এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • কলকাতার কানাচে ৩ -- ভোটবাজার

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৫ এপ্রিল ২০১১ | ৯৮২ বার পঠিত
  • নেতা নন, মন্ত্রী নন, পুলিশ নন, আমলা নন, কলকাতার কানাচে এবার ভোটের ইন থিং কি? আর তার চেয়েও বড়ো কথা, আসল তারকা কারা? এক ঝলকে ঝট করে চিনে নিন।

    নির্বাচন কমিশন

    ইনি হার-জিতের ঊর্ধ্বে। প্লেয়ার না হয়েও একদা আইপিএলে ললিত মোদীর যা ভূমিকা ছিল বা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধীর, সেই মহান ঐতিহ্যকে ইনি নির্বাচনের মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। কোনো ব্যক্তি নন, কোনো দল নন, ইনি স্রেফ তারকা। এবারের নির্বাচনে ইনি নন-প্লেয়িং স্টার। রাজ্যজুড়ে আমদরবার করছেন। নিয়ম করে টিভি স্টুডিওয় হাজিরা দিচ্ছেন। কোনো এলাকায় গেলেই ফিল্মস্টারের মতো মবড হচ্ছেন। লোকে অভাব অভিযোগের ঝুড়ি উপুড় করে দিচ্ছে। ইনি সক্কলকে অভয়বাণী দিচ্ছেন।

    ইনি না খেলিয়াও প্লেয়ারদের হাড়ে কম্প ধরিয়ে দিচ্ছেন। আজ কর্পোরেশন থেকে এই পার্টির প্রাক্তন মেয়রের ছবি নামাচ্ছেন। কাল ঐ পার্টির ব্যানার খুলিয়ে ছাড়ছেন। অঙ্গুলীহেলনে হেলায় বাঘা আমলাদের হাতে মাথা কাটছেন। কমিশনারকে বনবাসে পাঠাচ্ছেন। দোর্দন্ডপ্রতাপ আইপিএসরা ভয়ে কাঁটা। বাঙালির আইকন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে অবধি ইনি এক ঝটকায় টিম থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন।

    ইনি চলমান অশরীরী। সর্বত্র এঁর উপস্থিতি। বাচ্চারা কোনো দুষ্টুমি করলে লোকে এখন "ঐ কমিশন আসছে' বলে ভয় দেখাচ্ছে। ভয়ের যথার্থ কারণও আছে। কারণ ইনি সর্বত্র বিরাজমান। এঁর প্রতাপে গাড়িবাবুরা রাস্তায় গাড়ি বার করতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ যে কোনো রাস্তায় যেকোনো মোড়ে নির্বাচন কমিশন ওঁত পেতে থাকতে পারে। রাস্তায় চলমান গাড়ি দেখলেই ইনি যেকোনো মুহূর্তে বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। করলে আর কোনো ওজর-আপত্তি টিকবেনা। সবই নির্বাচনের নিমিত্ত। ইনি ব্যাঙ্ক থেকে বেশি টাকা তুলতে মানা করেছেন। জনতা নতমস্তকে সে আদেশ পালন করছে।

    এঁর প্রতাপের চোটে রাজনৈতিক দললো খচে লাল। আইপিএসরা কাঁটা। দাদাভক্তরা ক্রুদ্ধ। গাড়িবাবুরা বিচলিত। কিন্তু কেউই কিছু করতে পারছেনা। জনতা মূক। দললি নির্বাচনী বিধির আওতায়। দাদাভক্তরা শাহরুক খানের মুন্ডপাত নিয়ে ব্যস্ত। গাড়ি ও ব্যাঙ্কবাবুরা ঠিক প্রলেতারিয়েত নন, তাই তাই ফ্রি ল্যান্স বুদ্ধিজীবী থুড়ি নাগরিক সমাজ "এটা কি ব্যক্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়?' বলবেন কি বলবেন না বুঝতে না পেরে নিশ্‌চুপ। এমনকি অন্ধের যষ্টি হাইকোর্ট অবধি রায়দানে আমতা-আমতা করছে। নির্বাচন নামক মহাযন্ত্রে কমিশন হল অশ্বমেধের ঘোড়া। সব্বাই গজরাচ্ছে, কিন্তু এই দিগ্বিজয়ীর সামনে আসার সাহস কারো নেই।

    পরিবর্তন

    ব্রাজিলের পেলে কলকাতায় আসছেন না আসছেন না, সেই নিয়ে বড়জোর মাসখানেক আলোচনা হয়েছিল। ময়দানে মারাদোনা আসবেন কিনা নিয়ে কুল্লে সতেরো দিন। পিট সিগার নিয়ে দু-হপ্তা। দেরিদা নিয়ে সাতদিন। আর ইনি সেই মেগাস্টার যিনি সত্যিই আসছেন কি আসছেন না তাই নিয়ে সেই নন্দীগ্রাম পর্ব থেকে বিগত তিন বছর ধরে বাংলা উত্তাল। একদল এঁকে আনবেনই বলে কোমর বেঁধেছেন। আরেকদল চোয়াল শক্ত করে চিল্লাচ্ছেন যে ইনি এলেই সাড়ে সব্বোনাশ। একদল বলছেন বদল চাইই। আরেকদল বলছেন তা বলে জলের বদলে কি বিষ খাব? সেই নিয়ে টিভির পর্দায় নাগাড়ে খিস্তি-খেউড়। রাস্তায় হাতাহাতি। মাঠে ময়দানে রক্তারক্তি। খেয়োখেয়ি। মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

    ইনি বঙ্গের সর্বশেষ ক্রেজ। ফ্যাশানদুরস্তদের কেতা। বোহেমিয়ানদের পাগলামি। অন্ধজনের আলো। অনাথের আশ্রয়। আতুরের শেষ সম্বল। বঙ্গে যাঁরা একে চান, তাঁদের পরিবর্তনপন্থী বলে। আগে পরিবর্তনপন্থীদের সংখ্যা নগণ্য ছিল। তখন বুদ্ধিজীবিরা প্রকাশ্যে "পরিবর্তন চাই' বলতে লজ্জা পেতেন। মঞ্চে উঠতে দোনামনা করতেন। হোর্ডিং এ ভুল করে মুখ দেখিয়ে ফেললে মুখ সরিয়ে নিতেন। কিন্তু ইদানীং এঁদের সংখ্যা বিপুল হারে বর্ধমান। আগে যাঁরা পরিবর্তন-নিরপেক্ষ ছিলেন, তাঁরা এখন সশব্দে ফ্যানক্লাবে নাম লিখিয়েছেন। আগে যাঁরা মূক ছিলেন, তাঁরা এখন মুখর হয়েছেন। টিভি ও রেডিও দেখলেই এই "পরিবর্তন' সহজেই পরিলক্ষিত হয়। "আদি' পরিবর্তনপন্থীরা অনেকেই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। অনেকে একে বেনোজল বলেও ডাকছেন।

    ইনি কোনো মানুষ না হলেও এঁর অজস্র নাম। সশরীরে কখনও দেখা না গেলেও টিভিতে ইদানীং এঁকে নানা নামে প্রত্যহ পঁচিশবার দেখা যাচ্ছে। নানা কন্ঠে ও নানা সুরে সর্বক্ষণ এঁর অষ্টোত্তর শতনামসংকীর্তন চলছে। টিভি খুললেই দেখা যায়, গায়করা এঁকে ভালোবেসে "আমরা বদল চাই, বদলা চাইনা' বলে ডাকছেন। কৃষকরা ডাকছেন "মা মাটি মানুষের জোর' নামে। কলেজের ছোঁড়াছুঁড়িরা ডাকছে "সবুজ বিপ্লব' নামে। গম্ভীর মহা আঁতেল ডাকছেন "ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত' নামে। আর সমস্বরে সক্কলে একজোটে বলছেন "জমি দখল থেকে উচ্ছেদ। অনেক হয়েছে আর না'। মানে যা হবার ঢের হয়েছে। এবার ইনি আসছেনই।

    ইনি এলে ঠিক কি হবে অবশ্য বোঝা যাচ্ছেনা। কেউ বলছেন পৃথিবী সবুজ হবে। কলকাতা লন্ডন হবে। দার্জিলিং সুইজারল্যান্ড হবে। বাকিরা বলছেন এসব কাঁচা ঢপ। বিজ্ঞাপনের চাতুরি। আসলে পরিবর্তন এলে বঙ্গে সুনামি হবে। ফ্যাসিবাদ ফুলে ফলে পল্লবিত হবে। কিন্তু পরিবর্তন নিজে আসলে কোনো বি'¡পন নন। আশ্বাসবাণীও নন। তিনি এক গামা রিয়েলিটি শো। নাচ-গান-সুপারহিট মুকাবিলা, সাসপেন্স ও নাটকে ভরপুর। আসুন বা আসুন, তিনি সর্বদাই সুপারহিট। পরিবর্তন আসুক বা না আসুক আজ বসন্ত।

    প্রত্যাবর্তন

    পরিবর্তন যদি ক্রেজ হয়, তো ইনি বঙ্গের চিরপুরাতন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ইনি বাংলার শ্যামল মাটির টান, বঙ্গজননীর কোমল স্নেহচ্ছায়ার হাতছানি। বঙ্গজননী বিদায়কালে বলেন "এসো'। পুজোর বিসর্জনে যুবককুল "আসছে বছর আবার হবে' বলে ফেড়ে স্লোগান দেয়। সত্যযুগে প্রতি বছর দুগ্গাপুজোয় বঙ্গের জননীরা উমার প্রত্যাবর্তনের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতেন, "এবার আমার উমা এলে আর পাঠাবোনা' বলে প্রতি'¡ করতেন। আর কলিকালে পাঁচ বছর অন্তর বঙ্গজনতা ভোটে একই সরকারকে ফিরিয়ে আনেন। ফিরিয়ে আনার এই চিরন্তন আকুতিই হল প্রত্যাবর্তন। একই মদকে নতুন মোড়কে বারবার গিলে চলার গামাধামাকাই হল "প্রত্যাবর্তন'।

    ইনি এক চিরন্তন ঐতিহ্য। ব্রিটিশ আমলে এঁকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলা হত, এখন বলা হয় বামফ্রন্ট সরকার। ইনি অজর, অমর ও অক্ষয়। জলে ভেজেন না। আনে পোড়েন না। ফ্যাশান, ক্রেজ, বা হুজুগে বিশ্বাস করেন না। বুজ্জোয়া মিডিয়ার ধামাকার পরোয়া করেন না। ভোটের আগে হুড়োহুড়ি করে প্রচারের খ্যামটানাচের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতিকে থোড়াই কেয়ার করেন। এঁর কাজ চলে চোখের আড়ালে। ওরা কাজ করে নগরে বন্দরে। পাড়ায়-পাড়ায়। মহল্লায় বন্দরে। এলসি-জোনাল কমিটিতে। ইনি বচ্ছরভর জলের মধ্যে মাছের মতো, ভালোবাসার ধনের মতো মানুষের পাশে-পাশে থাকেন। আর পাঁচ বছর পর পর নিজেকে নতুন করে পাবেন বলে বিপুল ভোটে প্রত্যাবর্তন করেন।

    ইনি আত্মপ্রচারে বিমুখ। ভোট ভিক্ষা করেন না। ভোটের মুখে নিজের নামে শ্রেণীশত্রু বুজ্জোয়া মিডিয়ায় কোনো বি'¡পন দেননা। তবে পুরাতনী ঐতিহ্যে বিশ্বাসী হলেও ইনি এক্কেবারে আধুনিকতা বর্জিত মৌলবাদী নননন। বরং যেখানে যেমন সেখানে তেমন। তাই গ্রামে-গ®" ইনি ধুতি হলেও শহরে জিন্‌স-টি শার্ট। বেলপাহাড়িতে শাড়ি হলেও বেলেঘাটায় স্লিভলেস। প্রেসিডেন্সিতে টাটা পন্থী হলেও গার্ডেনরিচে সংগ্রামশীল। স্ট্রিট কর্নারে গোঁড়া হলেও অর্কুট-ফেসবুকে হাইটেক। পরমহংসের মতো বুর্জোয়া মিডিয়ার ভালো ণটিকে রপ্ত করে তিনি তার পিছে পিছে দৌড়ন। বচ্ছরভর কাজ করেন বলে সারা বছরই টিভিতে এঁর এক অবতারকে দেখা যায়। তাঁর নাম বামফ্রন্ট সরকার। তাকে ইনি চোখের মনির মতো রক্ষা করেন। পরিবর্তে তিনি এঁকে প্রচার দেন। এঁর যেটুকু প্রচার সবই সরকারের অ্যাকাউন্টে।

    ইনি অশুভকাজে বাগড়া দেন। শুভকাজে কল্যাণহস্ত প্রসারিত করেন। রেলমন্ত্রক কোন অনুষ্ঠানে কাকে ফ্রিতে বিরিয়ানি খাওয়ালো তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রাখেন এবং যথাসময়ে টাইট দেন। কিন্তু শুভকাজে খরচের পরোয়া করেন না। সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী হলেও বচ্ছরভর তাকে টিভি-রেডিওয় নিজের ঢাক নিজে পেটাতে অনুমতি দেন। সেই প্রচারে এঁর পক্ষে জনতার ঢল নামে। অস্থায়ী শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর, মহিলা, জনতার সমস্ত সেগমেন্ট থেকে একজন এসে এঁর পক্ষে এফিডেভিট করে যান। পাত্র পাত্রী আলাদা হলেও শপথবাক্যটি মোটামুটি একই। আমার নাম অমুক। আমি আগে খুব খারাপ থাকতাম। এখন আমার হেবি উন্নতি হয়েছে। এ সবই করেছে বামফ্রন্ট সরকার। আমার সরকার আমার পাশে। ট্যানটানা।

    প্রচারেই প্রকাশ, যে, রণে বনে ইউনিয়নে, বাজারে-রান্নাঘরে-শোবার ঘরে ইনি সতত: "আমার', মানে জনতার সঙ্গেই থাকেন। জনতার ভালো নিজেই বুঝে নেন। পারলে জনতার ভোটটিও নিজেই দিয়ে দেন, পাছে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে না ফেলে। পরিবর্তনপন্থীরা অনেকেই তা দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরেন। প্রত্যাবর্তনের প্যারডি করেন। বলেন, যে, বি'¡পনের ভাষায় বললে "আমার সরকার' ব্যাপারটা নাকি এরকম: "আমার নাম অমুক। আমার স্বামী ছিল অক্ষম। কিন্তু এখন আমার চার-চারটি ছেলেমেয়ে। এসবই করেছে এই সরকার। আমার সরকার আমার পাশে।'

    পরিবর্তনপন্থীদের এই রসিকতা যতই মর্মভেদী হোক, প্রত্যাবর্তনের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার মতো সময় এখনও আসেনি। বঙ্গের ঐতিহ্য এখনও শক্তিশালী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো আজও তার শিকড় হারায়নি। পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন, এই নিয়ে আজও বঙ্গের রঙ্গমঞ্চ উত্তাল। তিনদিনের ছুটকো ফ্যাশান না তিন দশকের ঐতিহ্য, জিতবে কে?

    সাধারণ মানুষ

    তবে পরিবর্তন হোক বা প্রত্যাবর্তন, ভোটের গিগাস্টার এঁরা কেউ না। গিগাস্টার বলুন বা মহারু, তিনি অন্য আরেকজন। তিনি বাংলার রেসিডেন্ট বাস্তুঘুঘু। সমস্ত পার্টিকে ইনি চরিয়ে খান। বুদ্ধি ও বীক্ষায় নির্বাচন কমিশনকে হেলায় দশগোল দেবার ক্ষমতা রাখেন। ইনি কলকাতার আত্মা। বঙ্গের শরীর। ইনি জনতা জনার্দন। কলকাতার বাজারে তিনি নানা অঙ্গে বিরাজ করেন। কেউ গাড়ি চড়ে শপিং মলে ঘোরেন। কেউ বস্তিতে বিরাজ করেন। কেউ পরিবর্তনপন্থী। কেউ প্রত্যাবর্তনের দিশারী। কেউ সফটোয়্যারে চাকরি করেন, কেউ নাইট ক্লাবে নাচতে যান। কেউ বাসস্থান থেকে উচ্ছিন্ন হন, কেউ সেই নিয়ে আন্দোলন করেন। কিন্তু শ্রেণী-দল নির্বিশেষে এঁদের একটিই স্লোগান। "সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবেনা'।

    ইনি নিজে অবশ্য কারো কথা ভাবেন বলে টের পাওয়া যায়না। ইনি চান্স পেলেই রাস্তায় হিসি করেন। মেট্রো রেলে থুথু ফেলেন। পুলিশ দেখলেই স্যার বলেন। কাউন্সিলার দেখলেই ধান্দা করতে দৌড়ন। ছিয়ে নিতে ইউনিয়ন করেন। ফ্ল্যাট বাগাতে পার্টি। শ্রমিক হলে শ্রেণীসংগ্রামের নামে কোম্পানি লাটে তোলেন। মালিক হলে কর্মসংস্কৃতির নামে শ্রমিককে ছিবড়ে করে দেবার তাল করেন। বাড়িওয়ালা হলে ভাড়াটের মাথায় গরম জল ঢালেন। ভাড়াটে হলে বাড়িওয়ালার দাড়ি ওপড়ান। বাঘা আঁতেল হলে দেরিদা কপচান। বিপ্লবী হলে শ্রমজীবি মানুষের দু:খে কেঁদে ভাসান। বাড়ির কাজের লোককে ছুটি দিতে হলে মুন্ডপাত করেন। এ-ওর মুন্ডু চেবান। উনি-একে চিমটি কাটেন। জল যেদিকে যায়, প্রাচীন ভেড়ার মতো সেই দিকেই ধাবিত হন। যে পক্ষ সুবিধা দেয়, ইনি তার প্রতিই প্রীত হন। কেবল ভোট এলেই সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ইনি "সাধারণ মানুষ' হয়ে যান। আর তাঁর দু:খ কেউ বোঝেনা বলে বিলাপ করেন।

    এ দেশ হল গণতন্ত্রের মন্দির। সে মন্দিরের উৎসবের নাম ভোটপুজো। আর "সাধারণ মানুষ' হলেন সেই পুজোর ভগবান। এক দিনের বাদশা। এঁর মনোরঞ্জন, মতান্তরে ব্রেন ওয়াশের জন্য টিভি-রেডিওতে উর্বশী-মেনকারা প্রতিশ্রুতি রূপে নৃত্য করেন। নেতারা বক্তৃতারূপে মন্ত্রপাঠে ভজনা করেন। পুজোর সময় এঁর তাই হেবি রেলা। প্রাচীন সধবারা অবস্থাবৈকল্যে নিরামিষভোজন করতে বাধ্য হলেও অন্তত একাদশীর দিন দাঁতে মাছের কাঁটা ছুঁইয়ে সধবাত্ব বজায় রাখতেন। ইনিও অবস্থাবৈকল্যে সারাবচ্ছর লাথিঝাঁটা খান। ট্রামে বাসে গুঁতোগুঁতি করেন। সরকারি আপিসে মুখ ঝামটা খান। কেবল পুজোর দিন নিজের ভোটখানা দিয়ে গণতন্ত্রের মহিমা অক্ষুন্ন রাখেন।

    বঙ্গের ভোট এক সুপারহিট মেগা সিরিয়াল। আর ইনি গণতন্ত্র নামক ব্লকবাস্টারের আসলি হিরো। সিরিয়াল মেগাহিট হলে প্রোডিউসারের পকেট ভরে ঠিকই, কিন্তু প্রোডিউসার কখনও এই সাফল্যের নায়ক নন। এই সাফল্যের আসল উৎস হলেন আমজনতা। পয়সা কড়ি তিনি পাননা ঠিকই। কিন্তু বুড়ো আঙুল চুষলেও টিআরপি বাজারের নেপথ্যের আসল নায়ক তিনিই। তিনিই বিচারক। তিনিই বাদশা। তিনিই ভগবান। আর তাঁর ক্ষমতার নাম বাজারের ক্ষমতা। বঙ্গের ভোটও এক বৃহৎ বাজার। এক বিপুলাকার চৈত্র সেল। যেখানে হরেক আইটেমের হরেক ইউএসপি। ব্র্যান্ড বাদশারা ডালা সাজিয়ে বসেছেন। সন্নিসিরা ডিগবাজি দিচ্ছেন। কেরামতি দেখাচ্ছেন। পচা হোক আর ধসা, মাল সেখান থেকেই তুলতে হবে। ভগবান হোন বা শয়তান, একদিনের বাদশা হোন বা একশদিনের, অন্য কোনো চয়েস নেই। এর নাম ভোটবাজার। এর নাম ভোটপুজো। ডান না বাম, পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন, বেছে নিতে হবেই। আজ তোমার পরীক্ষা। ভগবান।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৫ এপ্রিল ২০১১ | ৯৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন