এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • ওই মহা মানব আসে (দ্বিতীয়)

    Mahua Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ১৭২৯ বার পঠিত
  • পর্ব এক | পর্ব দুই
    গল্পে গল্পে ভোর হয়ে যাবে, কিন্তু উনিশ শতকের কথকতার শেষ নেই বাপু। শত বছরের ঘুম ভেঙে নতুন জেগে ওঠা সময়! সে সময় আলোরও আবার অন্ধকারেরও। হুতোম প্যাঁচার নকশার মতো বাবুদের গপ্পোও ছিল আবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের আলোর সাতকাহনও ছিল। দ্বারকানাথের সাম্রাজ্যের সেরা উত্তরাধিকার দেবেন্দ্রনাথ। একথা পাঁচজনে মানত। দেবতার মতো রূপ আর তেমনি ব্যক্তিত্ব! বাপের চেয়ে আলাদা। যোগীপুরুষের মতো। লোকে বলে, মহর্ষি! । অথচ জীবনের শুরুতে ভক্তির আঁটাকাঁটা ছিল। ঠাকুমা অলকাসুন্দরীর সঙ্গে রীতিমতো তীর্থ করতে যেতেন। একবার সরস্বতী পুজোয় এমন গাঁদাফুল আনিয়েছিলেন, যে সকলের তাক লেগে গিয়েছিল। ঠাকুরবাড়িতে জীবন মরণ পায়ে পায়ে ঘোরে। অত লোক! সুখ অসুখ লেগেই আছে। দেবেন্দ্রনাথ অলকাসুন্দরীর বড় নেওটা ছিলেন। আসলে বাপ মার সঙ্গে একটু দূরত্বই ছিল বলা যায়। বাবা দ্বারকানাথ তো মুকুটহীনরাজপুত্তুর। দেশে বিদেশে ছড়ানো তাঁর রাজ্যপাট! ছেলেপিলের সঙ্গে দুদণ্ড বসে কথা কইবার সময় কই? আর মা দিগম্বরী? তাঁর ছিল সোনার প্রতিমার মতো রূপ! ওই মুখের আদলে ঠাকুরবাড়ির প্রতিমার মুখ আঁকা হত।ঘন নীল রঙের শাড়ি পরে স্বামীর সঙ্গে ঠাকুরঘরে বসে যখন পুজোর জোগাড় করতেন, তখন দাস দাসী করজোড়ে বলত, ‘সাক্ষাৎ লক্ষ্মী নারায়ণ!’। অলকাসুন্দরীও বেশ সমীহ করতেন পুত্রবধূকে। বড় বেশি শুচিবাই ছিল দিগম্বরীর। সারাদিনে একাহারী থাকা, জপমালা, বড় বেশি আচার বিচার! কী হল? স্বামী হাঁটল উল্টোপথে। আমিষ নিরামিষে ভেদ করল না। সাহেব বিবিদের সঙ্গে একাসনে খাওয়া, কালপাণি পার — সবই উল্টোপাল্টা! অবশ্য স্ত্রীকে অসম্মান করেন নি কখনো। কিন্তু যা হয়! দুটো উল্টো মনের মানুষ সমান্তরাল পথে জীবনে চললেন। কেউ কাউকে ছাড়লেন না, ধরলেনও না। দেবেন্দ্রনাথও হলেন ভিন্নধারার!পৌত্তলিকতা সম্পর্কে বাবার দ্বিধাটুকু ঝেড়ে নিজেকে পুরোপুরি অপৌত্তলিক ঘোষণা করলেন। তাও আবার পিতৃশ্রাদ্ধের সময়।

    অলকাসুন্দরীর মৃত্যু খুব কষ্টের। শারীরিক রোগভোগ তো ছিলই। অন্তকাল উপস্থিত বলে গঙ্গার তীরে নিয়ে এসেছেন তাঁকে সকলে। দেবেন্দ্রনাথের বুকটা ব্যথায় ভেঙে যাচ্ছে। টনটন করছে। ঠাকুমার হাত ধরে ঠনঠনিয়া কালিবাড়ি যখন যেতেন, বাপ মায়ের থেকে দূরত্বের কথা মনে হয় নি কখনো। আজ ব্যথায় কোঁকাচ্ছেন অলকাসুন্দরী! প্রলাপ বকছেন, ‘তোরা আমারে জোর করে নিয়ে এলি, আমিও মরব না, কষ্ট দেবো তোদের!’ আসন্ন শবদাহের প্রস্তুতি চলছে আর দেবেন্দ্রনাথ দর্শনের কথা ভাবছেন। ফিকে হয়ে আসছে অতীত। নতুন মানুষ জেগে উঠছে। রাত ভোর হয়ে আসছে। তারার আলো যেন আসমানে নকশা কাটছে। একটা ছেঁড়া পাতা জীবনের নির্দেশের মতো উড়ে এল দেবেন্দ্রনাথের সামনে—

    ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
    তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা, মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনং। ’

    দেবেন্দ্রনাথ অমৃতের স্পর্শ পেলেন। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হলেন। তত্ত্ববোধিনী সভা স্থাপন করলেন, পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন অপৌত্তলিক পদ্ধতিতে। সে এক আমল! রবির জন্ম সন্ধিক্ষণে।

    ঠাকুরদালানে ভর দুপুরে গোল হয়ে বসেছেন অন্দরমহলের মেয়ে বৌরা। আজ মালিনী এসে বই দিয়ে গেছে। কাড়াকাড়ি চলছে বই পড়া নিয়ে!রবির দিদি সৌদামিনী চুল এলো করে হাসিমুখে বললেন, ‘ওলো আমাকে আজ প্রহ্লাদচরিত্রটা দে। ওটি আমি পড়ব’। দূরে মেয়েমহলের জটলা দেখছিল রবি। এ তার প্রিয় কাজ। অবরে সবরে এসে বসে দিদি বৌদিদের জমায়েতে। বই পড়ে। সৌদিমিনী দিদি এই বইটা নেবে ও জানত। কৃষ্ণের ভক্ত তো! কী একটা জেনে ফেলেছে এমন মুখ করে গুটি গুটি সৌদামিনীর কাছে যায়। বলে, ‘দিদি তোমার ঘরের কৃষ্ণের পুজোর জন্য ফুল তুলে দেবো কাল?’। সৌদামিনী শিউরে ওঠে। রবির মুখ চেপে ধরে বলে, ‘চুপ, চুপ! একথা বলিস না ভাই কাউকে, বাবামশায় শুনতে পেলে——!’।

    রবি অপ্রস্তুত হয়ে সরে পড়ে। রেলিংগুলো হাত দিয়ে ছুঁতে ছুঁতে ভাবে। বাবামশায় এত রাগি কেন? কী হয় ইচ্ছে মতো পুজো করলে? পুজো কি লুকিয়ে করা যায় নাকি?

    তখনই বড়দাদার ঘর থেকে ভেসে আসে ব্রহ্মসঙ্গীত! বড়দাদা সদ্য ব্রাহ্ম সভায় যাতায়াত করছেন। কিন্তু খ্যাপামি যায় নি। আজ একটা সোজা জামার উপর উল্টো জামা পরেছেন। নাকি বোতাম আটকানোর সময় বাঁচে। রবি একটা ফতুয়া আর ধুতি পরেছে। পা টিপে টিপে বড়দাদার ঘর পেরিয়ে যায়। দেখতে পেলেই শক্ত শক্ত কথা বলবেন হেসে হেসে। এখন নিজের চাকরকে শোনাচ্ছেন। রবি ফিক করে হাসে! বড়দাদা মজার মানুষ, সেদিন একরাশ লোক ধরে এনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তো দিচ্ছিলেনই। পরে সকলে মুখ শুকিয়ে বলে, ‘খাওয়া?’ তখন জিভ কেটে দাদা বললেন, ‘তোমাদের খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিলাম না? এক্কেবারে ভুলে গেছি!’ তখন বাড়িতে সে কি কাণ্ড!

    আকাশে ঘন হয়ে মেঘ করেছে। কৃষ্ণের গায়ের রঙের মতো!মা নিশ্চয়ই রামায়ণ পড়তে ডাকবে। ঘরে চেবানো পানের গন্ধ ভুর ভুর করবে। রবির ইচ্ছে করবে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাতে । কিন্তু এ বাড়িতে ওসব হয় না। তবে মায়ের সখী শুভঙ্করী মাসিমাও বসবেন পাশে। রবি সুর করে রামায়ণ পড়তে পড়তে আড়ালে চোখ মুছবে। সীতার জন্য দুঃখ হয় ওর! বাইরে কি ঝড় হবে? আবছা শরীরে দেবী দেবতা এসে দাঁড়াবে কাছে? রবিও তো ব্রাহ্ম! বাবা দাদাদের মতো! তাহলে ওর মনে দেবী দেবতারা আসে যায় কেন? উত্তর বুঝি বড় হলে পাবে?

    সারদা দেবীর ঘরের বাইরে চুপটি করে দাঁড়ায় রবি। সারদাসুন্দরী মুখটা বাড়িয়ে বলে, ‘রবি, রামায়ণ পড়বি?’ রবি একমুখ আলো নিয়ে মাথা দুলিয়ে বলে, ‘হ্যাঁআআআ!’।

    বাইরে রাবণের গর্জনের মতো মস্ত ঝড় হঠে। মেছুয়া বাজারে জল জমবে মনে হয়। ( ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব এক | পর্ব দুই
  • ধারাবাহিক | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ১৭২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন