দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে যেভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বাঙালি মধ্যবিত্ত, ঠিক সেভাবেই ওরা তাকিয়ে ছিল মসজিদের বিরাট গেটটার দিকে। ‘ওরা’ মানে, একেবারে বিশুদ্ধ হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবার – কর্তা, গিন্নি, একটি বছর বারোর ছেলে আর একটি বছর আটেকের ফ্রক পরা মেয়ে। রমজানের সন্ধ্যা, তখন রোজা ভাঙা নামাজের সময়, জাকারিয়া স্ট্রীটের নাখোদা মসজিদের সামনে তখন চিলুবিলু ভিড়। সেই ভিড়ে স্পষ্ট দুটো ক্যাটাগরি – সংখ্যাগরিষ্ঠ ফেজ টুপি বা বোরখা পরা নামাজী মুসলমান আর তুলনামুলক সংখ্যায় কম সাদামাটা প্যান্ট-শার্ট বা জিনস-সালোয়ার-টি-শার্টের হিন্দু বাঙালি যুবক-যুবতী। দ্বিতীয় দলটিকে চেনা যায় মোবাইলে ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে দেখলে। মসজিদের প্রবেশপথের ওপর পরপর পাঁচটা বড় বড় ঘড়ি। সেদিকে দেখিয়ে অবিকল লালমোহনবাবুর স্টাইলে ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের বোঝাচ্ছিলেন, ‘ওই যে দেখছ ঘড়িগুলো, ওতে মুসলিমদের বিভিন্ন দেশের সময় দেখাচ্ছে। মক্কার সময়, মদিনার সময়… এই সব।‘ পাশে দাঁড়িয়ে দুধ-তরমুজের সরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ভদ্রলোকের ভুলটা শুধরে দিয়ে বললুম, ‘না দাদা। ওই পাঁচটা ঘড়িতে দিনের পাঁচবার নামাজের সময়গুলো দেখানো আছে। ভাল করে দেখুন, ঘড়ির গায়ে বাংলায় নামাজের নামও লেখা আছে – ফজর, জোহর, এষা, মগরিব…।‘ ‘ও আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি।’ ভদ্রলোকের মুখে বিব্রত হাসি। ... ...
ঘরের দেওয়ালে কত ছোট ছোট ঢেউ আটকে আছে দ্যাখো। কবেকার ঢেউ এসব। হয়তো তোমার মনে আছে। আমারও মনে আছে। ঢেউগুলোর পাথর আত্মাও হয়তো তোমাকে, আমাকে আমাদের মতোই মনে রেখেছে। স্টেশনের ভীড়ে জরদ্গব মানুষেরা যেমন ঠেলে, ঢুঁসিয়ে এগিয়ে যায় পড়ন্ত, অস্তগামী কোনো ট্রেন ধরবে বলে, আমাদের এলোমেলো অবিন্যাস্ত করে দিনগুলি এগিয়ে গেছে। সেই ভীড়, সেই ছোটাছুটি চিৎকারের পর তুমি আমি আছি। এমন আলস্যে আজ পাশাপাশি ভেঙে পড়ে আছি আর দেওয়ালে আছে ওই স্থির ঢেউ। কখনো তোমার অবর্তমানে দেখেছি, ঢেউগুলি যেন মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে। হয়তো অলীক, হয়তো দেখার ভুল। কিন্তু দেখেছি, মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে চোখে ওরা চেয়ে থাকে। প্রতিহিংসা নয়, বরং যেন কেমন বিষণ্ণ সেই চোখের দৃষ্টি। ... ...
আমি করলাম সেই দুঃসাহসিক কাজটা। না, টিকেট কাটি নাই ট্রেনের। কারণ যে ট্রেনের টিকেট কেটে সিটে বসা যায় না, সেই ট্রেনের টিকেট কেটে লাভ কী? কমলাপুর থেকে এক বড়ভাই যাবে শেরপুর, তাকে বললাম, ভাই আপনে আমার জন্য জায়গা ধরে আসবেন, আমি বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠব। আমি সেই চিল মুডে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্টেশনে বসে আছি, আমার কোনো চিন্তাই নাই, আমার জন্য জায়গা ধরে আসছে একজন কমলাপুর থেকে। বিমানবন্দর স্টেশনে গিজগিজ করছে মানুষ, তার মধ্যে আমার একবারের জন্য চিন্তা হচ্ছে না এর মধ্যে কিছু তো যাবে জামালপুর, এরা কই উঠবে, কীভাবে যাবে? তাদের চিন্তা তারা করবে, আমার তো এই সব নিয়ে ভাবনা নাই! ভাবনা শুরু হলো যখন ট্রেনকে আসতে দেখলাম! ও আল্লাহ গো! ট্রেন কই? আগাগোড়া ট্রেন দেখা যায় না, মানুষ আর মানুষ! তখন আমি ফোন দেয়া শুরু করলাম সেই বড়ভাইকে। তিনি ফোন ধরে বললেন, ঠ বগিতে আসো। বগির নম্বরও তো দেখা যায় না! আরেক মুশকিল না? আমি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছি তখন। কারণ এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না ট্রেন। এর মধ্যে আমাকে উঠতে তো হবে। একসময় পাইলাম ঠ নম্বর বগি। আবার ফোন, ভাই কই? আমি দেখছি একচুল জায়গা নাই বগিতে। এখন? তিনি বললেন মাঝামাঝি আসো। গেলাম, আবার ফোন, কই ভাই, যামু কেমনে? তিনি বললেন, আরে নিচে কী দেখো? উপরে দেখো! আমি উপরে তাকিয়ে দেখি ভাই আমার আরাম করে ছাদে বসে আছে, একটা ব্যাগ দিয়ে আমার জন্য জায়গা রেখেছে ছাদে! ... ...
সূত্রধর ১: (টেনে-টেনে) অনেক অনেক বছর আগের কথা। অনেক দূরে এক দেশ ছিল। সে দেশে বড় বড় ক্ষেত, লম্বা লম্বা নদী, উঁচু-উঁচু পাহাড়, আর গভীর-গভীর সমুদ্র। সেখানে গোলা-ভরা ধান, নদী-ভরা জল, গোয়াল-ভরা গরু, গাছ ভরা হনুমান। সূত্রধর ২: (থামিয়ে) ছোটো করে বল না। এত লম্বা করলে লোকে পালাবে। সূত্রধর ১: (বিরক্ত হয়ে) লোক জমবে বলেই তো লম্বা করছি। অ্যানাউন্সমেন্টের কী বুঝিস তুই। সব ধর-তক্তা-মার-পেরেক নাকি? যাই হোক। (আবার শুরু করে) সেখানে ছিলেন এক রাজা। রাজা যেমন বড়, তেমনি ধার্মিক। সূত্রধর ২: (থামিয়ে) রাজার দুই রানী। সীতা আর গীতা। রানীদের গা ভরা গয়না, প্রজাদের পকেট ভরা মায়না। কোথাও কোনো অভাব নেই, কেউ করেনা বায়না। সূত্রধর ১: (আরও বিরক্ত) তোদেরকে কে স্টেজে তুলে দেয় রে? প্রজাদের পকেটে কোনো পয়সা নেই। সূত্রধর ২: অ্যাঁ? তবে খায় কী? সূত্রধর ১: প্রজারা টাকার কলে লাইন দেয়। রোজ কিছু করে করে টাকা ছাড়া হয়। যারা পায়, তারা খায়। যারা পায়না, তারা পরেরদিন আবার লাইন দেয়। রাজা এসেই সব মোহর বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। সূত্রধর ২: কেন? সূত্রধর ১: যাতে লোকেরা মোহর নিয়ে অপচয় না করতে পারে। সূত্রধর ২: সব টাকা এখন রাজার ভান্ডারে? হেবি বুদ্ধি তো। সূত্রধর ১: তোর মতো গাড়ল হলে কি আর রাজা হত? রাজত্ব হত? সূত্রধর ২: আর রানী? সূত্রধর ১: ওরে পাঁঠা, এ রাজার কোনো রানী নেই। সূত্রধর ২: এ বাবা, বিয়ে করেনি? দেখতে বাজে? সূত্রধর ১: দেখতে বাজে? ছাতির মাপ জানিস? ইয়াব্বড়ো ছাতি। এত বড়, যে, বৌকেও ভয় পায়না। একজন বৌ আছে, কিন্তু সে রানী নয়। আলাদা থাকে। ... ...
নূরবানুর মনে পড়ল। তাঁর কিশোরীবেলায় দাদার হিন্দু বন্ধুরা বাড়ি থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে এসে মুরগির মাংস খেয়ে যেত তাঁদের বাড়িতে। কিশোরী নূর তখন রূপের ছটা ছড়ায়। তার দিকে আড়চোখে তাকাতও হিন্দু ছেলেদের কেউ কেউ। কিন্ত ঐ তাকানো পর্যন্তই। টুবাইয়ের ছোট দাদুও আসতো। মলিনার ছোট খুড় শ্বশুর। দিব্যি হাট্টা কাট্টা জওয়ান ছেলে। নূরবানুর বেশ ভালোই লাগত তাকে। অসময়ে পটাশ করে মরে গেল লোকটা। তাকানোর ভঙ্গী ভারি ভালো ছিল তার। ... ...
বর্তমানে সোশাল মিডিয়াতে তর্জার একটা মূল ধারা হল আমাদের ধর্মচেতনা। শুধু মাত্র ভারতে নয়, বা এই উপনিবেশে নয়, কিছু স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ বাদ দিলে সম্ভবতঃ বেশিরভাগ দেশেই একধরনের বিবাদমান যুযুধান কিছু গোষ্ঠী পাওয়া যাবে, যারা সদাই এই নিয়ে মাথা কুটে মরছে। ফলতঃ নানান কূট প্রশ্ন মাথায় ঘোরাফেরা করে যে এই ধর্মের সূত্রপাত কোথায়? কৈ বাকি জীবেরা তো ধর্ম অধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের মধ্যেই এর প্রকাশ কেন? সেই উদ্দেশ্যেই এই লেখার অবতারনা। এই লেখাটি মূলতঃ ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার প্যালিওএন্থ্রোপোলজিস্ট জেনিভিয়েভ ভন পেটজিঙ্গারের টেড টক আর কিছু পেপারের সার। ... ...
তখন পরীক্ষার আগের দিন ইদ পরতো। পরেরদিনও। স্নাতক সাম্মানিক বা স্নাতকোত্তর পর্বে বাড়ি যাওয়াই হতো না। একবার হোস্টেল ছেড়ে একটা মেসে আছি। মুসলিম ছেলেদের মেস। মনখারাপ। শহর তো গ্রামের মতো নয়। কে খাচ্ছে আর কে খাচ্ছে না, খবর রাখে কতজন? শরীর যেন অনেকটাই আত্মঘাতক আত্মকেন্দ্রিক। ... ...
চন্দ্রোদয়। ছোটদের সামনেই বলতে হবে, বুঝলে? ওদের মনটা এখন জলের মত স্বচ্ছ, আমাদের এই স্বচ্ছ স্বর্গভূমির মতো। ভালো খারাপ চিনতে শিখুক, আদর্শ কাকে বলে সেটা বুঝতে শিখুক, ওরাই তো আমাদের নতুন স্বর্গভূমির ভবিষ্যৎ। সামনের নির্বাচন থেকে আমরা সব অবোধ শিশুকে ভোট দেবার অধিকার দেব, জান না? শিশুরাই ভোট দেবে এখন থেকে, বিধর্মী আর না-ধর্মীরা সব বাতিল। হুঁঃ, দেশছাড়া করে ছাড়ব সব কটাকে। (বলরামকে) কী বলরাম, সেই ধর্ষণের কেসটা... মেয়েটাকে যখন হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এক্স-রে করবার জন্যে, তখন সেই অ্যাম্বুলেন্সকে তোমার ওই নম্বরহীন লরিটা দিয়ে ধাক্কা মারার ব্যবস্থা করনি তুমি? বলরাম। আমিই করেছিলুম গুরুজি। কিন্তু সে তো আপনার পরামর্শেই। ... ...
বনের ধারে রাখালি দোচালাখানি, বড় নিজের মনে হয় বুনোলতা, বুনোলতানো ফুল গাছ উঠে গেছে চালার উপরে নিদাঘের ভিতর এই ছায়াকুঞ্জ ... ...
এখন এই এক ঝামেলা হয়েছে। শীতটা পড়ার মুখে কেবল আকাশ ঢেকে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোর চাদরে।কেউ বলে দেওয়ালির চটরপটর আতসবাজির কারণে এই ধোঁয়াশা। আবার কেউ বলে ভিন রাজ্যের গ্রামের কিষানরা শস্য কেটে নিয়ে শুকনো গোড়া নাকি পুড়িয়ে দেয়। সেখান থেকেই শহরে উড়ে আসে এই ধোঁয়া ধোঁয়া ছাই; সেই কারণেই এই দূষিত বাষ্পের বেড়াজালে নাভিশ্বাস ওঠে শহরবাসীর। ... ...
ঘরের ভিতরের ছিটকিনি জোরে ঠ্যালা দিতেই একরাশ বাতাস আকুলি বিকুলি করে বেরিয়ে এলো আটকে থাকা বাতাস নাকি খবর দিতে চাওয়া? ... ...
তোমার অসহ্য রূপ পড়ে আছে ভূমিতে খানখান তুলে নিয়ে জোড়া দিই দুহাতের আঙুলে আঙুলে দশ আঙুলে জ্বলে ওঠে শিখা, ভুমা ফেটে যায় তুমি মুখে নিয়ে আগুন নেভাও আমি ফের গড়ে তুলি শূন্য হতে তোমার মৃত্তিকা ... ...
এখন আর ঘর ছেড়ে এদিক ওদিক যাবার দরকার পড়ে না। পুঁটি তবু ঘরে থাকে না, অনেকদিনের অভ্যেস। তাছাড়া যত বড় হচ্ছে ততই এ ঘর যেন তার কাছে খুবই ছোট হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নগুলো এ ঘরে আর খেলে না। জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না, বরং পিঙ্কিদের কোঠার পাঁচিল দেখা যায় । ভাইকে নিয়ে লালবাতির বাল্যশিক্ষা কেন্দ্রে দিয়ে আসে পুঁটি, আর নিজে চলে যায় মন্টুদাদের ক্লাবে। সেখানে পট্টির বাকি ছেলেরা থাকে, ক্যারাম পিটায়, বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা ফোঁকে, কেউ কেউ মদও খায়। পুঁটির সেখানে কোনও কাজ নেই, তবুও সেখানেই যায়, অকাজের ছেলেদের এই একটা যাবার জায়গা আছে এখানে। ... ...
ফ্যাশান ম্যাগাজিনটিতে পুরো ডুবে গিয়েছিলেন, তাই গাড়িটা গেইটের কাছে এসে যখন ধাক্কা খেল, তিনিও গাড়িটার সাথে শরিক হলেন, দু'জনে মিলে কিছুক্ষণ ভীষণ দুলে যখন থামলেন, তখন দু'জনেরই জল গড়িয়ে পড়ছে শরীর থেকে। অচিরেই দালানের ভিতর থেকে আসা একটা কানে তালা দেয়া আওয়াজ সেই জল পড়া থামিয়ে দিল। একই সঙ্গে তার স্বয়ংক্রিয় হৃদপিণ্ডটাও যেন থেমে যাওয়ার উপক্রম হল! ড্রাইভার আবুল একটুখানি ঘুরে এসে তা-ই জানালো যা তিনি আগেই জানতেন। দুইদিন পরপরই বদমাশগুলির মাথায় কী একটা কিরকিরা উঠে আর বেতন বাড়ানোর জিকির তুলে কা কা করতে থাকে সমস্বরে! ... ...
যাতায়াত কম হয়ে গেলে রাস্তাগুলো পথ হারিয়ে ফেলে ঘাস জঙ্গলে অজানা সাপখোপ, ভয় বেড়ে ওঠে। ... ...