আতংকিত, মানুষ অসহায়। যেন এক যুদ্ধ পরিস্থিতি! যেকোন মুহূর্তে সব তছনছ হয়ে যেতে পারে। আমার এতদিনের সযত্নে লালিত সংসার এক মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। এখন শত্রু আর ওইখানে কোথাও নেই, শত্রু আছে আকাশে-বাতাসে, মানুষের মধ্যে মিশে! তাই মানুষ মানুষকে সন্দেহ করছে। সামাজিক দূরত্ব রাখতে মানুষ মানুষের থেকে দূরে থাকতে চাইছে। সন্দেহ হলেই অপরকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে। করোনা-কেন্দ্রিক এক জীবন গড়ে উঠেছে আমাদের। এক মৃত্যু-মুখী চেতনার জীবন। ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া জীবন। "এরা ভিড় বাড়াচ্ছে, ওরা মাস্ক পরছে না" – এইসব নিয়ে অপরকে দোষারোপ করা একাকীত্ব যাপন।
এমনিতেই আমরা স্বাস্থ্য বলতে শুধুমাত্র ডাক্তার-ওষুধ-অপারেশন ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। যদিও স্বাধীনতার আগে থেকেই জানা ছিল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্প্রসারণ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির এক গুরূত্বপূর্ণ সোপান (ভোরে কমিটি রিপোর্ট, ১৯৪৬); তার পাশাপাশি দরকার মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। তবু, বৃটিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতার পর থেকেই, এক একটা রোগ সারানোর জন্য আলাদা আলাদা রোগ প্রতিরোধক প্রোগ্রাম নেওয়া শুরু হল। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে তারপর বহুবার। ১৯৭৮ সালে রাশিয়ার আলমা আটা’য় রাষ্ট্র-সংঘের ডিক্লেয়ারেশনের পরে, আমাদের দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলার দিকে একটা ঝোঁক এসেছিল। কিন্তু রোগকেন্দ্রীক প্রোগ্রামেরও ঘাটতি হয় নি। বর্তমানে করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা তারই আর একটা উদাহরণ।
এদেশে সকলের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি – তার একটা কারণ অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে সরকারের কম খরচ করা (জিডিপির মাত্র ১.৬% হল স্বাস্থ্যখাতে বাজেট, ২০২০)। কিন্তু, আরও গভীরে গেলে দেখতে পাবো, স্বাস্থ্যকে শরীর কেন্দ্রিক হিসেবে দেখাটা বোধহয় তার চেয়েও বড় সমস্যা। স্বাস্থ্যের মানে দাঁড়িয়েছে অসুস্থ না থাকা। আর মানুষ অসুস্থ হয় কেন? বাইরের রোগ-জীবাণুর আক্রমণে। শরীর যেন একটা আলাদা দেশ। তার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী আছে বাইরের কারুর অনুপ্রবেশ আটকানোর জন্য। সেই সৈন্যবাহিনী যদি না পারে, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান তাকে বাইরের থেকে কিছু অস্ত্র-শস্ত্র যোগান দেয়, যুদ্ধে জেতার জন্য।
এর বাইরে, স্বাস্থ্যকে অন্যভাবেও দেখা যায়। যেখানে শরীর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন কোন দেশ নয়। শরীরের ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে বাইরের জগতের নানা রকম যোগাযোগ ও আদান-প্রদান চলে নিরন্তর। এই সমন্বয়ের মধ্যে যে ঐক্যতান ওঠে, তাই আমাদের স্বাস্থ্য। বাইরের সেই জগতটা তৈরি হয় একদিকে যেমন কোটি কোটি জীবাণু দ্বারা, অন্যদিকে থাকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক পরিবেশ, যাদের সাথে নানা রকম সম্পর্কের উত্থান-পতনই আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করে বা অস্বাস্থ্যের সৃষ্টি করে। এবং এই সব কিছু আবার প্রভাবিত করে আমাদের মনকে, যার সঙ্গে শরীরের থাকে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
তাই স্বাস্থ্যের বৃত্তে থাকার জন্য আমাদের একদিকে লাগে ব্যক্তিগত বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর অভ্যেস – যার মধ্যে সকালে দাঁত মাজা থেকে শুরু করে নিয়মিত পরিষ্কার থাকা, ঠিকঠাক খাওয়া, পরিষ্কার জল পান করা, শরীর চর্চা করা, মনকে চাপমুক্ত রাখা, ঠিকঠাক ঘুম ইত্যাদি অনেক কিছুই লাগে। এইসব কিছু আবার নির্ভর করে চারিপাশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উপর। রোজগার না থাকলে, বাজারে জিনিসের দাম অগ্নিমূল্য হলে একজনের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা মুশকিল। উপযুক্ত পানীয় জলের যোগান না থাকলে কারুর সুস্থ থাকা মুশকিল। চাই যাতায়াতের সুবিধা, ইলেকট্রিসিটির সুবিধে, ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধা, চাই কাছাকাছি উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সুবিধে যেখানে সে তার প্রয়োজনীয় সবরকম স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে পারে। চাই কাছাকাছি স্কুল বা কলেজ যাতে সে একজন শিক্ষিত, স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে, যাতে তার রোজগারের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা সে পেতে পারে। যে রোজগার না থাকলে সে খেতেই পাবে না ঠিকঠাক। তার জন্য চাই আরও বিভিন্ন সিস্টেম যেখানে সাধারণ, নিম্নবিত্ত, অল্প শিক্ষিত, নিচু জাত, মাইনরিটি গোষ্ঠী, আদিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হয়েও সে সম্মানের সঙ্গে তার প্রয়োজনীয় রোজগারটুকু করতে পারে।
এত কিছু বললাম এই কারণে যে, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ ছিল মানুষকে স্বাস্থ্যের বৃত্তে রাখা। শুধুমাত্র পাখির চোখকে দেখতে পেয়ে মহাভারতের অর্জুনের চলেছে! কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকার আরও অনেক কিছু। তার স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হলে অনেক কিছুই দেখতে হবে একসাথে। শুধুমাত্র কোন একটি রোগ থেকে বাঁচার উপায় পেলেই মানুষ বাঁচে না।
শুধু যদি খাবারের কথাই ভাবি, আমরা দেখব অপুষ্টি হচ্ছে এদেশের বেশীরভাগ রোগব্যাধীর কারণ। এদেশে অপুষ্টি ছিল করোনার আগে থেকেই। ভারত অপুষ্টিতে বিশ্বে অনেকে দেশেরই উপরে! এখানে প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে একটি অপুষ্টিতে ভোগে। আমরা জানি অপুষ্ট মানুষ চট করে রোগাক্রান্ত হয়, বেশিদিন ভোগে, তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। ২০১৮ সালে, পাঁচ বছরের নীচে মৃত শিশুদের মধ্যে ৬৯% মৃত্যু ছিল অপুষ্টির কারণে (ইউনিসেফের রিপোর্ট)। এদেশের এত ব্যাপক শিশুদের সার্বিক টিকাকরণ প্রোগ্রামের সাফল্যের পরেও।
তার উপর যদি হয় করোনার মত সমস্যা। যে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমরা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো পাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছি। আমাদের চোখে এখন সেই পাখির চোখ হচ্ছে করোনা ভাইরাস। ভাইরাস থেকে বাঁচতে গিয়ে আমরা ভুলে গিয়েছি, মানুষ আরও কত কারণে মারা যায়। এত বড় গভর্ণমেন্ট প্রোগ্রাম, এত সব ওষুধ, ভ্যাকসিন থাকা সত্ত্বেও শুধু টিবি রোগেই আমাদের দেশে ২০১৮ সালে প্রায় সাড়ে চার লাখ লোক মারা যায় (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। এবং এটা কোন ব্যতিক্রমী বছর নয়, প্রতি বছরই এই ঘটনা ঘটে। ভাবুন তো টিবি ছাড়াও আরও কত সংক্রামক রোগ আছে, আছে বিভিন্ন ক্যান্সার, আছে দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যায় মৃত্যু।
আজ, শুধুমাত্র করোনাকে পাখির চোখ করতে গিয়ে আমরা এসব রোগ থেকেও যে মানুষকে বাঁচাতে হবে তা ভুলে গেছি।
করোনাকে কেন্দ্র করে যে লকডাউনকে আমরা পাখির চোখ করেছি, তাতে কত কোটি মানুষের রোজগার বন্ধ, শুধুমাত্র খাবার কিনতে না পেরে কতকোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগবে এবং তার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আরও কত মানুষ যে ভুগছে ও মারা যাচ্ছে এবং যাবে, তার হিসেব আমরা রাখছি না। দু-একটা তথ্য থেকেই এর ভয়াবহতা বোঝা যাবে। জনস্ হপকিনস ইউনভার্সিটি এবং ইউনিসেফের রিসার্চারেরা জানাচ্ছেন যে, এই সময়ের অব্যবস্থার কারণে শিশু মৃত্যুর হার বাড়বে ৪৫% এবং মাতৃমৃত্যুর হার বাড়বে ৩৯%। পৃথিবীর ভাঁড়ারে খাবারের অভাব না থাকলেও, বিশ্বব্যাপী ৮ - ১৩ কোটি লোক নিজেদের খিদে মেটাতে পারবে না।
আজ আমাদের ধ্যান-জ্ঞান শুধু করোনার স্ট্যাটিস্টিক্স দিয়েই আচ্ছন্ন। করোনার ভ্যাকসিন আর ওষুধ আবিষ্কারের নানান গুজব পেয়েই আমরা সন্তুষ্ট। ওদিকে চোখের আড়ালে সমাজ শ্মশান হতে বসেছে, সে খবর আমরা রাখি না। কারণ, আমাদের শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে, রোগের বিরুদ্ধে লড়াইটাই হচ্ছে মূখ্য। মানুষগুলো বাঁচল না মরল, সেটা গৌণ!
কার রোগ সারাবেন আপনি, যদি মানুষই বেঁচে না থাকে?
খুব ভালো লেখা।প্রশংসা জানানোর ভাষা নেই।করোনা,আমাদের মনুষ্যত্ব লুঠ করে নিয়েছে। সমাজ কে বিবস্ত্র করে দিয়েছে।
অভিজিৎ দা, এমন একটা লেখা খুব জরুরি ছিল।যেটুকু জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা আছে তাতে বুঝি সেখানে রোগী, রোগ, অর্থনীতি, বাঁচার ধরণ, পুষ্টি, খাদ্য সবটাই তো তার আওতায়। অথচ একটা বিশেষ রোগকে ' পাখির চোখ' করে দেশ, সমাজটাকে শ্মশান করে ছাড়ছে ওরা।
খুব সময়ে উপযোগী লেখা উপকৃত হবেন যারা পুরো লেখাটা মন দিয়ে পড়বেন I তবে মানুষ কে বোকা বানাবার কাজ সুকৌশলে চলে আসছে অনেকদিন ধরেই I
একদমই তাই... কাল রোগ সারাবো...