তবে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দানীর উৎসে পাশ্চাত্যের ঋণ থাকলেও এ কথা মানতেই হবে, পিতৃতান্ত্রিক অপরাধ-সাহিত্যপরিসরে গোয়েন্দা হিসেবে নারীদের উঠে আসা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। আর এই উত্থান যে ধূমকেতুর মতো সহসা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়ার মতো নয়, সে কথাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার পরবর্তী দুই দশকেই। তাই কৃষ্ণা-শিখার মতো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাতোয়ারা সম্পন্ন তরুণী কিংবা বিন্দিপিসি-সদুঠাকুমার মতো ঘরোয়া বয়স্কা মহিলা নন, ক্রমশ এই দুনিয়ায় আসর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন সেই মেয়েরা, যাঁরা পেশাগতভাবেই গোয়েন্দাগিরি বা অন্য কোনও বৃত্তিকে অবলম্বন করেছেন। অজিতকৃষ্ণ বসুর ডিটেকটিভ নন্দিনী সোম সায়েন্স কলেজ থেকে এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজির স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানাধিকারিণী। ... ...
গল্প শেষ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভিলমন্ত শুধুমাত্র পাস্তারনাকের কথা শুনেছিলেন। স্তালিনের কথাগুলো তাঁর বন্ধু তখনই নিজে তাঁকে বলেছিলেন। লাইনটা কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাস্তারনাক আবার ফোন করার চেষ্টা করেন। তিনি জানাতে চেয়েছিলেন যে মান্দেলস্তাম সত্যিই তাঁর বন্ধু নন, এমনটা নয় যে তিনি ভয় পেয়ে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বৃথাই চেষ্টা, ফোন ডেড! ... ...
১৯০২ এর সেপ্টেম্বরে, মৃত্যুর মাস তিনেক আগে, কাশ্মীরে থাকাকালীন,কর্নেল জেমস টডের ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যানটিকুইটিস অফ রাজস্থান’ বইটি দেখে সহচরদের বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত।” ভুল কিছু বলেননি। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে জ্যোতি-রবি-অবন ঠাকুর, কার কল্পনাকেই-বা প্রভাবিত করেনি টডের বই-এর মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে রাজপুত পৌরুষ ও নারী সতীত্বের আপোষহীন লড়াইয়ের চিত্র? ‘কেতুনপুরে বকুল-বাগানে/কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।/যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল/সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা’ পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’ কবিতায়। “বিধর্মী শত্রু সোনার মন্দির চূর্ণ করে বল্লভীপুর ছারখার করে চলে গেল,” পড়েছি অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে। ... ...
আফ্রিকার সঙ্গে আমার কাব্যিক পরিচয়, আমার চেতনার ঊষাকালে। কোন কোন রোববার, রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা খুলে আমার পিতৃদেব আমাদের কিছু কিছু কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল “আফ্রিকা”। মা বলতেন, “ওইটুকু ছেলে এই কবিতার মর্ম কী বুঝবে?” বাবা বলতেন, “মর্ম এখন নাই বা বুঝল। এই অমোঘ শব্দ-চয়ন, অন্ত্যমিলহীন ছন্দের এমন ঝংকার, বিষয়ের ব্যাপ্তি, নিষ্ঠুর সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এমন মানবিক আবেগ। এগুলোই আপাততঃ ওর মনে বসত করুক না - মর্ম উদ্ধারের সময় তো পড়েই রইল আজীবন”। আমার প্রতি তাঁদের উভয়ের বিবেচনায় এতটুকু ফাঁকি ছিল না। আর বড়ো বিলম্ব হলেও, ওই কবিতার মর্মোদ্ধার হল, হীরেন সিংহরায় মহাশয়ের “আমার আফ্রিকা” গ্রন্থটি পড়ে। ... ...
উপন্যাসটি আশ্চর্যজনকভাবে একজন প্যারানয়েড, নিজের জালে আটকে পড়া শাসকের চরিত্র চিত্রায়িত করেছে। যখন জাবিবা বলেছেন, “আপনার প্রাসাদের দিকে তাকান: মোটা দেয়াল, জানালা প্রায় নেই, অন্ধকার, বাইরের বাতাস ঢুকতে পারেনা, বাঁকানো করিডোর। এখানে থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো এক দানবের বাড়িতে বাস করছি। এখানে শুধু রাক্ষস বাস করতে পারে, এখানে ষড়যন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত হয়। রাজার দুর্গ তার কাছে কারাগারে পরিণত হয়েছে: যেমন মোটা দেয়াল আপনাকে বাইরে কী চলছে তা শুনতে বাধা দেয়, ঠিক যেমন আপনি খুব কমই দিনের আলো বা তাজা বাতাস পেতে পারেন, তেমনি বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য আপনার আর্তনাদ কখনই শোনা যাবে না। তার উপর আপনার পালানোর পথ অবরুদ্ধ, এবং আশেপাশে এমন কেউ নেই যে আপনাকে সাহায্য করবে।” ... ...
এতক্ষণ যা লিখলাম সে নিতান্ত ভূমিকা মাত্র। আসল যাত্রাপথের বিবরণ চমকপ্রদ, রোমহর্ষক। সবচেয়ে বড় কথা হল সেই পৃথিবী, পৃথিবীকে আবিষ্কারের সেই বিস্ময় আমরা ফেলে এসেছি বহু বছর আগে, এখন আর চাইলেও সেরকম যাত্রা করা সম্ভব নয়। পদে পদে প্রাকৃতিক বাধা বিপত্তি, চৈনিক প্রহরা সে যাত্রাকে করে তুলেছিল রোমহর্ষক, বিপদসংকুল। ঋতু হিসেবে তখন গ্রীষ্মের শুরু হলেও অধিকাংশ জায়গায় বরফ তখনো গলে নি, রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের অনেকটা নীচে। এই অবস্থায় অধিকাংশ যাত্রাপথ লেখক কাটিয়েছেন জুতো এমনকি মোজা ছাড়া। অনেকদূর এগিয়ে তবে এক তিব্বতি যাযাবর দলের থেকে তিব্বতি উলের মোজা কেনেন, আরো পরে প্রায় লাসা পৌঁছিয়ে কেনেন জুতো। আস্তে আস্তে অভ্যাস করেন নুন মাখন মেশানো চা খাওয়া, সম্পূর্ণ অন্ধকারে পাহাড়ি পথে হাঁটা আর কোনও প্ররোচনাতেই মুখ না খোলা, মৌনী হয়ে থাকা। ... ...
মূল বইটির বিষয়ে বলতে গেলে বলতে পারি যে, ইংরাজি বইটি ২০২১ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশের আগে করণ থাপার, বরখা দত্তের মত সাংবাদিকরা আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। দ্য উইক ম্যাগাজিনে কভার স্টোরি হয়। অ্যামাজনে বইটি অনেকদিন ধরেই বেস্ট সেলার হিসাবে আছে এবং বিক্রিও ভালই হচ্ছে। মারাঠি, পাঞ্জাবি, বাংলা, কন্নড় ও হিন্দীতে অনূদিত হয়েছে। তামিল অনুবাদ-ও শীঘ্রই আসছে। বইতে আপত্তিজনক কি কি আছে তা যদি কেউ তুলে ধরতে পারতেন তাহলে ভালো হত। আমি বলতে পারি, এই বইতে এমন কিছুই নেই যাতে একে মাওবাদী বলা যায়। বইটির উপসংহার বলছে যে পরিবর্তনের জন্য আনা যে কোনও সামাজিক প্রকল্প সফল হতে গেলে তাতে ব্যাক্তিত্বের স্বাভাবিকতা, অকপটতা, সততা, সারল্যের মত ভ্যালু বা মূল্যবোধের স্থান থাকতেই হবে – এমন কিছু গুণ যা আমি আমার প্রয়াত স্ত্রী অনুরাধার মধ্যে দেখেছিলাম। সেই সাথে, স্বাধীনতার অন্যতম উদ্দেশ্যই হতে হবে অধিকাংশের জন্য সুখ/আনন্দ। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তাদের কি অসুবিধা? তদুপরি, এই পুরস্কারের ক্ষেত্রে মূল বিচার্য ছিল অনুবাদের উৎকর্ষ। তিনি এই কাজটি করেছেন একজন পেশাদার অনুবাদক হিসাবে। যাঁর জীবিকা অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল, তাঁর থেকে পুরস্কার কেড়ে নিয়ে সরকার কি বার্তা দিতে চাইল? ... ...
গাঁওবুড়ো এক যাত্রাপথের গল্প। বলে যেতে পারে হাঁটার গল্প। হাঁটতে হাঁটতে সুখ অনুসন্ধানের গল্প। সুখ এখানে বিভ্রম। কিন্তু সন্ধানটা জরুরি। যে সন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সুখের স্বপ্ন দেখায়। মানুষ তো সুখের সন্ধানে বাঁচে। সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যেও আরেকটু সুখ বা সমস্ত অপ্রাপ্তির মধ্যেও সামান্য সুখের সন্ধান করে। ‘গাঁওবুড়ো’ তেমনই এক গল্প যেখানে বিভ্রমকে সামনে রেখে বিভ্রমের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করে জনপদ জীবনের চরম অর্থনৈতিক অস্বচ্ছন্দতার নিত্য নৈমিত্তিক দিনলিপি। রাঙা পথের জীর্ণ চিত্রে জার্নির ক্লান্তিতে মেঠো সুরে ব্যক্তি ও সমষ্টির ব্যথিত কোলাহল সহ রূপহীন-রংহীন মানুষের সমস্ত না পাওয়া ও পথের দিকে চেয়ে থাকার উদাসীন সোপান। যে ভূগোলে কিছুই নেই, যেখানে বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে মানুষ বাঁচে-স্বপ্ন দেখে, সেখানে কেউ কেউ অলীক জাল রচনা করে আরও দুই মুহূর্তের স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে যায়, ‘গাঁওবুড়ো’ সেই স্বপ্ন হাতছানির গল্প। ... ...
‘হোয়াই গুজরাট’? তিস্তা শেতলবাদ তাঁর বই ‘ফুট সোলজার অফ কন্সটিটিউশন’ এ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কেন গুজরাটকেই সংঘ পরিবার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ল্যাবরেটরি হিসাবে বেছে নিয়েছিল? তিস্তা উত্তরে বলছেন গুজরাট হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর রাজ্য, অহিংসা, শান্তির পীঠস্থান। তাঁর এই মতাদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার এটাই তো আদর্শ জায়গা! আরবি শ্রীকুমার, গুজরাটের ভূতপূর্ব ডিজি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের নজিরবিহীন রায়ের কারণে জাকিয়া জাফরি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, তিনি তাঁর বই ‘গুজরাতঃ বিহাইন্ড দ্য কার্টেন্স’ এ লিখছেন এগারশো শতাব্দীতে সোমনাথ মন্দিরে গজনির সুলতান মাহমুদের আক্রমণের স্মৃতি সচেতন ভাবে হিন্দু মানসিকতায় জিইয়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে রাজ্যে বারবার সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা গেছে। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাত্র সাত বছর বাদে সেখানে বড় দাঙ্গা হয়। ১৯৬৯, ১৯৮৫, ১৯৯২, প্রায় প্রতি দশকেই গুজরাটে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা গেছে। ১৯৬৯ সালে তো ৬০০ জনের মৃত্যু হয়। ... ...
নাট্যকারের প্রাণের সঙ্গে তাঁর নাটকও বেঁচে যায়। ঢাকায় বাংলা মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৯ সালে। সেখান থেকেই পরের বছর যুগান্তকারী নাটকটি প্রকাশিত হয়। দীনবন্ধু সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে প্রথমে তা প্রকাশিত হয়েছিল 'নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ-কেনচিৎ-পথিকেনভিপ্ৰাণীতং' ছদ্মনামে। বহুদিন পর্যন্ত তিনি নিজের আসল নাম প্রকাশ করতে পারেন নি। ঢাকার বাড়িতে বসে সরকারি চিকিৎসক ও দীনবন্ধুর প্রিয় বন্ধু ডাঃ দুর্গাদাস কর রাত জেগে নাটকের প্রুফ সংশোধন করেছিলেন। বাংলার আধুনিক নাট্যধারার পথিকৃৎ মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র অবশ্য মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারায় তিনিই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের নাট্যকারদের আদর্শ স্থানীয়। ... ...
‘চাঁপাডাঙার বউ’ উপন্যাস ভাঙনের কাছাকাছি গিয়ে আবার এক হয়ে যাওয়ার কাহিনি। নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়ে বাড়িতে এসেছিল ‘বড়বউ’। দেওর মহাতাপ তখন আট বছরের বালক। তাই তারা পরস্পরের বাল্যসঙ্গী। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক নিবিড় ভালোবাসা ও ভরসার সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল। সেই ছিল ছোটবউ মানদার রাগের কারণ। গ্রামের পাঁচজনে বউদি-দেওর সম্পর্ক নিয়ে পাঁচ কথা বলতে শুরু করায় সেতাবেরও মনে সন্দেহ জাগে। একথা শুনে বড়বউ রাগ করে তার স্বামীকে বলত, ‘ইতর’। বলত, পটোয়ারি-জালিয়াতি বুদ্ধিতে এই সম্পর্কের হিসেব বোঝা যায় না। ... ...
‘সন্দীপন পাঠশালা’র আগে তারাশঙ্কর তাঁর ছোটগল্পে শিক্ষক-মহাশয়দের কথা অল্প অল্প তুলে ধরেছেন। ১৯৩৩ সালে বঙ্গশ্রীর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘মধু মাস্টার’, ১৯৩৬ সালে দেশ পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় ‘পণ্ডিত মশাই’ এবং ১৯৪১ সালে প্রবাসীর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘হরি পণ্ডিতের কাহিনি’। ‘পণ্ডিত মশাই’এর যতীন চাটুজ্জে এবং ‘হরি পণ্ডিতের কাহিনি’র হরিনাথ চাটুজ্জে যে একই ব্যক্তি তা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না। দুজনেই পল্লীগ্রামের পণ্ডিত। দুজনেরই পাঠশালা বসে জমিদারের কাছারি বাড়িতে। ছেলে পড়ানোর চাকরির অঙ্গ হিসেবে দুজনকেই গ্রাম দেবতার পুজো করতে হয় এবং জমিদারের আগমন হলে রাঁধুনির ভূমিকা পালন করতে হয়। এঁদের দুজনেরই কাজে প্রবল নিষ্ঠা। খেটেখুটে একেকটি ছেলেকে এঁরা তৈরি করেন বৃত্তি পরীক্ষার উপযুক্ত করে। আর পার্শ্ববর্তী পাঠশালা সেই ছাত্রকে লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যায় পরীক্ষার আগেই। তাই এঁদের পাঠশালা সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকে। যতীন অথবা হরি পণ্ডিতকে এই কারণে লোকে ‘কাক-পণ্ডিত’ বলে। চিরকাল কাকের মতো তাঁরা অপরের বাচ্চাকে উপযুক্ত করেই যান। ... ...
বাস্তবিক, কুড়ি বছর আগে, ২০০১ সালে আমেরিকা ও যৌথবাহিনী যখন তালিবান ও আল-কায়দাকে ধ্বংস করতে আফগানিস্তান অভিযান চালিয়েছিল, তারা এমন একটি ভাব করেছিল যেন শুধুমাত্র তালিবানদের উৎখাত করাই নয়, ‘রক্ষণশীল’ আফগান সমাজের আধুনিকীকরণ এবং সেখানকার নারীদের রাতারাতি পশ্চিমী নারীতে পরিণত করাই তাদের অগ্রাধিকার। সেই সঙ্গে একটি মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি পশ্চিমী ধাঁচের উদার গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে শান্তি ও প্রগতির পতাকা তুলে ধরাও ছিল তাদের প্রতিশ্রুতির তালিকায়। কিন্তু গত দুই দশকে যে-সব ছবি উঠে এসেছে, তাতে এ-কথা আজ স্পষ্ট যে, শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা উন্নয়ন কোনটাই তাদের লক্ষ্য ছিল না। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরে পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে, রাশিয়া, চীন ও ইরান— মার্কিন সাম্রাজ্যের প্রতিস্পর্ধী এই দেশগুলির চারপাশে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি তৈরি করাই ছিল আফগানিস্তান দখলের প্রধান উদ্দেশ্য। ... ...
"স্টিফেন হকিং এর কোনো বই পড়তে গেলেই বোঝা যায় যে উনি একজন দুর্দান্ত শিক্ষক। ওঁর ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম পড়তে গিয়েই সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। কোনো জটিলতম বিজ্ঞানের তত্বকে সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা,সরস পরিবেশন এবং অন্তর্দৃষ্টি—এসবই তাঁর সম্পদ। ্মৃত্যুর আগে লিখিত সর্বশেষ বই ব্রিফ আনসারস টু দ্য বিগ কোয়েশ্চেনসও তার ব্যতিক্রম নয়। দু একটি দুরূহতম জায়গা ছাড়া প্রায় সবটাই সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার ভিতর নিয়ে আসতে পারেন তিনি। সাধে কি আর ব্রিফ হিস্ট্রি বেস্ট সেলার হয়েছিল।" পড়লেন সন্দীপন মজুমদার। ... ...
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন চর্চায় আমরা বারবারই এই প্রশ্ন তুলি, যে দেশভাগ কি এড়ানো যেত না ? তা কি অবশ্যম্ভাবী ছিল ? কীভাবে এড়ানো যেতে পারত দেশভাগ তার উত্তর দিতে গিয়ে নানাজনে নানা কথা বলেন। সম্প্রীতি উদ্যোগকে আন্তরিকভাবে দৃঢ় করার চেষ্টা থেকে ফেডারেল কাঠামোর কথা ভাবা – নানা প্রসঙ্গই সেখানে আসে। দেশভাগ যে দাঙ্গা, ভিটে ছেড়ে যন্ত্রণাযাত্রা আর উদ্বাস্তু জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত – তা আমাদের সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সিনেমা সহ নানা সাংস্কৃতিক পরিসরে উঠে এসেছে। আমরা এখন পড়তে চাইছি এরকম কিছু বইয়ের পাঠ, যা দেশভাগকে নানা দিক থেকে দেখেছে। ... ...
"পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক মুসলিম পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে লেখক সুকৌশলে বুনে দিয়েছেন – সাতচল্লিশের আগের অখণ্ড ভারতের উত্থান-পতন, তদানীন্তন রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশগঠন ও সামাজিক অবক্ষয়ের আখ্যান। এ কাহিনীর নায়ক সময়। সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতি মিলেমিশে গেছে এ উপন্যাসে। একটি পরিবারের নানা ওঠাপড়ার ছবি আঁকতে আঁকতে গোটা একটি সমাজের উত্থান-পতনের চিত্র এঁকে দিয়েছেন কাহিনীকার। বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুঠাম গদ্য পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। লেখক আগাগোড়া উপন্যাসটিতে রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন।" হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ নিয়ে লিখলেন রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায়। ... ...
কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এমনই এক অনুশীলক বলেই তাঁর হাতে জন্ম নেয় “উজানতলির উপকথা”-র মতো আদি-অন্তের সীমানা ছাড়ানো এক আশ্চর্য সৃষ্টি। দুই খণ্ডের এই উপন্যাসের প্রধান বিশেষত্ব হল এর বহুস্তরীয় প্রেক্ষাপট। দেশভাগের পরিণতিতে বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণ যেমন এর এক প্রেক্ষাপট, তেমনি আবার অবিভক্ত বাংলায় – এবং ভাঙ্গা বাংলায়ও বটে – বাঙালি জনসম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য এর অন্য এক প্রেক্ষাপট, আবার জাতি ও ধর্মীয় বিভাজনের সঙ্গে আর্থিক শ্রেণিবিভাজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এ কাহিনির তৃতীয়, এবং জটিলতর পৃষ্ঠভূমি। প্রেক্ষাপটের বিভিন্নতার বিপরীতে আছে সেই বিভিন্নতাগুলো নিয়ে নির্মিত ও এগিয়ে চলা এক বৃহত্তর মানব সংহতির উপাখ্যান। আলোচনা করলেন কুমার রাণা। ... ...
সুকোভ কোনও সময় টুপি পরে খাবার খায় না। সেটা খুলে সে হাঁটুর ওপর রাখে। তার দিয়ে তৈরি করা একটি চামচ যেটা সেই ১৯৪৩ সাল থেকে তার সঙ্গী সেটা সে তার পায়ের ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলোর মধ্যে থেকে বার করে। চামচ দিয়ে দুটো বাটির তরল নাড়িয়ে দেখে। গরম, ধোঁয়া উঠছে। এক চামচ সে মুখে দেয়, আরও এক চামচ। উষ্ণতা তার শরীরের জমে থাকা হিম ভেদ করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। আঃ স্বর্গীয়! তার মুখ উদ্ভাসিত, কোনও কষ্টই তার কাছে আর কষ্ট নয়। লপসিটা সে নাড়ায়, চলে যাবে, মাছের একটা সেদ্ধ ক্ষীণ কাঁটাও আছে যেটার সঙ্গে ফুলকো পাখনার টুকরাটাকরা লেপটে আছে। প্রতিটি কাঁটা সে শুষে নিঃশেষিত করে ফেলে, ছিবড়ে করে টেবিল ভরিয়ে দেয়। ৎসজারের বাটিতে আবার একটা বরফঘেয়ো আলু! কোনও তাড়াহুড়ো নেই তার, ধীরে সুস্থে খায়। আলুটা মিষ্টি, কিন্তু শক্ত। সুকোভ একটা বাটির তরল শেষ করে অবশিষ্টটা কাচিয়ে দ্বিতীয় বাটিতে ঢেলে দেয়। সেটাও চেটেপুটে চকচকে করে দিয়ে তবে তার শান্তি। ... ...
তবে শেষপাতে বলতেই হয়, কলকাতার পথঘাটের আনাচে কানাচে যতটা স্বচ্ছন্দে বিহার করেছেন হার্ট, লোক বা সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর ধারণা ততটাই অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট এবং নেড়াতথ্যের ভারে জর্জরিত। কাহিনি উঠে আসে না সেই থেকে; বড়জোর কিছু কিছু টুকরো ছবি দেখতে পাওয়া যায় বড়জোর। যেমন জানা যায়, ইংরেজদের আসারও আগে পর্তুগিজদের শুরু করা ক্রীতদাস প্রথা কিভাবে কোম্পানির শাসনকালেও বহাল তবিয়তে ছিল, ১৭৮৯ সন অব্দি। দাসপ্রথার সঙ্গে জড়িত বর্বরতার প্রতীক বা অমানবিকতার ইতিহাস, কোনোকিছুই মান্য হয় নি সেকালে। দিব্যি চলেছে দৈনিকে দাস কেনাবেচার, বা পালিয়ে গেলে সেই কারণে দেওয়া বিজ্ঞাপন। কেউ দাস কিনলে কাছারিতে রেজিস্ট্রেশন করাতে হতো সেই দাসের। তারপর নিংড়ানো শুরু। ... ...
খালের প্রসঙ্গ ধরে কলকাতার ইতিহাসে প্রবেশ করার গুস্তাখি মাফ; আমি নিরুপায়। যা পড়েছি, তাই বলছি: সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন মারাঠা বর্গিরা বারবার বাংলায় হানা দিচ্ছে, গঙ্গাপ্রান্তের এই শহরকে বাঁচানোর জন্য শহরের মাঝবরাবর একটা বিরাট খাল কাটা হয় (যাকে বুজিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের সার্কুলার রোড)। বৃথাই খাল-কাটা! বর্গি এল না কলকাতা ঘুরতে, উল্টে সেই পরাক্রমশালী খাল ডিঙিয়ে সিরাজের সৈন্যদল হাহা করে এসে শহরের সবচেয়ে পুরোনো নাট্যশালা 'ওল্ড প্লে হাউজ' ভাঙচুর করে চলে গেল ১৭৫৬ নাগাদ। এতকিছুর পর বোধ হয় অনেকের মনে হয়েছিল, এতবড় একটা খাল কাটলাম, একেবারে কোনোই কাজে আসবে না? সে থেকেই অনুবর্তী নবজাগরণ -- 'খাল-কাটা' টু ‘ক্যালকাটা’। ... ...