরস’।

    তাই আমি বললাম, - সাপোজ আই বাই দা ফিল্ম আফটার পেয়িং ইউ দা প্রাইস কোটেড, হোয়ট ডিফারেন্স ডাস ইট মেক হোয়াটেভার ইউজ আই পুট ইট টু?

    এখন সজনে ডাঁটা খাওয়া বাঙালিরা সোজা বল ঠিক খেলে দেয় পঙ্কজ রায়ের মত, তা জোরে হলেও। কিন্তু অফ স্পিন বা গুগ্‌লি হলেই কাত। তিনি বললেন, কী করবেন এই ফিল্ম দিয়ে? এগুলো কিন্তু খুব লো স্পীড।

    আমি বললাম, বাঃ আপনি বাংলাও জানেন? আমি আসলে লো স্পীড ফিল্মই খুঁজছি একটা বিশেষ কারনে। শুনেছি সতের আর একুশ স্পীড পাওয়া যায়। তাই-

    উনি বললেন, সতের এখন নেই, একুশ কটা দেব?

    আমি বললাম, একটাই দিন আপাতত, ব্যবহার করে দেখি যে কাজে নিচ্ছি হয় কিনা। ব্যাস্‌ হয়ে গেল ফিল্ম কেনা।

    এইবার মধ্যপ্রদেশ যেতে হয়। সে সময়ে রাজ্যটা ভাগ হয়নি, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা অনেকগুলোই ছিল। কিন্তু আমি অজানা অচেনা জায়গায় কোথায় যাই। দুম করে যদি কোনও দাদাজী তলোয়ার বের করে ছুটে আসেন, বার বার তো মিশ্রজী বাঁচাতে আসবেন না। অতএব চলো খাজুরাহো, চেনা জায়গা। ওখানেও ওই ধরণের গয়না পরা মহিলারা থাকেন, আমি আগেও দেখেছি। তবে একটা সোর্স চাই। সরাসরি গিয়ে ছবি তুলে নিলে আবার ‘আত্‌মা’ চুরির অভিযোগে মুন্ডু যেতে পারে।

    খাজুরাহো জায়গাটা অদ্ভুত। অতগুলো বিখ্যাত মন্দির আছে, কয়েকটা অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানও আছে। ওখানে ইরোটিক শিল্প দেখতেই মানুষ যায়, তা অস্বীকার করার উপায়ও নেই। বিদেশিরাতো দলে দলে আসে। তা সত্বেও যাতায়াত খুবই অসুবিধের। এখন একটা রেলওয়ে স্টেশন হয়েছে, তখন ছিলনা। তবে সেখানে দিনে গোটা দুয়েক গাড়ি আসে বোধহয়। তার মধ্যে রাজ্যের বাইরে একমাত্র দিল্লী থেকে একটা। বাস স্টেশন আছে। তখন শহরের মধ্যে ছিল, এখন বাইরে। সেখানেও দিনে গোটা দুয়েক বাস আসে আর যায় মোটে একটা, তাও সাত সকালে। এই অদ্ভুত ব্যবস্থার কারণ কিছু বোঝা যায়না।

    সে সময়ে অবশ্য শহর বলে কিছু ছিলনা, সামান্য কয়েকটি ঘরবাড়ি। লোকালয়ের মধ্যেই বাস চলে আসত সাতনা থেকে। তাতেই গেলাম। হোটেলে চেক ইন করেই খুঁজতে বেরোলাম একজন ‘সোর্স’ যে কিনা উদ্যত তলোয়ারের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্যই তার সেই গ্রীকো-জাপানি ভাষাটা জানা চাই।

    (চলবে)





    কে বি টোয়েন্টি ওয়ান

    ফিল্মটা অদ্ভুত দেখতে। সাধারণতঃ অন্য যে সব ফিল্ম দিয়ে আমরা ছবি তুলতাম, তার একদিক কালচে হত, আর বাইরের দিকটা বেগুনি গোছের। রঙীন ফিল্মের আগে সাদা কালো ফিল্ম ছিল, তাই দিয়েই আমরা ছবি তুলতাম, কেননা রঙীন ফিল্ম নিজে হাতে প্রোসেস করা যেতনা। তার জন্য বাতানুকুল ঘর লাগে। আর দোকানে প্রোসেস করতে দিলে বারোয়ারি ছবি হবে, যা চাইছি কক্ষনো হবেনা। তবু খুব পরিচিত কেউ বিয়ে বা ওই জাতীয় কোনও অনুষ্ঠানের ছবি তুলতে বললে রঙীন ফিল্মে তুলে দিতাম।

    ফিল্মের প্রোসেসিংটা এই রকম, ছবি তোলার পর একটা অন্ধকার ঘরে ফিল্মটা ক্যামেরা থেকে খুলে একটা ব্যাকেলাইটের ট্যাঙ্কে ঢোকাতে হত। তারপর বাইরে এনে তাতে কেমিক্যাল মেশানো পরিষ্কার জল ঢালতে হত। বাজারে অনেক সস্তা কেমিক্যাল পাওয়া গেলেও আমরা, মানে রবিনদার চেলারা, ‘মে অ্যান্ড বেকার’ কোম্পানির ‘প্রমিক্রল’ ব্র্যান্ডের দামী রাসায়নিক ফরমুলা ব্যবহার করতাম। ট্যাঙ্কের ভেতরে ফিল্মটা জড়িয়ে নিয়ে বাইরে এসে মাথার গর্ত দিয়ে রাসায়নিক মিশ্রন ঢালা হত কিন্তু ফিল্মের গায়ে আলো লাগতনা। আলো সর্বদাই সরল রেখায় ভ্রমণ করে তাই ফিল্মটা গর্তের সামান্য তফাতে থাকলেও নিরাপদ থাকত।

    ফিল্ম প্রোসেসিং অনেকটা বাটিকের নকশা করার মত। কাপড়ের ওপর মোম লাগিয়ে রঙে চোবাও। এবার মোম লাগানো জায়গায় রঙ লাগবেনা, অন্য জায়গায় লাগবে। পরে মোমটা তুলে নিতেই দু রকম রঙ। এখানেও তাই। যে দৃশ্য তোলা হচ্ছে, সেখান থেকে আলো এসে ক্যামেরার ফুটোর মধ্যে দিয়ে ফিল্মের গায়ে লাগে। কালো জায়গা থেকে আলো হয় আসেনা বা খুব কম আসে, আবার সাদা জায়গা থেকে আলো যত বেশি সাদা তত বেশি আসে। এবার ট্যাঙ্কের মধ্যে কেমিক্যালটা যেখানে যেখানে আলো লেগেছে, ফিল্মের সেই জায়গাগুলো বাটিকের মোমের মত ঢেকে দেয়। তার পর কেমিক্যাল ফেলে দিয়ে ট্যাঙ্কে হাইপো ঢেলে তাই দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। হাইপো মারাত্মক রকম ক্ষয়কারক বা করোসিভ, চোখে লাগলে চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেই হাইপো এবার যেখানে যেখানে আলো লাগেনি, মানে কালো জায়গাগুলোর ইমালশন খেয়ে নেয়, সেটা তখন স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট হয়ে যায়। আলো লাগা জায়গাগুলো তো প্রমিক্রল বা ওই ধরনের প্রোসেসিং এজেন্ট ঢেকে রেখেছে। তাই নেগেটিভে চুল সাদা আর ফর্সা গাল কালো লাগে। প্রিন্ট করার সময়ে আবার ওই স্বচ্ছ জায়গা দিয়ে প্রিন্টারের আলো ঢুকে সিলভার নাইট্রেট পেপারটা পুড়িয়ে দেয়, তাই সে আবার কালো হয়ে যায়, বাকিটা উলটো হয়। রঙীন ফিল্মেও সাদা কালো না হলেও নেগেটিভে উলটো রঙ দেখা যায়। লালের জায়গায় সবুজ, হলদের জায়গায় নীল, এইরকম। ওপরে যত জায়গায় ‘যায়’, ‘হয়’ এইসব লিখলাম, সবই ‘যেত’, ‘হত’, এরকম হবার কথা, ফিল্ম ব্যাপারটাই এখন ইতিহাস।

    টেকনিকাল ব্যাপার স্যাপার নিয়ে এত লেকচার দেবার অর্থ হল, ‘সাদা-কালো’ বললেই তো আর সব সাদা-কালো হয়ে যায়না, সাদা আর কালোর মাঝে অনেক শেড থাকে। সাদা থেকে কালোয় বা উল্টোটাতেও অনেক পথ ঘুরে যেতে হয়। তাই সেখানে, মানে ওই সব মাঝারি রঙের জায়গায়, রাসায়নিকও আলতো করে ঢাকে, আবার হাইপোও ধীরে সুস্থে খায়, তাই প্রিন্টেও সেই মাঝারি শেড গুলো দেখা যায়। এবার যত হাই স্পীড ফিল্ম, তত মাঝারি শেড বেশি। আবার যত লো স্পীড, তত কম। তার মানে সতের বা একুশ স্পীডের ফিল্ম দিয়ে তুললে তো সেই সময়ের দেয়ালে চিনের চেয়ারম্যানের স্টেনসিল কাটার মত শুধু সাদা আর কালো রঙ দুটোই থাকবে, মাঝখানের হালকা শেড তো থাকবেই না। এই রকম ভেবে ছুটলাম রবিনদার বাড়ি।

    রবিনদা বললেন, এই ফিল্মের ইমালশন খুব মোটা। একটা ছবি তুলে বড় করতে থাকুন। করতে করতে যখন কপালের ওপর একটা চুলে এসে পৌঁছবেন, দেখবেন একটা চুলের তিন রকম শেড দেখতে পাচ্ছেন। ছোট সাইজের ছবি অবশ্য হাই কন্ট্রাস্ট-ই হবে। কিনেছেন যখন পরখ করেই দেখুন না। ফিল্মের যে টুকু অংশ ক্যাসেটের বাইরে বেরিয়ে থাকে, সেটা খুলে দেখলাম, বেগুনি নয়, গাঢ় সবুজ রঙের ইমালশন। এমন কোনওদিন দেখিনি। আর সত্যিই সেটা বেশ মোটা।

    ট্রেনে চাপবার সময় থেকেই মন উচাটন। সঠিক মডেল পাব তো? ঠাকুদ্দা ফাকুদ্দা তলওয়ার বাগিয়ে ছুটে আসবেনা তো? এবার কিন্তু বাঁচানেওয়ালা কেউ নেই, একাই ফেস করতে হবে সব বিপর্যয়। কিন্তু কেবি টোয়েন্টি ওয়ানে ছবি তোলার প্রচন্ড আগ্রহে বাকি সব উৎকন্ঠা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। চল্‌ পানসি খাজুরাহো।

    (চলবে)





    ঘোমটা মাথায় ছিল খানিক বটে

    ‘মুক্ত বেণী’ তাও জোটেনি মোটে

    তবু কালো

    তা সে যতই কালো হোক

    ছিল যে তার কালো হরিণ চোখ

    হোটেলে চেক ইন করেই বেরোতে হল। নাওয়া খাওয়া মাথায় থাক, আগে কালো মেয়ের সন্ধান করি। একজনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, আচ্ছা এখানে - চাঁদি কে জেবরাত পহনি হুঈ দেহাতি অওরত কহাঁ মিলেগী ? লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে দেখে খেয়াল হ’ল, ওরেঃ সব্বোনাশ, কী বলতে কী বলে ফেলেছি। বললাম, না না মশাই, আমি শুধু ছবি তুলব, আর কোনও আলটিরিয়র মোটিভ নেই আমার। লোকটা পান খাচ্ছিল, খানি উম্‌ উম্‌ করে বলল, সে আমি বিলক্ষণ বুঝিচি। গয়না পরা মেয়েমানুষ খুজছেন যখন, তখন উদ্দেশ্য খুব একটা গোলমেলে নয়। এক কাজ করুন, এই পেছনের রাস্তা দিয়ে খানিক গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন, দেখুন কোনও রিক্সাওয়ালার দেখা পাওয়া যায় কিনা। ওই রাস্তায় গাঁয়ের থেকে রিক্সাওয়ালারা আসে। ওরা ঠিক হদিস দিতে পারবে।

    আকন্দ আর ল্যানটানার ঝোপের মাঝ দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। তার মধ্যে দিয়েই অনেক কষ্ট করে রিক্সাগুলো চলাচল করে। এখন খাজুরাহো গেলে ওই সব যায়গা দেখলে বেজায় হাসি পায়। মিনিট দশ দাঁড়াতেই দেখি মাথায় গামছা বাঁধা একজন দাঁড়িয়ে উঠে পেডালে চাপ দিয়ে গাড়ি ঠেলে আনছে। আমায় দেখেই বলল, চলিয়ে সাব, ওয়েস্টান গুরুপ ইস্টান গুরুপ, জৈন মন্দির সব দিখা দেঙ্গে, সির্ফ তিস রুপাইয়া সাব। আইয়ে ব্যাঠ যাইয়ে।

    আমি বললাম, দাঁড়াও বাছা। ওসব গুরুপ টুরুপ আমার অনেকবার দেখা আছে। আমি চাইছি অন্য কিছু। শোনো ভাই, আমি ছবি তুলি। ক্যামেরা জানতো, ক্যামেরা? ( এখানে আত্মা ফাত্মা বন্দী হয়না)। সে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ খুব জানি, সাহাবলোগ আকে মন্দির কি দিওয়ারসে মূর্তিয়াঁকি ফটু নিকালতে হ্যাঁয়। আমি বললাম, হ্যাঁ সেই ফটু। কিন্তু আমি যে বাছা সাহেব নই, তাই মূর্তি টুর্তির ওপর খুব একটা দিলচস্‌পি নেই। আমি চাই জ্যান্ত মূর্তি, তাও আবার কালো। এখানে কাছাকাছি কোনও গাঁয়ে একজন কালো মহিলার সন্ধান দিয়ে পার? শুধু মহিলা হলে হবেনা, তোমরা যে সব সাহেবি আমলের বড় বড় রূপোর টাকা গেঁথে গেঁথে গয়না বানাও, তেমনি গয়না পরা মহিলা চাই। ভাড়া ছাড়াও বখশিস পাবে, খুশি করে দেব আমি। পারবে?

    সে একগাল হেসে বলল, খুব পারব। তবে মেয়ে তো জোগাড় করে দেব, কিন্তু তাকে আপনার পছন্দ হবেই, এমন দায়িত্ব নিতে পারবনা। আরও ব্যাপার আছে। ওই সব গয়না এমনি বাড়িতে থাকেনা, এখানে খুব ডাকাতি হয়। তাই ওগুলো মাটির তলায় পোঁতা থাকে। তারা সেগুলো খুঁড়ে বের করবে কিনা, করলেও কত সময় নেবে, সেসব আপনার দায়িত্ব। আমার গাড়ি দুরকম ভাবে ভাড়া হয়, হয় জায়গা হিসেবে, নয় ঘন্টা হিসেবে। আপনি যদি এক ঘন্টার জন্য ভাড়া করেন, আমি কিন্তু এক ঘন্টার পর আর দাঁড়াবনা।

    সে সময়ে আমার মত চাকুরিজীবির কাছে দশ বিশ টাকার মূল্যও অনেক ছিল। আমি তাই এক ঘন্টার জন্য ভাড়া করলাম। ও বলল, যেতে পনের বিশ মিনিট লাগবে। এবার আপনার মেয়ে পছন্দ, ছবি তোলা, এতে কতক্ষণ লাগাবেন তা আপনার ব্যাপার। তবে একঘন্টা পেরিয়ে গেলেই দু ঘন্টার রেট নিয়ে নেব, হ্যাঁ –

    আমি বললাম, ঠিক আছে, চলো তাহলে। তবে একেবারে খেঁদি পেঁচি দিওনা বাপ, খরচা করে যাচ্ছি, আমার মুখটা রেখো। সে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় মাঝে মাঝে বসে, মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে চালাতে চালাতে বলল, আমার ওপর ছেড়েছেন যখন, আশা তো করি মান রাখতে পারব।

    মিনিট কুড়ি পরে একটা ঘুঁটে দেয়া দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল, গাড়ি থেকে নামুন, আমি ভেতর থেকে ডেকে আনছি। এবার কুঁড়ে ঘরের দরজা দিয়ে যে বেরোল, সে শার্ট প্যান্ট পরা এমন আজব চেহারা আশা করেনি। চট করে ঘোমটা টানার মুহূর্তে একটা স্ন্যাপ – খ্যাচাক্‌। শট তো নিলাম, কিন্তু আমার মুখে কথা নেই।

    “তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই

    বাতাসেও নেই সাড়া - ”

    (চলবে)





    অথ কৃষ্ণকলি বৃত্তান্ত

    রিক্সাওয়ালাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছিলামনা। এ কৃষ্ণকলি সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তার ধারে কাছে নেই। গায়ের রঙও আবলুস বলা যাবেনা, কিন্তু রীতিমত কালো। তবে এর মধ্যে ‘কী একটা যেন আছে’। এই ‘কী একটা’-র খোঁজে আমরা, মানে ছবি তুলিয়েরা দিক দিগন্তে ঘুরে বেড়াই। আহা, চোখ ফেরাতে পারছিনা, মানে, লেন্স ঘোরাতে পারছিনা। আমি রিক্সাওয়ালাকে বললাম, একে বলেছ গয়নার কথা? শ্রীমতিজী, আপনি গয়নাপত্তর বের করুন ফটাফট, আমার হাতে সময় একদম নেই। মনে মনে ভাবছি, এক ঘন্টা পেরিয়ে গেলেই তো দ্বিতীয় ঘন্টার রেট চালু হয়ে যাবে। সে সময়ে পয়সাকড়ি খুব বেশি থাকতনা পকেটে।

    কৃষ্ণকলি বলল, দাঁড়ান বাবুজী। আপনি এভাবে খুলে আম আমার ছবি তুলতে পারেন না। আমাদের এখানে একটা সমাজ আছে, আর তার নিয়মকানুন খুব কড়া। দেখতেই পাচ্ছেন আমি বিবাহিতা। আমি বললাম, সব্বোনাশ, তবে? কিন্তু রিক্সাওয়ালা বলল যে ছবি তোলা যাবে? ওই তো তোমার ঘরে ঢুকে তোমায় ডেকে আনল। আমি কি তোমাকে চিনতাম আগে? তাকিয়ে দেখি, আসে পাশে একটা একটা করে মানুষ জড়ো হচ্ছে, তাদের মাথায় সেই উমেরিয়ার মত মস্ত মস্ত পাগড়ি আর কানে ঝুলন্ত মাকড়ি। কিন্তু সেখানকার লোকেদের মত এদের খুব একটা বন্ধুভাবাপন্ন মনে হচ্ছেনা।

    আমি বললাম, কিন্তু তাহলে এতদূর এসে ফিরে যাব? তোমায় আমার খুব পছন্দ – একথা তো বলা যাবেনা, বিশেষ করে এই সব ভীষণদর্শন লোকেদের মাঝখানে। তাই বললাম, তোমার ছবি তুলতে পারলে আমার খুব ভাল লাগত। কিছু কি উপায় করা যায়না? কৃষ্ণকলি বলল, যায়, তবে তার জন্য আপনাকে কিছু পয়সা খরচ করতে হবে, মানে আমাকে কিছু টাকা দিতে হবে। আমি বললাম তার মানে? বলছ কি? এই ধ্যাধ্‌ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরেও মডেলিং ফী? আমি বাছা প্রোফেশনার ফোটোগ্রাফার নই। আর আমার ছবি ম্যাগাজিনরা কেনেনা যে আমি এ থেকে রোজগার করি।

    কৃষ্ণকলির চোখে অনুনয়। সে বলল, বাবুজী আপনি কষ্ট করে আমার ছবি তুলতে এতদূর এলেন, আপনাকে ফিরিয়ে দিতে আমারও খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এখানকার সমাজের কথা তো আগেই বললাম। আপনি পয়সা দিয়ে ছবি তুললেই কেউ আর কিচ্ছুটি বলবেনা। আমি বললাম, তা কেমন হবে তোমার এই নিয়মভাঙার মূল্য? কৃষ্ণকলি বলল, আমি নেব দশ টাকা, আমার স্বামী পাবেন পাঁচ। তারপর সসুরজী ও সাসুজীকে দিতে হবে দুটাকা করে। আমি বললাম, ঠিক আছে, তাহলে – সে বলল, দাঁড়ান, আরও আছে, জেঠজী ও জেঠানিজী পাবেন দুটাকা করে, দেবরজী ও ননন্দজীকেও দুটাকা, সবশেষে সরপঞ্চজীকে দুটাকা। আর এই রিক্সাওয়ালা ভাইকে – আমি বললাম, ওর জন্য তোমায় ভাবতে হবেনা। তোমার মোট কত হল বল। সে হিসেব টিসেব করে বলল, উনত্তিস।

    সে সময়ে উনত্রিশ টাকা বড় কম ছিলনা। মনে আছে তার আগের বছর কোদাইকানালে একটা টিলার ওপরে আইটিডিসির একটা সম্পূর্ণ কাঠের লাক্সারি বাংলোর একরাতের দক্ষিণা ছিল তিরিশ টাকা। সে সময়ে আড়াইটাকায় মাছ সমেত একবেলার বাজার হয়ে যেত। আমি বেশ ফাঁপরেই পড়লাম। তবে এ মডেল ছাড়া যায়না, তিরিশের জায়গায় তিনশো চাইলেও না। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি তাতেই রাজি। ভীড়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাগড়ি পরা লোকটাই সরপঞ্চ। সেও দেখলাম দুটাকা পেয়ে খুশি। বলল, হাঁ হাঁ লিজিয়ে ফটু, অব কোই মনা নহী করেগা।

    কিন্তু বিধাতাঠাকুর ওপরে মুচকি হাসলেন। এর পর যা হল, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

    (চলবে)






    সবাই কি আর কৃষ্ণকলি ?

    ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের ন্যায়’। আমি রিক্সাওয়ালাকে তাড়া লাগালাম, কই ভাই, গয়না বের করতে বল, সময় তো চলে যাচ্ছে। সে বুন্দেলখন্ডি ভাষায় কৃষ্ণকলির সঙ্গে কিসব আলোচনা করে মাথা টাথা চুলকে বলল, আসলে ব্যাপার হচ্ছে, এর কোনও গয়না নেই। ওই গায়ে যা পরে আছে, তাই এর সম্বল। গয়না আছে এর শ্বাশুড়ির কিন্তু তিনি সেগুলো দেবেন না। আমি বললাম, বাঃ এদিকে নিজের হিসেবের দুটাকা তো ঠিক বুঝে নিলেন। এখন উপায়? ভিড়ের মধ্যে একজন বলল, অমুকের কাকির গয়না আছে, তবে সে কি মাটি খুঁড়ে বের করবে? একজন দৌড়ে গেল ‘অমুকের কাকি’-র কাছে, আবার প্রায় তৎক্ষণাৎ দৌড়ে ফিরে এসে ডান দিক থেকে বাঁদিক জোরে জোরে মাথা নাড়ল, হবেনা।

    কৃষ্ণকলি খুব অপরাধিনীর মত মুখ করে বলল, বাবুজী, যা পরে আছি, তাতে হবেনা? আমি বললাম, হবেনা কেন, তুমি কিছু না পরে থাকলেও ( মানে গয়না) খুব হবে। কিন্তু এই বিশেষ গয়না পরা মেয়ের লোভে আমি কোলকাতা বলে একটা শহর থেকে বেশ ভালরকম পয়সা খরচা করে ছুটে এসেছি। দেখনা আর কেউ গয়না দেবেনা?

    আবার ভিড় থেকে একজন বলল, অ্যাই(রিক্সাওয়ালাকে) তুই তমুকের বৌকে একবার বলনা। ও তো বাপের বাড়ি থেকে প্রচূর গয়না এনেছে গতকালই। তমুকের বৌকে খবর আর দিতে হলনা, সে নিজেই দৌড়ে চলে এসেছে ইত্যবসরে। কই, কই, কোথায় সেই ছবি তুলিয়ে বাবুজী? আসুন আসুন আমার ঘরে আসুন। আমার অনেক গয়না আছে। আমার ছবি তুলবেন আসুন। মহিলাটি যুবতী এবং ভালরকম ফর্সা। তারপর ফেমিনিন অ্যাসেট্‌স যাকে বলে সে সব বেশ প্রবল। ফিল্ম অ্যাকট্রেস মার্কা চেহারা, অনেকটা সেযুগে সারিকা নামে যে অভিনেত্রী ছিলেন, তাঁর মত মুখটা। সে এসে সটান আমার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, কই আসুন –

    আমি বললাম, কিন্তু, মানে আমি তো এর ছবি তুলছিলাম। সে বলল, এর ছবি কি তুলবেন, শালি কালী, বিচ্ছিরি দেখতে, কোন পাগলে ওর ছবি তোলে, আমায় দেখছেন না, পছন্দ হবার মত চেহারা নয়? বলে বেশ প্রোভোকেটিভ ভঙ্গি করে দাঁড়াল। আমি বললাম, হ্যাঁ তুমি দেখতে ভাল, নিশ্চয়ই ভাল কিন্তু আজ তো আমি এর ছবিই তুলব। সারিকা আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল। আমি টাল সামলাতে না পেরে তার বুকের ওপর গিয়ে পড়লাম। সে তবু হাত ছাড়েনি, শক্ত করে ধরে টানতে লাগল, আসুন, আসুন –

    আমি হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগলাম, বেশি বলপ্রয়োগ করাও মুশকিল, ছাড়ো আমায়, আমি আজ ওর ছবিই তুলব। ওদিকে কৃষ্ণকলি এসে অন্য হাতটা ধরেছে, না বাবুজী আপনি আমায় পছন্দ করেছেন, আমার ছবি তুলুন। সারিকা আমায় ছেড়ে কৃষ্ণকলির চুলের মুঠি ধরল। শালি, আমি থাকতে তুই ছবি তোলাবি, অ্যাঁ - অ্যাঁ – বলে বেদম মারতে লাগল তাকে।

    কৃষ্ণকলি ঘুরিয়ে মারতে পারতনা তা নয়, বরং তারই বেশি বলিষ্ঠ চেহারা। কিন্তু অন্য কোনও ফ্যাক্টর কাজ করছিল বোধহয়, জাত পাত হতে পারে, আপাতদৃষ্টিতে তাই তো মনে হল। সরপঞ্চ এসে অনেক কষ্টে ছাড়াল দুজনকে। তারপর আমায় বলল, দেখুন বাবুজী আমাদের শান্তির গাঁওতে আপনি এসে খুব গোলমাল লাগালেন, এখন ছবি তুললে ঐ ফর্সা মেয়েটার ছবিই তুলতে হবে। আমি বললাম, কক্ষনো না। আমি কালো মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এতদূর এসেছি। শুনুন মশায়, আমি কোলকাতা নামে একটা শহরের ছেলে। ওর চেয়ে ফর্সা আর অনেক বেশি সুন্দরী মেয়েরা আমাদের শহরের অলি গলিতে ঘুরে বেড়ায়। আমি তুললে এর ছবিই তুলব, না হলে তুলবই না। সরপঞ্চ বলল তাহলে গাঁওওয়ালে লোগ ক্ষেপে যাবার আগে আপনি চলেই যান এখান থেকে। এর ছবি আপনি তুলতে পারবেন না। গাঁওওয়ালে লোগ-দের মুখচোখের অভিব্যক্তিও খুব একটা ভাল ঠেকছিলনা, আমি বললাম, তবে আমি চলেই যাব কিন্তু ওই মেয়েটার ছবি তুলবনা।

    মাটির দেয়ালে কাঠের দরজা, তাতে ঠেস দিয়ে আমার কৃষ্ণকলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আহা সে ছবিও যদি একটা তুলতে পারতাম। সে বুকের ভেতর থেকে একটা দোমড়ানো দশটাকার নোট বের করে বলল, বাবুজী খুব কষ্ট দিলাম আপনাকে। বাকি টাকা তো বাটোয়ারা হয়ে গেছে, আমার ভাগের এই দশটাকা আপনি ফেরত নিন। আমি তার হাত ধরার একটা সুযোগ পেয়ে দশটাকার নোটটা চেপে মুঠোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি ঘর থেকে বেরোতেই দুখানা ছবি তোলা হয়ে গেছিল তো, যদিও তার মধ্যে একটায় ঠিক মত ফোকাস হয়নি। যাকগে, এটা তারই নজরানা ধরে নাও।

    হলনা টাকার (ওরা বলে মোহরের) গয়না পরা কালো মেয়ের ছবি তোলা। রিক্সাওয়ালাকে বললাম, তবে, গিভ মি ওয়ান গুড রীজন যে কেন তোমায় আমি ভাড়া এবং বখশিষ দেব? সে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, বাবুজী কাল চলুন অন্য একটা গাঁওয়ে। আমার ফুফির মেয়ে আছে, সেও বেশ কালো। আমি হেসে বললাম, সব কালো মেয়েই কি কৃষ্ণকলি? না রে ভাই কাল দুপুরেই ট্রেন ধরব, সোমবার বেলায় হলেও অফিস জয়েন করতেই হবে।

    (চলবে)




    পাহাড়তলিতে

    আমরা এখন ফিরে যাই সেই দামোহ্‌ সার্কিট হাউসের নীচের পাহাড়ে। মন্দির চাতাল থেকে চড়াই ভেঙে উঠছি। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন শ্রী মনোহর কাজল। উনি ওখানে মোটামুটি সেলিব্রিটি। ওঁর একটা বই আছে, সব ব্যাকলাইটের ছবি। বাচ্চা ও মেয়েদের মধ্যেই উনি সীমাবদ্ধ রাখেন ওঁর ফোটগ্রাফি। কখনও বা দু একটা ছাগলছানা বা পাখিও ঢুকে পড়ে ওঁর ফ্রেমে। যদিও উনি আমাদের মত পাখির ছবি তোলেন না, তবু এই পাহাড়ে কোথায় কোন পাখি পাওয়া যাবে ওঁর মুখস্থ। বললেন, পাখি আমি তখনই নিই, যখন ফ্রেমের মধ্যে তার বা তাদের অন্তর্ভুক্তি ফ্রেমটাকে আলাদা মাত্রা এনে দেয়।

    এখন কথা হচ্ছে, আমিও ছবি তুলতাম এক কালে, মানে ওঁর মত ছবি। কিন্তু সেই সব ব্যাকলাইট পোর্ট্রেট বা ক্যানডিডগুলো দেখলে এখন মনে হয়, তাতে অনেক খুঁত, প্রচূর গ্রেন চলে আসে একটু অসাবধান হলেই। মনোহরজীর ছবিতেও সেই খুঁত ভালরকম আছে। টেকনোলজির উন্নতিতে আখেরে লাভই হয়েছে। তবে আমাদের কোলকাতায় ওঁর মত ফোটোগ্রাফার গন্ডায় গন্ডায় ঘুরত পাড়ায় পাড়ায়। এটা ছোট জায়গা, তাই উনি সেলিব্রিটি। কিন্তু ভদ্রলোক মানুষ বড় ভাল। তিনি বললেন, চলুন, আমিও পাহাড়ে উঠি আপনাদের সঙ্গে। আমি জানি কোন জায়গায় বা কোন ঝোপের সামনে গেলে আপনারা পাখি পাবেন।


    সার্কিট হাউস থেকে নামার সময়েই একটা লাল মুনিয়া পেয়েছিলাম, ওপরে উঠতে গিয়ে অনেক কিছু জুটল। মন্দিরের চাতালেই একটা লার্জ গ্রে ব্যাবলার পেয়ে গেলাম। ব্যাটার দারুণ দারুণ ছবি নিয়ে নিলাম বেশ কয়েকটা। একটা প্লেন প্রিনিয়া পেলাম, একটা সানবার্ড পেলাম, একটা গ্রে হেডেড বান্টিং পেয়ে মহা আনন্দ হ’ল, জীবনে প্রথম চর্মচক্ষে দেখলাম এই পাখি। একটা ক্রেস্টেড বান্টিং তুলে এত রাগ হল যে বলার নয়। আমার কপালটাই এমন, যে প্রায়ই, বেশি ভাল কোনও পাখি পেলে ছবি তুলে পরে ডিসপ্লে তে গিয়ে দেখি তার মুখের সামনে একটা ডাল। আমি ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকায় জটিয়া দম্পতি আমার পেছনে লাগলেন। তাঁরা বললেন, এবার থেকে ডালটাকে ফোকাস করবেন, তাহলে পরে দেখবেন শুধু পাখিটাই পেয়েছেন।

    পাহাড়ের অনেকটা ওপরে এসে ঝোপ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে অনেক উঁচুতে সার্কিট হাউসের বাংলোটা দেখা যাচ্ছিল। ওখান থেকেই বেশ রহস্যময় লাগছিল। ঐ বাংলোয় কাল রাত কাটিয়েছি ভেবেই যথেষ্ঠ শিহরণ অনুভব করছিলাম। আমি যেমন মুখের সামনে ডাল নিয়ে খুঁত খুঁত করে যাচ্ছি সমানে, জগদীশজীও সমানে বলে যাচ্ছেন কাঁটাতারের বেড়াটার কথা, কী আশ্চর্য, কারা বেড়াটা লাগাল আমি জানতেই পারলাম না? এতদিন সার্কিট হাউস থেকে সোজাসুজি নামতাম। এখন এতটা ঘুরে আসতে হবে? আচ্ছা লাগাল লাগাল, মাঝে মধ্যে একটা গেট ফেট রাখবে তো? দেখি যদি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট লাগিয়ে থাকে, তবে ডিএফও কে বলতে হবে তো ব্যাপারটা। আর যদি আমরা লাগিয়ে থাকি, যে অফিসার অর্ডার দিয়েছে, তার খবর নিচ্ছি আমি।

    মনোহরজী সান্ত্বনা দিলেন, আহা আখেরে ভালই হয়েছে তো, কাঠচুরি বন্ধ হবে, জঙ্গলটা আবার আগের মত ঘন হয়ে উঠবে, আপনাদের মত পাখিওয়ালাদের তো আখেরে লাভই হবে। শ্রীমতি নির্মলা বললেন, হ্যাঁ ঠিকই তো। আমি ভাবলাম, কচু হবে, কাঁটাতার কাঠচুরি ঠেকাতে পারে? কাল রাত্তিরে কী শুনলাম তবে? জগদীশজী বললেন, রূপঙ্করজী ফিরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিন। আমরা আজ যাব নওরাদেহি অভয়ারণ্যে। দেখা যাক কপালে কী আছে। পুরোটা ঘোরা যাবেনা অবশ্য, অত সময় থাকবেনা। আমি বললাম, সে তো বটেই, আমি জানি এটি ভারতের বৃহত্তম অভয়ারণ্য। কিছু কিছু জঙ্গলকে কনে সাজানোর মত করে বিদেশিদের সামনে র‍্যাম্পে হাঁটানো হয়, কিন্তু আসল জঙ্গলগুলো দুয়োরাণী হয়েই থেকে যায় চিরকাল। কেউ নামও শোনেনা তাদের।

    (চলবে)

    https://fbcdn-sphotos-g-a.akamaihd.net/hphotos-ak-ash3/t1.0-9/p180x540/1458693_664135723623407_1458688656_n.জ্প্গ

    দুখলাল

    সার্কিট হাউসে ফিরে এলাম। সারা দিনের জন্য বেরোচ্ছি, চান টান করে কিছু খেয়েই বেরোই। সুখলালকে ফোন লাগালাম। মানুষ যতই বিচক্ষণ হোক, প্রতি নিয়তঃ কিছু কিছু ভুল করে যায়। আমি আজ করলাম, বিরাট ভুল। অবশ্য আমার এতে খুব একটা দোষ নেই, এমন যে হতে পারে, তার বিন্দুমাত্র আভাস পাইনি আগে। সুখলাল এল ভুঁড়ি দুলিয়ে, ব্রেকফাস্টমে কেয়ে লেঙ্গে সাব? ভাবটা এমন, যেন পরিজ, ব্রেড অ্যান্ড বাটার, পোচ উইথ সানি সাইড আপ, সিডার জুস, সব হাজির করে দেবে এক্ষুণি। আমি তো তখনও জানিনা হাল চাল, বললাম, এক কাম করো, জেয়াদা ঝামেলা মোল লেনেকা জরুরত নহী, ম্যায় জরা জলদি মে হুঁ। মুঝে থোড়া পুরি সবজি বনা দো। সুখলাল অবোধ শিশুর মত মুখ করে বলল, সার পুরি কে জগহ অগর পরাঠা বনা দেঁ তো? আমি বললাম, যা পার করো বাছা, আমার তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। তুমি খাবার রেডি করো, আমি চানে ঢুকছি।

    চান টান করে ফিটবাবুটি হয়ে ক্যামেরা গুছিয়ে সোফায় বসলাম। খাবার আবার সুখলাল নিজে হাতে আনেনা, বিভিন্ন চামচার হাতে পাঠায়। কাল রাতে একটা ভুতের মত দেখতে লোক এসেছিল, আজ আবার অন্য একটা। এগুলো বোধ হয় টেম্পোরারি এমপ্লয়ী, ঘাড় মুচড়ে কাজ করিয়ে নেয়া হয়। আবার এও হতে পারে, যে খাবারের ঢাকনাটা খোলার পর আমার প্রাথমিক রিঅ্যাকশনটা সুখলাল দেখতে চাইছিলনা। আজকের লোকটা ঠিক ভুতের মত নয়, খানিক মানুষ মানুষ দেখতে। সে বলল, খা লিজিয়ে সাব ম্যায় পিছে আকে বর্তন লে যাউঙ্গা।

    ঢাকনা খুললাম। পরোটার ভেবে যে জিনিষটা তুললাম, তা তেলে চপচপে জুতোর সুখতলার মত। সত্যি সত্যি সুখতলা সেদ্ধ করে তারপর ভেজে দিয়েছে, তাও হতে পারে। আমি সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান করলাম, তাঁকে পাওয়া গেলনা। সঙ্গে একটা তরকারি ছিল। তাতে শুধু ফুলকপি খুব ছোট ছোট করে কাটা। না আলু নেই, কড়াইশুঁটি নেই, কিচ্ছু নেই। কোনও গ্রেভিও নেই। জিনিষটা ভাজা না সেদ্ধ তাই আঁচ করার চেষ্টা করে বিফল হলাম। এবার ফুলকপি সাধারণতঃ সাদা রঙের হয়। কোনও কোনও জায়গায় একটু হলদেটে হয়, তাও দেখেছি। আর আছে ব্রকোলি, যেটা গাঢ় সবুজ, কিন্তু তার ফুল অন্যরকম। কোনওমতেই দুটোকে গুলিয়ে ফেলার কোনও সুযোগ নেই। কুচকুচে কালো রঙের ফুলকপি কেমন করে পাওয়া গেল এও একটা বিষ্ময়। সেটা মুখে দিয়ে চিবোতে গিয়ে দেখলাম নুন নেই, ঝাল সামান্য আছে, বেশির ভাগটাই তেতো। নিজে খানিক রান্না জানি বলে বোঝা গেল প্রায় তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে একই তেলে ভাজা হচ্ছে সব কিছু এবং তাতেই পরোটা ভেজে তারপর ফুলকপি ভাজা হয়েছে। সামান্য গোলমরিচ ছাড়া আর কোনও মশলা সম্ভবতঃ নেই সুখলালের স্টকে, নুনও না।

    অনেকগুলো প্রশ্ন ও সাইমালটেনিয়াস উত্তর চলে এল মনে ঃ

    প্রথমতঃ বোঝা গেল, এটায় বুকিং করে রেখেও কেন জগদীশজী আমায় প্রথমে ডাক বাংলোয় তুলেছিলেন।

    দ্বিতীয়তঃ কেন ভুতরা সামান্য ‘ম্যহ্‌সূস’ করানো ছাড়া আর কোনও উপদ্রব করছেনা ইদানিং ( মানে সুখলালের অ্যাপোর পর থেকে)। শ্রীমতি দামিনী তো কি যেন কুরেশি নামক অন্য একজন খানসামাকে পেয়েছিলেন।

    তৃতীয়তঃ এত ভাল ফাইভ স্টার বন্দোবস্ত থাকতেও মন্ত্রীমশাইরা শৈলাবাসে বড় একটা আসছেন না কেন আজকাল।

    গাড়ি এসে গেছে। আজ আবার শাহিদ সারথী, সঙ্গে একজন পেয়াদা গোছের। সে বলল, চলিয়ে সার, পহলে আপকো জটিয়া সাব কা ঘর লে জানে বোলা। ফির ওয়াহাঁসে আপলোগ নিকলেঙ্গে।

    গেলাম জগদীশজীর বাড়ি। আসলে এটা অফিশিয়াল কোয়ার্টার। এখানে এমন বাড়িতে আগেও এসেছি। এগুলো সব সময়েই একতলা বাংলো। সামনে একটা শেড দেয়া বারান্দা, তার সামনে একটা মোলায়েম ঘাসে ঢাকা ছোট লন। তার চারদিকে বাহারি ফুলের গাছ। লনে গার্ডেন চেয়ার ও সেন্টার টেবিল পাতা আছে। দু একটা ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রও আছে সেখানে। সেই লনেই অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। সেটাই প্রথা প্রায় সব বাড়িতেই। কেবল বৃষ্টি এলে বোধহয় শেডটার তলায় উঠে যেতে হয়। আমি অবশ্য জগদীশজীর বাড়ির ভেতরে যাইনি তা নয়, তবে আজ এখানেই বসলাম। আর্দালি এসে চায়ে ক’চামচ চিনি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে গেল।

    (চলবে)





    বনের পথে

    এবার জগদীশজী চলে এলেন। চা ইত্যাদির পর্ব শেষ হতে উনি বললেন, তাহলে ভেতরে আসুন একটু খেয়ে নেয়া যাক। আমি বললাম, আবার কী খাব ? জগদীশজী বললেন, সারা দিন তো বাইরেই কাটবে, তাই নির্মলাকে বলেছি একটু পোহা বানাতে। আমি বললাম, নাঃ এবারে আর নির্মলাজীর হাতের পোহা খাওয়া হলনা। আমি তো সার্কিট হাউসে ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি। মনে মনে বললাম, কী ভুলটাই না করে ফেলেছি। আমার আন্দাজ করা উচিত ছিল, যে ওঁদের বাড়ি গেলে ওঁরা খেতে বলবেনই। আবার ভাবলাম, ঐ ভগ্নদূতটি যখন এসে বলল যে ওঁদের বাড়ি যেতে হবে, তার আগেই তো সুখলালের ‘দুখভরী’ সুখতলা চিবোনো হয়ে গেছে। আজ সারা দিনের ধকলেও তা হজম হবে কিনা সন্দেহ। আমি বললাম, আপনি খেয়ে আসুন, আমি বসছি। জগদীশজী বললেন, নাঃ আমার একার জন্য ওকে আর খাটাবনা, রাস্তায় কিছু কিনে নিলেই হবে। আমি ভাবলাম, আমার কপালটাই খারাপ। নির্মলাজীর পোহা জাস্ট অপ্রতিরোধ্য।

    মধ্যপ্রদেশের অনেকটা জায়গা জুড়েই ‘পোহা’র দাপট। পোহা একটি উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাবার। এটি সকালের জলখাবার হিসেবেই চলে বেশি। জব্বলপুরের রাস্তায় সকাল সাড়ে ছটা বাজলেই পোহার গাড়ি বেরিয়ে পড়ে। হাতে ঠেলা আইসক্রীমের গাড়ির চেয়ে একটু বড় কাঠের গাড়ি , ভেতরে গুঁড়ো কয়লা চাপানো উনুন আছে, গরম না হলে পোহা কেউ খাবেনা। পোহা জিনিষটা আর কিছুই নয়, বাংলায় যাকে আমরা চিড়ের পোলাও বলি, তাই, কিন্তু এখানে একটু হলদেটে বা বাসন্তী রঙ হয়। রাস্তারগুলোয় বাজারের রঙ মেশানো হয় হয়ত, বাড়িরগুলোয় অন্য কোনও মাধ্যম। কিন্তু শুধু চিড়ের পোলাও সেভাবে খাওয়া যাবেনা, তার ওপর ছড়িয়ে দিতে হবে সেওভাজা, মুমফলি বা চিনেবাদাম, নিরামিষাশী হলে খুব পাতলা করে কাটা মূলো, আমিষাশী হলে পেঁয়াজ। রাস্তার গাড়িগুলো থেকে ভোরবেলাতেই বিক্রি বেশ ভালই, একটা গামলা গোছের চাপানো আছে গুঁড়ো কয়লার উনুনে। অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে, গরম না হলে কেউ খাবেনা। মাঝে মাঝে হাতা দিয়ে উল্টে পাল্টে নেড়ে দেয়া হয়, যাতে তলা না ধরে যায়। খদ্দের হাজির হলেই স্টীলের প্লেটে ঢেলে তারওপর সেওভাজা, মুমফলি ইত্যাদি ছড়িয়ে হাতে গরম সাত টাকা। এটা দু হাজার তেরোর দাম, চোদ্দয় খাবার সুযোগ হয়নি, তাই দাম জানিনা।

    মধ্যপ্রদেশে নানা জাতির বাস, তাদের মধ্যে মুখ্য হচ্ছে মালওয়া ও বুন্দেলখন্ডের লোকজন। ঐতিহাসিক দিক থেকে মালব্য ও বুন্দেলখন্ড ঠিক এখনকার মধ্যপ্রদেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিলনা, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানের কিছু অংশও ছিল এই সব দেশে। মালব্য দেশটা ছিল এখনকার মধ্য প্রদেশের পশ্চিম ভাগ ও রাজস্থানের খানিক অংশ নিয়ে। কালিদাস ও ভর্তৃহরির মত অনেক গুণীজনের জন্ম এই ভূমিতে। এই জায়গার একটা নিজস্ব কৃষ্টি আছে, তা হল, রাজস্থানি, মারাঠি ও গুজারাটির এক মিলিত রূপ। যাক সে কথা, আমাদের কথা হচ্ছিল পোহা নিয়ে। মধ্যপ্রদেশে পোহা খেলে, সেটা মালওয়ি না বুন্দেলখন্ডি তা বোঝা যায় সহজেই। বুন্দেলখন্ডি পোহা ঝাল ঝাল আর মালওয়ি পোহা মিষ্টি। এখন জগদীশজীরা বুন্দেলখন্ডের বাসিন্দা হলেও জাতে মালওয়ি, তাই নির্মলাজীর হাতের পোহাও বেশ মিষ্টি। এবার তার ওপর সেওভাজা পড়তেই সে এক অনবদ্য স্বাদ। সুখলালের সুখতলা চিবিয়ে আসার জন্য নিজের দুগালে থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে করছিল।

    পোহা না খেলেও পথে যেতে যেতে একটা দোকানে ঢুকে খাবার দাবার কেনা হল। খাবনা খাবনা করেও একটা সিঙাড়া দেখে লোভ সামলাতে পারলামনা। তার ওপর কর্তা গিন্নী দুজনেরই উপরোধ, একবার খা কে তো দেখিয়ে। একটা নতুন জিনিষ শেখাও হল সিঙ্গাড়া, যেটাকে পুরো হিন্দী বেল্টেই ‘সামোসা’ বলা হয়, সেটা নাকি এখানে দুরকম, অর্থাৎ তার ভেতরের পুর, মশলা সবই আলাদা। যেটা খেলাম, সেটা নাকি শাদি কে সামোসে, মানে, বিয়েবাড়িতে খাওয়ানো হয়। দারুণ টেস্ট বটে। জগদীশজী জিজ্ঞেস করলেন আপকে ওয়াহাঁ বঙ্গালমে তো শায়দ সামোসে নহী বনতে হ্যাঁয়? আমি বললাম হয়ানা আবার, হয় তো ডেফিনিটলি এবং তাকে আমরা বলি সিঙ্গাড়া ( হিন্দীতে পানিফল হল সিঙ্গারা। ‘ড়’ এর জায়গায় ‘র’ তবে দুটোই তিনকোনা, অসুবিধে নেই)। কিন্তু তার ভেতরে পুরটা থাকে অন্য। নির্মলাজী জিজ্ঞেস করলেন কী থাকে তাতে? আমি বললাম, এখন তো হিন্দীভাষী মানুষ কোলকাতায় ছেয়ে গেছে, তাই কোলকাতার দোকানগুলো সামোসা-ই বানায়, তবে গ্রামাঞ্চলে গেলে এখনও বাঙালি সিঙাড়া পাওয়া যায়, যার মধ্যে আলুসেদ্ধ একটা বিশেষ রকমের মশলা দিয়ে নেড়েচেড়ে, তার সঙ্গে শীতকালে অবশ্যই ফুলকপি, চিনেবাদাম(মুমফলি) ও আদার টুকরো থাকে। উনি বললেন, শুনে মনে হচ্ছে টেস্টিই হবে।

    বেশ খানিক বাজার এলাকার মধ্যে দিয়ে যেতে হল, এবার মুক্তাঞ্চলে পড়ছি ধীরে ধীরে। শহর পিছিয়ে পড়ছে, গ্রাম আরম্ভ হচ্ছে। গ্রাম লাগোয়াই বনাঞ্চল। আসলে এই সব বনকে সংরক্ষিত অঞ্চল বানাবার আগেই মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল বনের ভেতর। একটা টালির দোতলা বাড়ি, পাশে কাপড় মেলা রয়েছে, তার ফাঁক দিয়েই এক ঝাঁক শামুকখোল উড়ছে – দৃশ্যটা এত ভাল লাগল, যে জানলা দিয়েই তুলে নিলাম। ওপরে সেই ছবি।

    (চলবে)





    আমাদের বন জঙ্গল

    ভারতবর্ষের আম জনতা যতগুলো জঙ্গলের নাম শুনেছে, আসলে আছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু জঙ্গল থাকলেই তো হবেনা, এক সময় কোলকাতা শহরটাও সুন্দরবনের জঙ্গলের অংশ ছিল, ধর্মতলায় ধর্মঠাকুরের থান ছিল, ছিল চৌরঙ্গি সাধুর ডেরা। কালে কালে মানুষ বাড়ে, জঙ্গল হারিয়ে যায়। এই কিছুদিন আগেই, আমরা যখন ছোট, তখন কোলকাতার আসেপাশেই কত জঙ্গল ছিল। সেই সব জঙ্গলে বাঘ ভাল্লুক থাকতনা, থাকত ছোট ছোট নানারকম জীবজন্তু আর বহু পাখি। ধীরে ধীরে জঙ্গল কেটে মানুষ বসতবাড়ি ও চাষ আবাদ শুরু করল। যত সময় গেল, তত মানুষ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কমতে লাগল গাছপালা ও জীবজন্তুর সংখ্যা। কিছু কিছু প্রাণী বিলুপ্তও হয়ে গেল। জীববিজ্ঞানীরা চ্যাঁচামেচি শুরু করলেন, আসতে লাগল নানারকম আন্তর্জাতিক চাপ, তখন কেন্দ্রিয় সরকারের টনক নড়ে শুরু হল অরণ্য সংরক্ষণ। এই যে কিছু কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেল, তারই একটির সঙ্গে নওরাদেহি অরণ্যের যোগ রয়েছে, আমি আসছি সে কথায় পরে।

    এবার সরকারি টনক নড়ানড়ির ফলে শুরু হল অরণ্য সংরক্ষণ, সেও আবার অনেক রকম। কিছু জায়গার নাম হল, সংরক্ষিত অরণ্য, মানে, ইংরিজিতে রিসার্ভড ফরেস্ট, কিছু জায়গার নাম হল অভয়ারণ্য, মানে স্যাংচুয়ারি। আবার উনিশশো তিয়াত্তর সালে (সম্ভবতঃ), শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন প্রজেক্ট টাইগার, অর্থাৎ ব্যাঘ্র প্রকল্প। তখন কোনও কোনও অভয়ারণ্য চলে এল ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায়, কোনওটি বা গন্ডার প্রকল্পের। এখানে বাঘ ও গন্ডারের সুমারি হতে থাকল, তার জন্য মোটা মোটা ফাইলে অনেক মিথ্যে কথা লেখা হতে থাকল। অন্ততঃ দুটি ভারতীয় বাঘ সংরক্ষণের অভয়ারণ্যে কোনও বাঘই ছিলনা বা মেরে শেষ করে দেয়া হয়েছিল বহুকাল আগেই, তা জানা গেল কিছু কিছু এন জি ও মাঠে নামবার পর।

    অন্য রকম অভয়ারণ্যও আছে। আমাদের কোলকাতার খুব কাছে নরেন্দ্রপুরে আছে চিন্তামণি কর পক্ষী অভয়ারণ্য। আসলে ওটা সাতাশ একর জমির ওপর একটা কয়েল কারখানার বাগান ছিল। তার মধ্যে দশ একর দখল হয়ে যাবার পর কিছু স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে এবং প্রখ্যাত ভাষ্কর চিন্তামণি কর হস্তক্ষেপ করায় বন দপ্তর জমিটি হাতে নেয়। মাত্র সতের একর বাঁচানো যায় অবশেষে। সেই ছোট্ট বাগানটাও নাকি অভয়ারণ্য, ঢুকতে গেলে চল্লিশ টাকার টিকিট লাগে। আসলে আমাদের দেশে যে কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়েই লুঠ চলে প্রতি নিয়তঃ, হয় সরকারি তরফে, নয়তো বেসরকারি। সরকারি লুঠ চলে বলেই বেসরকারি ভীরাপ্পণরা গজায়, যাক সে কথায় কাজ নেই, ধড়ে একটা মোটে মুন্ডু।

    এছাড়াও, সরকারি ঘোষণায় ‘বনাঞ্চল’ বা ফরেস্টেড এরিয়া বলে উল্লেখ করা আছে কিছু জায়গা। সেগুলোর প্রতি অবশ্য দায়বদ্ধতা খাতায় কলমে। সেখানে নিত্য গাছ কেটে লগ বিক্রী করে বড়লোক হয়ে গেছে কিছু লোক, অবশ্যই সব ‘জায়গায়’ নজরানা গুঁজে। তার ওপর সেসব জমি দখলও হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। কেউ কিচ্ছু বলছেনা। যেখানে ঘন জঙ্গল ছিল দু বছর আগেও, সেখানে ট্র্যাকটর চলছে ডিজেলের ধোঁয়া উড়িয়ে, সরকারি খাতায় জমির চরিত্র পাল্টাতে খরচ হয় খুবই অল্প টাকা, যা ওই দুর্মূল্য গাছপালাগুলোর নোশনাল ভ্যালুর এক শতাংশও নয়। তাছাড়া জঙ্গল কেটে মানুষ বসানোর ক্ষেত্রে রাজনীতির একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তখনকার উত্তর প্রদেশের, মানে এখনকার উত্তরাখন্ডের জিম করবেটের সেই বিখ্যাত কালাঢুংগি জঙ্গল একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত কেটে সাফ করে পাকিস্তান থেকে আগত পাঞ্জাবি শিখ উদ্বাস্তুদের বসানো হয়েছিল, যেখানে বাঙালিরা মরিচঝাঁপির জঙ্গল কাটছিল বলে গুলি খেয়েছিল। তবে আমি একেবারেই রাজনীতি বুঝিনা, তাই ও প্রসঙ্গে আর নয়।

    আর আছে সোশাল ফরেস্ট্রি বা সামাজিক বনসৃজন। নাই মামার চেয়ে স্লাইটলি ভাল কানা মামা। সেখানে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয় এমন সব গাছ সরকারি তত্বাবধানে লাইন দিয়ে কবরখানার ফলকের মত বসানো হয়। কোনও পাখি ভুলে কোনও গাছে হঠাৎ উড়ে এসে বসলে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবার উড়ান দেয়। ওরা বড় ভয় পায় এই ‘সাজানো বাগান’ গুলোকে। সরকারি ইউক্যালিপ্টাস কাগজ কলে চালান হবে বছর সাতেক পরেই। আবার কিছু কবরখানার ফলক বসবে সেই জায়গায়। সেই জমিতে বহু বহু বছর পর্যন্ত আর কোনও উদ্ভিদ গজাবেনা, ইউক্যালিপ্টাস জমিকে প্রচন্ড অ্যাসিডিক করে দেয় চিরতরে না হলেও বহু বহু বছরের তরে।

    এই সব জঙ্গলের মধ্যে কিছু আবার জাতীয় উদ্যান বা ন্যাশনাল ফরেস্ট। ওপরে যতগুলো নাম লিখলাম, মানুষকে গুলিয়ে দেবার বা কনফিউজ করার পক্ষে তা যথেষ্ঠ। এবার এই ন্যাশনাল ফরেস্টগুলোর মধ্যে স্যাংচুয়ারিও পড়ে, প্রজেক্ট টাইগারও পড়ে, গুজারাটের ‘গির’ অভয়ারণ্য আবার জাতীয় উদ্যানও বটে। সেখানে , মানে একমাত্র সেখানে এসিয়াটিক লায়ন বা এসিয়ার সিংহ দেখা যায়। ভারতে আর কোথাও তারা নেই, আর নেই বলেই গন্ডগোল। গন্ডগোল কাকে নিয়ে? না নওরাদেহি । যে নওরাদেহি অভয়ারণ্যও বটে, জাতীয় উদ্যানও বটে, অথচ কেউ নাম শোনেননি।

    আগে যা যা লিখেছি, তার মধ্যে ছেঁকে নিয়ে তিন চারটি কথা মনে রাখলেই এর পরের অধ্যায়ে যেতে সুবিধে।

    ১) নওরাদেহি অভয়ারণ্য এবং জাতীয় উদ্যান একটি বিলুপ্ত প্রাণীর সঙ্গে জড়িত।

    ২) এসিয়াটিক লায়নেরও ভূমিকা আছে এই উদ্যানের ব্যাপারে।

    ৩) এটি জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য হওয়া সত্বেও সাধারণ মানুষ কেউ নাম শোনেননি।

    ৪) একথা আগে বলিনি – এটি ভারতের বৃহত্তম অভয়ারণ্য।

    (চলবে)






    তীর্থের পক্ষী

    সেই বিলুপ্ত প্রাণী আর সিংহের কথায় আসব আমি, তার আগে ওপরের ছবিটা নিয়ে কিছু বলি। নওরাদেহিতে ঢোকার কিছুক্ষণ আগেই এঁকে পেয়ে গেলাম। এত কাছে ইনি বসে থাকবেন, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনওদিন। প্রাণ ভরে ছবি তুললাম অনেকগুলো। আমার অনেক দিনের শখ আজ মিটল, তাও এত কাছ থেকে।

    যখন ছোট ছিলাম, অন্য বন্ধুদের মত খেলায় মেতে না থেকে আমি শিশুপাঠ্য বই পড়তাম গাদাগাদা। সে সময়ে দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রতি বছরই একটা পূজোবার্ষিকি বেরোত। তখন রঙিন ছবি ছিলনা বলে সাদা কালো ছবিই কয়েকটা লাল, কয়েকটা নীল রঙের কালিতে ছাপিয়ে বৈচিত্র আনা হত। তা সেই রকম এক পূজোবার্ষিকিতে পড়লাম এক আশ্চর্য কাহিনী। মাদ্রাজের (তখন চেন্নাইকে তাই লেখা হত বাংলায়) পক্ষীতীর্থম নামক স্থানে নাকি একজোড়া অদ্ভুত পাখি এসে বসে রোজ মন্দিরের চূড়ায়। পূজারী তাদের জন্য নির্দিষ্ট ‘প্রসাদম’ থালায় করে তুলেই রাখেন, তারা নির্ভয়ে এসে সে প্রসাদ খেয়ে অজানা গন্তব্যে উড়ে চলে যায়। কথিত আছে এরা নাকি রাম আর লক্ষণের আত্মা পাখিদের রূপ ধরে আসেন। যে সব ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী ভক্ত সে দৃশ্য দেখতে পান, তাঁরা প্রচূর পূণ্যলাভ করেন। তখন কতই বা বয়স, ইস্কুলের খুব নীচু ক্লাসে পড়ি। প্রথম প্রশ্নই যেটা মনে এসেছিল, তা হল, এরা রাম-লক্ষণ কেন, রাম-সীতা না হয়ে?

    পাখি দুটোর ছবি ছিল খুবই অস্পষ্ট, তবে সাদা রঙের লম্বা গোছের পাখি এটা দেখেছিলাম। যদিও বইয়ে লেখা এবং সে সময়ে বইয়ের লেখা বেদবাক্য বলে ধরা হত, মনে মনে ভেবেছিলাম, কোন সে পাখি, আমি না দেখলে বিশ্বাস করতে রাজি না। সেই প্রবন্ধে এও লেখা ছিল, গোটা ভারতবর্ষে এমন পাখি কেউ কোনওদিন দেখেনি। আন্দাজ করা হচ্ছে, এরা প্রসাদ খেয়ে সাগর পেরিয়ে সীলোন (এখনকার শ্রীলঙ্কা)-এ চলে যায়।

    ১৯৭৮ সালে প্রথম ম্যাড্রাস যাই (তখনও এই নাম) তখন স্টেট ট্যুরিজমের কন্ডাকটেড ট্যুরগুলো সত্যি খুব ভাল ছিল। বাসগুলোও খুব আরামদায়ক। আমরা চার বন্ধু ট্যুর করছি বাসে। আমাদের ট্যুর গাইড মিসেস রাজেন্দ্রন। পৃথিবীতে কত সহস্র মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কেবল কিছু লোকের নাম মনে থাকে কেন কে জানে। অসম্ভব আকর্ষণীয়া ছিলেন এই ভদ্রমহিলা। যাই হোক, তিনি পক্ষীতীর্থমের কাছে যাওয়ার আগেই বলে দিলেন, ওখানে গিয়ে কোনও লাভ নেই। পাখিরা এই সময়ে আসেনা। এটা ওদের খাবার সময় নয়। তাছাড়া উঠতে নামতে যা সময় যাবে, সেটা বাঁচাতে পারলে পরের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো আরও ভাল করে দেখতে পারবেন। আমাদের লীডার বিশু। চাটগাঁইয়া, নাস্তিক ও ঘোর, মানে তুমুল কমিউনিস্ট। ধুস্‌ শালা ভালই হয়েছে বলে সে চোখ বন্ধ করে পুশব্যাক সীট ঠেলে কাত হল। আমার মনটা খুঁত খুঁত করছিল, ইস পাখিটা দেখা হবেনা? দেব সাহিত্য কুটির যে বলেছিল এমন পাখি ভূ ভারতে কেউ দেখেনি?

    পক্ষীতীর্থমের কাছে এসে অবস্থান বদল হল। মিসেস রাজেন্দ্রন রাস্তায় দাঁড়ানো দু চারজন লোকের সঙ্গে তামিল ভাষায় কীসব বলে আমাদের জানিয়ে দিলেন, হ্যালো হ্যালো, লিসন টু মি। ইট ইজ রিপোর্টেড দ্যাট দা বার্ডস আর হিয়ার। দোস অফ ইউ হু ওয়ান্ট টু ভিসিট দা টেম্পল আর গিভেন ওনলি হাফ অ্যান আওয়ার টু ক্লাইম্ব আপ অ্যান্ড ডাউন। রিমেম্বার, ওনলি হাফ অ্যান আওয়ার। ঘোর কমিউনিস্ট বিশু, সেমি কমিউনিস্ট দেবা আর শুকদেব নামে বাচ্চা ছেলেটা তিন লাফে হাওয়া। আমি যেতে গিয়ে দেখি ওরেব্বাবা, এ আমার কম্মো নয়। বিশাল উঁচু উঁচু সিঁড়ির ধাপ। আর মন্দিরটা যেন কতশো ধাপ পেরিয়ে। আমার সে সময়ে ওপরে উঠতে বুকে হাঁফ তো ধরতই, পায়ের জানুতে প্রচন্ড মাসল ক্র্যাম্প হয়ে যেত খানিক উঠলেই। তাই পারত পক্ষে আমি ওপরে উঠতামনা। আশ্চর্য, বুড়ো হয়ে সেসব কষ্ট গায়েব হয়ে গেছে।

    আমি সিঁড়ির ধাপে বসে অপেক্ষা করছি, দেখি এক সম্পর্কিত দাদা নামছেন। তাঁরাও ম্যাড্রাস ট্যুর-এ এসেছেন একই ট্রেনে, তবে তাঁদের ট্যুর অনেক ছোট। তিনি বললেন, কিরে দেখবিনা? আমরা তো দেখে এলাম। আমি বললাম আমি পারবনা, আমার দ্বারা হবেনা, তিনি বললেন, হবেনা মানে? আমি ধরে ধরে তুলছি আয়। এতদূর এসে এই আশ্চর্য জিনিষ না দেখে ফিরে যাবি? অগত্যা, সে যে কী কষ্ট করে উঠলাম তা ঈশ্বর জানেন। দাদা প্রায় অর্ধেকের বেশি নেমে এসেছিল, আবার উঠল আমায় টানতে টানতে। উঠে দেখি ও হরি, এতো রাম লক্ষণ, সীতা, লব-কুশ, এন্টায়ার ফ্যামিলি। বললাম, ধুস্‌ শালা, এই দেখতে এত কষ্ট? বিশু বলল, তুই চিনিস এই পাখি? আমি বললাম, আলবাত চিনি। এতো ঈজিপশিয়ান ভালচার। আর বলে নাকি এক জোড়া? দুটো মন্দিরের চূড়োয় বসে আর তিনটে চক্কর মারছে। ঐ একটা নেমেও এল। এই নাকি লঙ্কা থেকে উড়ে আসা রাম লক্ষণ? ধুস্‌।

    পূজারী লোকটা বাংলা না বুঝলেও, তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে সেটা খুব বুঝেছে। তার ওপর ইংরিজিতে ভালচার শব্দটা বুঝেছে ভালই। সে আবার কয়েকটা অন্য পূজারী চেলা জুটিয়ে খুব ভয়ঙ্কর ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ইন্ডো মিন্ডো কি সব বলতে লাগল। আমরা মানে মানে পালিয়ে এলাম। এখন কথা হচ্ছে ঈজিপশিয়ান ভালচারদের মন্দিরের প্রসাদি ফল খাওয়ার কথা নয়। এরা ঘোর মাংসাশী এবং অন্য পাখির ডিম পাথরে আছাড় মেরে ভেঙে খেতে অভ্যস্ত। এরা হয়ত কোনও কারনে একবার অভ্যাস করে ফেলেছে। পূজারী ব্যাটাচ্ছেলেরা লুকিয়ে প্রসাদের মধ্যে ডিম ফিম পাচার করে কিনা তাই বা কে জানে। যতদিন এরা আসবে, ততদিন ইনকাম।

    তা এ ভদ্রলোককে ক্যামেরাবন্দী করার কতদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছি। একবার তো জব্বলপুরে বন্দরকুদের ওপর থেকে বহু দূরে একজনকে টার্গেট করতে গিয়ে খেয়াল হল, পা ফসকালেই কয়েক শো ফীট নীচে। তাকালেই মাথা ঘুরছে। সেই তিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে আজ একেবারে হ্যান্ডশেকিং ডিস্ট্যান্সে বসে। আমাদের দেখে উড়ে গিয়ে সামান্য দূরে বসলেন। আমি জগদীশজী কে বললাম, নওরাদেহিতে আর কাউকে না পেলেও আমার আসা সার্থক।

    (চলবে)




    নওরাদেহি

    আগেই বলেছি, অনেক জঙ্গল এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকলেও র‍্যাম্পে হাঁটা সুন্দরীদেরই মানুষ চেনে। মধ্যপ্রদেশে গিয়ে জঙ্গল বলতে লোকে জানে কানহা আর বান্ধবগঢ়। পান্না সংরক্ষিত অরণ্যের নামও ইতি উতি শোনা যায় আজকাল, কিন্তু শিরোনামে আগের দুজনই। পর্যটন ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে এদের দৌলতে। তারা মার্কা রিসর্ট গজিয়ে ওঠে রাতারাতি, যে সব খেটে খাওয়া মানুষজন ভাল করে হিন্দী বলতে পারতনা, তারা আমেরিকান অ্যাকসেন্টে ইংরিজি বলে মেমসাহেবদের সাথে। খাজুরাহো-পান্না ঘোরাতে যে অটোগুলো যায় তাদের চালকরা স্প্যানিশ বা ইটালিয়ানও জানে দেখেছি। আমরা, মানে গেরস্ত মার্কা মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা বেড়ার ধার থেকে দেখি এইসব জঙ্গল। কিছুদিন আগেই তো ঘুরে গেছি, তখন তো – বললে শুনতে হয়, ভুলে যান সে সব দিনের কথা।

    নওরাদেহির নাম কেউ শোনেনি। খোদ মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরাও শোনেননি এই অদ্ভুত নাম। অথচ এটি ভারতের বৃহত্তম অভয়ারণ্য। কিসের অভয়ারণ্য, বাঘের? শুধুই যে বাঘের অভয়ারণ্য হয় তা নয়, গন্ডারের আছে, কুমিরের আছে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিরল উল্লুকদের জন্য আছে, মণিপুরে নাচিয়ে হরিণের জন্য আছে, আরও অনেক রকম আছে। জগদীশজী বললেন, এটা এখন নির্দিষ্ট হয়েছে ক্যারাক্যাল( এক ধরণের বন বিড়াল) স্যাংচুয়ারি হিসেবে। নির্মলাজী বললেন, তবে আপনি সারা জঙ্গল ঘুরলে অন্য দু একটা জন্তু দেখতে পেলেও পেতে পারেন কিন্তু ক্যারাক্যাল পাওয়ার কোনও চান্স নেই।

    আসল ব্যাপারটা হল, এই জঙ্গলটায় খুব ঘন ভেজিটেশন বা গাছপালা নেই, এবং তাই জন্যই এটা ঠিক করা হয়েছিল চিতাদের বাসস্থান হিসেবে তবে সে প্রজেক্ট এখন ভোগে। ঠিক বোঝাতে পারলামনা বোধহয়, প্রজেক্ট আবার কি, চিতাবাঘ তো গন্ডায় গন্ডায় ঘুরে বেড়ায় আমাদের সব জঙ্গলেই। এমনকি মুম্বাইয়ের পোয়াইতে আইআইটি ক্যাম্পাসে যখন তখন ঢুকে পড়ছে, কাণ্ডিভেলি অঞ্চলে বস্তি থেকে বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে হরদম, উত্তরবঙ্গের চা বাগানে লুকিয়ে থাকছে ঘাপটি মেরে, কখন একটা মাতাল চা শ্রমিককে একলা পাবে, চিতাবাঘ কি কম পড়িয়াছে?

    হ্যাঁ কম পড়িয়াছে। ভারতবর্ষে চিতাবাঘ একটিও নেই। যেটাকে আমরা চিতাবাঘ বলি, সেটি ‘গুলবাঘ’, ইংরিজিতে লেপার্ড। তবে যখন আলিপুর চিড়িয়াখানাতেই লেপার্ডের এনক্লোজারের সামনে ‘চিতাবাঘ’ লেখা থাকে, আমজনতার আর দোষ কী। যাকগে, আমাদের দেশে কিন্তু এককালে অনেক চিতাবাঘ ছিল। এটি নামে বাঘ হলেও মানুষের কোনও ক্ষতি করেনি কোনওদিন এবং সেকারনেই মানুষ তাদের সাবড়ে দিয়েছে চিরতরে। মুঘল শাসকদের আমলে চিতাবাঘ পোষা একটা ফ্যাশন ছিল। পুরোন পেইন্টিং-এ দেখা যায়, নবাবজাদী বা বেগমসাহেবার সিংহাসনের একদিকে বিশাল খড়্গ হাতে হাবসি খোজা, অন্যদিকে একটা বা একজোড়া চিতা সিংহাসনের পায়ার সঙ্গে সোনার শেকল দিয়ে বাঁধা।

    কিছু তার্কিক আছেন, তাঁরা সব শুনে বলেন, না না, আপনি যে প্রাণীর কথা বলছেন, সেটি চিতা, শুধু চিতা। আর চিতাবাঘ হল লেপার্ড, ও নাম ঠিকই আছে। তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেই ছোট্টবেলায় পড়া অ’য়ে অজগর আসছে তেড়ে থেকে একটু এগিয়ে –

    ঙ-য় চড়ে নাচে ব্যাঙ

    চিতাবাঘের সরু ঠ্যাঙ্‌

    লেপার্ডের ঠ্যাং কিন্তু যথেষ্ঠ মোটা। যাক সেই চিতা বা চিতাবাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ভারত থেকে। তার মুখ্য কারণ হল, সম্রাটদের ‘হান্টিং চিতা’ পোষার ব্যারাম। চিতা এমনিতে পোষ মানে, শিকারে নিয়ে গেলে হরিণ টরিণ ধরেও আনে কিন্তু তারা ক্যাপটিভ ব্রীডিং-এ অভ্যস্ত নয়, অর্থাৎ বন্দী অবস্থায় প্রজনন করেনা। তাই জঙ্গলের ভেতর থেকেই মায়ের কোল থেকে বাচ্চা ছিনিয়ে আনা হত পোষার জন্য। মা ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলে তাকে খতম। সম্রাট আকবরের অধীনেই এক হাজার শিকারি চিতা ছিল। শুধু তো সম্রাট নয়, বড় মানুষরা লাইন ধরে চিতা পুষছেন। মানুষের খোঁয়াড়ে হাজার হাজার চিতা, কিন্তু তারা তো প্রজনন করবেনা, তাই জঙ্গলে আকাল পড়ে গেল। তবু দুচারটে এদিক ওদিক লুকিয়ে ছিল। এবার রাজা বাদশা দের জায়গা নিল সাদা চামড়ার বাদশারা। বিলেতি সাহেবরা আবার ট্রফি হান্টিং খুব ভালবাসত। প্রায়ই দেশীয় রাজাদের বগলদাবা করে জঙ্গলে গিয়ে সম্বর, বারসিঙ্গা, বুনো মোষ টোষ মেরে এনে তার মুন্ডু টাঙিয়ে রাখত ঘরের সামনে। বাঘ মারার এলেম সকলের ছিলনা, কিন্তু চিতা? সে তো প্রায় নিরামিষ, হরিণের মতই। তাই মারো।

    ১৯৪৭ সালে সাহেবগুলো চলে গেল কিন্তু স্যুট টাই পরা কিছু দেশি সাহেব রেখে গেল এদেশের মাটিতে। তারা এদেশের রাজন্যবর্গ। সেই ১৯৪৭শেই সরগুজার মহারাজা, রামানুজ প্রসাদ সিংদেও তিনটে চিতাকে গুলি করেন মারেন বীরদর্পে। একটা ছবি নেটে খুঁজলে পাওয়া যায়, বরাহন্দনটি সেই তিনটি অসহায় চিতার পাশে সাহেবদের ফেলে যাওয়া টাই-স্যুট পরেই বিজয় দর্পে দাঁড়িয়ে। তারাই এদেশের শেষ তিনটি চিতাবাঘ। কিছুদিন অপেক্ষা করার পর ১৯৫২ সালে দেশ ‘চিতা-মুক্ত’ ঘোষনা করা হয়।

    বহুদিন চলে গেছে। এখন কিছু কিছু মানুষ আবার বন্যপ্রাণীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন, তাই ঠিক হল চিতা আবার এদেশে রি-ইন্ট্রোডিউস করা হবে। তা আমাদের দেশের চিতা তো এসিয়াটিক চিতা। তেমন চিতা পাওয়া যাবে কোথায়? সরকারি তরফে সলিউশন চট করে দেয়ার লোকের অভাব নেই, ঐ তো ইরান, ইরানে তো এসিয়াটিক চিতা আছে, ওখান থেকে আনা হোক। ইরান বলল, দেবনা ভাই। আমার সাকুল্যে কুড়িয়ে বাড়িয়ে মোটে একশোটা চিতা। এই সংখ্যাটা প্রায় বিলুপ্তরই সামিল। এর থেকে দেয়া যাবেনা।

    তখন কিছু পন্ডিত বলল, যাক গে দেবেনা তো দেবেনা। আমরা আফ্রিকা থেকে চিতা আনাব, ওখানে তো আর একশোটা নেই। কিন্তু এসিয়ায় আফ্রিকান চিতা? একটু গোঁজামিল হচ্ছেনা ব্যাপারটা? ওই যে বললাম, ভারতবর্ষে পন্ডিতের অভাব কোনওদিন ছিলওনা, থাকবেওনা। পন্ডিতরা বললেন, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। আফ্রিকান চিতা থেকে এসিয়ান তুতো ভাইরা সরে এসেছে মাত্র পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, এর মধ্যে জেনেটিক পরিবর্তন খুব একটা হয়না। তখন কয়েকজন বলল, তা কী করে হবে, আফ্রিকার সিংহ থেকে ভারতীয় সিংহ তো একেবারেই আলাদা। পন্ডিত বলল, হ্যাঁ ওদের সিংহ থেকে আমাদেরগুলো তো অনেক আগে আলাদা হয়েছে, কিন্তু চিতা হয়েছে পরে।

    তাই কখনও হয়? ভূখন্ড আলাদা হলে প্রাণীরা মোটামুটি এক সঙ্গেই তো ছড়িয়ে পড়ে। এবার যাঁরা সত্যি পন্ডিত, তাঁরা বললেন, না, চিতা আলাদা হয়েছে ন্যুনতম সাতষট্টি হাজার বছর আগে এবং এই সময় জেনেটিক পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ঠ। তা সে যাই হোক, ইরান যখন দেবেই না, আফ্রিকানই আসুক। সেই চিতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সারা ভারতে কয়েকটা জঙ্গল ঠিকও করা হয়ে গেল, যাতে খুব ঘন গাছপালা নেই। চিতা তো দৌড়ে শিকার ধরে, লেপার্ডের মত ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েনা। তাদের তো দৌড়নোর মত জায়গা দিতে হবে। সেই কয়েকটি মধ্যে একটি হল নওরাদেহি। সব ঠিকঠাক, কিন্তু একজন দিলেন সুপ্রীম কোর্টে মামলা ঠুকে।

    (চলবে)





    মোদী ভার্সাস চৌহান

    কেন হল সেই মামলা? সে এক জটিল থেকে জটিলতম ব্যাপার। আমাদের দেশে এককালে বহু রকম প্রাণী ছিল, যার মধ্যে বেশ কিছু হারিয়ে গিয়েছে। তবে অত সব প্রাণী ছেড়ে আমরা এখন বলব শুধু পশুরাজ সিংহের কথা। ভারতে একসময়ে এসিয়াটিক লায়ন নামে এক ধরণের সিংহ ছিল। শুধু ভারতে নয়, তখনকার পারস্য, মানে, এখনকার ইরান, এখনকার ইরাক, প্যালেস্টাইন, বালুচিস্তান, আফঘানিস্তান, সিন্ধ এবং ভারতের হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, গুজারাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, এমনকি শুনলে অবাক লাগে, বাংলাতেও সিংহ ছিল। যে নওরাদেহি নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করছি, সেখানেও সিংহ ছিল এককালে।

    তা সে সিংহ গুলো গেল কোথায়? যেভাবে চিতা গেছে, সেভাবেই গেল, না, ঠিক সেভাবে নয়। সিংহের বাচ্চা তো কেউ পুষবে বলে তুলে আনতনা। আবার আনতনা বললে একটু ভুলও হবে, আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমে আলজিরিয়া, মরক্কো আর টিউনিসিয়ার মধ্যে দিয়ে যে অ্যাটলাস পর্বতমালা চলে গেছে, তাতে বাস করত ‘বারবেরি লায়ন’ নামে এক সিংহ। তারাও শেষ, কিন্তু তাদের অবস্থা চিতাদের মত। মেরেও শেষ, আবার পুষেও শেষ। তাও বরং পোষা হত বলে কয়েকটা বিংশ শতকের মাঝামাঝিও বেঁচে ছিল।

    ফিরে আসি আমাদের দেশি সিংহ এসিয়াটিক লায়নের ব্যাপারে। বন্দুক আবিষ্কারের পর থেকেই জীব জন্তুকে গুলি করে মারা মানুষের একটা হিংস্রতম অভ্যাস। পৃথিবীর আর কোনও জন্তু খাদ্য, চারণভূমি, ও যৌনসঙ্গী রক্ষার কারণ ছাড়া অপর কোনও প্রাণীকে মারেনা। বরং আগ বাড়িয়ে দু একটা ক্ষেত্রে বাঁচানোর চেষ্টা করে, এমনও দেখা গেছে। একমাত্র মানুষ খেলাচ্ছলে পশুপাখি হত্যা করে। আমেরিকার প্যাসেঞ্জার পিজিয়ন নামে একটা বহুবর্ণ জঙলি পায়রা ছিল। তারা যখন ঝাঁক বেঁধে উড়ত, এক একটা ঝাঁক এক মাইল চওড়া ও তিন মাইল পর্যন্ত লম্বা হত। এই বিপুল সংখ্যাক পাখিদেরও শুধু খেলাচ্ছলেই মেরে শেষ করে দেয়া হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে।

    আমাদের দেশেই ছিল ‘পিঙ্ক হেডেড ডাক’ বা গোলাপি মাথা ওয়ালা হাঁস, পৃথিবীর একমাত্র পাখি যারা পিংপং বলের মত একেবারে গোল ডিম পাড়ত। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিও কোলকাতার তালতলা বাজারে পনের টাকা জোড়ায় বিক্রী হয়েছে। এত সব লজ্জার কথা লিখতেও কষ্ট হয়। সে যাক, সেই এসিয়াটিক লায়নও মেরে মেরে শেষ করে দেয়া হয়েছিল কিন্তু – ভাগ্যিস সেই বারবেরি লায়নের মত কেউ পুষত। পুষত মানে, ওদের মত খাঁচায় বা চেন দিয়ে বেঁধে নয়। আমাদের দেশের জুনাগড়ের রাজার একটি নিজস্ব মৃগয়ার জঙ্গল ছিল। তিনি আবার সব পশু মারতেন না, কিছুটা পশুপ্রেমিক তিনিও ছিলেন। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজ্যপাট যখন সরকারের হাতে, তখন আবিষ্কার হল, গুজারাটের জুনাগড়ে কয়েকটা এসিয়াটিক লায়ন বেঁচে আছে। জুনাগড় আবার তিনটে আছে, একটা উড়িষ্যায়, একটা রাজস্থানে, এটা গুজারাটে।

    আচ্ছা নওরাদেহি নিয়ে বলতে গিয়ে চলে এল চিতা, সেখান থেকে সিংহ, সেখান থেকে জুনাগড়। আমরা যাচ্ছি কোথায়? আসলে এই এসিয়াটিক লায়ন আর এসিয়াটিক চিতা, দুজনের সঙ্গেই নওরাদেহির খুব যোগাযোগ। ফিরে যাব সেই সুপ্রীম কোর্টের মামলায়, তার আগে একটু দেখে নিই সিংহ গুলো জুনাগড় থেকে বেরিয়ে এতদিন ছিল কোথায়। আসলে তারা সেখানেই ছিল। সেই যে সেই জুনাগড়ের রাজা, তাঁর মৃগয়ার জঙ্গলই এখনকার গির অভয়ারণ্য। তিনি একদিন খেয়াল করলেন, মাত্র পনেরটা সিংহ বেঁচে আছে। তিনিই তখন সিংহ মারার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। পরে ভারত সরকার তাদের খাইয়ে দাইয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে শেষ সুমারিতে ৪১১ তে পৌঁছে দিয়েছে।

    এবার হল ঝামেলা। প্রত্যেক প্রাণীর জন্য একটা নির্দিষ্ট টেরিটরি লাগে। গুরারাটের গির জঙ্গল এখন ওভার পপুলেটেড। ৪১১ সংখ্যাটা একটা জঙ্গলের পক্ষে একটু বেশিই। তাছাড়া ইনব্রীডিং অর্থাৎ অজাচারের ফলে বিকলাঙ্গ বা রোগগ্রস্ত বাচ্চা হতে পারে, ক্রমশঃ জাতিটা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই ঠিক হল, এদের মধ্যে কিছু সিংহ কে রিলোকেট করতে হবে। যেখানে যেখানে তাদের আবার পাঠানো হবে সেই মাত্র কয়েকটি জঙ্গলের মধ্যে আছে নওরাদেহি। এইবার মঞ্চে প্রবেশ আর এক পুরুষ সিংহ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর। তিনি বললেন, দেবনা, যা পারো করে নাও। আরে! দাদাগিরি নাকি? দেবনা মানে?

    শুরু হয়ে গেল সেম সাইডের লড়াই, আদালতে মোদী ভার্সাস চৌহান এবং যেহেতু দুজনেরই মূল উদ্দেশ্য ট্যুরিজম থেকে আমদানি, তাই ট্রন্সলোকেশনের বিপক্ষের আসল আর্গুমেন্টটা মোদীর পেয়াদা বন দপ্তরের আধিকারিকরা কোর্টে বলতেই পারলেন না। সেটা হল, সিংহ কে ট্রান্সলোকেট করার চেয়ে তাদের নিজেদের ছড়িয়ে পড়াই শ্রেয় এবং অ্যাকচুয়ালি তাই ঘটেছে। মাত্র ১৪১২ কিমি-র গিরের জঙ্গল থেকে তারা নিজেরাই এখন ১০৫০০ কিলোমিটার ব্যাপি আমরেলি, সাভারকুন্ডলা, পোরবন্দর, মিতিয়ালা, ছারা, বাবারিয়া, কোদিনার, ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। আর মধ্যপ্রদেশ? যারা নিজেকে টাইগার কান্ট্রি বলে কাগজে বিজ্ঞাপণ দিত ট্যুরিজমের খাতিরে, তারা গত দশ বছরে ৭০০ বাঘের মধ্যে ৪৫০-ই মেরে ফেলেছে, এত তাদের দেশে বন্দুকবাজ। তারা সিংহ কে যে জামাই আদর করে রাখবে এমন গ্যারান্টী কে দেবে?

    তা তো হল, কিন্তু চিতার কী হল, আর নওরাদেহি ? আসলে ব্যাপারটা গোলমেলে। সেই সে সিংহ নিয়ে বিতন্ডা, তাতে খচে গিয়ে মধ্যপ্রদেশ সরকার এখন বলছে, সিংহ দেবেনা তো চিতাও নেবনা। কিন্তু তেমন করে তো বলা যায়না, তাই বলছে নওরাদেহির মধ্যে অতগুলো গ্রাম রয়েছে, সেগুলোকে সরিয়ে তাদের অন্য বাসস্থানের সংস্থান করতে লাগবে ২০০ কোটি আর চিতারা এলে তাদের প্রথমে এনক্লোজারে রাখতে হবে, পরে বাইরে ছাড়া হবে। সেই এনক্লোজার বানাতে লাগবে ৫০ কোটি। এই আড়াইশো কোটি আমরা দিতে পারবনা, দিলে সেন্টার দিক।

    ওদিকে অন্য একটা অভয়ারণ্যে ( কুনো পালপুর) সিংহের জন্য খরাচাপাতি করা শুরু হয়ে গেছিল। এবার সেখানেও চিতা আসার কথা। সিংহ দেবেনা, তবে এত খরচা করে ফেল্লুম যে? চিতাও নেবনা তাইলে। এতেই থেমে থাকেনি তারা, এক এনজিও কে দিয়ে ঠুকে দিয়েছে আর এক মামলা। এই যে আফ্রিকান চিতা আনা হচ্ছে, তা ভারতের সর্বোচ্চ বন্যপ্রাণী সংস্থাকে জানানো হয়েছে? তারা কি বলেছে, অন্য জেনেটিক মেক-আপ এর চিতা চলবে এদেশে? এই রকম হাজার ফ্যাচাং। আবার ইরানের কাছ থেকে মোটে এক জোড়া এসিয়াটিক চিতা চাওয়া হল,বলা হল, আমরা ক্লোন টোন করে নেব। তারা বলল, তবে একজোড়া এসিয়াটিক সিংহ দাও। এঁরা তা দেবেন না। তবে তারাই বা দেবে কেন?

    মোটমাট গল্প হল এই, যে ট্রান্সলোকেশন, সে সিংহই হোক বা চিতা এখন সাত হাত জলের তলায়। মামলাবাজ ভারতবর্ষে সাধারণ মামলাই কুড়ি বছর লাগে। নওরাদেহি ক্যারাকাল স্যাংচুয়ারি এখন। তবে নির্মলাদেবী বললেন, আপনি অন্য কোনও জন্তু একটা দুটো দেখতে পেলেও ক্যারাকাল পাবেন না একটাও, এটা নিশ্চিত।

    (চলবে)




    ‘আমি সরকারি কর্মচারি
    আমি সরকারি কর্মচারি’...।

    - নচিকেতা

    অভয়ারণ্যের গেটের কাছে আসতেই দূর থেকে জটিয়া সাহেবের অ্যাম্বার বাতি দেখেই একজন খাকি উর্দি দৌড়ে এল। এরা যখন সরকারি অফিসার দেখে তখন মেদিনী কাঁপিয়ে স্যাল্যুট ঠোকে, এও ঠুকল। পুরো হিন্দী বলয় জুড়েই সরকারি আদমীদের দাপট খুব। আমি যে সংস্থায় কাজ করতাম, সরকারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিলনা সে সময়ে। আমার অবসর গ্রহণের বছর তিনেক পরে কাগজে পড়লাম সরকার আমাদের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হয়েছে, অতএব এখন বলা যেতে পারে। কিন্তু সেই কতকাল আগেই খুব মজা লাগত একটা জিনিষ দেখে।

    আগেকার দিনে বাঙালি খেতে না পেলেও চাপরাশি বা ফরাসের কাজ করতনা। মুটে, মজু্র‌, রিক্সাওয়ালাও কোলকাতায় যা ছিল, সবাই বিহারী বা উত্তরপ্রদেশের। এবার জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও পূর্ববঙ্গ থেকে লাগাতার উদ্বাস্তু আসায়, ক্রমে ক্রমে বাঙালি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী দেখা যেতে লাগল। তাদের সিংহভাগই পুব বাংলা থেকে আগত। যেহেতু বাঙালি একটা ফলস ডিগ্‌নিটিতে চিরকাল ভোগে, তাই এই বাঙালি চতুর্থ শ্রেনীর কর্মীরা প্রায় কেউই সংস্থা থেকে দেয়া ইউনিফর্ম পরতেন না। তাই নিয়ে শোকজ করে, ইউনিয়নের সঙ্গে ঝামেলা করে, দুদিন গায়ে চাপাতে পারলেও তারপর আবার যে কে সেই। পাড়ায়, লোকাল ট্রেনের সহযাত্রীদের বা কুটুমবাড়িতে পরিচয় দিতেন করনিক হিসেবে। সেই ট্র্যাডিশনটা সম্ভবতঃ এখনও চলছে। ওদিকে সেই বিহারী বা ইউপিয়ানরা ইউনিফর্ম তো পরবেনই, তাদের কাচা, ইস্তিরি করা, জেল্লা বাড়ানোর হরেক প্রক্রিয়া তাঁরা পালন করতেন ও দেশে যাবার সময়ে ইনভেরিয়েবলি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। যে কজন বিহারী করনিক ছিলেন, তাঁরাও দুঃখ করতেন, তাঁদেরও ইউনিফর্ম নেই বলে। দেশে গেলে ‘সরকারি করমচারি’-র খাতিরই আলাদা। আর ইউনিফর্মটা পৈতের মত, চেনা অচেনা সব বামুনের এক ওজন।

    সেবার উনিশশো চুরাশি সাল, অক্টোবরের শেষ। নৈনিতালে বেড়াচ্ছি সস্ত্রীক ও স-ছ্যানা আমি, সঙ্গে ভ্রাতৃপ্রতীম নোটন ও তার বৌ বুড়ি। উঠেছিলাম টিফিন টপে। অতখানি ওঠা নামা, ফেরার সময়ে খুব খিদে পেয়েছে, বিশেষ করে ছ্যানাটা কাঁদছিল। যাক নেমে এসেছি, এখন কোনও একটা দোকানে ঢুকে – কী ব্যাপার? সব বন্ধ কেন? এখানেও কি কোলকাতার মত দুমদাম বন্ধ ডাকে নাকি? দেখি মোড়ের মাথায় এক মুমফলিওয়ালা। নোটন বলল, চলুন বাদামই খাই আর কিছু যখন নেই। আমি বললাম, তা তো খাব কিন্তু ছ্যানাটা কি বাদামে কান্না থামাবে? চল দেখি। বাদামওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ভাই? সে বলল, আপলোগ জানতে নহীঁ? ইন্দিরা গান্ধীকো কিসিনে গোলি মার দিয়া। আপলোগ জলদি ভাগিয়ে, ম্যায় ভি যাতা হুঁ।

    হোটেলে পৌঁছতে তারা বলল, আপনারা রাতের খাবার খেতে চাইলে এক্ষুনি খেয়ে নিন। আমরা কিচেন বন্ধ করে দিচ্ছি, না হলে ঝামেলা হবে। আমরা বললাম এই বিকেল ছ’টায় রাতের খাবার? তারা বলল, কিচ্ছু করার নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম, যে হোটেলে আমরা আছি, সেই হোটেলেই ইন্দিরাজীর বাবাকে এডুইনা মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে বিছানায় কেলো করতে দেখে ফেলেছিলেন বালক রুসি মোদি। তাঁর মেময়ার্সে লিখেছেনও সেকথা। তাঁরই মেয়ে গুলি খেয়েছেন বলে আমরা সেই হোটেলেই বন্দী। পৃথিবীটা গোল বটে। কোন ঘরে ছিলেন তাঁরা, এই ঘরেই নয়তো? তখনো জানিনা যে মিসেস গান্ধী মারা গেছেন।

    নোটন বলল, এখানে থাকা যাবেনা, চলুন কাল জঙ্গলে পালাই। শোনা গেল শিখ ড্রাইভারদের গাড়ি বা ট্রাক থেকে নামিয়ে দুটো হাত কেটে পথের ধারে ফেলে দেয়া হচ্ছে। শহরে সব শিখদেরই বড় বড় দোকান, সেগুলো সমস্ত লুঠ হয়ে গেছে। খবর পেলাম আমাদের সংস্থারই কোলকাতার দুই বাঙালি কর্মী এবং দুজনেই উচ্চবর্ণের, ভদ্র(?)সন্তান, দুহাতে শিখদের দোকান থেকে লুঠের মাল নিয়ে পালাচ্ছেন দেখা গেছে। তার মধ্যে বেয়াল্লিশ ছাতির সোয়েটার, মেয়েদের ব্রা, শিশুদের চাড্ডি, সবই ছিল। দুহাতে জাপটে নিয়েছেন তো, বাছাবাছির সুযোগ ছিলনা। একই সংস্থা ও এক শহরের লোক বলে, লজ্জায় মাথাটা কাটা যাবার আগেই পালাই এখান থেকে।

    একটা গাড়ি ঠিক করা হ’ল। ড্রাইভার স্বভাবতই কুমায়ুনের। শিখ তো পাওয়া যাবেনা। ভদ্রলোকের নাম দেভী দত্‌, ষাট বছরের সিনিয়র সিটিজেন। এক ছেলে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, অন্যজন চাকুরিরত এঞ্জিনীয়র। তারা বাবাকে দেখেনা, তাও না। তবু ইনি ড্রাইভারি করেন অভ্যেসে। তিনি নিয়ে গেলেন রাম নগরে। সেখানে আর এক বিপদ। আমার তখন শশ্রুগুম্ফ শোভিত মুখমন্ডল। তিন জায়গায় তাড়া খেলাম। এক জায়গায় তো লিঞ্চড হতে হতে বেঁচে গেলাম বৌয়ের মাথায় সিঁদুরের জন্য। সে সময়ে সাস-বহু সিরিয়াল ছিলনা বলে গোটা ভারতবর্ষে বাঙালি ছাড়া কেউ সিঁদুর পরতনা। শুধু বিহারিরা কমলা রঙের মেটে সিঁদুর পরত। শুনলাম এ এলাকায় ‘হিন্দুরা’ কেউ দাড়ি রাখেনা, শুধু মুসলিমরা রাখে, তবে তাদের দাড়িগোঁফ অন্যরকম। এমন দাড়ি শুধু শিখদেরই হয়, অতএব সাবধান। নোটন বলল চলুন, নাপিতের দোকানে গিয়ে কেটে আসবেন। দেভীদত্‌জী বললেন খবরদার,এখন শিখরা দলে দলে গিয়ে দাড়ি কাটাচ্ছে। ওতে আরও সন্দেহ বাড়বে।

    কোনও রকমে রামনগর থেকে সবজি, তেল, মশলা এসব কিনে গাড়ির ডিকিতে ভরে, প্রজেক্ট টাইগারের অফিসে গেছি। ফরেস্ট অফিসার তিরিক্ষে মেজাজে বললেন, কেয়া চাহিয়ে অ্যাঁয় ? আমি বললাম, বললাম মানে, অমন ধমক খাবার পর একটু আমতা আমতা করেই, আসলমে হমলোগোঁকো জঙ্গল যানা হ্যায়। তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। জঙ্গল যানা হ্যায়? কিঁউ, কেয়া রখ্‌খা হ্যায় জঙ্গলমেঁ অ্যাঁয়? ইয়ে কোই জু নহী হ্যায় কি শের ঘুমতে হ্যাঁয় পিঞ্জরেকে অন্দর। যাও যাও বিউয়ি বচ্চে লেকর নৈনিতাল যাও, ঘুমকে ঘর ওয়াপস যাও। বললাম, হমলোগ ওয়াহিঁসে আ রহেঁ হ্যাঁয়। তিনি চুপ। বললাম দেখিয়ে – তিনি বললেন, দেখো মেরা ওয়ক্ত বরবাদ মত করো। বোলানা জঙ্গল মঙ্গল যানেকা পারমিসন(মিশন) নহী? লোকটা লাগাতার তুমি তুমি বলে যাচ্ছে, কান গরম হচ্ছে, কিন্তু হাত পা বাঁধা। তার ওপর একগাল দাড়ি, শালা শিখ বলে চ্যাঁচালে আমি নেই।

    তবু দাঁড়িয়ে আছি দেখে বলল আভি ভি খড়ে হো? কেয়া করোগে জঙ্গল যাকে? কেয়া কাম করতে হো? আমি পকেট থেকে আইডি কার্ডটা বের করলাম। সে সময়ে ল্যামিনেটেড কার্ড ফার্ড ছিলনা, একটা লাল রেক্সিনে মোড়া পিচবোর্ডের ছোট্ট বইয়ের মত থাকত আইডি কার্ডগুলো। সেটা দেখেই লোকটা সটান দাঁড়িয়ে উঠল, স্যালুট করেনি তবে হাতটা মাথার কাছে নিয়ে গেল, আরে সার, আপ সেন্ট্রাল গভমেন্ট অফসর হ্যাঁয় ইয়ে পহলে বোলনা থা। ব্যায়ঠিয়ে ব্যায়ঠিয়ে, দেভিজী আপ ভি ব্যায়ঠিয়ে ( এই দেভিজী আমার বৌ, গাড়ির চালক নন)। আরে ভাইসাব(নোটনকে) আপলোগ ভি ব্যায়ঠিয়ে। আমি বললাম দেখিয়ে হমলোগ সরকারি অফসর নহী হ্যাঁয়। হমসে সেন্ট্রাল গভমেন্টকা কোই লেনা দেনা নহী।

    (চলবে)





    সব বকওয়াস

    ভদ্রলোক বললেন, আরে ছাড়ুন না সার, সব বুঝেছি। একটু চা বলি? ঠান্ডা খাবেন না গরম? আমি বললাম, না না কিচ্ছু লাগবেনা, দয়া করে আমাদের একটা ফরেস্ট বাংলো ব্যবস্থা করে দিন, সেই জন্যেই এখানে আসা।

    ফরেস্ট অফিসার বললেন, আপনারা নিশ্চয় করবেট ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে যাবেন না? আমি বললাম, ঢিকালা? না মশাই, যেখানে ট্যুরিস্টরা ভিড় করে সেখানে না। একটু নিরিবিলি চাইছিলাম। আমরা বাঘ দেখতে আসিনি, জঙ্গল দেখতে এসেছি। উনি বললেন, সে আমি বিলক্ষণ বুঝেছি। শুনুন তবে, জঙ্গলে ওই ঢিকালা ট্যুরিস্ট এনক্লোসার ছাড়াও আমাদের ছটা বাংলো আছে। আপনাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হল মালানি। গেলে আপনার দিল খুশ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার অ্যাডভাইস যদি নেন, ওখানে যাবেন না। সঙ্গে মহিলারা আছেন, জায়গাটা ভাল না। ডাকাতি টাকাতি হয় আর ডাকাতগুলোও ভালনা, মানে, শুধু ডাকাতি করেই ক্ষান্ত হয়না। আপনি নিশ্চয় বুঝেছেন কী বলতে চাইছি। আমি আপনাদের জন্য বেছে রেখেছি গর্জিয়া। এটাও খারাপ না, পেছন থেকে দেভিজী বললেন, না, এটাও একদমই খারাপ না। তবে আসুন সার এইখানে সই করুন, বলে একটা জাবদা খাতা বাড়িয়ে দিলেন।

    খাতায় নাম ঠিকানা ইত্যাদি নানা হিজিবিজি লেখায় চোখ বুলিয়ে একদম ডান দিকে সই করতে গিয়ে ঠিক আগের কলামে টাকার অঙ্কে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম, একি? তিন টাকা? কী লিখেছেন এখানে? ফরেস্ট অফিসার একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ সার, যা দেখছেন, ঠিকই তো। সেন্ট্রাল গভ্‌মেন্ট অফিসারদের এটাই তো রেট। আমি বললাম, কি মুশকিল আমি তো বলছি আমরা সেন্ট্রাল গভ্‌মেন্ট অফিসার না, গভ্‌মেনটের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। উনি আবার হাসেন, কেন যে সার মজাক করছেন, না হয় প্রথম দিকে একটু উল্টাসিধা বলেই ফেলেছি। মানুষের কি ভুল হয়না? যান আর বেলা করবেন না, দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছতে হবে। আমি তাঁকে বোঝাতে অসমর্থ হয়ে বললাম, কিন্তু যদি তিনটাকাই প্রতিদিন হয়, আমরা তো তিনদিন থাকব। তাহলে ন’টাকা লিখুন অন্ততঃ। উনি বললেন, তিন কেন, সাত দিন থেকে যান না পছন্দ হলে, কে দেখতে যাচ্ছে। বলে খাতা মুড়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিলেন।

    গর্জিয়ার বাংলোতেও কিছু লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল। লিখতে লোভও হচ্ছে, কিন্তু আমরা মধ্যপ্রদেশে আছি, উত্তরপ্রদেশে না। এখন তো সেটা আবার উত্তরাখন্ড। আমরা মধ্যপ্রদেশেই ফিরে যাই। শুধু সরকারি অফিসারদের ওপর যে ভয়ানক দুর্বলতা সমগ্র উত্তর বা মধ্য ভারতে, সেটাই বলতে বলে ফেললাম এই সব কাহিনী।

    জটিয়াজীর অ্যাম্বার বাতি(যেটা কখনই জ্বলেনা) লাগানো গাড়ি দেখে দৌড়ে এল একজন। যথারীতি লম্বা স্যাল্যুট। ফরেস্ট গার্ডই হবে বোধহয়। জগদীশজী বললেন, শাহিদ মিঞাঁ, একে পেছনে তুলে নাও। নির্মলাদেবী বললেন, ওঃ আবার সেই লোকটা? দূর থেকে আবছা কিছু দেখিয়ে বলবে, ওই যে সার বারসিঙ্গা, ওই যে সার সম্বর কিংবা নীলগাই। আর কিছু তো জীবনে দেখাতে পারেনি। কিছু সত্যি আছে কিনা কে জানে। সব বকওয়াস হ্যায়। জগদীশজী মুচকি হেসে বললেন, তা অবশ্য ঠিকই বলেছ, তবে আমরা তো আর জানোয়ার দেখতে আসিনি, পাখির খোঁজ পেলেই হল।

    আসলে জায়গাটা সত্যি অনেক দূর। তাছাড়া আমরা সকালে সার্কিট হাউসের পেছনে মনোহরজীর সঙ্গে পাখির খোঁজে অনেকটাই সময় দিয়ে ফেলেছি। এখন বেলা চড়ে গেছে। যাঁদের জঙ্গলে ঘোরা অভ্যাস আছে, তারা জানবেন, এই সময়ে পাখি হোক বা জানোয়ার, দেখতে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। ওদের বাইরে আসার সময় হল, সকাল সাতটা থেকে ন’টা। আবার বিকেল তিনটে থেকে চারটে। লোকটা অবশ্য ঠিকই যথারীতি, উওহ দেখিয়ে সার বারসিঙ্গা, উওহ দেখিয়ে সার নীলগায় বলে চেঁচিয়ে উঠল। এবং আবছা নয়, স্পষ্টই তাদের দেখা গেল দৌড়ে পালাতে। এখানেও একটা মজা আছে, যে সব জঙ্গলে ট্যুরিস্ট ফ্লো খুব বেশি, সেখানে এরা এত দৌড়ো দৌড়ি করেনা, পালাওনা। একবার বন্দিপুরের জঙ্গলে রাত্রিবেলা দরজায় খটখট। খুলে দেখি কেয়ারটেকার মিস্টার রামস্বামী। তিনি বললেন, ইউ ওয়ান্ট টু সী সামথিং? কাম উইথ মি। ডু নট টক, ব্রীদ ভেরি লাইটলি, বিকজ ইভন দা সাউন্ড অফ ব্রীদিং মে ফ্রাইটেন দেম। বেরিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় হাজার হাজার চিতল হরিণ। সে দৃশ্য ভোলবার নয়। আমি ফিসফিস বললাম, এরা তো জানে এখানে, এই বাংলোয় মানুষ থাকে। তো এত কাছে চলে এসেছে কেন? রামস্বামী বললেন, জঙ্গলে ঢোল অর্থাৎ জংলি কুত্তা এদের তাড়া করে এই সময়ে। এরা প্রাণে বাঁচতে বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ে। কুত্তারা যখন এদের খায়, সে আপনি চোখে দেখতে পারবেননা, এত বীভৎস সেই দৃশ্য। এরা বাঘের মতন ঘাড় মটকে মেরে খায়না, একটা হরিণ যখন অর্ধেকের বেশি খাওয়া হয়ে গেছে, তখনও সে জীবিত। আমি বললাম, বলেন কি? উনি বললেন, হ্যাঁ, সেই জন্যেই এরা মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। এরা কয়েক পুরুষ ধরে মানুষ দেখে দেখে বুঝে গেছে, এই প্রাণীগুলো বড়জোর ছবি তুলবে, আর কিছু করবেনা। একবার রেঞ্জার সাহেব রাতে বেরিয়েছিলেন, ওঁর সামনেই কুত্তাগুলো একটা হরিণকে খাচ্ছিল। সেই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে উনি তৎক্ষণাৎ তিনটে কুকুরকে গুলি করে মারেন। দেখুন জঙ্গলে এক পশু আর এক পশুকে খাবে এটাই নিয়ম। আর তাদের গুলি করা বাইরের পোচার দের পক্ষে তো বটেই, জঙ্গলের হেফাজতকারীদের পক্ষে তো আরোই বেআইনি। তা সত্বেও সাহেব গুলি করলেন। আমি বললাম, তবে? ওনার শাস্তি হলনা? রামস্বামী হেসে বললেন, সার, জঙ্গলে কে কাকে গুলি করছে, বাইরে সে খবর যায়? এ বড় অদ্ভুত জায়গা সার। এই শুনে আমার আবার অন্য দুটো গল্প মনে পড়ে গেল।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৮ মার্চ ২০১৪ | ২৫৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Prabir | ***:*** | ১৯ মার্চ ২০১৪ ০৭:৪৬73777
  • রীতিমাফিক সুখপাঠ্য, কিন্তু বড্ড-ই কম কম, এক নিশ্বাসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে যেন !
  • de | ***:*** | ১৯ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫৪73778
  • তাড়াতাড়ি পরের পর্ব আসুক। খুব ভালো হচ্ছে।
  • b | ***:*** | ২০ মার্চ ২০১৪ ০৯:৩৭73779
  • এরকম হোমিওপ্যাথিক ডোজে বিরিয়ানি খাইয়ে কি ভালো কাজ করছেন, রূপঙ্করবাবু?
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ২২ মার্চ ২০১৪ ০১:৫৭73780
  • ামি এখন আসামী ( না পান নয়) আসামে এসেছি। তবুও চেষ্টা করছি দেয়ার।
  • Rupankar Sarkar | ***:*** | ২২ মার্চ ২০১৪ ০২:৩১73781
  • তাড়াহুড়োয় পর্ব ১৪ ও ১৫ উল্টে গেছে। ১৪ পড়ে তারপর ১৫য় যেতে হবে। আমি বাইরে আছি, কোলকাতায় ফিরে আবার পোস্ট করব।
  • kumu | ***:*** | ২৯ মার্চ ২০১৪ ০৮:৪৮73782
  • সুখলালের রান্নার জন্য বসে আছিতো।
  • Rupankar Sarkar | ***:*** | ৩০ মার্চ ২০১৪ ০৪:০৭73783
  • ওহ্‌ সে রান্না যেন শত্রুকেও খেতে না হয়। আসলে সে রান্নাকে ভূতরাও ভয় পেত বলেই 'অনাথবাবু' না হয়ে ফিরে এলাম এ যাত্রায়। :)
  • | ***:*** | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৭73785
  • ভুতের চেয়ে এই ছবির গল্পটা বেশী ইন্টারেস্টিং।
  • aranya | ***:*** | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:৪৫73784
  • উপভোগ্য লেখা
  • de | ***:*** | ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২৯73787
  • তারপর? বসে আছি পড়বো বলে!
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৮:৪১73786
  • ঠিক সময়ে পরের পর্ব না আসায় যাঁরা রেগে যাচ্ছেন, তাঁদের বলি, সব সময়ে অ্যাড করার চিহ্নটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যেমন, আজ সকাল থেকেই নেই। অতএব যতক্ষণ না সে ফিরে আসছে, আমি পরবর্তী লেখাগুলো দিতে অক্ষম।
  • Rupankar Sarkar | ***:*** | ১১ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৪০73788
  • de , - আজ অনেক চেষ্টার পর পারা গেল, তাও মলাটের ছবিটা গেলনা।
  • শিবাংশু | ***:*** | ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৩৮73789
  • রীতিমতো মৌতাত এসে গেছে, এক ভবঘুরের গপ্পো পড়ে আরেক ভবঘুরের....

    অপেক্ষায় আছি.....
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন