অনেকদিন পরে সম্প্রতি গবেষণার কাজে রাতের বোম্বে, থুড়ি, মুম্বাই, মেল ধরে সাতনার দিকে যাত্রা করলাম। সেই সুবাদে নানা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল, আর এখনকার মনটা দিয়ে সেগুলো নিয়ে ভাবারও সুযোগ পেলাম। ভূগোলের দিদিমনি হওয়ার কারণে ছেলেপিলেদেৱ নিয়ে, পথে-ঘাটে রাস্তায় আমি বহুদিন ধরেই ঘুরছি। এমন সময়ে এসব চলাফেরা, যেসব কালে বেশির ভাগ মেয়েই ছিল 'পথে বিবর্জিতা'। শুধু তাই নয়, এমন সব অদ্ভুতুড়ে পাহাড়-জঙ্গলে-গুহা-সমুদ্দুরে চলতো এসব ঘোরাঘুরি যে এখনো অনেকে শুনে আঁতকে ওঠেন: 'বলো কী?' তবে হ্যাঁ, ঘর হতে দুই কেন, এক পা ফেললেই নিজেকে তো বটেই, অন্যদেরও অনেকটা গভীর করে জানা ও বোঝা যায়। আপনারা তো বলেই দিয়েছেন, 'স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম, দেবা ন জানন্তি', তাই ছেলেদের বিষয়ে এসব ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে কী শিখেছি, সেটাই বলি না হয়?
তখন আমি বিশ্ববাঙালি হই নি, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল পড়াই। ভূগোলের পাঠ্যবস্তুর একটা অন্যতম অংশ ছিল ক্ষেত্রসমীক্ষা। তখনকার দিনের ভূগোলের নিয়মকানুন ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে, এধরণের যাত্রায় আমরা দূর দূরান্তরের নানা অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝার চেষ্টা করতাম। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে বেশির ভাগ শিক্ষক ও শিক্ষিকারাই পাঠ্যের এই অংশটি অপছন্দ করতেন। হয়তো তাঁদের পরিবার-সংসার ও দৈনন্দিন জীবনে সকলকে সামলে ছুটির ফাঁক বের করার সুযোগ ছিল কম। তাছাড়া অনেকগুলি সদ্য টিন-উত্তীর্ণ, বক-বকন্দাজ যুবক-যুবতীর সঙ্গ সকলের ভালো লাগারও কথা নয়। আর এধরণের অনাদায়ী কর্মপ্রকল্পে যে পরিমাণ প্রকরণ ও পরিকল্পনা লাগে, তা দেওয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই তাঁদের ছিল না। মনে রাখতে হবে যে এটা উনিশশো আশির যুগের কথা। এখানে বলে রাখা ভালো যে সেই টরেটক্কায় যোগাযোগের কালে না ছিল মোবাইল ফোন, না ছিল চটজলদি যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা। যেমন ধরুন সেই সময়ে মাঝামাঝি কোনো রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলে আগে থেকে আসন সংরক্ষণ করা একটা ভয়ংকর মুশকিলের ব্যাপার ছিল। মোটামুটি আমরা বর্ধমানের মত ছোট একটা জংশন থেকে ট্রেনে উঠতাম বলে সুবিধের চেয়ে চলাফেরায় অসুবিধেই বেশি ছিল। এসব নানা কারণে বেশির ভাগ বছরেই এই ক্ষেত্রসমীক্ষার দায়িত্ব আমি স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিতাম।
আমি ছিলাম একাকী মা। সঙ্গে আমার ছেলেটিও তাই থাকতো। আর বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, আমার একটি সহকারীও থাকতেন; তবে তিনি না বলতেন ইংরেজি, না হিন্দি। ফলে সাধারণত সামনে থাকার চেয়ে পেছনদিকটা সামলাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন!
ফলে এই বিরাট নারীপ্রধান গোষ্ঠীর আমিই হতাম মাথা। আর এমন একটা মাথা, যার মাথায় ঘিলুর চেয়ে পোকাই বেশি। সুতরাং, দলবল নয়, একে বলতে পারেন বল-বিহীন দল।
এই বল-বিহীন যূথবদ্ধ ভ্রমণে আমার মতন দরিদ্রের অল্প-খরচে ভূগোলশিক্ষা তো বটেই, একান্ত ব্যক্তিগত প্রবল ভ্রমণলিপ্সারও কিছুটা পূরণ হতো। সর্বোপরি, আমার ছোট্ট ছেলেটিকে অতি সহজে ও কম খরচে নিজের দেশকে চেনানো ও বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীল করে তোলার এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এই সব পনেরো-কুড়ি দিনের ভ্রমণের মাধ্যমে একঘেয়ে মফসসলি মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরের পৃথিবীটার ঝাঁকিদর্শন, আর ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট সংসর্গ পাওয়ার সুযোগ আমি খুবই উপভোগ করতাম। এগুলোই এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখানে তারই ছোট্ট ছোট্ট কটা টুকরো তুলে দিলাম।
বেশির ভাগ সময়েই আমরা ট্রেনে যাতায়াত করতাম। তবে কোনো কোনো সময়ে, পরিস্থিতির প্রয়োজন মত পুরো একটা বাস রিজার্ভ করে, সঙ্গে রাঁধুনির দল নিয়েও যাওয়া হতো. বিশেষ করে বিহারের কোনো গ্রামে গেলে তো বাসেই সুবিধে বেশি ছিল। এতে করে গ্রামের ছেলে-মেয়ে, যাদের অনেকেই সবে প্রথম বাড়ির বাইরে উচ্চ-শিক্ষার জন্যে বেরিয়েছে, তাদের পছন্দসই খাবার, যেমন ধরুন আলু-পোস্ত ও কলাই-এর ডাল, পেতে সুবিধে হতো। আমাকেও আর ওদের কাছে অদ্ভুত এমন সব খাদ্য - যেমন পোহা, কিংবা দোসা – খাওয়ার জন্যে ওদের পীড়াপীড়ি করতে হতো না!
এরকম-ই বাস যাত্রায় একবার চলেছি। সেবারে যাবো সুবর্ণরেখা নদীর ওপরে যে চান্ডিল বাঁধ বিশ্বব্যাংকের টাকায় তৈরি হচ্ছে, সেটি দেখতে ও তার ফলে ওই বাঁধের আশপাশের গ্রামের যাঁরা বাসিন্দা ছিলেন, তাঁদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার খোঁজ নিতে। তবে সুশীল পাঠক নিজগুণে অপরাধ নেবেন না, এখানে (জামার কলার তুলে) একটু বলে নিই যে তখনও যদিও মেধা পাটকার-এর বাঁধবিরোধী আন্দোলন তেমন জমাট বাঁধে নি, আমরা ভূগোলের ছাত্র-ছাত্রীরা তখনই মানুষ-ও-পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত এসব বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছি। বুঝতেই পারছেন যে এটা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধিক অগ্রগামিতার সাক্ষাৎ প্রমাণ!
ভ্রমণের দিনের সংখ্যা বাঁচানোর জন্যে সাধারণত রাতে বাস যাত্রা। আর একথা বলাই বাহুল্য যে তাতে করে আমাদের হুল্লোড়ও বেশি হতো. গানে-কবিতায়-হাসি ও মজায় সারারাত যে কী করে কখন কেটে যেত তার খেয়ালও থাকতো না। আমি জানি যে আপনার একবিংশ শতাব্দীর সাবধানি মন বলছে, ‘তা তো হল, বলো দেখি তুমি এতগুলো মেয়ের নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা নিতে?’
মনে করিয়ে দিই যে তখনকার দিনে মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে-মেয়েরা কম-ই ঘুরত, আর সেজন্যেই সেটা এক রকমের সুবিধেও ছিল।যেমন ধরুন একবার কেরালা-র ভেম্বানাদ হ্রদের জলে জল-পুলিশের নৌকোয় করে সকলকে নিয়ে যে ঘণ্টা-চারেক ঘোরা গেল, সেটা ওই বাঙালি নারীকুলের মিষ্টি হাসির গুণেই। তাছাড়া তখনকার ছেলেরা কথায় কথায় মেয়েদের মুখে না ছুঁড়ত অ্যাসিড, না করতো গণধর্ষণ! কখনো কোনো ছাত্র ভুল করে একটু মদ বা ওই জাতীয় কোনো বিশ্রী জিনিস খেয়ে ফেললে তার ফলে হয়তো একটু বেশি কবিতা আওড়াত কিংবা খুব বেশি হলে বড়জোর মেয়েদের দরজায় ধাক্কা মারত। আর সেটা আমি জেনে ফেলে চোখ একটু পাকালে সেটুকুই বেশ জোলাপের কাজ দিতো।
যাই হোক, ওই রাতের যাত্রার জন্যেই চান্ডিল যাওয়ার অভিজ্ঞতা কোনো দিন ভুলবো না। রাত বারোটার পরে বাসে বর্ধমান ছেড়েছি। যথারীতি গান-বাজনা চলছে উচ্চৈঃস্বরে। বর্ধমানের জেলাশাসক দয়া করে সঙ্গে পুলিশের জিপ দিয়েছেন - সেটা তার লাল-নীল আলো জ্বালিয়ে প্যাঁ-পোঁ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আগে আগে চলছে আমাদের পাহারা দিয়ে। বর্ধমান জেলার সীমান্ত পেরোনোর পর আমাদের বাসের দায়িত্ব নিলো বাঁকুড়া, অর্থাৎ পরবর্তী জেলার পুলিশের জিপ। সেভাবেই পুরুলিয়ায় ঢোকার পরে সেখানকার পুলিশ আমাদের সঙ্গ নিলো। এমন সময়ে হঠাৎই দেখি রাস্তার ওপরে আড়াআড়ি ভাবে ফেলা বিরাট একটা গাছের গুঁড়ি। অর্থাৎ, রাস্তা ব্লক! তখনকার দিনে অন্যান্য সব কিছুর মত অপরাধের ধরণগুলোও ছিল আলাদা। সেসময়ে শোনা যেত এই পদ্ধতিতে গাড়ি থামিয়ে এক বাস যাত্রীদের জিনিসপত্র তো বটেই, পরনের জামা-কাপড় পর্যন্ত খুলে নিতো দুষ্ট সব হাইওয়ে ডাকাতেরা। ওদের কল্যাণে হাইওয়ের কত যে গাছ প্রাণ হারিয়েছে তার কোনো সঠিক গুনতি নেই. শুধু প্রবাদ-ও-গল্পকথায় সেসব কাহিনি বেঁচে আছে।
কিন্তু ওই পুলিশের গাড়ির লাল-নীল আলো দেখেই হোক, বা গুরুগর্জনে নারী কণ্ঠের বিপুল সংগীতের কল্যানেই হোক, আমাদের বাস এসে পড়ার আগেই দুষ্কৃতীরা সব ধানের খেতে লুকিয়েছে।
এখানে রাস্তায় এগোনোর জন্যে দরকার 'পুরুষের বল' অর্থাৎ, ম্যানপাওয়ার। তাহলে একটু লজ্জা হলেও এখানে বলেই নি যে আর সব কিছুর মতই, যেমন জাত-পাত দিয়ে মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচু বা ছোট-বড় ভাগের মতই আমাদের দেশে লেখা-পড়ার নানারকম বিষয় গুলোর মধ্যেও অলিখিত হলেও নিশ্চিত একটা ভাগ ছিল। আবার এই ভাগের ফলে - হয়তো ভাগগুলোর একটা উঁচু-নিচু অর্থ হয় বলেই - প্রতিটি বিষয়ের একটা সামাজিক লিঙ্গ-ও ছিল। যেমন ধরুন, বাংলা ছিল 'মেয়েদের' বিষয়। আর মেয়েরা পড়তো বলে, বাংলা পড়াটাই যেন ছিল মেয়েলি। ঠিক এই ভাবে, ইতিহাস প্রভৃতি 'নরম' বিষয়গুলোও ছিল মেয়েলি। অনেকদিন পর্যন্ত ভূগোল ছিল 'মেয়েদের পছন্দসই' বিষয়; তার মানে কলাবিভাগের ভালো রেজাল্ট করা ছেলেরা যদি ধনবিজ্ঞান পড়ে তাহলে মেয়েরা পড়তো ভূগোল।
তাহলে, মোদ্দা কথা হল এই যে আমার ওই বল-বিহীন দলের বেশির ভাগ সদস্য-ই নারী। সুখের বিষয় এই যে তখনকার দিনে প্রতিটা ব্যাচ এখনকার মত বিশাল ছিলোনা - আমি পাঁচটি মেয়েকে নিয়ে উনিশশো বিরাশি সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম, তবে দ্রুত এই সংখ্যা বেড়ে মোট জনা তিরিশেকে পরিণত হয়. এই তিরিশজনের মধ্যে প্রায় সাতাশজন-ই মেয়ে। তখনকার দিনের বেশিরভাগ ছাত্রীই কিন্তু এখনকারদের মতই ছিল: সমাজের 'চতুর্থ-শ্রেণির' নাগরিক হওয়ার জন্যেই হোক বা অন্য কোনো কারণে তারা ছিল মজাদার, হাসিখুশি, কৌতূহলী ও কষ্টসহিষ্ণু।
তবে ছাত্ররা যে সকলেই সেরকম ছিল, একথা বলতে পারি না। গানে-কবিতায় ওস্তাদ হলেও ওদের অনেকেই এক একটি ক্ষুদ্র মহারাজা। সেই ট্র্যাডিশন সামনে চলছে: তখনকার মত এখনও বেশিরভাগ ছেলেই মায়ের কোলে, বরাবর অত্যধিক আদর ও প্রশ্রয়ে মাখোমাখো হয়ে, বড় হয়ে ওঠা আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তি। ফলে না ছিল তাদের পুরুষালি 'শিভালরি', না ছিল কষ্টসহিষ্ণুতার অভ্যাস। তারা খাবার সামনে পেলে সকলের আগে খেত, কষ্ট হলে তীব্র অনুযোগ করতো, আর মেয়েদের ব্যাগ ট্রেনে-বাসে তুলে সাহায্য করতে হলে তার বিনিময়ে চিরকৃতজ্ঞতা দাবি করতো।
এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়; যেমন ধরুন একজন-দুজন রাজকন্যে, যাঁরা হিল-তোলা জুতো পরে মাঠে-জঙ্গলে হাঁটতে আসতেন, রোদে পুড়ে কালো হতে যাদের ভালো লাগতোনা মোটেই, কিংবা যাঁরা পালকের ঘায়ে কাতর হতেন। তেমনি জনাদুয়েক ছেলেও ছিল যারা এগিয়ে আসত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। তবে ব্যতিক্রম তো ওই সাধারণ নিয়মকেই প্রমাণ করে, তাই না? আর সত্যি কথা বলতে কি, তাদের অনেকেরই চেষ্টা ছিল এসব ভ্রমণের কালে একটু আধটু বিশেষ ও 'গভীর' বন্ধুত্ব গড়ে তোলা।
তাই সেই মাঝরাতে মেয়েরাই নামলো বাস থেকে, হেঁইও-মারি জোয়ান-ভারি করে সরাল ওই গাছের গুঁড়িটাকে যাতে আমাদের বাস নির্বিঘ্নে ওই বাধাটুকু পেরিয়ে যেতে পারে। এমনকি আমাদের জিপগাড়ি থেকে প্রহরী কজন-ও নামলেন না । আর এসব সত্ত্বেও, এক সময়ে আমরা পৌঁছেও গেলাম চান্ডিল বাঁধের একটা ভাঙা-চোরা অতিথি ভবনে।
থাকার জন্যে সেখানকার ঘর-বণ্টন নিয়েও একটা মজার গল্প লেখা যেত, কিন্তু সেকথা আরেকদিন হবে। এবারে বলি আমাদের মধ্য ভারতে ভ্রমণের কাহিনি যার মধ্যে দিয়ে আমার বক্তব্য আরো পরিষ্কার হবে।
উনিশশো অষ্টাশি সালে, প্রায় জনা তিরিশেক ছাত্রী ও তিনটি ছাত্র-কে নিয়ে, হাওড়া-বোম্বে মেলে করে যাচ্ছি মধ্য ভারতে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে। সাতনায় নেমে আমরা গেলাম পাঁচমারি। সেখানকার বিন্ধ্য পর্বতের পাহাড়-জংগলে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে চুনাপাথরের গুহায় সট্যাল্যাকটাইট ও সট্যাল্যাগমাইট কেমন হয় তা দেখে ও বুঝে খাজুরাহো হয়ে জব্বলপুর, যেখানে মর্মর পাথরের ওপর ধুঁয়াধার জলপ্রপাত। আমাদের ফেরা এলাহাবাদ স্টেশন থেকে। পাঁচমারির গুহায় আশ্চর্য হয়ে দেখলাম চুনাপাথরের স্তূপগুলোতে অন্ধবিশ্বাসীরা সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করছে। এমনটা যে হতেও পারে, সভ্য মানুষ যে একটা পাথরকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে পারে, তা আমার ভৌগোলিক ও শিক্ষকের মন কোনোদিন ভাবতেও পারে নি! শুধু তাই নয়, মধ্য ভারতের গোবলয়ে এসব আচরণের সঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িত আছে এক ভয়ংকর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিচয় আরো নানা ছোটো ছোটো জিনিসের মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারছিলাম; জব্বলপুরের রাস্তায় প্রথম শুধু মেয়েদের-ই নয়, আমাকেও উত্ত্যক্ত হতে হল গুঁফো সব হিন্দিভাষী গোপূজারীদের হাতে। এ-ও একরকমের দেশ-দর্শন, এবং শিক্ষা অর্জন। তবে তা মোটেও আনন্দদায়ক নয়। বোধহয় খুব-ই আশ্চর্য এবং হয়তো একটু বিরক্তও তাদের লাগছিলো ওই অতগুলো অবলা মেয়েকে খোলা রাস্তায় নির্ভীক ভাবে চলাফেরা করতে দেখে।
সে কথা থাক। সমালোচনা তখনই ভালো যখন তা নিজের দিকে ধাবিত হয়। আসা যাক আমাদের নিজেদের দলের মধ্যবর্তী অনুল্লেখিত, অগোচর পুরুষতান্ত্রিকতায়।
আমাদের নির্বলী দলকে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনের ঠিক সময়ে এলাহাবাদ স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি। সেই স্টেশনে এসে দেখা গেল যে বর্ধমান স্টেশন থেকে পাঠানো টেলিগ্রাফ গাঙ্গেয় উপত্যকার জনসমুদ্রের কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। দরকারি প্রমাণসহ কাগজপত্র দেখালেও এলাহাবাদের স্টেশন মাস্টার তো মনেই করতে পারলেন না বর্ধমান থেকে এরকম কোনো নির্দেশ পাওয়ার কথা। পরে বুঝেছিলাম যে ওই দিন সেখানকার একটা প্রতিপত্তিশালী পরিবারে একটা শুভ অনুষ্ঠান ছিল, আর সেজন্যে রেলের সব কয়টা সিট-ই তাঁরা রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। ট্রেন আসার পরে, অসীম দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে তিন মিনিটের মধ্যে মালপত্তর-সহ সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের সামনের যে কোনো একটা কামরায় উঠিয়ে নিতে হোল। তখন আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কোচেই চলাফেরা। ওঠার পরে শুরু হোল কালোকোট-পরিহিত অসীম ক্ষমতাশালী টিকিট-চেকারের সংগে দরাদরি। ঠিক দরাদরি নয়, পরিস্থিতির চাপে তাকে সিট ভিক্ষা বলাই সমীচীন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটল এভাবেই। কোনোমতে পায়খানার সামনে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে বসে থাকা, আর কালোকোটের পেছন পেছন দৌড়নো, যাতে কয়েকটা অন্তত শোয়ার বার্থ পাওয়া যায়। বাঙালিনির এই দৌড়োদৌড়ি তাঁর কেমন লাগছিল জানি না, তবে রাত নামতে তিনি গোটা তিনেক বার্থ আমাদের দলকে দিলেন।
আগে কাদের শুতে দিই বলুন তো? ভাববেন এতো সহজ ব্যাপার।
সহজ ঠিকই, এক্কেবারে জলের মত।
তাও ধাঁধা দিলাম, সমাধান করুন: 'পনেরো-কুড়িদিন মাঠে-ঘাটে অনভ্যস্ত ভ্রমণের পর, সুযোগ মিলতেই কারা গেল আগেভাগে সেই আসনগুলোর দখল নিতে?! 'আর কারা বসে রইল গাদাগাদি করে সেই পূতিগন্ধময় দুঃসহ ঘিঞ্জি ট্রেনের শৌচাগারের সামনে? আর সারারাত গান গাইল, কবিতা বললো, হাসি-আনন্দে ভরিয়ে রাখল সব্বাইকে?
গল্পের এই পর্যন্ত পড়েছেন যখন, তখন এই প্রশ্নের উত্তরটা শুধু আমার নয়, আপনারও জানা, তাই না?
এসব ছেলেরা এখন বড় হয়েছে, আর এদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষা জগতের সংগে যুক্ত তাই কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখের প্রয়োজন নেই। আর আমার কথাটাও কোনো ব্যক্তিবিশেষ-কে নিয়ে নয় - তাতে গল্পের মোড় ঘুরে যাবে। তাই ফিরে আসি সেই শুরুর বিন্দুতে। পুরোনো এসব ঘটনার দিকে তাকিয়ে, গভীরভাবে ভাবতে গেলে যে মৌলিক প্রশ্নটা ওঠে সেটা হল: ‘এ কেমন আমাদের সমাজ যা পুরুষদের শেখায় যে এই পৃথিবীর সব কিছু, সব সুযোগ ও আরামের অধিকার তাদেরই?’ মেয়েরা শুধু তাদের আরামের উপকরণ যোগাবে, আর বাইরে হোক কি ঘরে, যে কোনো স্থানে, যে কোনো পরিস্থিতিতে, তাদের দেখাশুনো করবে আর ছেলেদের শরীর ও মনের তৃপ্তির বন্দোবস্ত করবে। মায়েরাও এভাবেই যুগ যুগ ধরে ছেলেদের বড় করেছেন। তাদের জানিয়েছেন যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারাই আসল, তারাই প্রধান, তাদের জন্যেই আকাশের সূর্য-তারা ওঠে, তাদের জন্যেই রাত শেষ হয়ে ভোর হয়। হয়তো মায়েরাই তাঁদের অজান্তে কিংবা কোনো নিগূঢ় স্বার্থে অনড়-অচল এই আশ্চর্য অসাম্য সৃষ্টি করেছেন এবং লালন করছেন।
কতকিছুই তো আমরা বদলাচ্ছি প্রতিদিন। দেশের শহর ও অন্যান্য স্থান-নাম দ্রুত বদলাচ্ছে। আমরা ভৌগোলিকেরা জানি যে স্থান-নাম হল ইতিহাসের ধারক ও বাহক, একটা স্থানের নামের মধ্যে সেই জায়গার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব ভূগোলের জ্ঞান তো মেয়েলি, তাই না? তাই কে যেন বোম্বে-কে হঠাৎ করে একদিন মুম্বাই করে দিল কলমের এক খোঁচায়। নতুন নামের মাধ্যমে কসমোপলিটান বোম্বে হয়ে গেলো শিব-সেনার প্রিয় আমচি মুম্বাই; এই নাম যেন জোর করে মুছে দিলো শহরের সকল বৈচিত্র্যময় গৌরবের ইতিহাস।
এসব বাহ্যিক বদল তো হয়েছে এবং আরো-ও হবে, কিন্তু কবে বদলাবে ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজের পুরুষদের 'স্বাভাবিক' অধিকার বোধ যা এই গল্পে বলা ছোটো ছোটো দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে?
ভারতীয় নারীবাদীরা এতদিন শুধুই মেয়েদের কথা ভেবেছেন আলাদা করে। কিন্তু সমস্যা তো পুরুষদের নিয়ে; তাই না? তাঁরাই যখন বেশির ভাগ সমস্যার সৃষ্টি করেন, তখন তাঁদের নিয়েই ভাবা দরকার। কিন্তু তাঁদের কে বদলাবে? কবে?