মেড়ামেড়ির ঘর জ্বলে রে........... হু---ই!
এই হচ্ছে আশৈশবের মকর সংক্রান্তির দিনের সূচনা। গোটা দেশে এই দিনটিতে বিভিন্ন নামে উৎসব পালন করা হয় ঠিকই। ভোগালি, পোঙ্গল, ওনাম, মকর সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ইত্যাদি।
মূল কথা তো একই! ফসল তোলার উৎসব। ভাড়ার উপচে পড়ার আনন্দে মেতে ওঠার উৎসব। কয়েকটি মাস হাঁড়ির হাল নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার উৎসব। সন্তানদের নুনে ভাতে রাখতে পারার নিশ্চিন্দিপুর প্রাপ্তির উৎসব।
তবে 'বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিতা সুন্দরী শ্রীভূমি'র থেকে নির্বাসিত শ্রীহীনদের এই উৎসব পালন নিয়ে আজ দুটো কথা বলব। পছন্দ হোক চাই না হোক, প্রাণ বাঁচাতে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসত গড়া ঐ শ্রীভূমির শ্রীহীন ও শ্রীময়ীরা বসতবাটি ত্যাগের ডে ওয়ান থেকে আজ অব্দি যেন প্রতিদিন আরো এক চামচ বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন নিজের কৃষ্টিকে। সংস্কৃতিকে।জীবন চর্যাকে। জীবন যাপনকে। আর এই বহমান যাত্রায় আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা, মা-ঠাকুর্মারা দায়িত্ব নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের আচার অনুষ্ঠান।
কাজেই এই মেড়ামেড়ির সকালে এই ঘর ও এই রাতের পিকনিক নিয়ে কারো শৈশব স্মৃতি নেই বললে আপনি কিন্তু সত্যিই সুন্দরী শ্রীভূমির বিতাড়িত লোকেদের তালিকা থেকেও বাদ পড়বেন। যার যা আছে ঝুলিতে বলে ফেলুন দিকি!
মফস্বল শহরে জন্ম। বাড়ি। গ্রামের দশ কিয়ার ক্ষেত, দুশো মন ধান, দু-দশটা হালের গরু, দুধেল গাই কিচ্ছুই পাই নি উত্তরাধিকার সূত্রে। তবে আবার পৌষ সংক্রান্তি কি করে হবে! হ্যাঁ! যেমন আশ্বিন মাসের গর্ভ সংক্রান্তিতে বাপের কেনা তিন কাঠা সাত ছটাকের বাড়িতে নিজের হাতে লাগানো ষোলটা সুপুরি গাছ, তিনটে নারকেল গাছ, আমলকি ও নিম দুটো বাড়ি রাখাল গাছের গোড়ায় চালতা পাতার টগা দেওয়াতেন মা ! ফসল পোকামুক্ত থাকার কামনায়। তেমনি মেড়ামেড়িটাও হোত জম্পেশ করে।
ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দাদার তখন স্বাধীন বিচরণ। পৌষ মাস পড়তেই হাতে দা, ছুরি, কাঁচি কিছু একটা নিয়ে সকালের খাবার খেয়েই রওয়ানা আবুল কালাম স্কুলের মাঠে। সঙ্গে আমি ফেউ। কাটতে না পারি। বয়ে আনতে তো পারি! পাড়ায় তখন আমাদের ছোটদের একটাই আলোচ্য বিষয়। কে কত গল্লা (আঁটি) ন্যাড়া জমিয়েছে। ন্যাড়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলে বাঁশ সংগ্রহ অভিযান।
তারপর মেড়ামেড়ির দুদিন আগে থেকেই দাদার তো নাওয়া খাওয়ার জো নেই। অতো বড় দায়িত্ব। ঘর বানাতে হবে। একা। জোগাড়ে একটা আছে যদিও।সে বড্ড বেশি দুধভাত মার্কা। খড়ের ঘসা লেগে হাত ছড়ে যায়। বাঁশ এগিয়ে দিতে বললে কাটা বাঁশের কোণ লেগে পা কেটে যায়। এক্কেবারে বিচ্ছিরি রকমের বে-ভূতা। কোনো কম্মের নয়। অগত্যা এই ক'দিন দাদাকে তোয়াজ করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ঘর তো হল। এবার মেড়ামেড়ির রাতের পিকনিকের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দিদিরা। মুরগি ঘরে রান্না!! নৈব নৈব চ। এই তো শুরু। নিজেদের রন্ধন শৈলী পরখ করে দেখার এমন দুর্দান্ত সুযোগ এর আগে বাড়ির মেয়েরা পায় কোথায়! এদিকে আমি আনাড়ি এখানেও ডাহা ফেল। তুতো দাদা দিদি সহ বাড়ির সব ভাই বোনদের টিমে দুধভাত আমি এখানেও জোগাড়ে। সবাই বলতো 'পেয়াইলপাছলি'। সন্ধ্যেবেলা ডিম পাউরুটি দিয়ে 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট' তৈরির মহড়া দিয়েই দিদিদের রান্নার হাতেখড়ি শুরু হোত। তো সন্ধ্যে হতেই ওর'ম রুটি-টোস্ট সদৃশ কিছু একটা খেয়ে শুরু হোত মুরগি রান্না।
পাঠকদের মাথায় রাখতে হবে এসব ঘটনার প্রেক্ষাপট হচ্ছে আশির দশকের শুরু। তখন এই মফস্বলের বাতাসে আজকের মতো এতো কার্বন জমে হাওয়া ভারি করে তোলে নি। চারদিকে জমে ওঠে নি আমিময়তা। আমরা তোমরা'র বিষবাষ্প নিঃশ্বাসে ক্লেদ ঢোকায়নি।
একবার মুরগি কেনার টাকা দিতে বাবা নারাজ। অথচ বচ্ছরে ঐ একটা দিন নিজের শেফ গিরি, শিভ্যালরি, শো-ম্যানশিপ...... শ'ওয়ালা আরো কত কিছু পাড়ার বন্ধুদের দেখানোর সুযোগ পাওয়া যায়। আর ঐ দিনটাতেই যদি পাঠা আসে, তবে তো মা এই হাতুড়ে পাচকদের হাতে রান্নার ভার ছাড়বেন না। মুরগি তখনও রান্না ঘরে প্রবেশাধিকার পায় নি। অতএব.......! ভুতো দাদার শরণাপন্ন হতে হলো। সে বললো, ' অন্ধকারটা হতে দে!' সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ পরেই আমাদের বাড়িমুখো রওয়ানা হলো ভুতো দাদা। আর ব্যাটার পয়াও মানতে হয়। আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো পাড়াটায় কয়েকঘর মুসলমান বসতি ছিল তখন। তাদের বেশ কয়েকজন হাঁস মুরগি পালন করতেন। ঠিকানাহীন একটি বেশ বড় সাইজের মুরগি কিনা এসে পড়লো ভুতো দাদার চলার পথেই। আর যায় কোথায়! তখনও রাস্তায় পুরসভার আলো, নিয়নবাতি জ্বলে নি। ঘরে ঘরে কুপি লণ্ঠনই সম্বল। আধো অন্ধকারে বগলের বাজার ব্যাগের মুখ খুলে টুক করে মুরগিটাকে ধরে দিল ব্যাগে চালান করে। তারপর ও যখন এসে বাড়িতে কাটা, বাটা রান্না শুরু করলো, বাবার আর কিছু বলার রইল না। হাজার হোক সম্বন্ধী পুত্র তো! শুধু একটাই শাসানি দিয়ে রাখলেন। 'কাল সকালে যদি কোনো নালিশ আসে আমার কাছে, তোদের সবকটাকে পুলিশে দেব।'
আসলে ব্যাপারটা বাবা জানলেন যখন পাখির পালক ফেলা নিয়ে শুরু হয়েছে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর। আগে জানলে এরআগেই পাখিটি তার ঠিকানায় চলে যেত। এদিকে আমার ভুতো দাদাটিও এককাঠি সরেস। বাবার বকুনি সব নিমতেতো মুখে হজম করে দুর্দান্ত একখান মুরগির ঝোল বানিয়ে ভাই-বোন নিয়ে হৈচৈ করে খাওয়া দাওয়া করে যাবার পথে আবার বাজারের থলেতে সব পালক ঢুকিয়ে রাত বারোটায় বাড়ির পথে। আমাদের দুবাড়ির ঠিক মাঝখানটায় পড়ে শহরের একমাত্র শ্মশানঘাট। নির্বিবাদে শ্মশানকালীকে সাক্ষী রেখে শ্মশানের দেয়াল টপকে থলেটা উপুড় করে আবার ভালো ছেলের মত বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। ব্যস, কেল্লা ফতে!
এদিকে মেড়ামেড়ির রাতে মা তখন অন্য যুদ্ধে ব্যস্ত। ওদেশের ধান, মাছ না-ই বা থাকলো। নিয়ম তো রয়েছে। আর তা পালনও করতে হবে অক্ষরে অক্ষরে। পৌষ মাসের পর আর মূলো খেতে নেই। বারণ আছে। তাই মূলোর এক বিশাল বাজার সেদিন আমাদের রান্নাঘরে হরেক রং আর সাইজের। মূলো কুচিয়ে শিদল শুটকি দিয়ে করুয়া। লাল গোলগাল মুলোর বড়া। ইত্যাদি। বাড়ির পুকুর না থাকলেও বাজারেরই সই। বেশ বড় সাইজের তিন-চার কিলো ওজনের পাকা রুই বা কাতলা। এর মুড়ো দিয়ে পানীলাউয়ের ঘণ্ট। হজমে খুব কাজে দেয়।(আমার পিতৃদেবের যুক্তি)। সঙ্গে ধনেপাতা দিয়ে পাকা মাছের শর্সেবাটার চচ্চরি। বিরুণ ভাত। থাল বেগুন ভাজা। মাছ ভাজা ।সবই চাই বাবার। বাচ্চাদের চেনাতে হবে। শেখাতে হবে তো!
সঙ্গে রয়েছে মায়ের পিঠে পর্ব। চাল গুড়ো করার জন্য একজোড়া বা দুজোড়া গাইল-ছিয়া (হামানদিস্তার দৈত্যাকার সংস্করণ) তখন পাড়াময় ঘুরে বেড়াতো গোটা পৌষ মাস জুড়ে। আমার নির্ভেজাল মা এই দৌড়ে টাল সামলাতে পারতেননা। তাই উপায় না পেয়ে শিল নোড়ায় বাটা হোত চাল। তৈরি হোত মালপোয়া, পাটিসাপটা, দুধপুলি, পুলিপিঠে। নারকোল কুড়োতেন পাঁচটা ছটা। একা হাতে করতেন ছোলা বেটে চানার পিঠে, আলুর পিঠে, সব্জির পুলি আরো কত কি! সব শেষ করে পরের দিন সংক্রান্তির ঝাড়পোছ ধোয়ামোছা করতে করতে কাক ডেকে উঠতো। একমুখ হাসি নিয়ে লেপ কম্বল পায়ের তলায় ফেলে ঠাণ্ডায় জড়োসড়ো মেড়ামেড়ির ঘরে নিশিযাপন করা ভাই বোনেদের গায়ে লেপ টেনে দিয়ে মা প্রথম দফার চানের তাগাদা দিয়ে চলে যেতেন চানের জল গরম করতে। দু-তিনবার তাড়া খেয়ে, এবাড়ি ওবাড়ি থেকে সঙ্গীসাথীদের হাঁকডাক শুনে আমরাও বীরবিক্রমে নেড়ার শয্যা ছেড়ে উঠে পড়তাম। সূর্যোদয়ের আগে মেরামেরির ঘর পোড়াতে না পারলে এই ডিসক্রেডিট সেদিন পাড়াময় তাড়া করে বেড়াবে। তা-ও আবার চান সেরে ধোয়া কাপড় জামা পড়ে।
মেড়ামেড়ির ঘর জ্বালিয়ে তাতে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় চান করা শরীরটা সেঁকে নিয়ে শুরু হল পৌষ সংক্রান্তির দিন। তিলের নাড়ু, তিলুয়া খেয়ে শুরু তিল সংক্রান্তি। তারপরই মায়ের তৈরি পিঠে পুলির থালা। সঙ্গে একবাটি করে দই। পিঠের সঙ্গে ক্ষীর ওপারে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এপারে এসে সেই গরুও নেই, সেই দুধও নেই। তাই সেটা শিফট করে বাবা লাল দইয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আর এখনকার মত আমাদের এই মফস্বল শহরের ময়রারা সেই আশির দশকে গরুর দুধ 'তৈরি' করতে শেখে নি। তাই বাজারে ইচ্ছেখুশি ক্ষীর পাওয়া যেতো না। এদিকে ঘরের থালাটা শেষ করে আশপাশের লোকজনের ঘরে নেমন্তন্ন রক্ষা করা। সে-ও এক বিশাল দায়। দুয়েক ঘরের পিঠে সাবাড় করেই এই ছোট ছোট পেটগুলির তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
ততক্ষণে বেলা বাড়তে শুরু করেছে। আরম্ভ হয়েছে কীর্তনের পরব।পাড়ায় কীর্তন গেয়ে রবি চক্কোত্তি দাদুর নেতৃত্বে কীর্তনিয়া দলের পাড়া পরিক্রমা। সঙ্গে আমরা একদল কচিকাঁচা। সবার বাড়িতে কীর্তনের পর লুট। কে ধরল নারকোল, কে ধরল কমলা আর কে ধরল ক্ষীরা (শসার স্থানীয় সংস্করণ)। আর আমাদের মতো কুচোদের ভাগ্যে জুটতো বাতাসা, নকুল দানা ইত্যাদি। কিছুদূর গিয়েই কাহিল আমরা ছোটরা ঘরমুখো হতাম।
কেঊ কেউ আবার মেড়ামেড়ির ঘর জ্বালানোর সময় তাতেই আগের থেকে তৈরি করে রাখা চোঙ্গা ফেলে দিতেন। শরীরে উষ্ঞতার ছোঁয়া নিতে নিতে উল্টেপাল্টে তৈরি করে নিতেন চোঙ্গা পোড়া। এ এক মজাদার খাবার। বিরুণ চাল ভালো করে ধুয়ে জল ঝড়িয়ে রাখা হয় । ডলু বাঁশ নামের বিশেষ এক ধরনের বাঁশ এক-দেড় হাত লম্বা সাইজে বাঁশের আখ অব্দি কেটে তাতে কলাপাতা ঢোকানো হয় । তারপর ঐ কলাপাতার মোড়কের ভেতরে বিরুণ চালগুলো আদ্ধেক পরিমাণ দিয়ে বাকি আদ্ধেকটা জল দিয়ে ভর্তি করা হয়। এরপর বাঁশের মুখটা শক্ত করে ন্যাড়া চাপা দিয়ে খড়ের আগুনে পোড়ানো হয়। বাঁশের গন্ধ সহযোগে এই বিরুণ ভাত পৌষ সংক্রান্তির এক বিশাল প্রাপ্তি।
যাইহোক কীর্তন আসবে আমাদের বাড়িতেও। মা মাটির উঠোন লেপে তাতে আসন পেতে আল্পনা দিয়ে গৌর নিতাইকে বসিয়ে দিয়েছেন। সামনে সকালে চান করে তৈরি করা আলাদা বাসনে নিরামিষ উনুনে পাঁচ রকমের পিঠে পুলি। কমলা, নকুল বাতাসা। তিলুয়া কদমা (তিলুয়ার বড় ভাই)।
দুপুরে ভাজাভুজি সহযোগে বিরুণ ভাত আর আগের দিনের রান্না করে রাখা শীতে জমে যাওয়া মাছের তরকারি ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা তো চিৎপটাং। ঘুমে অচেতন।
আজও মেরামেরির রাত পোহালে নরম কম্বলের তলায় আপন মনে ন্যাড়ার ঘর পোড়াতে পোড়াতে মিনমিনে গলায় চীৎকার করে উঠি......! মেড়ামেড়ির ঘর জ্বলে রে.....! হু-----ই!!
শান্তশ্রী সোম
১৪ জানুয়ারি,২০২২
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।