সুমিতদা আর আমি মার্কিন মুলুকে পিএইচ ডি করে একই দিনে বেল ল্যাবে যোগ দিই – সুমিতদা নেপারভিল-এ ইন্ডিয়ান হিলস ল্যাবে, আমি কলম্বাসে। সালটা ছিল উনিশশো সত্তর। তবে চেনা-জানার শুরু আশি দশকের প্রথমে - দুজনেই যখন বদলি হয়ে নিউ জার্সি আসি।
বিজ্ঞান-মনস্ক সুমিতদা’র আগ্রহ ছিল নানান বিষয়ে - সাহিত্য, সংগীত, সিনেমা, নাটক – কী নয়। সুমিতদা’র বাড়ির বেসমেন্টে যে লাইব্রেরি ছিল, তার বিশালত্ব এবং রকমারিত্ব দেখলেই আঁচ করার যেত আগ্রহের বৈচিত্র্য। বইগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জন্যে নয়, একাধিক বার তাঁর প্রমাণ পেয়েছি। কথা বলতে বলতে নীচে গিয়ে একটা বই খুঁজে বই বার করে তথ্যের সন্ধান করছে দেখে।
গানের মধ্যে বিশেষ করে ভালোবাসত রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর ভালোবাসত রবীন্দ্রনাথকে। আমি খ্যাপাতাম ‘টেগোরাইটিস’ রুগী বলে। একটা গল্প চালু ছিল। বিই কলেজের এক প্রাক্তনী কোনও এক পার্টিতে দুম করে বলে বসেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি বলার কোনো অর্থ হয় না, কারণ বিশ্বের প্রথম দশজন কবির লিস্টে রুমি বা লি পো থাকলেও রবীন্দ্রনাথ নেই।’
সবাই চুপ। নীরবতা ভাঙল সুমিতদা’র মন্তব্য, ‘‘বিশ্বকবি’ বলে সত্যিই কিছু আছে কিনা জানি না, তবে ‘বিশ্ববখাটে’ আছে, আর এই রুমেই সে আছে।’
এটা সত্যি কিনা জানি না, কিন্তু হলে অবাক হব না। সুমিতদা ছিল ‘নো-ননসেন্স’ ম্যান, আজেবাজে কথা সহ্য করতে পারত না। কেউ বাজে বকতে শুরু করলে, তর্কাতর্কি না করে জিজ্ঞেস করত, ‘এটা কি আপনার ওপিনিয়ন, মানে বিশ্বাস, না এর পেছনে কোনো তথ্য আছে? এটা আপনার বিশ্বাস হলে সময় নষ্ট করব না।’
বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের দু-জনেরই পাগলামি ছিল, সেই সুবাদে জড়িয়ে পড়লাম নানান ‘কুকর্মে’ (সুমিতদার কথায়)। কম্পিউটার তখন এসে গেছে, সুমিতদার মাথায় চাপল কম্পিউটারে লেখার জন্য বাংলা ফন্ট তৈরি করবে। কাজ শুরু হল, করছে সুমিতদা, আমার কাজ এক-আধ সময় সঙ্গত দেওয়া। অর্থাৎ, এটা দেখতে ভাল লাগছে না, ওটা একটু ছোটো কর – এইসব বলা। এই ‘হরফ’ ফন্ট ব্যবহার করে কলকাতায় আর নিউ জার্সিতে দুয়েকটা বইও ছাপা হয়ে গেল। দু হাজার এক সালে এই ফন্টকেই একটু কাট-ছাঁট করে আমরা বাংলা ওয়েবসাইট ‘অবসর.নেট শুরু করলাম।
সুমিতদা বাংলা ইংরেজি দুটো ভাষাতেই ছিল দক্ষ। ইংরেজিতে আমি বরাবরই কাঁচা, সুতরাং কতটা ভালো লিখত সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। সেই নিয়ে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমি করব না। তবে সুমিতদার বাংলা ছিল ঠাস-বুনুনি ‘ক্লাসিক বাংলা’ – এদিক ওদিক ওজনদার শব্দ দিয়ে গাঁথা অত্যন্ত সুপাঠ্য রচনা। মাঝে মাঝে অবশ্য ডিকশনারি খুলতে হত মর্মোদ্ধারের জন্য। তখন বুঝতে পারতাম ভাব প্রকাশের জন্য সেটিই ছিল মোক্ষম শব্দ। শুধু কতগুলো শব্দের ওপর সুমিতদার বাড়াবাড়ি রকমের দুর্বলতা ছিল, যেমন ‘চেষ্টিত’ কথাটা। লেখায় ‘চেষ্টিত’ চোখে পড়লেই আমি চ্যাঁচামেচি করতাম।
“চেষ্টিত করতে হবে কেন, চেষ্টা করতে হবে লিখতে পারো না?”
সুমিতদা গজগজ করত, “কেন খারাপটা কি, কথাটায় তো বাঁধুনি আছে, প্রচেষ্টার ভাবটা স্পষ্ট কেমন ফুটে উঠছে।” বার বার আমার তাড়া খেয়ে, শেষে আর কথাটা আর লিখত না। পরে মাঝে মাঝেই অনুযোগ করেছে, “তোর জন্য আমার লেখার ফ্লো কমে যাচ্ছে!”
বাজে কথা, ফ্লো মোটেও কমে যায়নি, ওই বিশেষ শব্দ বাদ দিয়েও সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে বহু সুপাঠ্য প্রবন্ধ সুমিতদা লিখেছে অবসর ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় - পরশুরাম, দিলীপকুমার রায়, শরদিন্দু, প্রমুখদের নিয়ে নানান আলোচনা। বাংলায় ভালো প্রবন্ধ বেশি চোখে পড়ে না, বিশেষ করে এ-যুগে। গায়ক বা লেখকের বিশাল কর্মকাণ্ড থেকে নির্যাসটুকু বার করে, তার বিশ্লেষণ ক-জন করতে পারেন?
আমার বাংলা সাদামাটা বাংলা। চাইলে যে সুমিতদা সেভাবেও লিখতে পারত তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ- বিভূতিভূষণের ‘পোনু’-কে নতুন ভাবে মার্কিন মুলুকে আত্মপ্রকাশ করিয়ে সুমিতদা-র লেখা এক গুচ্ছ ‘পোনুর চিঠি’। পুরোনো ‘অবসর’ আর অধুনালুপ্ত ‘আন্তরিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিগুলো ছিল ব্যাঙ্গ আর শ্লেষে পরিপূর্ণ! অত্যন্ত সুপাঠ্য সেই চিঠির একটাতে হোঁচট খেয়েছিলাম ‘পন্টক’ শব্দটা দেখে - ব্যবহার করা হয়েছে কোনও এক সম্মেলনে কয়েকজনকে উদ্দেশ্য করে।
‘পোনুর চিঠিতে এই কঠিন শব্দটা কেন ঢোকালে, এর অর্থ কী?’
‘কেন ডিকশনারিতেপাসনি?’
‘না।’
‘কণ্টক কথাটার অর্থ জানিস?’
‘কাঁটা।’
‘তাহলে?’
এই হল সুমিতদা!
গান ছিল সুমিতদার প্রাণ। নিউ জার্সিতে রুবিদি(বনানী ঘোষ)-র গানের স্কুল ‘অন্তরা’-র প্রচার এবং প্রসার নিয়ে আদ্যন্ত রবীন্দ্রপ্রেমী সুমিতদা’র ব্যস্ততা ছিল দেখার মতো। একে গান, তার ওপর রবীন্দ্রসঙ্গীত। দু-তিনটে রবীন্দ্র-মেলা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল, যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল সুমিতদা।
শারীরিক ভাবে একাধিক বার ধাক্কা খেয়েছে জীবনে… হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, মেনিনজাইটিস, ইত্যাদি অনেক ঝড় ওর দীর্ঘ দেহ সামলেছে। যে গান ছিল সুমিতদা’র প্রাণ, শারীরিক কারণে সুর উপভোগ করার ক্ষমতা যখন প্রায় লোপ পেল, একটা প্রবন্ধ লিখল ‘বধিরতা’ নিয়ে – তথ্যপূর্ণ কী অপূর্ব লেখা! গান শোনা বন্ধ হল, সেটা পুষিয়ে নিতে বই পড়ার গতি বাড়ল বহু গুণ।
মৃত্যুর সপ্তাহ পাঁচেক আগে যখন জানতে পারল দুরারোগ্য ক্যানসার রোগের খবর, তার দিন দুই বাদেই ফোন।
‘একটা বাজে খবর আছে রে…।’
শান্ত ভাবে খবরগুলো দিয়ে বলল, ‘গীতবিতান.নেট-কে কী করে বাঁচিয়ে রাখা যায় বল তো?’
সুমিতদা’র–নিজের হাতে তৈরি এই সাইট আমার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের এনসাইক্লোপিডিয়া। নিজের মৃত্যুর থেকে এটা নিয়েই চিন্তা! ছেলেমেয়েদের বলে গিয়েছিল মারা যাবার পরে সেই সাইটে নীচের এই পোস্টটা দিতে …
“পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহো ভাই--
সবারে আমি প্রণাম করে যাই॥ ...”
----সুমিত রায় ----
The discharge papers have arrived,
say farewell to me folks,
my regards to you all....
----Sumit Roy ----
বিদায় দিতে তো মন চাইছে না সুমিতদা! যেখানেই থাকো ভালো থেকো।
খুব মন খারাপ হলো লেখাটা পড়ে।.. ভালো মানুষদের জন্য বোধহয় ভগবানও অপেক্ষা করেন।..
অধুনালুপ্ত ‘আন্তরিক’ পত্রিকার ডিসেম্বর ১৯৮০ থেকে শুরু করে পরের ৬ টি সংখ্যা কি বাই এনি চান্স সংগ্রহে রয়েছে সুজনবাবু?
সুমিত আমারও প্িয় বন্োধু ছিল। গত বছর পাঁচ্ ট্রাম্প আমাদের এক সূত্রে বেঁধে দিয়েছিল। আমরা কত বই পডলাম অবশ্য সুমিতই ছিল গুরু। রোজ ঘন্টা দুয়েক আলোচনা হোতো। ইদানিংবৃদ্ধ বয়সে অন্যদের মতোও আমি একটু বেদান্ত পডছি সুমিত ও সব গুলে খেয়ে হজম করে নাস্তিক। একদিন সুমিতকে বললাম আমি মুশ্কিল পডেছি বেদান্ত বলছে সকলকেই ঈশ্বরের অংশ ভাবতে হবে ট্রাম্পকে নিয়ে মুশ্কিল কি করে ওকে ঈশ্বরের অংশ ভাবি। সুমিতের চটজলদি উত্তর কেন ও তো ঈশেবরের পশ্ৎদেশের দুষ্টব্রন।
সেদিন দুপুরে সুমিত ফোন করে বলল একটা খারাপ খবর আছে ডাক্তার বলেছে লাং ক্যন্সার। আমি বললাম এখন তো অনেক চিকিৎসা বেরিয়েছে তবে ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে। সুজন আমি ভালো ডাক্তারদের জানি তাদের খবর করছি। সুমিত বলল আমি ভাবছিনা এ নিয়ে ছেলে মেয়েদের উপর ছেডে দিয়েছি। এত তাডাতাডি যে চলে যাবে কে জানত! বহু লোকের তুমি হৃদয়ে নিয়েছ ঠাঁই সুমিত।
অনেক অজানা কথা জানলাম। কলেজের প্রাক্তনী বলে ভালবাসা আরো বেড়ে গেল।
কষ্টের কিন্তু ভারী সুন্দর
অসাধারন একটি মানুষের কথা জানলাম। চলে গেলেন একটা দাগ রেখে। আজ তাঁরই কথা ভাববো
সুজন বাবু
আরো কিছু লিখুন এই মানুষটিকে নিয়ে। আপনার অনেক বলার আছে। লিখুন আপনাদের সময়টা নিয়ে। অলোক চক্রবর্তী মশায়ের কিছু বলার আছে। ট্রামপের গল্পটির মত আরো? একটা স্মৃতি সংগ্রহ ?এক অসামান্য মানুষটির বন্দনা হোক । জনসন চলে গেলেন বসওয়েলরা তো আছেন ।
অপূর্ব। এমন একটি মানুষের কথা জেনে আর একদম শেষের ওই উদ্ধৃতি পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। অসাধারণ মানুষের অসাধারণ স্মৃতিচারণা। ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
5/26/2021
" পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহো ভাই--
সবারে আমি প্রণাম করে যাই॥ ...
----সুমিত রায় ----
The discharge papers have arrived,
say farewell to me folks, my regards to you all....
----Sumit Roy ----