সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ঃ
যে ক"জন আদ্যন্ত আধুনিক মানুষ আমি দেখেছি, তাঁদের মধ্যে একজন এই মানুষটি। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। ১০ বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাপের দিন জানতে চেয়েছিলাম, "স্যার জীবন মানে কি"? বলেছিলেন,
"নিয়মগুলো ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলা"। সঞ্জয়দাকে কখনোই বাঙালি বলে মনে হয়নি আমার। আসলে সঞ্জয়দা ফরাসি। যিনি বেঞ্জামিন আর বার্ত-র কথা বলতেন খালি। আবার বলতেন, "২৩ বছর বয়সে মানিক পুতুলনাচ লিখেছেন, তুমি কি করছ?" প্ররোচিত করা, খেপিয়ে দেওয়া, প্রাণিত করা সঞ্জয়দার স্বভাব। গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়, রাসবেহারী মোড়, আরও আরও কত-কত ডায়লগ...মৃণাল সেন সঞ্জয়দাকে সাধে বলেছিলেন, আন্দ্রে বাঁজা..আর সন্দীপন তো তাঁকে বলেছিলেনই, "অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনর লেখক"..
লালাদা (প্রচেতা ঘোষ) ও তাপস ঘোষ লিখেছিলেন, এথেন্সের মোড়ে মোড়ে যেমন সক্রেটিসকে ঘিড়ে ছাত্রদের ভিড়, সঞ্জয়দাকে ঘিরেও তেমন। বেপরোয়া বিলো-দ্য-বেল্ট আক্রমণ করা এবং তার জন্য অপমানিত হওয়া দুটোই দেখেছি চোখের সামনে; বাঙালি করেছে। কিন্তু সেটা ঝেড়ে ফেলে, চলো মিলনের দোকানে চা খাই বলতেও সময় লাগেনি এই মানুষটির। তারপর বলা, "ধুর, জীবনটা পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যংক নাকি যে এত হিসেব করে চলতে হবে..."
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম উল্লেখ করেন তাঁদের লেখায় বিষ্ণু দে, দীপক মজুমদার ও দীপেন্দু চক্রবর্তী। এরপর, নবারুণ ভট্টাচার্য সেসময়ের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের সাথে সঞ্জয়ের উল্লেখ করেন একটি বইয়ের রিভিউতে। তখনও কুড়ির কোঠায় বয়স তাঁর।
আজ তিনি প্রতিষ্ঠান। ছাত্রদের আজও তবু মহাকালের সাথে তর্ক করতে শেখান। রাসবেহারী মোড়ে এনে দেখান কোথায় জীবনান্দের রক্ত ট্রামলাইনে.. তাঁর একটি দিক নিয়ে কোনওদিন কথা হয়নি। তা হল, রূপকলার অধিকর্তা পদ ছেড়ে যাদবপুরে চলে আসাটা নেহাত ঘটনা নয়। এর পেছনে, ছাত্রদের মধ্যে এক ধরণের রাজনীতি-কালচার ঢুকিয়ে দেওয়ার স্পষ্ট ছাপ পাই, যা সঞ্জয়দার ধ্রুব অভিজ্ঞান। দ্বিতীয়ত, বিদেশে একাধিক চাকরির সুযোগ পেয়েও কালীঘাটে বসে স্থানীয় ইতিহাস লিখে যাওয়ার মধ্যেও একই গন্ধ লক্ষ্য করি। এই দুই প্রবণতা যোগ করলে পাই এক ব্যক্তিত্ব, আবহমান-সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, যা বিনয় ও মেধায় উজ্জ্বল..
অনন্য রায়ের নেওয়া ইন্টারভিউতে তিনি বলেন,
আমরা বহুদিন ধরেই আমাদের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিসকল, সর্ব্বোচ্চ চিন্তা কাব্যে ও শিল্পে প্রকাশ করছি। আমাদের কোনও ইতিহাসকার নেই রবীন্দ্রনাথের পর্যায়ের, কোনও রাজনৈতিক নেতা নেই জীবনানন্দ পর্যায়ের, কোনও দার্শনিক নেই যিনি মানিকবাবুর পাশে দাঁড়াতে পারেন।...
এখান থেকেই ইন্টারডিসিপ্লিন এপ্রোচ সঞ্জয়দার লেখালেখির। একজন মহান কেন মহান, তাই খুঁড়ে বের করতে চান তিনি। সন্ধান করেন গোয়েন্দার মত বুড়ো আঙুলের ছাপ আন্দাজ দিয়ে। কখনোই নিদান দেন না। কারণ এসব লেখা একাডেমিক থিসিসের সাথে বরাবর সোশ্যাল ডিস্টানসিং মেনে প্রেম ও পাগল..
সত্তর দশক ও চার জন কবিকে নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। আজ বেশ কয়েকটি দশক পেরিয়ে এসে দেখি, সেই চার জন কবিই প্রতিষ্ঠান। এঁদের মধ্যে অনন্য রায় কবিদের কবি। নবারুণ আর সঞ্জয় ছাড়া যাঁকে নিয়ে কেউ কিছু বললেন না আজও..
সঞ্জয় ও নবারুণ কমরেড। অনন্য রায়েরও কমরেড তাঁরা। দেশপ্রিয় পার্কের লা কাফে বা রাসবিহারীর অমৃতায়নে আড্ডা জমাতেন তাঁরা। তারপর বাড়ি ফেরার পথে দেখতেন, চন্দ্রকুমার স্টোর্সের সামনে ফুটপাতে শুয়ে আছেন আকন্ঠ মদ্যপানে আসক্ত দেবদূত ঋত্বিককুমার ঘটক। তারপরের সকালে নবারুণ আর সঞ্জয়ের দেখা হত, গাঁজা পার্কের বিজন ভট্টাচার্যর ঠিকানায়। রাজেন্দ্র রোডে। দরজায় মায়কভস্কির ছবি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সঞ্জয়কে সাবধান করতেন নবারুণ, গুরু এখানে বেশি মাজাকি চলবে না। কারণ এই বিছানায় গত রাতের বিজন ও ঋত্বিকের বমির দাগ আছে।
এই বমির দাগের উত্তরাধিকারের কথা আজীবন বললেন সঞ্জয়। নবারুণের মতোই। দুই সহজীবী কয়েকটি প্রজন্মকে জানাল, মূলধারার ইতিহাসের আড়ালে লুকোনো বিকল্প ইতিহাস। তরুণ সঞ্জয়ের লেখা রিভিউ করেছিলেন প্রথম নবারুণ বড় লেখকদের সাথে। তারপর তাঁদের আলাপ ও আড্ডা। সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন সত্যজিৎ বা কমলকুমার বা বিষ্ণু দে। আলি আকবর এসে দই কিনতেন। ফ্রন্টিয়ার খুঁজতেন বইয়ের মলিন দোকানে মৃণাল সেন।
সঞ্জয় আজীবন শোনালেন এসব কথাই। নবারুণের সাথে বহু মঞ্চে ভাষণ দিয়েছেন তিনি। তাঁরা যুগ্মভাবে লড়েছেন কখনও অনন্য রায় তো কখনও ঋত্বিক ঘটক নিয়ে। বুলগাকভ স্তালিনের বন্ধু ছিলেন লিখেছিলেন সঞ্জয়। তবু তাঁর নাটক প্রতিষ্ঠানের শরীরে বমি করেছিল। নবারুণ সেখান থেকেই তাঁর গদ্য নেন।
ঋত্বিক ঘটকর কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন নবারুণ। দ্রুত মঞ্চে উঠে তাঁকে সামলাতে হয় সঞ্জয়ের।
আজ কলকাতা বড়লোকের। প্রিভিলেজড মধ্যবিত্তের। তাঁদের এসব অলীক আর রূপকথা মনে হয়। মনে হয় সানকিসড নস্টালজিয়া। কাফের নাম হয় সত্তরের বিপ্লবের নামে। চায়ের দোকান উঠিয়ে গজিয়ে দগেদগে স্পা। বন্দুকের মুখে উঠে গেছে শপিংমল। তবু তো ঘোর থেকে যায়। সত্তরের ভূত বা আত্মা ভর করে তবু নবারুণ-সঞ্জয়কে। তাঁরা চিরকুট চালাচালি করেন পাতালে। তাঁরা মিসফিট জেনেও সন্তানদের বাতলে দেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী থেকে সাফদার হাশমির নাম।
সঞ্জয় জানান, কীভাবে ঋত্বিকর কাছে ছেলেবেলায় গল্প শুনতেন নবারুণ, সিনেমা দেখতে যাওয়ার পথে। নবারুণ চিতকার করেন, আরে ঋত্বিক গ্রামার বানাচ্ছে, ওর সিনেমাটা শেখ বোকাচোদা সমালোচকের দল..রাগের সাদা ফেনা দগদগে ঘায়ের মত আছড়ে পড়ে এ শহরে..আমাদের সহসা প্রণাম জানাতে ইচ্ছে করে রাসবিহারী মোড় ও এ শহরের দিনরাত্রির কয়েকজন রাখালকে..মধ্যরাতে যারা কলকাতা শাসন করতেন..
আসলে, সত্তর দশককে আমরা বারবার ম্যানুফ্যাকচার করতে চেয়েছি। যেমন ভজহরি মান্নায় গিয়ে বাঙালি রান্না খাওয়া। অথচ এত সব অর্থে আন্তর্জাতিক দশককে বুঝতে আমাদের কমন ম্যানদের সাথে কথা বলার কথা ছিল। তার জন্যে জীবনেও আমাদের কমন ম্যান হওয়া প্র্যাক্টিস করার কথা। কিন্তু আমরা তো করপোরেট। আদ্যন্ত ডিবেসড। ডিপলিটিসাইজড। সাইকো। ডিপ্রেসড।
বুনো স্ট্রবেরি। এ কি উপন্যাস না কবিতা? স্মৃতিকথা না আত্মজীবনী? আধুনিক যুগে কি আর এ সব ভাগ আছে? বা সাইন্সে? তা হলে, ইতালো কালভিনো বা কুন্দেরা বা পামুকের লেখাকে কি বলব? সুবিমল মিশ্র সহ অসংখ্য কাউন্টার কালচার রেবেলদের নিয়ে প্রথম লেখেন সঞ্জয়। সত্তরে ধারাবাহিক অনুবাদ করেন গদার-বার্গম্যান। এক রকম আমন্ত্রণই জানান, আমাদের সাংস্কৃতিক পরিসরে। বেটে বাঙালি তখনও এঁদের চিনতে পারত।
সত্তর দশক-অনন্য রায়-দেশপ্রিয় পার্ক রাসবেহারী পেরোলে দেখা যায়, মধ্যবিত্ত দুপুরে সিনেম দেখত হলে গিয়ে। সঞ্জয়দাই প্রথম, তুলসী চক্রবর্তী, ন্রিপতি চট্টোপাধ্যায়র প্রতিভায় আলো দিলেন..অনভিজাতরাও যে অনিবার্য অপেরায়, গল্প হলেও যে সত্যি তাঁরাও শিল্পী, সঞ্জয়দা নিপুণভাবে জানালেন..যেভাবে অন্যত্র তিনি দেখান কমলকুমার-মানিক-জীবনানন্দ কীভাবে নাশকতার দেবদূত..কীভাবেই বা রচিত হয় রিত্বিক্তন্ত্রের চিন্তার দাউদাউ..
কুন্দেরার বীভৎস হাসিতে আক্রান্ত আজকের সমকাল। সবাই সবাইকে এত সম্মান দিচ্ছে!! সঞ্জয়দাও সব কিছু দেখতে দেখতে কিছুটা উদাসীন। বাংলা কালচার ৫০০ লোকের তিনি জানেন। তাই এখনও, নিজের টাকাতেই চলে যাচ্ছেন পুরুলিয়া-মুর্শিদাবাদ। বা উত্তরবঙ্গ। চুপি চুপি। সেমিনারে। যাতে এঁদো গ্রামের ছেলেটাও আলো পায়। অঞ্জনও ভোরবেলা কোনও নতুন শব্দ, কোনও পুরোনো নাম, কোনও বিশেষ ঘটনা জানার আছে, অজান্তেই আজও সঞ্জয়দাকে ফোন করে ফেলি। স্যার উত্তরও দেন! আজও..
নিজের একটি বই উপহার দিতে গিয়ে একবার সঞ্জয়দা লিখেছিলেন, "আকাশে বাতাসে ধ্রুবতারায়/ যারা বিদ্রোহে পথ মারায়/ তেমন একজন যুবক দেবর্ষিকে"। আরেকবার লিখেছিলেন, " যারা মফস্বল, যারা অপ্যারটমেন্টের গদ্য লেখে না, তেমন একজনকে"।
সঞ্জয়দার বার্গম্যানের সাইলেন্স অনুবাদ বহুদিন পর প্রকাশ পেল। বইটি আমায় উৎসর্গ করলেন তিনি। লিখলেন, নরকের তীর্থযাত্রী..
আর কি বলার থাকতে পারে এরপর, সলিডারিটি ছাড়া!
'তাঁরা মিসফিট জেনেও সন্তানদের বাতলে দেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী থেকে সাফদার হাশমির নাম'
- প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম , সন্তান-দের কানে পৌঁছোক এই সব নাম।
ধাক্কা দেওয়া লেখা, আগেও পড়েছি আবার পড়লাম।
ডুবে গিয়েছিল, তুললাম।