এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আচাভূয়া উড়াপাক

    অভিষেক ভট্টাচার্য্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ | ১৪৯৫ বার পঠিত
  • “ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
    শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ।
    বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
    জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বদী।
    আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
    আণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি।
    কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
    ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত।
    ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপজ্ঞে প্রকট —
    সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং টিং ছট্‌।।”

    - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    ওঁ স্বস্তি। এথে কলিযুগস্য পঞ্চসহস্র একশতবিংশতিবর্ষ গতে অথ চতুর্দ্দশশত চতুর্বিংশতি সংবৎসরে চতুরুদধিসলিলবীচিমেখলানিলীনসদ্বীপগিরিপত্তনবতী বসুন্ধরানিধি পূর্ব্বাচলোদিত দিবাকরতুল্য শ্রীশ্রী বঙ্গদেবস্য শ্রীপাদপদ্মে যথাযোগ্য সম্মানপূর্ব্বক নিবেদনমিদং। পিতৃপুরুষগণকে প্রণাম করি। ভূলোক-ভূবর্লোকাদি ঊর্দ্ধতর সকল লোকে সাকারে ও নিরাকারে যাবৎ যেখানে যাঁহারা অবস্থান করিতেছেন তাবৎ তাঁহাদিগের সকলকে নমস্কার করি। অনাদি মহাসত্যস্বরূপ পরমব্রহ্ম হইতে মনুষ্যপশুমেষাদি কীটাণু প্রভৃতি চৌরাশি লক্ষ যোনি ও ঐ জীবলোকাৎ ভূর্লোকাদি সত্যলোক পর্য্যন্ত ঊর্দ্ধতন সপ্তলোক অতলাদি পাতাল অধঃস্তন সপ্তলোকরূপ নিবাসস্থানের ও অমৃত যব ব্রীহি তৃণাদিরূপ তাবদ্ভোগ্যবস্তু সকলের স্ব-স্ব কর্ম্মানুসারে স্বর্গ নরক বন্ধ মোক্ষ ব্যবস্থার কল্প মন্বন্তর চতুর্যুগাদিরূপ কালবিভাগের অনন্তভাণ্ডস্বরূপ মায়াপ্রপঞ্চময় মহাবিশ্বকাণ্ড নিয়ত চলিতেছে। বর্ত্তমান পিতৃকল্পাদি ত্রিংশৎ কল্পের মধ্যে ঘটীযন্ত্রের ন্যায় কালচক্রের ভ্রমণবশতঃ শ্বেতবরাহ কল্প যাইতেছে। এক এক কল্পেতে চতুর্দ্দশ মনু হয়। তাহাতে শ্বেতবরাহ কল্পেতে বৈবস্বত নামে সপ্তম মনু যাইতেছেন। এক এক মনুতে দুইশত চৌরাশি মহাযুগ হয়। তাহাতে বৈবস্বত মনুতে একশত বারো মহাযুগের এই কলিযুগ যাইতেছে। ইহার পরিমাণ চারিলক্ষ বত্রিশ হাজার বৎসর। ইহার মধ্যে পাঁচ হাজার একশত বিশ বৎসর অতীত হইয়াছে ও উপস্থিত চারিলক্ষ ছাব্বিশ হাজার অষ্টাশি শত বৎসর বর্ত্তমান আছে। আকাশ বায়ু তেজো বারি ভূমি এই পঞ্চভূতের মধ্যে পৃথিবীর আট আনা ও অন্য অন্য আকাশাদি চারিভূতের দুই দুই আনা। এই সমুদয় ষোলআনাতে মিশ্রিত চন্দ্র সূর্য্য বুধ শুক্র মঙ্গল বৃহস্পতি শনি এই সপ্তগ্রহের সপ্তকক্ষতে ও উপরিভাগে নক্ষত্রমণ্ডলাদি আবৃত পাঞ্চভৌতিক এই ভূমিপিণ্ড কেবল শূন্যের উপরে আছেন। ইঁহার উপরে অধেতে ও পার্শ্বেতে সর্ব্বত্র দেব মনুষ্য দানব দৈত্য পশুপক্ষী কিন্নর যক্ষাদি ও পর্ব্বত গ্রাম নগরী বনাদি সকল কদম্বকুসুমের গ্রন্থির ন্যায় খোদিত আছে। এই সপ্তসাগরা পৃথিবীর উপরে অবস্থিত কলিকাতা নগরীর কথা ইহজন্মে যাহা দেখিয়াছি তাহা গৌড়ীয় ভাষাতে লিখি।

    সুকৃৎকর্ম্মফলহেতুঃ সত্যতপোময়মূর্ত্তিল্লোক। পূর্ব্বকৃতোধর্ম্মেণানু পালনীয় ইতি মত্বাভবদ্ভিঃ। সহস্রাণি স্বর্গেতিষ্ঠতি ভূমিদঃ। আক্ষেপ্তাচানুমন্তাচ তান্যেব নরকে বসেৎ।।

    * * *

    পূর্ব্বে কলিকাতার প্রায় প্রত্যেক পাড়াতেই দুই-একটি করিয়া পাগল থাকিত। তাহাদিগকে খেপাইলে তাহারা তাড়া করিত। আজিকাল কলিকাতা কল্লোলিনী কর্পোরেটি হইয়াছে। গলায় টেগ ঝুলাইয়া সে চাকুরি করিতে যায় এবং লেড়লেড়ে পিজ্জা খায়। গুমটি ভাঙ্গিয়া বহুতল উঠিয়াছে। এখন বায়স্কোপে-উপন্যাসে নিউ-ইয়র্ক হইতে সুগন্ধি প্রেমিকার মোবয়েল ফোঙে ‘অনি, এবারেও পুজোয় আসতে পারব না রে!’ প্রভৃতি ঢেমনামির যুগ। এ যুগে সকলে শান্ত হইয়াছে। সোভিয়েট্ উ্যুনিয়ন কলাপ্স্ করিয়াছে। বিশ্ব জুড়িয়া বিশ্বায়নের খোলা বাজার। আর কেহ নাই যে কড়কাবে। রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে। কানামাছি ভোঁ ভোঁ। যাকে পাবি তাকে ছোঁ।

    আমার বাল্যবয়সে পাড়ায় খোঁড়া হারুপাগলা রাস্তায় ঘুরঘুর করিত। তাহার জামাকাপড়ের ঠিক ছিল না। এদিক দিয়া নুনু দেখা যাইত তো ওদিক দিয়া পোঁদ। পাড়ার ফচকে ছোঁড়ারা তাহাকে রোজ ল্যাংটোচোদা বলিয়া খেপাইত ও পিছন হইতে ছেঁড়া লুঙ্গি ধরিয়া টানিত। হারু রাস্তার ধারে খাইতে খাইতে এলমিনিয়মের সানকির সাদা ভাত ফেলিয়া পাশ হইতে আধলা ইঁট তুলিয়া 'হারামজাদা, গুদমারানির ব্যাটারা, তোদের মাকে চুদি! মুকে মুতে দোব শালা খানকির বাচ্চারা!' বলিয়া চীৎকার করিয়া নেংচাইতে নেংচাইতে তাহাদিগকে তাড়া করিত। ছেলের দল প্রবল উল্লাসে কিয়দ্দূরে পলাইত ও হারু ফিরিলে আবার আসিয়া লুঙ্গি টানিত। হিহিহিহি। সেইসব সুখের দিন কোথায় চলিয়া গিয়াছে। এখন কোথাও কোনো সত্যকার পাগল দেখা যায় না। কেহ কাহারও মুকে মোতে না।

    বাল্যকালে কত কিছু দেখিতাম। দিন বদল করিতে গিয়া সন্ধ্যাবেলা মোড়ের লাইটপোস্টের আলোর তলায় পুলিশের গুলি খাইয়া হাত-পা ছড়াইয়া নিথর হইয়া পড়িয়াছিল বছর বাইশের নকশালপন্থী যুবক সমর মিত্রের লাশ। পার্শ্বস্থ দেওয়ালের গাত্রে ড্রেনের হাতপাঁচেক উপরে লালকালিতে কাহারা যেন লিখিয়া গিয়াছিল - ‘পুলিশের কুত্তা দেবী রায় হুঁশিয়ার - CPI(M.L.)’. থমথমে গলির মুখে টিম্ টিম্ করিয়া লাইটপোস্টের হলদে ডুম জ্বলিতেছিল। বড়রাস্তার দিকে দূরে মিলাইয়া যাইতেছিল ভ্যানের শব্দ। ডুমের আলো বহুকাল হইল নিভিয়া গিয়াছে। ধননাদাদা, বড়িলাল নাই। পিউ কাঁহা নাই। শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র বসুর চক্ষুদ্বয় প্রায় সর্বক্ষণ মুদ্রিত থাকিত বলিয়া সকলে তাঁহাকে আঁজুবাবু বলিত। তিনিও নাই। বাড়ি, ফ্লেট উঠিল। স্বপ্নের নতুন ঠিকানা। এগরোল, চিলি ফিশ, চিকেন চাউ উইথ একস্ট্রা গ্রেভি। আজিকাল ঐ সকল ফ্লেটবাড়ির দোতলা, তিনতলা হইতে গৃহবধূগণ সকালে দড়িতে বাঁধিয়া বাজারের ব্যাগ নিচে ঝুলাইয়া দেয়। খবরের কাগজ, মাদার ডেয়ারি, ডিম ওতে চড়িয়া দুলিতে দুলিতে উপরে উঠিয়া যায়। তাহাতে অণ্ডেণ অণ্ডফ্রয়েণ হয়। সমর মিত্রের আত্মা নিচে রাস্তায় ঘুরঘুর করে। যদি কোনোদিন সুবিধা পাইয়া কোনো বাজারের ব্যাগে চড়িয়া কোনো ফ্লেটের দোতলা, তিনতলায় উঠিয়া যায়? আমি প্রায়ই এ কথা ভাবি। লাইটপোস্টের ওখানে কেবল্ টিভির দোকান হইয়াছে। দেওয়ালে টাটা স্কাইয়ের গোল এন্টেনা। তাহার পর হইতে এখন সকলের লাইফ জিঙ্গালালা। মেট্রিক পরীক্ষা যেদিন দিব তাহার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা তালপুকুরের মোড়ে পুলিশভ্যানে দুমদাম বোমা পড়িল। কেরানি তৈরীর বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে কাহারা যেন ভাঙ্গিয়া দিতে চাহিয়াছিল শুনিয়াছি। তাহার পরে ধুঁয়া। চতুর্দ্দিকে কেবল ধুঁয়া। হুইসৈল ও গুলির আওয়াজ। গলির ভিতরে দ্রুত চলিয়া যাওয়া পায়ের শব্দ। তাহারও পরে আরো কী কী সব যেন হইল। বছর কাটিল। দশক কাটিল। কাহারা আসিল, কাহারা গেল। সকল বৃত্তান্ত আমি বুঝি নাই। ফলকথা, ধুঁয়া।

    আমি যে আত্মজীবনী রচনা করিতে বসিয়াছি এ কথা আর কেহ জানে না। তবে সকলে হিজিবিজি লিখিতে দেখিয়া বিরক্ত হয়। বর্ত্তমানে আমার কলেস্টেরল বাড়িয়া গিয়াছে। ইহা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না। এখন ডাক্তার বলিয়াছে। সুন্দরী নার্স আমার পিঠে হাত দিয়া আমাকে সোজা করিয়া ‘কাকু, একটু শান্ত হয়ে বসুন, এক্ষুণি হয়ে যাবে’ বলিতে বলিতে আমার রক্ত সংগ্রহ করিয়াছিল। আমার ধন খাড়া হইয়া গিয়াছিল। অমন কোমল হাতের স্পর্শ আমি বহুকাল পাই নাই। সেও আজ প্রায় দুই বৎসর হইয়া গেল। শপীঙমলে যাইলেও ওরূপ নরম নরম ধামড়ি মেয়েদের অতিকায় ধামার ন্যায় টাইট পাছা দুলাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখা যায়। কিন্তু উহারা গায়ে হাত দেয় না। আমাদের পাড়ায় একখানি নূতন ঝলমলে ব্যুটি পর্ল্লর হইয়াছে। সেদিন রাস্তায় যাইতে যাইতে দেখিতেছিলাম তাহার ভিতরে ডবকা ডবকা অনেকগুলা ধিঙ্গি মাগী চুল স্ট্রেট করাইতেছে আর বাহিরে কাঁচের গায়ে মুখ ঠেকাইয়া একখানি ভিখারির ছোট ন্যাংটো ছেলে একদৃষ্টে তাহা দেখিতেছে। ভিখারির ছোট ন্যাংটো ছেলের সম্মুখে টিঙটিঙে আধইঞ্চি নুঙ্কু ঝুলিতেছে।

    শপীঙমলের কথায় মনে পড়িয়া গেল, আমি গত বৎসর শারদীয়া পূজার প্রাক্কালে একবার শপীঙমলে গিয়াছিলাম। আমার স্ত্রী ও ছেলে জোর করিয়া আমাকে লইয়া গিয়াছিল। আমার স্ত্রী একটি মূর্খ মেয়েছেলে। টিভিতে প্রত্যহ দুপুরে মুটকি মুটকি মাগীদের অনুষ্ঠান দেখিয়া সে রান্না শিখে ও বাড়িতে করিতে চেষ্টা করে। ঐরূপ মুটকি মাগীরা টিভিতে ঝাল মাংস খাইয়া লাল লিপস্টিক্ পরা ঠোঁটে ‘উস্-আস্’ করে। উহাদের ওরূপ করিতে দেখিলে আমার মনে অশ্লীল চিন্তা আসে। আমার ছেলেটি একটি অপদার্থ। সে মাথায় লম্বা চুল রাখিয়া গিটার বাজায় এবং কোথায় কোন 'এনিমাল্ এক্টিভিস্ট্' দলে গিয়া যোগ দিয়াছে। রাস্তা হইতে ঘেয়ো নেড়িকুত্তা তুলিয়া আনিয়া উহাকে চুমো খাইয়া ফেস্-বুকে ছবি দিয়া উহারা মেয়েছেলের ন্যায় আদিখ্যেতা করে। উহাদের দেখিলে আমার হাড়পিত্তি জ্বলিয়া যায়। আমার ঊর্ধতন পঞ্চম পুরুষ নরহরি একা হাতে মাথার উপর বন্ বন্ করিয়া লাঠি ঘুরাইয়া হাঁকাড় পাড়িতে পাড়িতে পুরা ডাকাতদলকে গ্রামছাড়া করিয়াছিলেন ও প্রতি বৎসর সপ্তমী পূজার শেষে দরদালানে নিয়ম করিয়া নিজ হস্তে একটি কালপাঁটা বলি দিতেন। তাঁহার বংশধর এরূপ ন্যাকাচৈতন্য হইল কিরূপে? হে জগদম্বে, কোন পাপে তুমি আমার এইরূপ দশা করিলে।

    যেই দিবস আমি উক্ত শপীঙমলে গিয়াছিলাম সেই দিবস অতি ভিড় ছিল। ভিতরে এ-সি চলিতেছিল। আমি কিছু কিনি নাই, এদিকওদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম। আমার মূর্খ স্ত্রী ও ছেলে ট্রলি ভর্ত্তি করিয়া জিনের পেন্ট, জামা, শাড়ি, আচার, অর্গনিক্ ফুড্ ও আরো নানাবিধ দ্রব্য কিনিল। তাহার পর আমরা যেমনি দাম দিবার নিমিত্ত কৌন্টারের কাছে আসিয়াছি অমনি কোথা হইতে গোলাপী মোবয়েল ফোং হাতে পাছা দুলাইতে দুলাইতে আঁটোসাটো পোশাক পরা তিন ধিঙ্গি মাগী আসিয়া আমাদের সম্মুখে জুড়িয়া দাঁড়াইল ও আশপাশ হইতে এটাসেটা লইয়া নিজেদের ট্রলিতে ভরিতে লাগিল। উহাদিগের শরীর হইতে অতি মিষ্ট পর্ফিউ্যমের গন্ধ বাহির হইতেছিল, কিন্তু আমি ব্রহ্মসন্তান, ওসবে ভুলি না। সত্যযুগে আমার পূর্ব্বপুরুষগণ ওরূপ কেঙ্গরা মেয়েছেলের মুখে প্রত্যহ তিনটা লাথি মারিতেন। তিন মাগীর বেহদ্দ ছেনালি দেখিয়া আমার হাড়পিত্তি জ্বলিয়া গেল। আমি কহিলাম, ‘অরে, বেহায়া মেয়েছেলের দল! আমরা আগে আসিয়াছি, আমাদিগের রাস্তা ছাড়িয়া দে!’ তিন মুটকি ইহা শুনিয়া মহা কেঁওমেও করিয়া আমার সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল। উহাদিগের মধ্যে একজন মাই দুলাইয়া আমাকে ইডিয়ট্ ও ড্যমফুল্ বলিল। অপর দুইজন তাহার সহিত যোগ দিল। তাহাদের ধেষ্টামি দেখিয়া রাগে আমার গা জ্বলিয়া গেল। আমি বলিলাম, ‘দেখ ধিঙ্গি মাগী! তোদের ও কটরকটর ভাষা আমি বুঝি না, তোরা আমাদিগকে এইক্ষণেই রাস্তা ছাড়িয়া দিবি কি না!’ এবং ইহা বলিয়া এক লম্ফ দিয়া সম্মুখের মাগীটার ঘাড়ে পড়িলাম। এরূপ হইবে বলিয়া মাগীটা প্রস্তুত ছিল না, দমাস করিয়া সে গোলাপী মোবয়েল ফোং সহ পাছা ও মাই লইয়া ভূমিতে পড়িয়া গেল। আমি তাহার হস্তে কামড়াইয়া দিলাম। সিক্যুরটি আসিয়া আমাকে ধরিবার পূর্ব্বেই আমি দুই হস্ত শূন্যে তুলিয়া উলালালা করিতে করিতে দৌড়াইয়া সে শপীঙমল হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। হারামজাদির উচিত শিক্ষা হইল। উহার পর্ফিউ্যমে আমি ঘৃণাভরে বিষ্ঠাত্যাগ করি।

    পাগলেরা প্রায়ই হাওড়া ব্রীজের মাথায় উঠে। ইহা পাগলদিগের সমাজে অতি সম্মানীয় কার্য্য। এ কথা আমি জানি। আমি বহু পাগলকে পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছি। হাওড়া ব্রীজের মাথায় উঠিলে পরী, অট্টালিকা, ইউএফও, পূর্ব্বজন্ম প্রভৃতি দেখা যায়। ইহা যাহারা হাওড়া ব্রীজের মাথায় উঠে নাই তাহারা জানে না। আমি বর্তমানে অশক্ত হইয়াছি, না হইলে আমিও হাওড়া ব্রীজের মাথায় উঠিতাম। ওখান হইতে রাবণের স্বর্গের সিঁড়ির স্পষ্ট রাস্তা আছে। হারুও কখনো হাওড়া ব্রীজের মাথায় উঠে নাই, তবে হারুও বোধকরি এ কথা জানিত। হারু রাস্তা পার হইতে গিয়া লরিচাপা পড়িয়া মরিয়া গিয়াছে। তাহার মুক্তিলাভ হইয়াছে। তাহার পেটের লাল লাল কেঁৎলা ছেৎরাইয়া রাস্তায় পড়িয়া ছিল। উহা কুত্তা খাইবে বলিয়া আসিয়াছিল। লোকজন কুত্তাদিগকে তাড়াইল। আমি ছেলেবেলায় হারুর ন্যায় গোবরানী বুড়িকে খেপাইতাম। গোবরানী বুড়ি গোবর কুড়াইত ও ভোরবেলা ঘাসের উপর হইতে চাঁপাফুল তুলিত। কুকুরেরা তাহার পিছনে ঘাউ ঘাউ করিত। আমি একবার কালীপূজার সময়ে তাহার পিছনে ছুঁচোবাজি ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। ইহাতে তাহার থান ফুটা ফুটা হইয়া গিয়াছিল। গোবরানী বুড়িও হারুর ন্যায় বিশ্রী বিশ্রী খিস্তি করিয়াছিল। আমি তো হাসিয়া কুটিপাটি। আজিকাল কেহ ছুঁচোবাজি ছাড়ে না। শব্দবাজি নিষিদ্ধ হইয়া গিয়াছে। বাঙ্গালী বড়ই নির্ব্বিষ হইয়াছে। কে বলিবে এই বাঙ্গালীই একদা সাহেব মারিবে বলিয়া ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িতে লোহার খোলে পিক্রিক অ্যাসিড ভরিত। আজিকাল একটা চকলেট বোমাও একটু জোরে আওয়াজ করিয়া ফাটিলে সকলে চমকাইয়া উঠিয়া ভাবে বুঝি সাজানো বাগান শুকায়ে গেল। কবে হইতে যে বাঙ্গালী এরূপ গান্ডু হইল! বিজয় সিংহ সাগর ডিঙ্গাইয়া লঙ্কায় গিয়া হল্লা করিয়াছিলেন। মহারাজা ধননন্দের বিশাল হস্তিবাহিনীর ভয়ে যবনবীর সিকন্দর আলেকজন্দররের পেন্টুলুনে হিসি হইয়া গিয়াছিল। রাজা শশাঙ্কের সেনাদল গৌড়বঙ্গ ছাড়িয়া ঝোপজঙ্গল বনপাহাড় মহাকান্তার ভাঙ্গিয়া সুদূর কান্যকুব্জে গিয়া সেখানকার লোকজনকে বেধড়ক ক্যালাইয়াছিল। তৎকালে সমতট, হরিকেল, প্রাগজ্যোতিষ, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, সীতারাম রায়, শেল, শূল, শক্তি, তোমর, ভোমর, বল্লম, ভল্ল, আগাডুম, বাগাডুম, ঘোড়াডুম, কাড়া-নাকাড়া, ঝাঁঝর, দগড়, শিঙ্গা, দুন্দুভি, দামামা, জগঝম্প এইসকল ছিল। ভাবিলেই মনে ভক্তি উঠে। আর এখন বাঙ্গালীর কেবল মল্টীতে বাহুবলী দেখিয়া তিন হাজার টাকার খাইয়া সেল্ফি তুলা আছে। গুনগুন করিয়া তাহারা সারা দিবস কেবল হসমৎ পগলে প্যার হো জয়েগা গাইয়া থাকে। লাথাইয়া হারামজাদাদের মুখ ভাঙ্গিয়া দিতে হয়!

    লক্ষ্য করিলে দেখা যায় লরির পিছনে রাক্ষসের মুখ আঁকা থাকে। এরূপ অঙ্কন অতি যথার্থ। কেননা লরির সহিত চকলেট বোম, কালীপূজা, অন্ধকার, রাক্ষস প্রভৃতির নিকট সম্পর্ক রহিয়াছে। এ কথা আমার মনে হয়। উহারা সকলই শক্তির প্রতীক। লরির মাথায় জয় মা কালী লিখা থাকে। কালীঠাকুর লরিতে করিয়া ভাসান যায়। তখন দুম করিয়া চকলেট বোম ফাটে। ভ্যাট্-ভ্যাট্-ভ্যাট্-ভ্যাট্ করিয়া জেনারেটর চলে। এ সকল দেখিলেই মনে বেশ একরূপ জমাটি আনন্দ আসিয়া থাকে। কালীপূজার সহিত পাড়ার মোড়ের মাথার ক্যাওড়ামি অচ্ছেদ্য। কালীপূজা সরস্বতীপূজা নহে যে দুপুরবেলা পাজামা-পাঞ্জাবি ও বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিয়া ভদ্র ভদ্র শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা খিচুড়ি খাইবে ও মিষ্টি-মিষ্টি প্রেম করিবে। কালীপূজায় বিড়ি দিয়া চকলেট বোম ধরাইয়া গাম করিয়া ছুঁড়িয়া দিতে হয়। আহা, তাহার পরেই সে যা মজা! ঘন তাজা দুধের রাজা! লঙ্কা কি ধানিপটকাও ফাটানো চলে তবে উহাদের আওয়াজ সেরূপ নহে। শুনিয়াছি চীনদেশীয় ফা-হিয়ান গুপ্তযুগে শহরের প্রকাশ্য রাজপথে রথযাত্রার বর্ণনা দিয়াছিলেন। প্রায় দুই সহস্র বৎসর পরেও সে বর্ননার আজিও ইতরবিশেষ হয় নাই। গুপ্তযুগে লরি, ম্যাটাডোর ছিল না। থাকিলে চীনদেশীয় ফা-হিয়ান নির্ঘাৎ কালীঠাকুর ভাসানের বর্ণনা দিয়া যাইতেন। কালীঠাকুর অধিক উচ্চ হইলে কখনো কখনো ভাসানের সময় রাস্তার কারেন্টের তারে ঠেকিয়া যায়। ঠেকিলেই দুম করিয়া শব্দ ও ফ্ল্যাশ্ হয়। এরূপ আমি হইতে দেখিয়াছি। ঘোষবাড়ির বাপ্পা এই ঘটিয়া মরিয়াছিল। তাহাদের হইয়াছিল বার হাত কালী। ডেডাং-ডেডাং বাজনা বাজাইয়া চুকচুক বাংলা খাইতে খাইতে সকলে রাস্তায় চলিতেছে ও তামাসা-ফষ্টি করিতেছে। এমন সময় দমাদ্দম ঢাকের আওয়াজ আর প্রবল মাইকের শব্দের মাঝে মুকুটে ঠেকিয়া তার ছিঁড়িয়া পড়িল ম্যাটাডোরে চড়া বাপ্পার ঘাড়ে। তাহার পরে চড়বড় করিয়া ফুলঝুরির ন্যায় ফ্ল্যাশ্। সে বীভৎস কাণ্ড। চক্ষের নিমেষে বাদ্যবাজনা বন্ধ। লাশ পুড়িয়া কালো হইয়া গিয়াছিল। সে হইচইয়ের রাতে কোথায় বা ডাক্তার কোথায় বা কি। কোথায় যেন শুনিয়াছিলাম মুকুট নহে, গোটা মুণ্ডখানিই তারে আটকাইয়া গিয়াছিল। চড়াৎ করিয়া পোস্ট হইতে তার ছিঁড়িয়া ভাসানযাত্রীদের ঘাড়ে। এদিকে কালীঠাকুর কবন্ধ। ছিন্নমস্তা। ভয়াবহ দৃশ্য। খানতিনেক লোক মরিয়াছিল শুনিয়াছি। ছিন্নমস্তার অভিশাপ। বাল্যকালে দেখিতাম বাজারে রামকানাইয়ের মুদির দোকানে শ্রীশ্রী ভবতারিণী স্টোর্সের কালীঠাকুরের ছবিওয়ালা বাংলা কেলেন্ডার ঝুলিতেছে। কালীঠাকুরের কপালের তৃতীয় নয়ন হইতে শড়কির ন্যায় দুইটি তীব্র সাদা আলোর রেখা নির্গত হইয়া একটি তাঁহার পায়ের কাছে ডানদিকে বসা শ্রীরামকৃষ্ণের শরীরে ও অপরটি বামদিকে বসা সারদা মায়ের শরীরে প্রবেশ করিয়াছে। এছাড়া ছিল শ্রীচৈতন্যের কেলেন্ডার। দুইদিকে জগাই মাধাই নাচিতেছে। মধ্যে শ্রীচৈতন্যের মস্তকের পিছনে অতিকায় গোলথালার ন্যায় সোনালী চাকতি ঘুরিতেছে। পশ্চাতে কু্ঁড়েঘর ও নদীতে রাজহাঁস চরিতেছে। রামকানাই সম্মুখে দাঁড়িপাল্লা ও প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাটখারা লইয়া বসিয়া থাকিত। তাহার দোকানে আটা, গুড়ের বাতাসা ও লালবল পাওয়া যাইত। আমি বাল্যকালে লালবল লইয়া খেলিতাম।

    কালীপূজা বলিতে গিয়া মনে পড়িয়া গেল বলির কথা। আমি কখনো পাঁটাবলি দেখি নাই, তবে ডোমেদের শুয়োর মারা দেখিয়াছি। লম্বা লম্বা লোহার রড দিয়া মারে। আগুনে টকটকে লাল করিয়া পশ্চাদ্দেশে হড়হড় করিয়া ঢুকাইয়া দেয়। মুখ দিয়া রড বাহির হইয়া আসে। শুয়োরের তখন মরিবার আগে সে কী চেল্লানি! হঁক্কু-হঁক্কু-হঁক্কু। কিছুদিন পূর্ব্বেও গঙ্গার পাড়ে কাদায় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করিয়া কোঁৎকা শুয়োর ঘুরিয়া বেড়াইত। আজিকাল তাহারাও আর নাই। ভালো যাহা কিছু সকলই যাইতেছে। আমি একবার কালীপূজার রাত্রে শ্মশানে গিয়া পিশাচ দেখিয়াছিলাম। তাহার চক্ষুদ্বয় ধক্-ধক্ করিয়া জ্বলিতেছিল। রক্ষাকালী পূজা গভীর রাত্রিতে করিতে হয়। কারণ তখন আকাশে-বাতাসে ভূতাবেশ হয়। চিতার আগুনের পার্শ্বে সেই ভয়ানক পিশাচ দাঁড়াইয়া ছিল। দুইদিকে ডাকিনী-যোগিনী ছিল। ইহা আমার নিজের চক্ষে দেখা।

    পাগলের কথা বলিতে গিয়া পিশাচ আসিয়া গেল। আজিকাল কথার খেই থাকে না। বয়স বাড়িতেছে। দেখিতে দেখিতে কত বৎসর কাটিল। কত কিছু ঘটিল। দেয়াল পড়িল, দেয়াল উঠিল। টিভিতে দেখিয়াছিলাম আমেরিকায় এরো-প্লেন্ আসিয়া দুইটি অতিকায় স্তম্ভ ভাঙ্গিতেছে। তাহার পরে চতুর্দ্দিকে ভয়ানক আলোড়ন উঠিল। প্রবল যুদ্ধ হইল। সকলে মিলিয়া আমরা নূতন সহস্রাব্দে ঢুকিয়া পড়িলাম। কোথায় যেন পড়িয়াছিলাম পুরানো সহস্রাব্দ মরিয়াছে এবং তাহার ভূত আসিয়া এই নূতন সহস্রাব্দে ভয়ানক উপদ্রব করিবে। দেখিতেছি তাহাই হইতেছে। এক্ষণে সকল স্থানে বিষম ভৌতিক কাণ্ড চলিতেছে। দিনদুই পূর্ব্বে ভোররাত্রিতে আমি এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখিয়াছি। দেখিলাম আমার ঊর্ধতন দ্বাদশ পুরুষ স্বর্গত শ্রীরুদ্রদেব তর্কপঞ্চানন মহাশয় আদুল গায়ে মোটা পৈতে ও ধুতি পরিয়া আমার বাড়ি হইতে কিয়দ্দূরে মোড়ের মাথায় নূতন হওয়া ফ্লেটের ছাদে জলট্যাঙ্কির উপর বসিয়া আছেন। তাঁহার সারা গায়ে কাঠপিঁপড়ে বাহিতেছিল। উপরে বসিয়া খিলখিল রবে হাস্য করিতে করিতে তিনি কাঁচা মাংস খাইয়া চতুর্দিকে রক্তমাখা হাড় ছিটাইতেছিলেন। ইহা দেখিয়া আমার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। এ স্বপ্নের কথা আমি কাহাকেও বলি নাই। শুনিয়াছি পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলে তাঁহাদিগের প্রেতাত্মা কাকরূপ ধরিয়া পরলোক হইতে আসিয়া পিণ্ড খাইয়া যায়। ইহাকে কাকবলি বলে। স্বর্গত শ্রীরুদ্রদেব তর্কপঞ্চানন মহাশয় বোধকরি মরিয়া ব্রহ্মপিশাচ হইয়াছেন। ভাবিতেছি তাঁহার উদ্দেশ্যে ঐরূপ পিণ্ড দিব।

    প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়িয়া গেল, কিয়দ্দিন পূর্ব্বে আমাদের পাড়ার শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভর রায় মহাশয় মরিলেন। নরদেহ মরিয়া মরদেহ হইল। তাঁহার হার্টের রোগ ছিল, রাত্রে খাইতে খাইতে তিনি টিকটিকির ন্যায় থ্যাস্ করিয়া ডালের বাটিতে পড়িয়া যাইলেন, আর উঠিলেন না। তাঁহার বয়ঃক্রম হইয়াছিল আন্দাজ পঞ্চান্ন বৎসর। তাঁহার এক স্ত্রী ও দুই পুত্র ছিল। তাঁহাকে হাসপাতালে লইয়া যাইলে হাসপাতালের ডাক্তাররা তাঁহাকে ভিতরে লইয়া যাইয়া ঘুটুরঘুটুর করিলেন এবং অবশেষে বলিলেন যে তিনি মরিয়া গিয়াছেন। এরূপ বলিয়া তাঁহারা পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা না পাইলে বডি ছাড়িবেন না বলিলেন। সকলে বিস্তর কাকুতিমিনতি করিলেন কিন্তু ডাক্তারেরা বলিলেন যে উহা লাগিবে। সেই রাত্রে শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভর রায় মহাশয় হাসপাতালের এককোণে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার রিগ্গর্ মর্ট্যিস্ সেট হইয়া দেহটি পচিয়া গিয়াছিল। গাত্রবর্ণ ঘোর বেগুনী হইয়াছিল। অন্ত্রমধ্যস্থ গ্যাসের চাপে শরীরের মলমূত্রাদি নির্গত হইয়া গিয়াছিল। চিক্কুড়ে শঙ্খ বাজাইতে গিয়া সুবল ঘোষের গোগগোলটি বাহির হইয়া গিয়াছিল শুনিয়াছি। শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভর রায় মহাশয়ের অবস্থা তদপেক্ষাও ভয়ানক হইল। তিনি হেগেমুতে ন্যাতাজোবড়া হইয়া পড়িয়া রহিলেন। অবশেষে তিনদিন পরে তাঁহার পরিবার টাকা দিয়া তাঁহাকে ছাড়াইয়া শ্মশানে লইয়া গিয়াছিলেন। যাইবার সময়ে ভীষণ মাংসপচা পূতিগন্ধে সকলে নাকেমুখে কাপড় চাপা দিয়াছিলেন। অতঃপর শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভর রায় মহাশয় পুড়িলেন। ঘ্যাড়্-ঘ্যাড়-ঘ্যাড়্-ঘ্যাড়্ শব্দে চুল্লীর দরজা উঠিয়া গিয়াছিল। তিনি চুল্লীতে ঢুকিবার সঙ্গে সঙ্গে সকলে দেখিয়াছিলেন ওমনি দপ্ করিয়া তাঁহার চাদর ও মাথার চুল জ্বলিয়া উঠিয়াছে। পুড়িবার পরে তাঁহার অস্থি গঙ্গায় ভাসিল। এখনো তাঁহার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম্মাদি চোকে নাই। অতএব তিনি প্রেত্যদেহ প্রাপ্ত হইয়াছেন। বিষ্ণুধর্ম্মোত্তরে লিখিত আছে মরিবার পর সপিণ্ডকরণ না হইবা পর্য্যন্ত জড়দেহীদিগের এরূপ প্রেত্যদেহ হইয়া থাকে, ইহার অনন্তর আতিবাহিক দেহ হয়। শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভর রায় মহাশয়ের এখন এইরূপ প্রেত্যদেহ হইয়াছে। এক্ষণে শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভর রায় মহাশয় কি করিবেন? বোধকরি তিনি প্রতিশোধ লইবেন। ডাক্তারদিগকে, নার্সদিগকে মারিয়া ফেলিবেন। জিনিসপত্র ভাঙ্গিয়া দিবেন। তাহাতেও ক্ষান্ত হইবেন না। উহাদিগের বাড়িতে যাইবেন। বিছানায় মলত্যাগ করিবেন। নাতি খাইবেন, পুতি খাইবেন। অতঃপর মুক্তি পাইয়া তিনি ব্রহ্মলোকে চলিয়া যাইবেন। এইরূপ নিশ্চিত ঘটিবে।

    কোথা হইতে কোথায় আসিয়া পড়িতেছি। বাল্য বয়সে আমি চাবিকামান ফাটাইতাম। চাবির গর্ত্তে দিয়াশলাইয়ের বারুদ পুরিয়া পেরেক গুঁজিয়া আছাড় মারিয়া ফাটাইতে হয়। আজিকাল ফাটাইলে সকলে দূষণ হইতেছে, ধর্ষণ হইতেছে, সংস্কৃতির সতীত্ব নষ্ট হইতেছে প্রভৃতি বলিবে। তাই আমি আজিকাল আর উহা ফাটাই না। আমাকে উহা বানাইতে শিখাইয়াছিল হারান। হারান আমার ছোটবেলায় কারখানায় লেদ চালাইত। পরে মেশিন অফ করিতে গিয়া তাহার ডানহস্ত কাটা যায়। ছাঁটাই হইয়া হারান রেলকলোনিতে এদিকওদিক বেকার ঘুরিত। রেললাইনের উপর একলা বসিয়া বিড়ি টানিত। তাহার কারখানা বহুদিন হইল লক আউট হইয়া গিয়াছে। সেই স্থানে মল্টীপ্লেক্স হইয়াছে। সেই মল্টীপ্লেক্সে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষিতমনস্ক আধুনিক বাঙ্গালা ছবি চলে। সেই সকল ছবিতে বৌ লইয়া স্যুইৎজরল্যণ্ডে চলিয়া যাওয়া সক্টওয়্যার্ এঞ্জিনিয়র ছেলের দুঃখে অতিকায় সাজানো ফ্লেটে পচিয়া মরিতে থাকা সংস্কৃতিবান বাবা-মায়েরা রবীন্দ্র রচনাবলী পড়িতে পড়িতে গ্রামোফোনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে। মোটকা মোটকা বাবু, বিবি ও খোকাখুকুরা সেই ছবি দেখিতে গিয়া দেড়শো টাকায় পপকর্ণ ও চুকচুক ককাকোলা খায়। শুনিয়াছিলাম হারানের পেটে ক্যান্সার হইয়াছে। তাহার পর আর কোনো খবর পাই নাই।

    "পাগলা খাবি কী ঝাঁঝে মরে যাবি।”

    এই বাক্যবন্ধটি আমি বাল্যকালে শুনিয়াছিলাম। তদ্যবধি উহা মুখস্থ হইয়া গিয়াছে। আমার স্মরণশক্তি অতি ভীষণ। আমি রবি ঠাকুরের কবিতাও গড়্ গড়্ করিয়া বলিয়া যাইতে পারি। যেমন, ছপ্পড় পর কৌঁয়া নাচে ও আর কত কাল একা থাকব। এরূপ ভীষণ স্মরণশক্তি আজিকালকার বাঙ্গালীদের মধ্যে দেখা যায় না। শুনিয়াছিলাম মহাপুরুষ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের এইরূপ ভীষণ স্মরণশক্তি ছিল। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় বাঘের ন্যায় গর্জ্জন করিতে পারিতেন। এ কারণে লোকে তাঁহাকে বাঙ্গালার বাঘ বলিত। তিনি একবার অত্যাচারী বৃটিশ শাসকের বাড়িতে গিয়া এইরূপ ভয়ানক গর্জ্জন করিয়াছিলেন যে অত্যাচারী বৃটিশ শাসক ভয় পাইয়া তাঁহার নামে একটি অট্টালিকা লিখিয়া দেয়। সেই অট্টালিকাতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় একটি কলেজ স্থাপন করেন। সেই কলেজ অধুনা আশুতোষ কলেজ নামে খ্যাত। এইরূপ আরো বহু ঘটনার কথা আমি নানা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থে পড়িয়াছি। এইভাবে নানা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের পর গ্রন্থ পড়িতে পড়িতে আমি বর্ত্তমানে একজন কেও-কেটা হইয়াছি। আমার সহিত এখন আর কেহই পাল্লা টানিতে পারিবে না।

    পুনরায় এক কথা হইতে অন্য কথায় আসিয়া পড়িতেছি। আর অধিক লিখিব না। কালির খরচা দেয় কে। অনেক কিছু বলিলাম। ফল বিশেষ হইবে না। কারণ এখন প্রায় সব বেটাই হয় ঢেমনা নয়ত গাণ্ডু। জানিয়া রাখ, ঊর্দ্ধে মৃত্যুলোকে অতি প্রাচীন জাবদা খাতায় পিপীলিকার ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখিত অনিবার্য ব্যবস্থাপত্র লইয়া চিত্রগুপ্ত বসিয়া আছেন। একদিন সকলকে তাহা শুনিতে হইবে। যাহারা সকল দেখিয়া শুনিয়াও এখনো দাঁত কেলাইতেছে তাহাদিগকে মহারৌরব নরককুণ্ডে নিক্ষেপ করা হইবে। আমার আর কী। শালারা গরম তেলে পুড়িবি। খোলায় ভাজা হইবি। তোদের গুষ্টিকে গুষ্টি অষ্টবিংশতি নরকে পচিয়া মরিবে। গু-মুত খাইবে। তোদের গায়ে পচা ঘা হইবে। কৃমি-কেন্নো হইবে। আমার আর কী। আমি গড়্ গড়্ করিয়া লিখিতেছি। আরো বহু লিখিব। শীঘ্রই আমার রচনাবলী বাহির হইবে। আমার বিশ্বজোড়া নাম হইবে। তোরা ভাসিয়া যাইবি। তখন আমার বড়ই আনন্দ হইবে। আমি লাটের বেটা হইয়া পায়ের উপর পা তুলিয়া খাইব ও টাকডুম টাকডুম ঢোল বাজাইতে থাকিব। এমতি যেমতি কিরকিল কিমেল কটকট।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ | ১৪৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৪০50586
  • বাঃ। হেব্বী হয়েছে ।
  • সিকি | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৮50587
  • অত্যন্ত চমৎকার গদ্য। উপাদেয়।
  • | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৯50594
  • ভাষার উপর অত্যন্ত ভাল দখল ... কিন্তু পড়তে কয়েক জায়গায় বেশ বিরক্ত লাগল।
  • b | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:২১50588
  • অসম্ভব ভালো লেখা পড়্লাম।
  • ন্যাড়া | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৩৮50590
  • "খবরের কাগজ, মাদার ডেয়ারি, ডিম ওতে চড়িয়া দুলিতে দুলিতে উপরে উঠিয়া যায়।" উফ, কেয়া ছবি, কেয়া লেখা। একটু বেশি বড় হয়ে গেছে, কিন্তু পড়তে পড়তে ত্রৈলোক্যনাথ মনে পড়ে। এর থেকে বড় প্রশংসা জানিনা।
  • Tim | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৩৮50589
  • ভালো লাগলো। লেখক বলেইছেন আরো লিখবেন, তাই যেন হয়।
  • সুকি | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:২৪50591
  • ভালো লাগল লেখা
  • কুশান | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৪50592
  • তারিফ করার ভাষা নেই।

    মহাশয়, আরো লিখবেন। প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দিলেন।
  • শঙ্খ | ***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩১50593
  • একটু অগোছালো কিন্তু সুখপাঠ্য। সিরিজ আসুক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন